বৈজ্ঞানিক জয়যাত্রা ও নানাবিধ আবিষ্কারের কারণে কালের আবর্তনে বিলীনের পথে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প, তারপরেও পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যের এই পেশা এখনও ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। মাটির সাথে মানুষের জীবন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। মাটিকে সবাই পায়ের নিচে রাখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু এই মাটিই যখন উঠে আসে আমাদের ঘরে, সাজিয়ে তোলে অন্দর মহল, তখন মাটির স্থান হয় আভিজাত্যে। মৃৎশিল্প এমন একটি মাধ্যম যা মাটিকে নিয়ে আসে মানুষের কাছাকাছি। মৃৎশিল্প বলতে মাটি দিয়ে তৈরী যাবতীয় ব্যবহার্য এবং শৌখিন শিল্পসামগ্রীকেই বোঝায়। শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে মৃৎশিল্প অতি প্রাচীন। নগরায়নের ফলে কালের আবর্তনে বগুড়ার শেরপুরে অতি প্রচীন এই শিল্প এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। মাটির তৈরী হাড়ি পাতিল, ফুলের টব, মাটির ব্যাংক, আগরদানি, প্রদিপদানিসহ আরও অনেক ধরনের তৈজসপত্র দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়ে থাকলেও ব্যবহার্য এসব বস্তুর বর্তমান চাহিদা কমে গেছে, যে কারণে এ শিল্প থেক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন মৃৎশিল্পীরা। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি আর জীবন-মান উনয়নের জন্যে ক্রমশ অন্য পেশার দিক ঝুকে পরছেন তারা। এক সময় বংশানুক্রমে পাওয়া পেশা হিসেবে এ পেশাকে অনেকেই সাদরে গ্রহন করতো। এখন তা হচ্ছেনা। কারন মাটির তৈরী তৈজসপত্রের পর্যাপ্ত চাহিদা না থাকায় নতুন করে এ পেশায় কেউ প্রবেশ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
শেরপুর উপজলার বিভিন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, আগে যেখানে সহস্রাধিক মৃৎশিল্পী ছিল এখন সেখানে এ শিল্পের সাথে জড়িতদের সংখ্যা কমে মাত্র শতাধিক দাঁড়িয়েছে। এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই ছিল হিদু সম্প্রাদায়ের। এদের মধ্যে কেউ কেউ চলে গেছেন ভারতে। আবার কেউ কেউ জীবন যাত্রার মান উনয়নের জন্যে এ পেশা ছেড়ে অন্যান্য যান্ত্রিক পেশায় জিবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন। উপজেলার কল্যাণী গ্রামটি প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বাঙ্গালী নদী। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটিতে মূলতঃ হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী পাল বা কুমার সম্প্রদায়ে বসবাস। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হিটলারের দেয়া তথ্যমতে, কল্যাণী গ্রামে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ হাজার। এরমধ্যে হিন্দু ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩৫০ জন। এই গ্রামে ১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি টেকনিক্যাল কলেজ, ১ টি মাদ্রাসা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ১টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে।
দইয়ের সরা তৈরীর কারিগর মমতা রানী জানান, প্রতিদিন তিনি প্রায় ৩০০ সরা তৈরী করেন। প্রতিটি সরার জন্য তিনি এক টাকা হারে মজুরী পান। এই পেশায় তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যুক্ত। তাদের ২ ছেলে নীরব (১৩) ও সন্দ্বীপ (৯) স্থানীয় স্কুলে পড়াশুনা করে। ১ মেয়ে নিপা রানী-কে (২১) ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তিনি জানান, এই পেশায় নিযুক্ত থেকে পরিবারের যেমন দরিদ্রতা দূর করেছেন তেমনি সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্যামল চন্দ্র পাল জানান, তার ভাটায় প্রায় ৩০ জন কর্মচারী কাজ করেন। প্রতি এক মাস পর পর ভাটা জ্বালানো হয়। একটি ভাটায় ৫ হাজার সরা ও ২০ হাজার গ্লাস তৈরী করা যায়। প্রতি পিস সরা ৭/৮ টাকা, প্রতি পিস গ্লাস দেড়-দুই টাকায় বিক্রি হয়। তিনি জানান, এ পেশা থেকে আয় করে তার তিন ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তারা এখন বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থায় চাকুরি করছেন। কথা হয় এই গ্রামের আরও