জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সব সংস্কার শেষে নির্বাচন দেয়া উচিত বলে মনে করছেন জাতীয় সংলাপে অংশ নেয়া আলোচকদের অনেকে। তারা বলছেন, এজন্য রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন। তাদের মধ্যে একজন বলেছেন, যে এই সরকারের আমলে সংস্কার না হলে কোনো সরকারের আমলেই তা হবে না।
সংলাপে অংশ নিয়ে অনেকে দ্রুত নির্বাচন দেয়ার কথাও বলেছেন। তাদের মতে, সংলাপের পরিসর বাড়ানো হলে ‘বড় বিপদ’ হতে পারে। তাদের একজন বলেছেন, নির্বাচন ঝুলে গেলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ আরও দৃশ্যমান হবে।
সংস্কারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একা কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না জানিয়ে এই সরকারের একজন প্রতিনিধি বলেছেন, কতটা সংস্কার করা সম্ভব এবং কোনটা স্বল্পমেয়াদি আর কোনটা দীর্ঘ সময়ের জন্য সব কিছুই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ঐক্য দিয়ে কী করবেন- এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা না যায়, তাহলে এ সংস্কার ক্ষমতার পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না।
‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ বিষয়ে জাতীয় সংলাপের সমাপনী দিন শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) আলোচকদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে এসেছে। ঢাকার ফার্মগেটের খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ দুই দিনব্যাপী এই সংলাপের আয়োজন করে।
*এই আমলে না হলে*
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ এগিয়ে নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এখন সংস্কার সম্ভব না হলে কখনোই হবে না। সংবিধানের দোহাই দিয়ে এটা করতে না পারলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা হবে।’
এই উপদেষ্টা বলেন, ‘জনগণের প্রতিনিধিত্ব তৈরিতে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট হলে ভালো গাইডলাইন তৈরি করা সম্ভব।’
রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট (রাজনৈতিক দল আইন) তৈরি করতে হবে। কোনো অযুহাতেই তাদের চাঁদাবাজি মেনে নেয়া যাবে না। তাই পলিটিক্যাল পার্টিগুলোতেও সংস্কার করা জরুরি।’
*সম্মিলিত প্রয়াস*
সংলাপে সবার শেষে বক্তৃতায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘প্রশ্ন উঠেছে, দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন; নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, গুম হয়েছেন কিংবা যারা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগ ধরে রাখতে পারব তো?’
এই আত্মত্যাগ এই বিজয় ধরে রাখতে সবার সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের লক্ষ্যে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাতে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে সংলাপে অনেকে মন্তব্য করেন। নজরুল ইসলাম খান মনে করেন, ঐক্যে ফাটল ধরার কথাটি সঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে নানা বিষয়ে। এটি গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্যই দরকার।’
প্রশাসনের কর্মকর্তারা নানা দাবিদাওয়া নিয়ে সারাদেশে ‘হুলুস্থুল’ পরিস্থিতি তৈরি করেছেন উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, এখন অভিযোগের সময় নয়। এখন সময় সহযোগিতা করার। কোনো রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন একা সব করে ফেলতে পারবে না। পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে।
*বড় বিপদ*
গণফোরামের কো-চেয়ারম্যান সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংস্কারের ক্যানভাস বড় করে বড় বিপদ ডেকে আনা হবে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তারা অক্টোবরের মধ্যে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করবে, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেবে। তাহলে নির্বাচন আর দেরি করবেন কেন? নির্বাচন যত ঝুলিয়ে দেবেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ আরও বেশি দৃশ্যমান হবে।
নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে এখন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ করা যেতে পারে। দেশের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ঘোচাতে আইনি ও সামাজিক কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
*দল নিষিদ্ধ*
গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ থেমে যাওয়ার প্রসঙ্গে সংলাপে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে কোনো ‘রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার আইন হয়নি’।
তিনি বলেন, ‘তাছাড়া দল নিষিদ্ধ করার অন্যান্য আইনে অনেক বিধান রয়েছে; সন্ত্রাস দমন আইনে রয়েছে, নির্বাচনে আইনে রয়েছে, এমনকি স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টের মাধ্যমে করা সম্ভব। করতে চাইলে তো অনলাইনেই করা সম্ভব। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য যে আইন রয়েছে সেখানে নতুন করে এটা আনার দরকার নাই। তাই মতামতের ভিত্তিতে এটা বাদ দেয়া হয়েছে।’
*একা সিদ্ধান্ত নয়*
সংস্কারের বিষয়ে সরকার একা কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘কমিশন থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর সব রাজনৈতিক দল এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৃহত্তর পরিসরে আলোচনার পরিকল্পনা করছে সরকার। যা জানুয়ারিতে হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সংস্কারের বিষয়ে সরকার একা কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।’
