সারাদেশে চালের বাজারে ফের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫ থেকে ১৫ টাকা। এর মধ্যে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা। আর চিকন ও অন্যান্য চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে তারা দাম বাড়িয়েছে। আবার কিছু খুচরা ব্যবসায়ী বলছেন, চালকল মালিকরা সিন্ডিকেট করে চাল মজুদ করছেন। এতে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং দাম হু হু করে বাড়ছে। অনেকে বড় বড় করপোরেট গ্রুপের চালের ব্যবসায় আসার কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলেও তারা দাবি করেন। রাজধানী ঢাকাসহ দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ায় চালের বাজার ঘুরে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার (১৭ আগস্ট) কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫১ থেকে ৫২ টাকায়, বিআর আটাশ ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়, মিনিকেট ৭২ টাকা, নাজির ৮০ থেকে থেকে ৮৫ টাকায় আর চিনিগুঁড়া ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। এসব চাল গত এক সপ্তাহ আগেও ৫ থেকে ১৫ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে।
হঠাৎ এই পরিমাণ দাম বৃদ্ধি কেন হলো, জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা ফেনি রাইস মিলের বিক্রয়কর্মী মো. মাসুম সংবাদকে বলেন, ‘চালের বাজার এখন করপোরেট গ্রুপের হাতে। তারা হাজার হাজার টন চাল কিনে মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংটক সৃষ্টি করছে। আর বাজারে একটা পণ্যের সরবরাহ কমে গেলে দাম এমনিতেই হু হু করে বেড়ে যাবে।’
চালের পাইকারি বাজার রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটর মেসার্স সূচনা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী সবুজ মিয়া বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগেও ৫০ কেজির ১ বস্তা বিআর আটাশের দাম ছিল ২৪০০ টাকা। সেই চালের বস্তা আজ ২৭৫০ টাকা। মিলারর দাম বাড়ালে আমরা কি করব। তারা যখন যে রেট ধরে সেই রেটে মাল নিতে হয়।’
এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী এই দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বুধবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্য এতটা বাড়ার কোন কারণ নেই। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার প্রবণতার কারণে সবাই এক লাফে দাম বাড়িয়ে দেয়। মনে করেন, তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচের জন্য প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সা করে বাড়তে পারে। সেখানে ব্যবসায়ীরা ৪ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এখানে কোন লজিক আছে? নাই। হঠাৎ করে সুযোগ কেউ কেউ নিয়েছে। যে পরিমাণ বাড়ার কথা, তার থেকে অনেক বেশি সুযোগ নিয়েছে, এটা সত্যি কথা। আমরা চেষ্টা করছি।’
শুধু রাজধানী ঢাকায় নয় এই অবস্থা সারাদেশেই। দেশের সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদনকারী জেলা দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়া জেলাতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। গত কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে এসব জেলায় হু হু করে বেড়ে গেছে চালের দাম।
দিনাজপুর : এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে প্রতি বস্তা ধানের দাম (৭৭ কেজি) আড়াইশ’ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। একই সময়ে চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দেড়শ’ থেকে ২০০ টাকা। চালকল মালিকরা বলছেন, ধান-চালের দাম কমতে শুরু করেছে। দিনাজপুরের চাল ব্যবসায়ী সোলায়মান আলী সাম্প্রতিক সময়ে দিনাজপুরসহ সারাদেশে ধান-চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘দেশের বড় বড় করপোরেট গ্রুপ হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বেশি দামে ধান ক্রয় করছে। এতে কৃষকেরা ধানের দাম কিছুটা বেশি পেলেও ভোক্তারা তাদের কাছ থেকে সুন্দর প্যাকেটে ভরা চাল কিনছেন সাধারণ বাজারের তুলনায় প্রতি কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি দামে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্থানীয় চালকল মালিকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী ধান কিনতে পারছেন না। তাই ধান-চালের বাজার এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এছাড়া আকস্মিকভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে ধান-চালের ওপর। বোরো মওসুম শুরু হতেই বিদ্যুতের লোডশেডিং। এ কারণে সবগুলো চালকলের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে।
