রাজকুমার শেখ
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
নদীর বাঁকের মতো তার কোমর। অনির তা-ই মনে হয়েছিল প্রথম মেয়েটিকে দেখার পর। হয়তো নদী ভালোবাসে বলেই তার এমন ভাবনা। বেশ কিছুক্ষণ ও চোখ ফেরাতে পারেনি। সুন্দর পৃথিবীর সুন্দর একটি অংশ। মন ভালো হয়ে গেল ওর। চোখ থাকলেই সব দেখা হয় না। দেখতে হয় মনের চোখ দিয়ে। মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করতে ওর মন করছে। একবার ভাবলো নাম জিজ্ঞেস করি। তারপর ও ভাবলো কী হবে নাম জিগ্যেস করে? একটু পরেই ও নৌকা থেকে নেমে চলে যাবে। আর হয়তো কোনো দিনই দেখা হবে না। সদরঘাট দিয়ে ও প্রায়ই যাতায়াত করে। ওর কাজের জায়গায় যেতে বেশ সময় লাগে। ওপারে গিয়ে অটো করে বেশ অনেকটা পথ। দুধারী সবুজ আর সবুজ। এখনো এখানে ফাঁকা জায়গা। নিঃশ্বাস নিতে পারা যায়। কিছু কিছু জায়গায় বড়ো শিমুল গাছ। জারুল। নিম। আম। আরও কত রকমের গাছ। অনি এ সব দৃশ্য দেখতে দেখতে তার অফিসে আসে। বুনোফুলের গন্ধ। তার মন ভরে থাকে। ওর ঘরেও সে গন্ধ চলে আসে। গোটা ঘর ভরে যায়। অনি ঘরের জানালা বন্ধ করে দেয়। যাতে ফুলের সুগন্ধি চলে না যায়। অনির কেয়ারটেকার মাঝে মাঝে মজা করে বলে, অনিদা, আপনি ফুলবন হয়ে গেছেন।
কী বললি জয়?
না। কিছু না দাদা।
ফুলবন সে আবার কী রে?
কোন কবি যেন বলেছিল।
তুই কবিতা পড়িস?
পড়তাম একসময়।
বাহ্। বেশ বেশ। দে এক কাপ চা দে।
অনি কাজে মন দেয়। কলম ঘষে চলে। এ সব তার নিত্য দিনের ব্যাপার। কিন্তু আজ মনটা তার অন্য রকম হয়ে গেল। মেয়েটি কেন তাকে এত টানছে? এমন তো কোনো দিন হয় না। ওর শাড়ি পরা। যত্ন করে জুতো জোড়ায় ফরসা পাখানি গলানো। আলতো করে গালে কি যেন ছুঁয়ে দিয়েছে? টানা চোখগুলোতে নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ। অনি আবার ভাবলো চোখে আবার নদীর ঢেউ হয় নাকি? এবার ওকে সবাই পাগল বকবে। বোকা কোথাকার। ও নিজের মনে বলে কথাটা।
হাসতে থাকে। এমন সময় মেয়েটি পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। অনি যেন এবার নৌকো থেকে পড়ে যাবে। ও বেশ টলে গেল। আজ এমন কেন হচ্ছে ওর? মেয়েটি আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। নৌকো ঢেউয়ে দুলছে। তার মনও দুলছে এক ভালো লাগায়। আজ সকালটা খুব সুন্দর হয়ে উঠছে। একটি অজানা মেয়ে গোটা বাতাবরণ বদলে দিল। সত্যি মেয়েরা অনেক কিছুর অধিপতি। কত গুণ তাদের। নৌকাটা আজ এখানেই থেমে থাকুক। কিন্তু তা কি হবার উপায় আছে? মাঝি মোটা গলায় হাঁক দেয়, ও বাবু নেমি যান গো।
ও অনিকেই বলছে কথাটা। কেননা সবাই নেমে গেছে। মেয়েটিও এগিয়ে গেছে। অনি বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। এক ঝলক ঠা-া বাতাস ওর গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি চলে গেল। নাম ধাম কিছুই তার নেওয়া হলো না। আজ এমন কেন হলো? আসলে মনকে অত সহজে বশ করা যায় না। অনি নেমে আসে নৌকা থেকে। মায়ঝিরা তাকে চেনে। কত দিনের যাতায়াত। কাজটা সে ভালো বেসেই নিয়েছে। চাল কলের কাজ। এখানে