দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বড় একটি অংশজুড়ে ঘূর্ণিঝড় ও ভারী বৃষ্টিপাতে গত কয়েক দিনে ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। সরকারি তথ্যমতে, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডেই ১ হাজার ২৫০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। অনেকে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। পরপর দুটি ঘূর্ণিঝড় ও একটি টাইফুন এ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় শহর ও গ্রাম কাদায় তলিয়ে গেছে। উদ্ধার তৎপরতায় কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় বন্যা ও ভূমিধসে ১১ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। গত ২৮ নভেম্বর দেশটির প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে এই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) এক রায়ে বলেছে, গ্যাস নির্গমন হ্রাসে সহযোগিতা, বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি অনুসরণ এবং দুর্বল জনগোষ্ঠী ও বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতি থেকে রক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ‘অস্তিত্বের সংকট’ মোকাবিলায় জরুরিভিত্তিতে কাজ করতে হবে। দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের মহাপরিচালক সম্পথ কোটুওয়েগোডা বলেন, ‘দেশটি নজিরবিহীন এক মানবিক সংকট মোকাবিলা করছে।’
তবে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। আল-জাজিরার প্রতিবেদক জেসিকা ওয়াশিংটন জানিয়েছেন, তিনি উত্তর সুমাত্রা প্রদেশজুড়ে সর্বত্র ভূমিধস দেখেছেন। উত্তর সুমাত্রার ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি তাপানুলি। ওই এলাকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি আগেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর সংগ্রহ করেছি। সাধারণত নির্দিষ্ট একটি জায়গায় ভূমিধস সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু এবার আমরা যেসব গ্রাম পেরিয়ে এসেছি, সব জায়গায় ভূমিধস হয়েছে।’
কেন এমন বন্যা ও ভূমিধস: ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির খবর ছড়িয়ে পড়তেই অনলাইনে এর কারণ খুঁজতে শুরু করে মানুষ। দেখা যায়, মানুষ জানতে চাইছে ঠিক কোন কারণে এতগুলো দেশে একসঙ্গে এমন চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া দেখা দিয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা ভারী বৃষ্টিপাত এবং মারাত্মক গ্রীষ্মম-লীয় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন জনগোষ্ঠী সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বন্যার কবলে পড়েছে। কয়েকটি দেশে সর্বশেষ বন্যা পরিস্থিতি ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আরও খারাপ আকার ধারণ করেছিল। এর মধ্যে রয়েছে টাইফুন ‘কোটো’ যা ফিলিপাইনে তীব্র আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের সৃষ্টি করে। ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’ ইন্দোনেশিয়ার উত্তর সুমাত্রায় মারাত্মকভাবে আঘাত হানে। আর ঘূর্ণিঝড় ‘ডিটওয়া’ শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়।
অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির এনভায়রনমেন্টাল জিওগ্রাফি বিভাগের অস্থায়ী অধ্যাপক স্টিভ টারটন বলেছেন, এই অঞ্চলে সাধারণ যে চিত্রটি দেখা গেছে, প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টির পানি মোকাবিলা করতে গিয়ে জনগোষ্ঠীগুলো হিমশিম খাচ্ছিল। এই বৃষ্টিপাত ভূমিধসসহ আরও নানা সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
টারটন বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে যেখানে এ ধরনের ক্রান্তীয় ঝড়প্রবণ আবহাওয়া রয়েছে, সেগুলোকে আপনি টাইফুন, হারিকেন বা ঘূর্ণিঝড় যা-ই বলুন না কেন, এগুলো আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। আর এটা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।’