নওগাঁ : এক সপ্তাহের ব্যবধানে সরু ও মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি তিন থেকে চার টাকা করে বাড়িয়েছে মিলগুলো। ফলে প্রতি কেজি শর্টিং করা জিরা (মিনিকেট) চাল ৭০-৭৫ টাকা ও নন-শর্টার জিরা ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কাটারি ৬৭-৬৮ টাকা, বিআর-২৮ চাল ৫২-৫৬ টাকা ও স্বর্ণা-৫ চাল ৫০-৫৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় বর্তমানে বাজারে ধানের দাম বাড়তি। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ধান-চাল পরিবহনের খরচ বেড়েছে। ফলে ধান-চাল দুটিরই দাম আরও বেড়েছে। এ নিয়ে গত দুই-তিন সপ্তাহে নওগাঁ মোকামে ধানের দাম মণপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এদিকে ধানের দাম ও পরিবহন খরচ বাড়ায় চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল আমদানি করা না গেলে আগামী তিন মাস চালের দাম কমার সম্ভাবনা দেখছেন না তারা। কারণ নতুন ধান (আমন ধান) বাজারে আসতে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে। নওগাঁ মোকামে ধান-চালের দাম বাড়লে সরাসরি এর প্রভাব পড়ে সারাদেশের বাজারে।
রংপুর : রংপুরে কেজিপ্রতি চালের প্রকারভেদে ৬ থেকে ১০ টাকা কেজিতে দাম বেড়েছে। আড়তগুলোতে হাজার হাজার বস্তা চাল থাকলেও চালের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। আকস্মিকভাবে চালের দাম বৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষ, শ্রমজীবীসহ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। চালের দাম তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
বিভাগীয় নগরী রংপুরের দেশের অন্যতম বৃহৎ চালের মোকাম রংপুর সিটি বাজার ও মাহিগঞ্জ মোকামে গিয়ে দেখা গেছে, মোটা ৪০ টাকার চাল কেজিপ্রতি ৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশি স্বর্ণা চাল ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন কেজিপ্রতি ৮ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেট ৬০ টাকার চাল কেজিপ্রতি ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বিআর-২৮ ৫৪ টাকার চাল ৬২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
আড়তদাররা অভিযোগ করছেন, বড় বড় মিলাররা হাজার হাজার বস্তা চাল গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করায় চালের দাম বেড়েছে। তারা বড় বড় মিলারদের দায়ী করলেও সিটি বাজার ও মাহিগঞ্জ মোকামে ব্যবসায়ীদের গুদামে হাজার হাজার বস্তা চাল অবৈধভাবে মজুদ রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্নআয়ের মানুষ, শ্রমজীবীসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। রিকশাওয়ালা সাজাহান ও কুলি নবাব আলী সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের আয় বাড়েনি অথচ চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। ৪০ টাকার মোটা চাল ৫৮ টাকায় উঠেছে। ফলে তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা আধা পেট করে ভাত খেকে হচ্ছে। একই কথা জানালেন গৃহবধূ সালমা বেগম। তিনি বলেন, ‘যেভাবে চালের দাম বাড়ছে তাতে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে।’
কুষ্টিয়া : কিছুতেই কাটছে না কুষ্টিয়য় চালের বাজারের অস্থিরতা। হু হু করে বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম। কুষ্টিয়ার বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। চালের এই দাম বৃদ্ধির লাগাম যেন কিছুতেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। চালের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতা সাধারণকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘বর্তমান যে দাম রয়েছে সেই দাম আরও বৃদ্ধি পেলেও বলার কিছু থাকবে না। শুধু চাল নয়, কুষ্টিয়ার বাজারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কাঁচা মরিচ, তরি-তরকারিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম।’
চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে খুচরা ব্যবসায়ী ও একাধিক মিলারের সঙ্গে কথা বলা হয়। তাদের দাবি, মূলত তিনটি কারণে চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথমত, সরকার ডিজেলের মূল্য এক লাফে লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বৃদ্ধি করায় পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। যে কারণে ব্যবসায়ীদের চালের দাম বাড়াতে হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, বাজারে ধানের দাম চড়া, সেই সঙ্গে ধানের সংকটও রয়েছে। ধান পাওয়া গেলেও দাম বেশি। ধানের দাম চড়া হওয়ায় চালের দামেও প্রভাব পড়ছে। তৃতীয় কারণ হিসেবে তাদের যুক্তি হচ্ছে সরকার চাল আমদানির সুযোগ দিলেও সেখানে ২৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। অতিরিক্ত এই ভ্যাট আরোপের কারণে ব্যবসায়ীরা কেউ চাল আমদানি করতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না।
দাম বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় কয়েকজন ক্রেতা সংবাদকে বলেন, ‘বাজার তদারকির দায়িত্ব নামমাত্র। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলে এমন হতো না। সীমিত আয় নিয়ে আমাদের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে, গেলে তারা বলে, পাইকারি দাম বেড়ে গেছে। নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বেড়ে গেছে তাতে আমাদের দিনে দিনে না খেয়ে মরার মতো অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।’