একজন মৃৎশিল্পী সুধাংশু কুমার পাল-এর সাথে। তিনি কল্যাণী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি এই শিল্পের সাথে জড়িত। তিনি জানান, মৃৎশিল্পের কাজ এক সময় খুব কষ্টের ছিল। চৈত্র মাসে নদী থেকে মাটি তুলে রাখা হতো। এখন বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন মাটি এনে আমাদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতি ট্রলি মাটির দাম পড়ে প্রায় ১ হাজার থেকে ১২’শ টাকা পর্যন্ত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই কাজ এখন অনেক সহজ হয়েছে। বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহার করে চাকা ঘুরিয়ে দই তৈরীর সরা, পাতিল, ও গ্লাস তৈরী করা হয়। অবসর সময়ে বসে না থেকে তিনি এই কাজ করে মাসে প্রায় ১৫/২০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করেন। কল্যানী গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য হুমায়ুন কবির জানান, লাভজনক হওয়ায় মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই এ পেশাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের কাশিয়াবালা পালপাড়ার সুশীল পাল বলেন, আমার বাপ-দাদার জাত ব্যবসা ধরে রাখার জন্যে আমি ৩২ বছর এ পেশায় কাজ করছি, তবে আমার চার ছেলের কেউই এ পেশায় নেই। তাদর মধ্যে কেউ চাকরি কেউ পড়াশুনা করছে। আমার পর আমার পরিবারের আর কেউ এই পেশায় থাকবে না। দিন দিন মাটির তৈরী জিনিসপত্রের চাহিদাও কমছে, বর্তমানে স্যানিটারি ল্যাট্রিনের চাক বা রিং বা কুয়ার রিং তৈরী করছি। এটার স্থায়িত্ব সিমেন্টের তৈরী রিংয়ের তুলনায় অনেক বেশি।
এ প্রসঙ্গে শেরপুর উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা ওবায়দুল হকবলেন, মৃৎশিল্পীদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সমাজসেবা অধিদপ্তর সহ বিভিন্ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও ঋনদান কর্মসূচী সহ নানা পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। তাতে মৃৎশিল্পীদের অনেকের আগ্রহ বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫
বৈজ্ঞানিক জয়যাত্রা ও নানাবিধ আবিষ্কারের কারণে কালের আবর্তনে বিলীনের পথে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প, তারপরেও পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যের এই পেশা এখনও ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। মাটির সাথে মানুষের জীবন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। মাটিকে সবাই পায়ের নিচে রাখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু এই মাটিই যখন উঠে আসে আমাদের ঘরে, সাজিয়ে তোলে অন্দর মহল, তখন মাটির স্থান হয় আভিজাত্যে। মৃৎশিল্প এমন একটি মাধ্যম যা মাটিকে নিয়ে আসে মানুষের কাছাকাছি। মৃৎশিল্প বলতে মাটি দিয়ে তৈরী যাবতীয় ব্যবহার্য এবং শৌখিন শিল্পসামগ্রীকেই বোঝায়। শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে মৃৎশিল্প অতি প্রাচীন। নগরায়নের ফলে কালের আবর্তনে বগুড়ার শেরপুরে অতি প্রচীন এই শিল্প এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। মাটির তৈরী হাড়ি পাতিল, ফুলের টব, মাটির ব্যাংক, আগরদানি, প্রদিপদানিসহ আরও অনেক ধরনের তৈজসপত্র দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়ে থাকলেও ব্যবহার্য এসব বস্তুর বর্তমান চাহিদা কমে গেছে, যে কারণে এ শিল্প থেক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন মৃৎশিল্পীরা। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি আর জীবন-মান উনয়নের জন্যে ক্রমশ অন্য পেশার দিক ঝুকে পরছেন তারা। এক সময় বংশানুক্রমে পাওয়া পেশা হিসেবে এ পেশাকে অনেকেই সাদরে গ্রহন করতো। এখন তা হচ্ছেনা। কারন মাটির তৈরী তৈজসপত্রের পর্যাপ্ত চাহিদা না থাকায় নতুন করে এ পেশায় কেউ প্রবেশ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