টারটন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’ ও ‘ডিটওয়া’ এবং টাইফুন ‘কোটো’ বাতাসের গতির কারণে তীব্র ঝড় হিসেবে শ্রেণিভুক্ত না হলেও এগুলো অনেক বেশি বৃষ্টি ঝরিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘বায়ুম-লের উষ্ণতা ও সাগরের উষ্ণতা এ ধরনের বৃষ্টি ঝরানো ঝড়কে আরও শক্তিশালী করছে।’ ভারতের ট্রপিক্যাল মেটিওরোলজি ইনস্টিটিউটের জলবায়ুবিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথিউ কোল এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘তুলনামূলক উষ্ণ মহাসাগর ঘূর্ণিঝড়ের চারপাশে শক্তিশালী বৃষ্টিবলয় তৈরি করে। আর তুলনামূলক উষ্ণ বায়ুম-ল বেশি আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং তা আরও তীব্রভাবে ঝরায়।’
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘লা নিনা’ নামের একটি স্বাভাবিক আবহাওয়া চক্র। এই চক্রে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাংশ স্বাভাবিকের চেয়ে ঠান্ডা আর পশ্চিমাংশ উষ্ণ থাকে। এর ফলে বাতাস শক্তিশালী হয়ে এশিয়ার দিকে আরও বেশি উষ্ণ পানি ও আর্দ্রতা ঠেলে দেয়। কোল বলেন, ‘এই ধরনটি এশিয়ার বায়ুম-লে অতিরিক্ত আর্দ্রতা সঞ্চার করে, যা ভারী বৃষ্টি ও প্রবল বন্যার ঝুঁকি বাড়ায়।’
বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির প্রভাবটি ভালোভাবে বোঝা গেলেও টারটন উল্লেখ করেছেন, গত সপ্তাহের ঘূর্ণিঝড়গুলোর অন্যান্য অস্বাভাবিক দিকগুলো— যেমন, ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’ ও টাইফুন ‘কোটো’ কীভাবে একে অপর থেকে শক্তি সঞ্চার করল, সেই বিষয়ে আরও সুনির্দিষ্ট গবেষণার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
গ্রান্থাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট সম্প্রতি ইম্পিরিয়াল কলেজ স্টর্ম মডেল (আইআরআইএস) ব্যবহার করে এ ধরনের এক গবেষণায় ইতিমধ্যে খুঁজে পেয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে টাইফুন ‘ফাং-ওং’-এর কেন্দ্র ঘিরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১০ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই টাইফুনটি গত মাসে ফিলিপাইনে আঘাত হেনেছিল।
মোকাবিলায় করণীয় কী: সোমবার উত্তর সুমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের সময় ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এমন এক সমস্যা, যা ইন্দোনেশীয়দের মোকাবিলা করতেই হবে। তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক প্রশাসনগুলোকেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’ গ্লোবাল ক্লাইমেট অ্যান্ড হেলথ অ্যালায়েন্সের প্রচার-প্রধান শ্বেতা নারায়ণ বলেন, সরকার ও শহর কর্তৃপক্ষগুলো চরমভাবাপন্ন এসব আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর পরিণতি সামলানোর ক্ষেত্রে প্রস্তুতি নিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাস্তবতার সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের ইচ্ছাকৃত অবহেলার বিশাল ফারাক রয়েছে। আর এর মূল্য চুকাচ্ছে সাধারণ মানুষ।’
সতত সম্পদ ক্লাইমেট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা হরজিৎ সিং বলেন, একেকটি দুর্যোগের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক এখন স্পষ্ট। এখন এটি মোকাবিলার দিকে এগোনোর সময়। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ এখন এক ধরনের তথ্য-উপাত্তই বলা চলে। এখন এসব তথ্য-প্রমাণ (যারা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, তাদের) জবাবদিহি নিশ্চিতে কাজে লাগানো উচিত।’
জলবায়ু অধিকারকর্মী হরজিৎ সিং বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন দুর্যোগের মাত্রা ও দুর্যোগের আঘাত হানার পরিমাণ যে বাড়াচ্ছে, এটা বোঝার জন্য প্রতিটি ঘটনা নিয়ে আলাদা গবেষণার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেসব দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে ধনী হয়েছে, তাদের আইনি ও নৈতিক দায়িত্ব হলো এখনই অনুদানভিত্তিক অর্থসহায়তা দেওয়া, যাতে আক্রান্ত দেশগুলো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে।’