ধান থেকে চাল। হয়। বস্তা বস্তা চাল লরিতে চলে যায় শহরে। অনিকে সব দেখভাল করতে হয়। জয় ওর হুকুম শোনে। তবে ও কাজে ফাঁকি দেয়। কোথাও গিয়ে চুপ করে বিড়ি ফোঁকে। সবই টেরপায় অনি। কিন্তু ওকে কিছু বলে না। মুনিশ পাঠ নিয়ে কাজ। ধান মেলা থেকে শুরু করে চাল অবধি তাদের ছুটি নেই। অনি সারাদিন সব হিসেব রাখে। কিন্তু মাঝেমধ্যে ও হাঁপিয়ে ওঠে। তখন সব ফেলে কাছাকাছি কোথাও গিয়ে একটু দুধের চা দিয়ে সেকা পাও রুটি খায়। একটু গাছগাছালির ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। পাখির ডাক শোনে। কিন্তু আজ যে পাখির খোঁজ পেল ও তা তো রোজ দেখা যায় না। ও একসময় অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ে। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। এমন সময় জয় চা নিয়ে আসে। সঙ্গে মুড়ি মাখা। কাঁচা মরিচ।
অনিদা, নাও খেয়ে।
ওর ভাবে ছেদ পড়ে। জয়ের জন্য ও ভালো কিছু ভাবতে পারে না। ঠিক ও ভাবনার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এত বেয়াড়া! মাঝে মাঝে মনে হয় দিই ঠাস করে একটা।
অনি মনে মনে হেসে ফেলে। না, জয়টা আছে বলেই ওর খাতিরটা একটু বেশিই হয়। না জয়কে নিয়ে এ সব ভাবাটা তার খুব অন্যায়। আর এ সব ভাববে না। কোনো মানুষকে এমন ভাবতে নেই! জয়টা থাকে কাছেপিঠে। ও সবার আগে আসে। কাজে ফাঁকি দেয় না কখনো। ঘরে বিবি বাচ্চা আছে। চলে যায় কোনো রকমে। সব সময় হাসিখুশি। একবার গেছিল অনি। খুব যতœ করে বসতে দিয়েছিল। চা। মিষ্টি খেয়ছিল অনি। ওর ছেলেটা খুব মিষ্টি। ওকে ও আদর করে। কোলে নেয়। অনির তো কেউ নেই। একা মানুষ। তাই ও জয়কে ভাই মনে করে। ওর হাতে মাস মাহিনা থেকে কিছু দেয় অনি।
দাদা, তুমি!
রাখ রাখ। দাদা বলিস যে। আমি তোর দাদা।
জয় টুক করে একটা প্রণাম করে। অনি ওর মাথায় আলতো করে হাত রাখে। অনি এই গাছপালা। মানুষজন। নতুন চালের গন্ধ। এই সব তার দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। ফিরে আসে বাড়িতে। একা আর রাতের রান্না করতে ভালো লাগে না। ও রাস্তার মোড় থেকে রুটি আর সবজি নিয়ে আসে। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো কোনো দিন বই পড়ে রাত করে। বই পড়ার নেশা ওর অনেক দিনের। ওর মা বই পড়তেন। ওর বাড়িতে অনেক বই। মায়ের ছোঁয়া এখনো লেগে আছে। অনি মাঝেমধ্যে তা অনুভব করে। বইগুলো ও আগলে রেখেছে। বইগুলো দেখলেই ওর মায়ের কথা মনে পড়ে। আপনা থেকেই ওর চোখের পাতা ভিজে ওঠে। কীভাবে সব হারিয়ে গেল! ওর আর বিয়ে করা হয়ে উঠলো না। তেমন করে কাউকে ভালো বাসতে পারলো কই! তেমন করে কেউ কাছে আসেনি। অনি অবশ্য এ সব নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি। তবে আজ ওর মনের ভেতর একটা তোলপাড় করা নদীর আষাঢ়ে ঢেউ আছাড়ে পড়ছে। এ সব কথা আবার জয়কে বলা যাবে না। কী বলতে কী বলে ফেলবে। ওর আবার মুখ খুব আলগা। না চুপ থাকায় ভালো। বোবার কোনো শত্রু নাই।
অনি আবার কাজে মন দেয়। এ সব ভাবলে কাজ এগোবে না। আজ একটু আগেভাগে ফিরতে হবে। ও কাজে ডুব দেয়।
২.