বুধবার, ১৭ আগস্ট ২০২২
সারাদেশে চালের বাজারে ফের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫ থেকে ১৫ টাকা। এর মধ্যে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা। আর চিকন ও অন্যান্য চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে তারা দাম বাড়িয়েছে। আবার কিছু খুচরা ব্যবসায়ী বলছেন, চালকল মালিকরা সিন্ডিকেট করে চাল মজুদ করছেন। এতে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং দাম হু হু করে বাড়ছে। অনেকে বড় বড় করপোরেট গ্রুপের চালের ব্যবসায় আসার কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলেও তারা দাবি করেন। রাজধানী ঢাকাসহ দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ায় চালের বাজার ঘুরে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার (১৭ আগস্ট) কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫১ থেকে ৫২ টাকায়, বিআর আটাশ ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়, মিনিকেট ৭২ টাকা, নাজির ৮০ থেকে থেকে ৮৫ টাকায় আর চিনিগুঁড়া ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। এসব চাল গত এক সপ্তাহ আগেও ৫ থেকে ১৫ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে।
হঠাৎ এই পরিমাণ দাম বৃদ্ধি কেন হলো, জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা ফেনি রাইস মিলের বিক্রয়কর্মী মো. মাসুম সংবাদকে বলেন, ‘চালের বাজার এখন করপোরেট গ্রুপের হাতে। তারা হাজার হাজার টন চাল কিনে মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংটক সৃষ্টি করছে। আর বাজারে একটা পণ্যের সরবরাহ কমে গেলে দাম এমনিতেই হু হু করে বেড়ে যাবে।’
চালের পাইকারি বাজার রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটর মেসার্স সূচনা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী সবুজ মিয়া বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগেও ৫০ কেজির ১ বস্তা বিআর আটাশের দাম ছিল ২৪০০ টাকা। সেই চালের বস্তা আজ ২৭৫০ টাকা। মিলারর দাম বাড়ালে আমরা কি করব। তারা যখন যে রেট ধরে সেই রেটে মাল নিতে হয়।’
এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী এই দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বুধবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্য এতটা বাড়ার কোন কারণ নেই। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার প্রবণতার কারণে সবাই এক লাফে দাম বাড়িয়ে দেয়। মনে করেন, তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচের জন্য প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সা করে বাড়তে পারে। সেখানে ব্যবসায়ীরা ৪ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এখানে কোন লজিক আছে? নাই। হঠাৎ করে সুযোগ কেউ কেউ নিয়েছে। যে পরিমাণ বাড়ার কথা, তার থেকে অনেক বেশি সুযোগ নিয়েছে, এটা সত্যি কথা। আমরা চেষ্টা করছি।’
শুধু রাজধানী ঢাকায় নয় এই অবস্থা সারাদেশেই। দেশের সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদনকারী জেলা দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়া জেলাতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। গত কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে এসব জেলায় হু হু করে বেড়ে গেছে চালের দাম।
দিনাজপুর : এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে প্রতি বস্তা ধানের দাম (৭৭ কেজি) আড়াইশ’ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। একই সময়ে চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দেড়শ’ থেকে ২০০ টাকা। চালকল মালিকরা বলছেন, ধান-চালের দাম কমতে শুরু করেছে। দিনাজপুরের চাল ব্যবসায়ী সোলায়মান আলী সাম্প্রতিক সময়ে দিনাজপুরসহ সারাদেশে ধান-চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘দেশের বড় বড় করপোরেট গ্রুপ হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বেশি দামে ধান ক্রয় করছে। এতে কৃষকেরা ধানের দাম কিছুটা বেশি পেলেও ভোক্তারা তাদের কাছ থেকে সুন্দর প্যাকেটে ভরা চাল কিনছেন সাধারণ বাজারের তুলনায় প্রতি কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি দামে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্থানীয় চালকল মালিকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী ধান কিনতে পারছেন না। তাই ধান-চালের বাজার এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এছাড়া আকস্মিকভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে ধান-চালের ওপর। বোরো মওসুম শুরু হতেই বিদ্যুতের লোডশেডিং। এ কারণে সবগুলো চালকলের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে।