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ ৩০) শেষ হওয়ার এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে সর্বশেষ ঝড়গুলো আঘাত হেনেছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর দাবি অনুযায়ী ওই সম্মেলনে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া যায়নি।
হরজিৎ সিং বলেন, ‘তাদের দাবির মধ্যে ছিল অনুদানভিত্তিক অর্থসহায়তা, ঋণ নয়। কারণ, ঋণ তাদের দেনা আরও বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার জরুরিভিত্তিতে কমানোর সিদ্ধান্তও চেয়েছিল তারা।’
চলতি বছরের শুরুর দিকে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) এক রায়ে বলেছে, গ্যাস নির্গমন হ্রাসে সহযোগিতা, বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি অনুসরণ এবং দুর্বল জনগোষ্ঠী ও বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতি থেকে রক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ‘অস্তিত্বের সংকট’ মোকাবিলায় জরুরিভিত্তিতে কাজ করতে হবে।
ভানুয়াতুর নেতৃত্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর আনা একটি মামলার প্রেক্ষাপটে আইসিজের সভাপতি ইউজি ইওয়াসাওয়া বলেন, ‘জলবায়ু ব্যবস্থা সুরক্ষায় উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে কোনো রাষ্ট্রের ব্যর্থতা... আন্তর্জাতিকভাবে একটি অপরাধমূলক কাজ হিসাবে গণ্য হতে পারে।’ সোমবার ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি) দুর্যোগকবলিত মানুষের সুরক্ষায় ‘জরুরিভিত্তিতে আরও শক্তিশালী আইনি ও নীতি কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার’ বিষয়টি তুলে ধরেছে।
আইএফআরসির এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক আলেক্সান্ডার ম্যাথিউ বলেন, ‘এই বন্যাগুলো স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগগুলো নতুন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠছে এবং অভিঘাত মোকাবিলা ও প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অপরিহার্য।’
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বড় একটি অংশজুড়ে ঘূর্ণিঝড় ও ভারী বৃষ্টিপাতে গত কয়েক দিনে ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। সরকারি তথ্যমতে, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডেই ১ হাজার ২৫০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। অনেকে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। পরপর দুটি ঘূর্ণিঝড় ও একটি টাইফুন এ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় শহর ও গ্রাম কাদায় তলিয়ে গেছে। উদ্ধার তৎপরতায় কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় বন্যা ও ভূমিধসে ১১ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। গত ২৮ নভেম্বর দেশটির প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে এই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) এক রায়ে বলেছে, গ্যাস নির্গমন হ্রাসে সহযোগিতা, বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি অনুসরণ এবং দুর্বল জনগোষ্ঠী ও বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতি থেকে রক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ‘অস্তিত্বের সংকট’ মোকাবিলায় জরুরিভিত্তিতে কাজ করতে হবে। দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের মহাপরিচালক সম্পথ কোটুওয়েগোডা বলেন, ‘দেশটি নজিরবিহীন এক মানবিক সংকট মোকাবিলা করছে।’
তবে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। আল-জাজিরার প্রতিবেদক জেসিকা ওয়াশিংটন জানিয়েছেন, তিনি উত্তর সুমাত্রা প্রদেশজুড়ে সর্বত্র ভূমিধস দেখেছেন। উত্তর সুমাত্রার ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি তাপানুলি। ওই এলাকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি আগেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর সংগ্রহ করেছি। সাধারণত নির্দিষ্ট একটি জায়গায় ভূমিধস সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু এবার আমরা যেসব গ্রাম পেরিয়ে এসেছি, সব জায়গায় ভূমিধস হয়েছে।’