সদরঘাটে এলেই তার মনটা ভালো হয়ে যায়। মনের মধ্যে জমে থাকা খারাপ দাগগুলো বাতাস লেগে উঠে যায়। মন সুন্দর হয়। অনির জীবনেরসঙ্গে এই ঘাট মিশে আছে। কত মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে। কতজন হারিয়ে গেছে। এই তো সেদিন জগু ঠাকুর চলে গেলেন। মানুষটি এই ঘাট ভালোবেসে থেকে গেছেন। তার ঠিকানা বলতে এই ঘাট। এক পাশে ঝুপড়ি করে বসবাস করতেন। পুজো পাঠ নিয়ে থাকতেন। মুখে হাসি লেগে থাকতো। অনি খুব পছন্দ করতো মানুষটিকে। তেমন কথা হতো না। তবু মানুষটিকে ঘাটে না দেখতে পেলে কেমন যেন লাগতো। আজ ঘাটে এসে কেমন সব ফাঁকা লাগছে। মাঝির নৌকোখানি আজ বড্ড বেশি একা। ঘাটে লোকজন নেই। নয়ন মাঝি একটা বিড়ি ধরিয়ে টান দেয়। হিলহিলে বাতাস। নৌকো দুলে ওঠে। অনি ভেবেছিল আজ আবার তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু কই সে? মনটা খারাপ হয়ে গেল।
দুচারজনকে নিয়ে নৌকো ছেড়ে দিল। এমন সময় হঠাৎ কে যেন মাঝিকে ডাকে। মেয়েলি কণ্ঠ। অনি পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে সেই মেয়েটি। ওর বুকটা ধড়াস করে ওঠে।
ও নয়ন, নৌকো ভিড়া পাড়ে।
অনি বলে কথাটা।
কেন গে বাবু? তুমার কে লাগি?
তোর মজা করার স্বভাব গেল না নয়ন।
নয়ন মিটি মিটি হাসে। মেয়েটিকে তুলে নেয় নৌকোতে। কোথা থেকে চন্দনের গন্ধ ছড়িয়ে গেল বাতাসে। মেয়েটির গা থেকে কি সুগন্ধি বের হচ্ছে? অনি বুক ভরে বাতাস নেয়। নয়ন গুনগুন করে গান ধরে। পাগলা নয়ন। মাঝি হলে হবে কী! ও কিন্তু ভালো কবিগান করে। বিভিন্ন পালাতে গাইতে যায়। ওর বেশ নামডাক আছে। সারা বছর তো আর পালা হয় না। তাই ও পারাপারের কাজ করে। বেশ আছে ও তার জগৎ নিয়ে।
অনি মেয়েটিকে দেখছিল। সত্যি সে নদীর মতো। বা সে কোনো পরীর মতো। অনির ইচ্ছে হলো কথা বলতে। কিন্তু ও বলতে পারছে না। তার আলগা খোঁপাতে একটা পলাশ। এখানে বেশ কিছু পলাশ গাছ আছে। অনি পলাশ খুব ভালোবাসে। বার বার ওর চোখ চলে যাচ্ছে আলগা খোঁপার দিকে। না আজ তার দেরি হয়ে যাবে কাজের সাইডে যেতে। আজকাল এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় কি? অনি নিজেকে সামলায়। এমন পাগলামি করবে না ও। ও চোখ ফিরিয়ে নেয়। নৌকাটা সামান্য দুলে ওঠে। জলের ছোট ছোট ঢেউ।
একসময় পাড়ে ভিড়ে নৌকা। অনি নামলো। আরও লোকজন নেমে গেল। অনি একটু থমকে দাঁড়ায়। ওর পিছন পিছন মেয়েটি নামছে। খুব ধীরে। নয়ন নামতে সাহায্য করে। অনি দেখছিল। এমন সময় মেয়েটি এগিয়ে এসে বলে, আপনি কাজে যাবেন না?