নওগাঁ : এক সপ্তাহের ব্যবধানে সরু ও মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি তিন থেকে চার টাকা করে বাড়িয়েছে মিলগুলো। ফলে প্রতি কেজি শর্টিং করা জিরা (মিনিকেট) চাল ৭০-৭৫ টাকা ও নন-শর্টার জিরা ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কাটারি ৬৭-৬৮ টাকা, বিআর-২৮ চাল ৫২-৫৬ টাকা ও স্বর্ণা-৫ চাল ৫০-৫৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় বর্তমানে বাজারে ধানের দাম বাড়তি। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ধান-চাল পরিবহনের খরচ বেড়েছে। ফলে ধান-চাল দুটিরই দাম আরও বেড়েছে। এ নিয়ে গত দুই-তিন সপ্তাহে নওগাঁ মোকামে ধানের দাম মণপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এদিকে ধানের দাম ও পরিবহন খরচ বাড়ায় চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল আমদানি করা না গেলে আগামী তিন মাস চালের দাম কমার সম্ভাবনা দেখছেন না তারা। কারণ নতুন ধান (আমন ধান) বাজারে আসতে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে। নওগাঁ মোকামে ধান-চালের দাম বাড়লে সরাসরি এর প্রভাব পড়ে সারাদেশের বাজারে।
রংপুর : রংপুরে কেজিপ্রতি চালের প্রকারভেদে ৬ থেকে ১০ টাকা কেজিতে দাম বেড়েছে। আড়তগুলোতে হাজার হাজার বস্তা চাল থাকলেও চালের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। আকস্মিকভাবে চালের দাম বৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষ, শ্রমজীবীসহ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। চালের দাম তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
বিভাগীয় নগরী রংপুরের দেশের অন্যতম বৃহৎ চালের মোকাম রংপুর সিটি বাজার ও মাহিগঞ্জ মোকামে গিয়ে দেখা গেছে, মোটা ৪০ টাকার চাল কেজিপ্রতি ৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশি স্বর্ণা চাল ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন কেজিপ্রতি ৮ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেট ৬০ টাকার চাল কেজিপ্রতি ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বিআর-২৮ ৫৪ টাকার চাল ৬২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
আড়তদাররা অভিযোগ করছেন, বড় বড় মিলাররা হাজার হাজার বস্তা চাল গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করায় চালের দাম বেড়েছে। তারা বড় বড় মিলারদের দায়ী করলেও সিটি বাজার ও মাহিগঞ্জ মোকামে ব্যবসায়ীদের গুদামে হাজার হাজার বস্তা চাল অবৈধভাবে মজুদ রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্নআয়ের মানুষ, শ্রমজীবীসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। রিকশাওয়ালা সাজাহান ও কুলি নবাব আলী সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের আয় বাড়েনি অথচ চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। ৪০ টাকার মোটা চাল ৫৮ টাকায় উঠেছে। ফলে তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা আধা পেট করে ভাত খেকে হচ্ছে। একই কথা জানালেন গৃহবধূ সালমা বেগম। তিনি বলেন, ‘যেভাবে চালের দাম বাড়ছে তাতে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে।’
কুষ্টিয়া : কিছুতেই কাটছে না কুষ্টিয়য় চালের বাজারের অস্থিরতা। হু হু করে বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম। কুষ্টিয়ার বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। চালের এই দাম বৃদ্ধির লাগাম যেন কিছুতেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। চালের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতা সাধারণকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘বর্তমান যে দাম রয়েছে সেই দাম আরও বৃদ্ধি পেলেও বলার কিছু থাকবে না। শুধু চাল নয়, কুষ্টিয়ার বাজারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কাঁচা মরিচ, তরি-তরকারিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম।’
চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে খুচরা ব্যবসায়ী ও একাধিক মিলারের সঙ্গে কথা বলা হয়। তাদের দাবি, মূলত তিনটি কারণে চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথমত, সরকার ডিজেলের মূল্য এক লাফে লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বৃদ্ধি করায় পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। যে কারণে ব্যবসায়ীদের চালের দাম বাড়াতে হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, বাজারে ধানের দাম চড়া, সেই সঙ্গে ধানের সংকটও রয়েছে। ধান পাওয়া গেলেও দাম বেশি। ধানের দাম চড়া হওয়ায় চালের দামেও প্রভাব পড়ছে। তৃতীয় কারণ হিসেবে তাদের যুক্তি হচ্ছে সরকার চাল আমদানির সুযোগ দিলেও সেখানে ২৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। অতিরিক্ত এই ভ্যাট আরোপের কারণে ব্যবসায়ীরা কেউ চাল আমদানি করতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না।
দাম বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় কয়েকজন ক্রেতা সংবাদকে বলেন, ‘বাজার তদারকির দায়িত্ব নামমাত্র। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলে এমন হতো না। সীমিত আয় নিয়ে আমাদের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে, গেলে তারা বলে, পাইকারি দাম বেড়ে গেছে। নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বেড়ে গেছে তাতে আমাদের দিনে দিনে না খেয়ে মরার মতো অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।’