কেন এমন বন্যা ও ভূমিধস: ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির খবর ছড়িয়ে পড়তেই অনলাইনে এর কারণ খুঁজতে শুরু করে মানুষ। দেখা যায়, মানুষ জানতে চাইছে ঠিক কোন কারণে এতগুলো দেশে একসঙ্গে এমন চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া দেখা দিয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা ভারী বৃষ্টিপাত এবং মারাত্মক গ্রীষ্মম-লীয় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন জনগোষ্ঠী সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বন্যার কবলে পড়েছে। কয়েকটি দেশে সর্বশেষ বন্যা পরিস্থিতি ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আরও খারাপ আকার ধারণ করেছিল। এর মধ্যে রয়েছে টাইফুন ‘কোটো’ যা ফিলিপাইনে তীব্র আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের সৃষ্টি করে। ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’ ইন্দোনেশিয়ার উত্তর সুমাত্রায় মারাত্মকভাবে আঘাত হানে। আর ঘূর্ণিঝড় ‘ডিটওয়া’ শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়।
অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির এনভায়রনমেন্টাল জিওগ্রাফি বিভাগের অস্থায়ী অধ্যাপক স্টিভ টারটন বলেছেন, এই অঞ্চলে সাধারণ যে চিত্রটি দেখা গেছে, প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টির পানি মোকাবিলা করতে গিয়ে জনগোষ্ঠীগুলো হিমশিম খাচ্ছিল। এই বৃষ্টিপাত ভূমিধসসহ আরও নানা সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
টারটন বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে যেখানে এ ধরনের ক্রান্তীয় ঝড়প্রবণ আবহাওয়া রয়েছে, সেগুলোকে আপনি টাইফুন, হারিকেন বা ঘূর্ণিঝড় যা-ই বলুন না কেন, এগুলো আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। আর এটা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।’
টারটন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’ ও ‘ডিটওয়া’ এবং টাইফুন ‘কোটো’ বাতাসের গতির কারণে তীব্র ঝড় হিসেবে শ্রেণিভুক্ত না হলেও এগুলো অনেক বেশি বৃষ্টি ঝরিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘বায়ুম-লের উষ্ণতা ও সাগরের উষ্ণতা এ ধরনের বৃষ্টি ঝরানো ঝড়কে আরও শক্তিশালী করছে।’ ভারতের ট্রপিক্যাল মেটিওরোলজি ইনস্টিটিউটের জলবায়ুবিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথিউ কোল এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘তুলনামূলক উষ্ণ মহাসাগর ঘূর্ণিঝড়ের চারপাশে শক্তিশালী বৃষ্টিবলয় তৈরি করে। আর তুলনামূলক উষ্ণ বায়ুম-ল বেশি আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং তা আরও তীব্রভাবে ঝরায়।’
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘লা নিনা’ নামের একটি স্বাভাবিক আবহাওয়া চক্র। এই চক্রে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাংশ স্বাভাবিকের চেয়ে ঠান্ডা আর পশ্চিমাংশ উষ্ণ থাকে। এর ফলে বাতাস শক্তিশালী হয়ে এশিয়ার দিকে আরও বেশি উষ্ণ পানি ও আর্দ্রতা ঠেলে দেয়। কোল বলেন, ‘এই ধরনটি এশিয়ার বায়ুম-লে অতিরিক্ত আর্দ্রতা সঞ্চার করে, যা ভারী বৃষ্টি ও প্রবল বন্যার ঝুঁকি বাড়ায়।’
বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির প্রভাবটি ভালোভাবে বোঝা গেলেও টারটন উল্লেখ করেছেন, গত সপ্তাহের ঘূর্ণিঝড়গুলোর অন্যান্য অস্বাভাবিক দিকগুলো— যেমন, ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’ ও টাইফুন ‘কোটো’ কীভাবে একে অপর থেকে শক্তি সঞ্চার করল, সেই বিষয়ে আরও সুনির্দিষ্ট গবেষণার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
গ্রান্থাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট সম্প্রতি ইম্পিরিয়াল কলেজ স্টর্ম মডেল (আইআরআইএস) ব্যবহার করে এ ধরনের এক গবেষণায় ইতিমধ্যে খুঁজে পেয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে টাইফুন ‘ফাং-ওং’-এর কেন্দ্র ঘিরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১০ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই টাইফুনটি গত মাসে ফিলিপাইনে আঘাত হেনেছিল।