অনি এ কথা শুনে চমকে ওঠে। অনি একটু সময় নিয়ে বলে, যাবো। আপনি?
আমি কুসুম। ফুল তলাতে পড়াতে যাই। আপনিও দেখি একই টাইমে যান। তাই।
ও। আমি অনি। রাইস মিলে কাজ করি।
ওরা কথা বলতে বলতে এগিয়ে যায়। পলাশ গাছে ফাগুনের রং। চোখ জুড়িয়ে যায়। অনির সঙ্গে বেশ জমে উঠেছে।
অনি আজ কাজ করতে করতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
৩.
গত রাতে হঠাৎ খুব ঝড় হয়। সেই সাথে জল। গাছের ডালপালা ভেঙে গেছে। অনি রাতে ঘুমোতে পারেনি কুসুমের কথা ভেবে। আজ ওরা বনে বনে ঘুরবে বলেছিল। আজ ছুটির দিন। কুসুম কি আসবে সদরঘাটে? নয়নের নৌকা করে ওরা নেমে যাবে বলেছিল জলার ডাঙায়। ওখান থেকে বন পথ ধরে ওরা হারিয়ে যাবে। অনির মনটা কেমন কিন্তু কিন্তু করছে। অনি এক সময় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় এসে কুলুদার দোকানে রুটি সবজি খায়। চা-টা আর খাওয়ার সময় হয়না। বেলা হয়েছে। কুসুম নিশ্চয় এতক্ষণে চলে এসেছে। অনি পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। ওর বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের পথ। ও হেঁটেই যায় রোজ। এদিকে তেমন বাড়িঘর নেই।বেশ ফাঁকা। গাছগাছালির সারি। অনির খুব ভালো লাগে। এ সব দৃশ্য দেখতে দেখতে সে কাজে চলে যায়। কিন্তু আজ তো অন্য রকম অনুভূতি তার মনে। কুসুম আর সে। বনের মধ্যে ওরা ঘুরবে। ওর মনটা কেমন নেচে ওঠে।
একসময় ও সদরঘাটে পৌঁছে যায়। নয়ন এখন ওপারে নৌকা নিয়ে গেছে। ওর আসতে সময় লাগবে। অনি এপাশ ওপাশ তাকায়। কুসুম কি এসে গেছে? না তার দেখা নেই।
অনি বসে মাচানে। এখানে অনেকে বসে। এখন তেমন কেউ নেই। একটু পর লোকজনের আনাগোনা শুরু হবে। অনি নদী দেখছিল। গত রাতে বৃষ্টিতে সব ধুয়ে গেছে। ঝকঝক করছে চরাচর। নয়ন নৌকা নিয়ে আসছে জলের বুক চিরে। এই নদীর সঙ্গে তার যত ভাব। সারাদিন মেতে থাকে মানুষের সঙ্গে।
আজ ওকে এই অসময়ে ঘাটে দেখে নয়ন জিগ্যেস করে, কী গে দাদাবাবু, এ অসময়ে?