শেরপুর উপজলার বিভিন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, আগে যেখানে সহস্রাধিক মৃৎশিল্পী ছিল এখন সেখানে এ শিল্পের সাথে জড়িতদের সংখ্যা কমে মাত্র শতাধিক দাঁড়িয়েছে। এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই ছিল হিদু সম্প্রাদায়ের। এদের মধ্যে কেউ কেউ চলে গেছেন ভারতে। আবার কেউ কেউ জীবন যাত্রার মান উনয়নের জন্যে এ পেশা ছেড়ে অন্যান্য যান্ত্রিক পেশায় জিবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন। উপজেলার কল্যাণী গ্রামটি প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বাঙ্গালী নদী। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটিতে মূলতঃ হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী পাল বা কুমার সম্প্রদায়ে বসবাস। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হিটলারের দেয়া তথ্যমতে, কল্যাণী গ্রামে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ হাজার। এরমধ্যে হিন্দু ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩৫০ জন। এই গ্রামে ১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি টেকনিক্যাল কলেজ, ১ টি মাদ্রাসা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ১টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে।
দইয়ের সরা তৈরীর কারিগর মমতা রানী জানান, প্রতিদিন তিনি প্রায় ৩০০ সরা তৈরী করেন। প্রতিটি সরার জন্য তিনি এক টাকা হারে মজুরী পান। এই পেশায় তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যুক্ত। তাদের ২ ছেলে নীরব (১৩) ও সন্দ্বীপ (৯) স্থানীয় স্কুলে পড়াশুনা করে। ১ মেয়ে নিপা রানী-কে (২১) ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তিনি জানান, এই পেশায় নিযুক্ত থেকে পরিবারের যেমন দরিদ্রতা দূর করেছেন তেমনি সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্যামল চন্দ্র পাল জানান, তার ভাটায় প্রায় ৩০ জন কর্মচারী কাজ করেন। প্রতি এক মাস পর পর ভাটা জ্বালানো হয়। একটি ভাটায় ৫ হাজার সরা ও ২০ হাজার গ্লাস তৈরী করা যায়। প্রতি পিস সরা ৭/৮ টাকা, প্রতি পিস গ্লাস দেড়-দুই টাকায় বিক্রি হয়। তিনি জানান, এ পেশা থেকে আয় করে তার তিন ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তারা এখন বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থায় চাকুরি করছেন। কথা হয় এই গ্রামের আরও একজন মৃৎশিল্পী সুধাংশু কুমার পাল-এর সাথে। তিনি কল্যাণী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি এই শিল্পের সাথে জড়িত। তিনি জানান, মৃৎশিল্পের কাজ এক সময় খুব কষ্টের ছিল। চৈত্র মাসে নদী থেকে মাটি তুলে রাখা হতো। এখন বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন মাটি এনে আমাদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতি ট্রলি মাটির দাম পড়ে প্রায় ১ হাজার থেকে ১২’শ টাকা পর্যন্ত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই কাজ এখন অনেক সহজ হয়েছে। বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহার করে চাকা ঘুরিয়ে দই তৈরীর সরা, পাতিল, ও গ্লাস তৈরী করা হয়। অবসর সময়ে বসে না থেকে তিনি এই কাজ করে মাসে প্রায় ১৫/২০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করেন। কল্যানী গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য হুমায়ুন কবির জানান, লাভজনক হওয়ায় মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই এ পেশাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের কাশিয়াবালা পালপাড়ার সুশীল পাল বলেন, আমার বাপ-দাদার জাত ব্যবসা ধরে রাখার জন্যে আমি ৩২ বছর এ পেশায় কাজ করছি, তবে আমার চার ছেলের কেউই এ পেশায় নেই। তাদর মধ্যে কেউ চাকরি কেউ পড়াশুনা করছে। আমার পর আমার পরিবারের আর কেউ এই পেশায় থাকবে না। দিন দিন মাটির তৈরী জিনিসপত্রের চাহিদাও কমছে, বর্তমানে স্যানিটারি ল্যাট্রিনের চাক বা রিং বা কুয়ার রিং তৈরী করছি। এটার স্থায়িত্ব সিমেন্টের তৈরী রিংয়ের তুলনায় অনেক বেশি।
এ প্রসঙ্গে শেরপুর উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা ওবায়দুল হকবলেন, মৃৎশিল্পীদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সমাজসেবা অধিদপ্তর সহ বিভিন্ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও ঋনদান কর্মসূচী সহ নানা পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। তাতে মৃৎশিল্পীদের অনেকের আগ্রহ বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।