তিনি বলেন, ‘কতটা সংস্কার করা সম্ভব এবং কোনটা স্বল্পমেয়াদি আর কোনটা দীর্ঘ সময়ের জন্য সব কিছুই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। এরপর জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে পরিষ্কার হবে যে আমাদের অগ্রাধিকারমূলক সংস্কারগুলো কী এবং আমরা কী করতে সক্ষম হবো।’
মাহফুজ বলেন, ‘রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ঐক্য দিয়ে কী করবেন। রাষ্ট্র প্রধানত তার প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। আমরা ৭২-এর সংবিধানের সমালোচনা করছি। কারণ এর দ্বারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা না যায়, তাহলে এ সংস্কার ক্ষমতার পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের পর আমরা দেশকে সংস্কার ও প্রতিষ্ঠা করতে বড় একটা সুযোগ পেয়েছি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা যদি রাষ্ট্রের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হই, তাহলে সব কিছু ভেস্তে যাবে।’
*দেশের স্বার্থ*
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেই জনমানুষের স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। তাই দেশের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়ে কাজ করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ঠিক না হলে শুধু এই অঞ্চল নয়, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে। সবার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
*বিচার*
অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমদের প্রায়রিটি হচ্ছে অপরাধগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিচার করা। সেটি আমরা আগামী এক বছরের মধ্যে শেষ করতে পারব বলে আশা করি।’
*ঐক্যে ফাটল*
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যে ঐক্য নিয়ে আমরা রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হয়েছিলাম সেই ঐক্যতে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, সেই ফাটলটাই প্রথম চ্যালেঞ্জ।’
বিগত ১৬ বছরে সংগঠিত অপরাধগুলোর ‘অগণিত সাক্ষী’ পাওয়া গেছে বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্বচ্ছ কাচের মতো সাক্ষী পেয়েছি। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন সে বিষয়টি আপনাদের সামনে আনা উচিত না বলে বলছি না। আমরা প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছি না, আমরা বিচার করতে চাচ্ছি। এর মাধ্যমে আমরা আগামী প্রজন্মকে ইতিহাসের দায় থেকে মুক্ত করতে চাচ্ছি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সংঘটিত ৩০ হাজার জাসদ নেতাকর্মীর হত্যাকা-গুলোর যদি বিচার হত তাহলে ১৬ বছরে গুম-খুন হয়তো বন্ধ হতে পারত।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. মাহাদী আমিন, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের দিদারুল ইসলাম, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটির চেয়ারপারসন রোকসানা খন্দকার, মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান, অ্যাডভোকেট দিলরুবা শারমিন, গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ।
জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দিয়ে বক্তারা তাদের বক্তব্যে ডিজিএফআই, র্যাব ও ডিবি বিলুপ্ত করার দাবি জানান।
শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সব সংস্কার শেষে নির্বাচন দেয়া উচিত বলে মনে করছেন জাতীয় সংলাপে অংশ নেয়া আলোচকদের অনেকে। তারা বলছেন, এজন্য রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন। তাদের মধ্যে একজন বলেছেন, যে এই সরকারের আমলে সংস্কার না হলে কোনো সরকারের আমলেই তা হবে না।
সংলাপে অংশ নিয়ে অনেকে দ্রুত নির্বাচন দেয়ার কথাও বলেছেন। তাদের মতে, সংলাপের পরিসর বাড়ানো হলে ‘বড় বিপদ’ হতে পারে। তাদের একজন বলেছেন, নির্বাচন ঝুলে গেলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ আরও দৃশ্যমান হবে।
সংস্কারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একা কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না জানিয়ে এই সরকারের একজন প্রতিনিধি বলেছেন, কতটা সংস্কার করা সম্ভব এবং কোনটা স্বল্পমেয়াদি আর কোনটা দীর্ঘ সময়ের জন্য সব কিছুই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ঐক্য দিয়ে কী করবেন- এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা না যায়, তাহলে এ সংস্কার ক্ষমতার পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না।
‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ বিষয়ে জাতীয় সংলাপের সমাপনী দিন শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) আলোচকদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে এসেছে। ঢাকার ফার্মগেটের খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ দুই দিনব্যাপী এই সংলাপের আয়োজন করে।
*এই আমলে না হলে*
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ এগিয়ে নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এখন সংস্কার সম্ভব না হলে কখনোই হবে না। সংবিধানের দোহাই দিয়ে এটা করতে না পারলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা হবে।’
এই উপদেষ্টা বলেন, ‘জনগণের প্রতিনিধিত্ব তৈরিতে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট হলে ভালো গাইডলাইন তৈরি করা সম্ভব।’
রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট (রাজনৈতিক দল আইন) তৈরি করতে হবে। কোনো অযুহাতেই তাদের চাঁদাবাজি মেনে নেয়া যাবে না। তাই পলিটিক্যাল পার্টিগুলোতেও সংস্কার করা জরুরি।’
*সম্মিলিত প্রয়াস*
সংলাপে সবার শেষে বক্তৃতায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘প্রশ্ন উঠেছে, দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন; নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, গুম হয়েছেন কিংবা যারা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগ ধরে রাখতে পারব তো?’