একটু কাজ আছে নয়ন।
ও।
নয়ন নৌকা বাঁধে। তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে টান দেয়। এদিকে অনি উসখুস করছে। কখন আসবে কুসুম! বেশ সময় হলো। এমন সময় দেখছে পিছনে কার হাসাহাসির শব্দ। অনি পিছনে ফিরে তাকায়। দেখছে কুসুম। কিন্তু ওর সঙ্গে একটা যুবক। অনি ওকে চেনে না। কুসুম অনিকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ে। অনি মাচান ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
কুসুম পরিচয় করিয়ে দেয়। ওর সঙ্গে নাকি বিয়ে হবে। অনির মুখের থুতু কেমন নোনা লাগে। এই প্রথম কেমন এক ধাক্কা খেল ও। আজ বনের সব ফুল যেন ঝরে গেল একটা ঝটকা বাতাসে। তার ভালো লাগা পলাশ কুঁড়িটা এলোচুলে গুঁজে দেব বলে আগলে রেখেছিল পলাশ। কিন্তু খোঁপাতে তার মনফুল বাসি হয়ে গেল। অনি নদীর চর ধরে হাঁটতে থাকে। কুসুম এখন ফুটছে একটু একটু করে নতুন ছোঁয়ায়।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
রাজকুমার শেখ
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
নদীর বাঁকের মতো তার কোমর। অনির তা-ই মনে হয়েছিল প্রথম মেয়েটিকে দেখার পর। হয়তো নদী ভালোবাসে বলেই তার এমন ভাবনা। বেশ কিছুক্ষণ ও চোখ ফেরাতে পারেনি। সুন্দর পৃথিবীর সুন্দর একটি অংশ। মন ভালো হয়ে গেল ওর। চোখ থাকলেই সব দেখা হয় না। দেখতে হয় মনের চোখ দিয়ে। মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করতে ওর মন করছে। একবার ভাবলো নাম জিজ্ঞেস করি। তারপর ও ভাবলো কী হবে নাম জিগ্যেস করে? একটু পরেই ও নৌকা থেকে নেমে চলে যাবে। আর হয়তো কোনো দিনই দেখা হবে না। সদরঘাট দিয়ে ও প্রায়ই যাতায়াত করে। ওর কাজের জায়গায় যেতে বেশ সময় লাগে। ওপারে গিয়ে অটো করে বেশ অনেকটা পথ। দুধারী সবুজ আর সবুজ। এখনো এখানে ফাঁকা জায়গা। নিঃশ্বাস নিতে পারা যায়। কিছু কিছু জায়গায় বড়ো শিমুল গাছ। জারুল। নিম। আম। আরও কত রকমের গাছ। অনি এ সব দৃশ্য দেখতে দেখতে তার অফিসে আসে। বুনোফুলের গন্ধ। তার মন ভরে থাকে। ওর ঘরেও সে গন্ধ চলে আসে। গোটা ঘর ভরে যায়। অনি ঘরের জানালা বন্ধ করে দেয়। যাতে ফুলের সুগন্ধি চলে না যায়। অনির কেয়ারটেকার মাঝে মাঝে মজা করে বলে, অনিদা, আপনি ফুলবন হয়ে গেছেন।
কী বললি জয়?
না। কিছু না দাদা।
ফুলবন সে আবার কী রে?
কোন কবি যেন বলেছিল।
তুই কবিতা পড়িস?
পড়তাম একসময়।
বাহ্। বেশ বেশ। দে এক কাপ চা দে।
অনি কাজে মন দেয়। কলম ঘষে চলে। এ সব তার নিত্য দিনের ব্যাপার। কিন্তু আজ মনটা তার অন্য রকম হয়ে গেল। মেয়েটি কেন তাকে এত টানছে? এমন তো কোনো দিন হয় না। ওর শাড়ি পরা। যত্ন করে জুতো জোড়ায় ফরসা পাখানি গলানো। আলতো করে গালে কি যেন ছুঁয়ে দিয়েছে? টানা চোখগুলোতে নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ। অনি আবার ভাবলো চোখে আবার নদীর ঢেউ হয় নাকি? এবার ওকে সবাই পাগল বকবে। বোকা কোথাকার। ও নিজের মনে বলে কথাটা।
হাসতে থাকে। এমন সময় মেয়েটি পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। অনি যেন এবার নৌকো থেকে পড়ে যাবে। ও বেশ টলে গেল। আজ এমন কেন হচ্ছে ওর? মেয়েটি আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। নৌকো ঢেউয়ে দুলছে। তার মনও দুলছে এক ভালো লাগায়। আজ সকালটা খুব সুন্দর হয়ে উঠছে। একটি অজানা মেয়ে গোটা বাতাবরণ বদলে দিল। সত্যি মেয়েরা অনেক কিছুর অধিপতি। কত গুণ তাদের। নৌকাটা আজ এখানেই থেমে থাকুক। কিন্তু তা কি হবার উপায় আছে? মাঝি মোটা গলায় হাঁক দেয়, ও বাবু নেমি যান গো।