মোকাবিলায় করণীয় কী: সোমবার উত্তর সুমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের সময় ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এমন এক সমস্যা, যা ইন্দোনেশীয়দের মোকাবিলা করতেই হবে। তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক প্রশাসনগুলোকেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’ গ্লোবাল ক্লাইমেট অ্যান্ড হেলথ অ্যালায়েন্সের প্রচার-প্রধান শ্বেতা নারায়ণ বলেন, সরকার ও শহর কর্তৃপক্ষগুলো চরমভাবাপন্ন এসব আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর পরিণতি সামলানোর ক্ষেত্রে প্রস্তুতি নিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাস্তবতার সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের ইচ্ছাকৃত অবহেলার বিশাল ফারাক রয়েছে। আর এর মূল্য চুকাচ্ছে সাধারণ মানুষ।’
সতত সম্পদ ক্লাইমেট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা হরজিৎ সিং বলেন, একেকটি দুর্যোগের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক এখন স্পষ্ট। এখন এটি মোকাবিলার দিকে এগোনোর সময়। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ এখন এক ধরনের তথ্য-উপাত্তই বলা চলে। এখন এসব তথ্য-প্রমাণ (যারা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, তাদের) জবাবদিহি নিশ্চিতে কাজে লাগানো উচিত।’
জলবায়ু অধিকারকর্মী হরজিৎ সিং বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন দুর্যোগের মাত্রা ও দুর্যোগের আঘাত হানার পরিমাণ যে বাড়াচ্ছে, এটা বোঝার জন্য প্রতিটি ঘটনা নিয়ে আলাদা গবেষণার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেসব দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে ধনী হয়েছে, তাদের আইনি ও নৈতিক দায়িত্ব হলো এখনই অনুদানভিত্তিক অর্থসহায়তা দেওয়া, যাতে আক্রান্ত দেশগুলো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে।’
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ ৩০) শেষ হওয়ার এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে সর্বশেষ ঝড়গুলো আঘাত হেনেছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর দাবি অনুযায়ী ওই সম্মেলনে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া যায়নি।
হরজিৎ সিং বলেন, ‘তাদের দাবির মধ্যে ছিল অনুদানভিত্তিক অর্থসহায়তা, ঋণ নয়। কারণ, ঋণ তাদের দেনা আরও বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার জরুরিভিত্তিতে কমানোর সিদ্ধান্তও চেয়েছিল তারা।’
চলতি বছরের শুরুর দিকে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) এক রায়ে বলেছে, গ্যাস নির্গমন হ্রাসে সহযোগিতা, বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি অনুসরণ এবং দুর্বল জনগোষ্ঠী ও বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতি থেকে রক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ‘অস্তিত্বের সংকট’ মোকাবিলায় জরুরিভিত্তিতে কাজ করতে হবে।
ভানুয়াতুর নেতৃত্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর আনা একটি মামলার প্রেক্ষাপটে আইসিজের সভাপতি ইউজি ইওয়াসাওয়া বলেন, ‘জলবায়ু ব্যবস্থা সুরক্ষায় উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে কোনো রাষ্ট্রের ব্যর্থতা... আন্তর্জাতিকভাবে একটি অপরাধমূলক কাজ হিসাবে গণ্য হতে পারে।’ সোমবার ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি) দুর্যোগকবলিত মানুষের সুরক্ষায় ‘জরুরিভিত্তিতে আরও শক্তিশালী আইনি ও নীতি কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার’ বিষয়টি তুলে ধরেছে।
আইএফআরসির এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক আলেক্সান্ডার ম্যাথিউ বলেন, ‘এই বন্যাগুলো স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগগুলো নতুন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠছে এবং অভিঘাত মোকাবিলা ও প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অপরিহার্য।’