এই আত্মত্যাগ এই বিজয় ধরে রাখতে সবার সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের লক্ষ্যে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাতে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে সংলাপে অনেকে মন্তব্য করেন। নজরুল ইসলাম খান মনে করেন, ঐক্যে ফাটল ধরার কথাটি সঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে নানা বিষয়ে। এটি গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্যই দরকার।’
প্রশাসনের কর্মকর্তারা নানা দাবিদাওয়া নিয়ে সারাদেশে ‘হুলুস্থুল’ পরিস্থিতি তৈরি করেছেন উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, এখন অভিযোগের সময় নয়। এখন সময় সহযোগিতা করার। কোনো রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন একা সব করে ফেলতে পারবে না। পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে।
*বড় বিপদ*
গণফোরামের কো-চেয়ারম্যান সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংস্কারের ক্যানভাস বড় করে বড় বিপদ ডেকে আনা হবে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তারা অক্টোবরের মধ্যে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করবে, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেবে। তাহলে নির্বাচন আর দেরি করবেন কেন? নির্বাচন যত ঝুলিয়ে দেবেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ আরও বেশি দৃশ্যমান হবে।
নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে এখন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ করা যেতে পারে। দেশের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ঘোচাতে আইনি ও সামাজিক কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
*দল নিষিদ্ধ*
গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ থেমে যাওয়ার প্রসঙ্গে সংলাপে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে কোনো ‘রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার আইন হয়নি’।
তিনি বলেন, ‘তাছাড়া দল নিষিদ্ধ করার অন্যান্য আইনে অনেক বিধান রয়েছে; সন্ত্রাস দমন আইনে রয়েছে, নির্বাচনে আইনে রয়েছে, এমনকি স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টের মাধ্যমে করা সম্ভব। করতে চাইলে তো অনলাইনেই করা সম্ভব। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য যে আইন রয়েছে সেখানে নতুন করে এটা আনার দরকার নাই। তাই মতামতের ভিত্তিতে এটা বাদ দেয়া হয়েছে।’
*একা সিদ্ধান্ত নয়*
সংস্কারের বিষয়ে সরকার একা কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘কমিশন থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর সব রাজনৈতিক দল এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৃহত্তর পরিসরে আলোচনার পরিকল্পনা করছে সরকার। যা জানুয়ারিতে হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সংস্কারের বিষয়ে সরকার একা কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।’
তিনি বলেন, ‘কতটা সংস্কার করা সম্ভব এবং কোনটা স্বল্পমেয়াদি আর কোনটা দীর্ঘ সময়ের জন্য সব কিছুই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। এরপর জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে পরিষ্কার হবে যে আমাদের অগ্রাধিকারমূলক সংস্কারগুলো কী এবং আমরা কী করতে সক্ষম হবো।’
মাহফুজ বলেন, ‘রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ঐক্য দিয়ে কী করবেন। রাষ্ট্র প্রধানত তার প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। আমরা ৭২-এর সংবিধানের সমালোচনা করছি। কারণ এর দ্বারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা না যায়, তাহলে এ সংস্কার ক্ষমতার পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের পর আমরা দেশকে সংস্কার ও প্রতিষ্ঠা করতে বড় একটা সুযোগ পেয়েছি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা যদি রাষ্ট্রের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হই, তাহলে সব কিছু ভেস্তে যাবে।’
*দেশের স্বার্থ*
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেই জনমানুষের স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। তাই দেশের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়ে কাজ করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ঠিক না হলে শুধু এই অঞ্চল নয়, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে। সবার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
*বিচার*
অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমদের প্রায়রিটি হচ্ছে অপরাধগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিচার করা। সেটি আমরা আগামী এক বছরের মধ্যে শেষ করতে পারব বলে আশা করি।’
*ঐক্যে ফাটল*
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যে ঐক্য নিয়ে আমরা রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হয়েছিলাম সেই ঐক্যতে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, সেই ফাটলটাই প্রথম চ্যালেঞ্জ।’
বিগত ১৬ বছরে সংগঠিত অপরাধগুলোর ‘অগণিত সাক্ষী’ পাওয়া গেছে বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্বচ্ছ কাচের মতো সাক্ষী পেয়েছি। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন সে বিষয়টি আপনাদের সামনে আনা উচিত না বলে বলছি না। আমরা প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছি না, আমরা বিচার করতে চাচ্ছি। এর মাধ্যমে আমরা আগামী প্রজন্মকে ইতিহাসের দায় থেকে মুক্ত করতে চাচ্ছি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সংঘটিত ৩০ হাজার জাসদ নেতাকর্মীর হত্যাকা-গুলোর যদি বিচার হত তাহলে ১৬ বছরে গুম-খুন হয়তো বন্ধ হতে পারত।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. মাহাদী আমিন, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের দিদারুল ইসলাম, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটির চেয়ারপারসন রোকসানা খন্দকার, মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান, অ্যাডভোকেট দিলরুবা শারমিন, গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ।
জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দিয়ে বক্তারা তাদের বক্তব্যে ডিজিএফআই, র্যাব ও ডিবি বিলুপ্ত করার দাবি জানান।