ও অনিকেই বলছে কথাটা। কেননা সবাই নেমে গেছে। মেয়েটিও এগিয়ে গেছে। অনি বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। এক ঝলক ঠা-া বাতাস ওর গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি চলে গেল। নাম ধাম কিছুই তার নেওয়া হলো না। আজ এমন কেন হলো? আসলে মনকে অত সহজে বশ করা যায় না। অনি নেমে আসে নৌকা থেকে। মায়ঝিরা তাকে চেনে। কত দিনের যাতায়াত। কাজটা সে ভালো বেসেই নিয়েছে। চাল কলের কাজ। এখানে ধান থেকে চাল। হয়। বস্তা বস্তা চাল লরিতে চলে যায় শহরে। অনিকে সব দেখভাল করতে হয়। জয় ওর হুকুম শোনে। তবে ও কাজে ফাঁকি দেয়। কোথাও গিয়ে চুপ করে বিড়ি ফোঁকে। সবই টেরপায় অনি। কিন্তু ওকে কিছু বলে না। মুনিশ পাঠ নিয়ে কাজ। ধান মেলা থেকে শুরু করে চাল অবধি তাদের ছুটি নেই। অনি সারাদিন সব হিসেব রাখে। কিন্তু মাঝেমধ্যে ও হাঁপিয়ে ওঠে। তখন সব ফেলে কাছাকাছি কোথাও গিয়ে একটু দুধের চা দিয়ে সেকা পাও রুটি খায়। একটু গাছগাছালির ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। পাখির ডাক শোনে। কিন্তু আজ যে পাখির খোঁজ পেল ও তা তো রোজ দেখা যায় না। ও একসময় অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ে। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। এমন সময় জয় চা নিয়ে আসে। সঙ্গে মুড়ি মাখা। কাঁচা মরিচ।
অনিদা, নাও খেয়ে।
ওর ভাবে ছেদ পড়ে। জয়ের জন্য ও ভালো কিছু ভাবতে পারে না। ঠিক ও ভাবনার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এত বেয়াড়া! মাঝে মাঝে মনে হয় দিই ঠাস করে একটা।
অনি মনে মনে হেসে ফেলে। না, জয়টা আছে বলেই ওর খাতিরটা একটু বেশিই হয়। না জয়কে নিয়ে এ সব ভাবাটা তার খুব অন্যায়। আর এ সব ভাববে না। কোনো মানুষকে এমন ভাবতে নেই! জয়টা থাকে কাছেপিঠে। ও সবার আগে আসে। কাজে ফাঁকি দেয় না কখনো। ঘরে বিবি বাচ্চা আছে। চলে যায় কোনো রকমে। সব সময় হাসিখুশি। একবার গেছিল অনি। খুব যতœ করে বসতে দিয়েছিল। চা। মিষ্টি খেয়ছিল অনি। ওর ছেলেটা খুব মিষ্টি। ওকে ও আদর করে। কোলে নেয়। অনির তো কেউ নেই। একা মানুষ। তাই ও জয়কে ভাই মনে করে। ওর হাতে মাস মাহিনা থেকে কিছু দেয় অনি।
দাদা, তুমি!
রাখ রাখ। দাদা বলিস যে। আমি তোর দাদা।
জয় টুক করে একটা প্রণাম করে। অনি ওর মাথায় আলতো করে হাত রাখে। অনি এই গাছপালা। মানুষজন। নতুন চালের গন্ধ। এই সব তার দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। ফিরে আসে বাড়িতে। একা আর রাতের রান্না করতে ভালো লাগে না। ও রাস্তার মোড় থেকে রুটি আর সবজি নিয়ে আসে। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো কোনো দিন বই পড়ে রাত করে। বই পড়ার নেশা ওর অনেক দিনের। ওর মা বই পড়তেন। ওর বাড়িতে অনেক বই। মায়ের ছোঁয়া এখনো লেগে আছে। অনি মাঝেমধ্যে তা অনুভব করে। বইগুলো ও আগলে রেখেছে। বইগুলো দেখলেই ওর মায়ের কথা মনে পড়ে। আপনা থেকেই ওর চোখের পাতা ভিজে ওঠে। কীভাবে সব হারিয়ে গেল! ওর আর বিয়ে করা হয়ে উঠলো না। তেমন করে কাউকে ভালো বাসতে পারলো কই! তেমন করে কেউ কাছে আসেনি। অনি অবশ্য এ সব নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি। তবে আজ ওর মনের ভেতর একটা তোলপাড় করা নদীর আষাঢ়ে ঢেউ আছাড়ে পড়ছে। এ সব কথা আবার জয়কে বলা যাবে না। কী বলতে কী বলে ফেলবে। ওর আবার মুখ খুব আলগা। না চুপ থাকায় ভালো। বোবার কোনো শত্রু নাই।
অনি আবার কাজে মন দেয়। এ সব ভাবলে কাজ এগোবে না। আজ একটু আগেভাগে ফিরতে হবে। ও কাজে ডুব দেয়।
২.
সদরঘাটে এলেই তার মনটা ভালো হয়ে যায়। মনের মধ্যে জমে থাকা খারাপ দাগগুলো বাতাস লেগে উঠে যায়। মন সুন্দর হয়। অনির জীবনেরসঙ্গে এই ঘাট মিশে আছে। কত মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে। কতজন হারিয়ে গেছে। এই তো সেদিন জগু ঠাকুর চলে গেলেন। মানুষটি এই ঘাট ভালোবেসে থেকে গেছেন। তার ঠিকানা বলতে এই ঘাট। এক পাশে ঝুপড়ি করে বসবাস করতেন। পুজো পাঠ নিয়ে থাকতেন। মুখে হাসি লেগে থাকতো। অনি খুব পছন্দ করতো মানুষটিকে। তেমন কথা হতো না। তবু মানুষটিকে ঘাটে না দেখতে পেলে কেমন যেন লাগতো। আজ ঘাটে এসে কেমন সব ফাঁকা লাগছে। মাঝির নৌকোখানি আজ বড্ড বেশি একা। ঘাটে লোকজন নেই। নয়ন মাঝি একটা বিড়ি ধরিয়ে টান দেয়। হিলহিলে বাতাস। নৌকো দুলে ওঠে। অনি ভেবেছিল আজ আবার তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু কই সে? মনটা খারাপ হয়ে গেল।
দুচারজনকে নিয়ে নৌকো ছেড়ে দিল। এমন সময় হঠাৎ কে যেন মাঝিকে ডাকে। মেয়েলি কণ্ঠ। অনি পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে সেই মেয়েটি। ওর বুকটা ধড়াস করে ওঠে।
ও নয়ন, নৌকো ভিড়া পাড়ে।
অনি বলে কথাটা।
কেন গে বাবু? তুমার কে লাগি?
তোর মজা করার স্বভাব গেল না নয়ন।
নয়ন মিটি মিটি হাসে। মেয়েটিকে তুলে নেয় নৌকোতে। কোথা থেকে চন্দনের গন্ধ ছড়িয়ে গেল বাতাসে। মেয়েটির গা থেকে কি সুগন্ধি বের হচ্ছে? অনি বুক ভরে বাতাস নেয়। নয়ন গুনগুন করে গান ধরে। পাগলা নয়ন। মাঝি হলে হবে কী! ও কিন্তু ভালো কবিগান করে। বিভিন্ন পালাতে গাইতে যায়। ওর বেশ নামডাক আছে। সারা বছর তো আর পালা হয় না। তাই ও পারাপারের কাজ করে। বেশ আছে ও তার জগৎ নিয়ে।
অনি মেয়েটিকে দেখছিল। সত্যি সে নদীর মতো। বা সে কোনো পরীর মতো। অনির ইচ্ছে হলো কথা বলতে। কিন্তু ও বলতে পারছে না। তার আলগা খোঁপাতে একটা পলাশ। এখানে বেশ কিছু পলাশ গাছ আছে। অনি পলাশ খুব ভালোবাসে। বার বার ওর চোখ চলে যাচ্ছে আলগা খোঁপার দিকে। না আজ তার দেরি হয়ে যাবে কাজের সাইডে যেতে। আজকাল এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় কি? অনি নিজেকে সামলায়। এমন পাগলামি করবে না ও। ও চোখ ফিরিয়ে নেয়। নৌকাটা সামান্য দুলে ওঠে। জলের ছোট ছোট ঢেউ।
একসময় পাড়ে ভিড়ে নৌকা। অনি নামলো। আরও লোকজন নেমে গেল। অনি একটু থমকে দাঁড়ায়। ওর পিছন পিছন মেয়েটি নামছে। খুব ধীরে। নয়ন নামতে সাহায্য করে। অনি দেখছিল। এমন সময় মেয়েটি এগিয়ে এসে বলে, আপনি কাজে যাবেন না?
অনি এ কথা শুনে চমকে ওঠে। অনি একটু সময় নিয়ে বলে, যাবো। আপনি?
আমি কুসুম। ফুল তলাতে পড়াতে যাই। আপনিও দেখি একই টাইমে যান। তাই।
ও। আমি অনি। রাইস মিলে কাজ করি।
ওরা কথা বলতে বলতে এগিয়ে যায়। পলাশ গাছে ফাগুনের রং। চোখ জুড়িয়ে যায়। অনির সঙ্গে বেশ জমে উঠেছে।
অনি আজ কাজ করতে করতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
৩.
গত রাতে হঠাৎ খুব ঝড় হয়। সেই সাথে জল। গাছের ডালপালা ভেঙে গেছে। অনি রাতে ঘুমোতে পারেনি কুসুমের কথা ভেবে। আজ ওরা বনে বনে ঘুরবে বলেছিল। আজ ছুটির দিন। কুসুম কি আসবে সদরঘাটে? নয়নের নৌকা করে ওরা নেমে যাবে বলেছিল জলার ডাঙায়। ওখান থেকে বন পথ ধরে ওরা হারিয়ে যাবে। অনির মনটা কেমন কিন্তু কিন্তু করছে। অনি এক সময় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় এসে কুলুদার দোকানে রুটি সবজি খায়। চা-টা আর খাওয়ার সময় হয়না। বেলা হয়েছে। কুসুম নিশ্চয় এতক্ষণে চলে এসেছে। অনি পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। ওর বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের পথ। ও হেঁটেই যায় রোজ। এদিকে তেমন বাড়িঘর নেই।বেশ ফাঁকা। গাছগাছালির সারি। অনির খুব ভালো লাগে। এ সব দৃশ্য দেখতে দেখতে সে কাজে চলে যায়। কিন্তু আজ তো অন্য রকম অনুভূতি তার মনে। কুসুম আর সে। বনের মধ্যে ওরা ঘুরবে। ওর মনটা কেমন নেচে ওঠে।
একসময় ও সদরঘাটে পৌঁছে যায়। নয়ন এখন ওপারে নৌকা নিয়ে গেছে। ওর আসতে সময় লাগবে। অনি এপাশ ওপাশ তাকায়। কুসুম কি এসে গেছে? না তার দেখা নেই।
অনি বসে মাচানে। এখানে অনেকে বসে। এখন তেমন কেউ নেই। একটু পর লোকজনের আনাগোনা শুরু হবে। অনি নদী দেখছিল। গত রাতে বৃষ্টিতে সব ধুয়ে গেছে। ঝকঝক করছে চরাচর। নয়ন নৌকা নিয়ে আসছে জলের বুক চিরে। এই নদীর সঙ্গে তার যত ভাব। সারাদিন মেতে থাকে মানুষের সঙ্গে।
আজ ওকে এই অসময়ে ঘাটে দেখে নয়ন জিগ্যেস করে, কী গে দাদাবাবু, এ অসময়ে?
একটু কাজ আছে নয়ন।
ও।
নয়ন নৌকা বাঁধে। তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে টান দেয়। এদিকে অনি উসখুস করছে। কখন আসবে কুসুম! বেশ সময় হলো। এমন সময় দেখছে পিছনে কার হাসাহাসির শব্দ। অনি পিছনে ফিরে তাকায়। দেখছে কুসুম। কিন্তু ওর সঙ্গে একটা যুবক। অনি ওকে চেনে না। কুসুম অনিকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ে। অনি মাচান ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
কুসুম পরিচয় করিয়ে দেয়। ওর সঙ্গে নাকি বিয়ে হবে। অনির মুখের থুতু কেমন নোনা লাগে। এই প্রথম কেমন এক ধাক্কা খেল ও। আজ বনের সব ফুল যেন ঝরে গেল একটা ঝটকা বাতাসে। তার ভালো লাগা পলাশ কুঁড়িটা এলোচুলে গুঁজে দেব বলে আগলে রেখেছিল পলাশ। কিন্তু খোঁপাতে তার মনফুল বাসি হয়ে গেল। অনি নদীর চর ধরে হাঁটতে থাকে। কুসুম এখন ফুটছে একটু একটু করে নতুন ছোঁয়ায়।