রেলওয়ের রানিং স্টাফ ও কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ডাকা ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে মঙ্গলবার ২৮শে জানুয়ারি গভীর রাতে। এরপর ২৯শে জানুয়ারি বুধবার সকাল থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও সিডিউলে বিপর্যয় ঘটেছে। এতেও বুধবার ও যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। রানিং স্টাফদের প্রায় ৩০ ঘণ্টার ধর্মঘটে ট্রেন বন্ধের কারণে এক দিনে ক্ষতি সোয়া কোটি টাকা হয়েছে বলে কমলাপুর রেল স্টেশনের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন।
অন্যদিকে বুধবার সরকারের অর্থ বিভাগ থেকে রেলের রানিং স্টাফদের অ্যালাউন্স সুবিধা বহাল রেখে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, রানিং স্টাফ হিসেবে চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভ্রমণ ভাতা বা দৈনিক ভাতার পরিবর্তে রেলওয়ের এস্টাবলিশমেন্ট কোর্ডের বিধান অনুযায়ী রানিং অ্যালাউন্স প্রাপ্য হবেন। চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের জন্য রানিং অ্যালাউন্স ছাড়া অন্য কোনো ভাতা প্রাপ্য হবেন না।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, মঙ্গলবার দিনভর আলোচনার পরও কোনো সমাধানে পৌঁছতে না পারায় মধ্যরাতে যোগাযোগ ও রেল উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের বাসায় বৈঠকের পর চলমান কর্মবিরতি বা ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়। রাত ৩টার দিরে ট্রেন চলাচল শুরুর ঘোষণা দেন রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান।
এরপর ৩০ ঘণ্টা পর বুধবার সকাল থেকে ফের ট্রেন চলাচল শুরু হয়। তখন ট্রেনের সূচিতে বিপর্যয় দেখা দেয়। কোনো ট্রেন নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে যেতে পারেনি। কমলাপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্টেশনের গার্ড, লোকমাস্টার, সহকারী লোকমাস্টার, টিটি ও রেলের রানিং স্টাফরা ট্রেন চলাচলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সারাদেশে রেলওয়ের ১৭শ’র বেশি রানিং স্টাফ কাজ করছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, দৈনিক কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা হলেও রানিং স্টাফদের গড়ে দিনে ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সে জন্য তাদের আগে দেয়া হত বিশেষ আর্থিক সুবিধা, যাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয়, মাইলেজ। মাইলেজ রানিং স্টাফদের বেতনেরই অংশ। প্রতি ১শ’ কিলোমিটার ট্রেন চললে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক দিনের বেসিকের সমপরিমান টাকা অতিরিক্ত পেত। ৮ ঘণ্টা এক দিনের কর্মদিবস ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ হয় আড়াই থেকে তিন মাসের সমপরিমান। তাদের বেতনও সেই ভাবে দেয়া হত।
এ ছাড়াও মূল বেতনের হিসেবে অবসর কালিন ভাতা যা হয়, তার সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ৭৫ শতাংশ টাকা বেশি দিয়ে তাদের পেনশন দেয়া হত। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে রানিং স্টাফদের সেই সুবিধা বাতিল করা হয়। এরপর থেকে রেলওয়ের রানিং ষ্টাফরা আন্দোলন করে আসছিল। অবশেষে সোমবার রাত ১২টার পর থেকে তারা আবার ধর্মঘটে যান।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, রানিং ষ্টাফদের কর্মবিরতির প্রত্যাহারের পর সারাদেশের ট্রেন চলচল শুরু হলেও বিপর্যয় দেখা দেয়। ঢাকায় কোচ না থাকায় সিলেট রুটের জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুড়িমারী রুটের বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রা বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ।
সরজমিনে বুধবার ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল ১০টা পর্যন্ত জয়দেবপুর কমিউটার, রাজশাহী রুটের দূমকেতু এক্সপ্রেস, সোনারবাংলা এক্সপ্রেস, কক্সবাজারগামী পর্যটন এক্সপ্রেস, তিস্তা এক্সপ্রেসসহ ১০টি ট্রেন ছেড়ে গেলেও প্রতিটি ট্রেন ছেড়েছে নির্ধারিত সময়ের একঘণ্টা পর। সবচেয়ে বেশি বিলম্ব হয়েছে পারাবত এক্সপ্রেস।
কমলাপুর থেকে সকাল সাড়ে ৬টার পারাবত এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা থাকলেও তা ১০টা পর্যন্ত ছাড়া সম্ভব হয়নি।
সকাল সোয়া ৮টার মহুয়া কমিউটার, সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে চট্রগ্রাম রুটের কর্ণফুলী কমিউটার, সকাল ৯টা ১০ মিনিটের রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। তবে সিডিউল বিপর্যয়ের কারনে ১০টা পর্যন্ত ট্রেনগুলো ছাড়তে পারেনি। তখন বহুযাত্রী প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিল।
সিলেটগামী পারাবাত এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী রাবেয়া বেগম উপস্থিত সাংবাদিকদেরকে জানান, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ট্রেন ছিল। দেরি হবে জেনে সকাল ৮টায় তিনি স্টেশেনে পৌঁছান। স্টেশনে গিয়ে জানতে পারেন ট্রেন সকাল ১০টার পরে ছাড়বে।
পারাবত এক্সপ্রেসের আরেকজন যাত্রী জানিয়েছেন, ভোরে জানতে পেরেছি কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরপর ভোর ৫টার দিকে ওই যাত্রী স্টেশনে যান। ট্রেন ছাড়েনি। এরপর অপেক্ষার পালা শুরু হয়।
কমলাপুর স্টেশনের ম্যানেজার শাহাদাত হোসেন সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন, ট্রেনগুলো নির্ধারিত সময়ে ছাড়ার চেষ্টা করেছেন। তবে প্রস্তুতি নিতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। ট্রেনের ইঞ্জিন চালু করা, কোচগুলো পরিষ্কার করে রেডি করতে সময় লাগছে। এই সব কারণে ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব হয়েছে।
এ ছাড়াও গভীরাতে ট্রেন চলাচল শুরুর বিষয় অনেকেই জানতো না। টিকিট কাটা যাত্রীদের অন্তত মোবাইল ফোনে ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানানোর ব্যবস্থা করলে ভালো হতো বলে অনেকেই মন্তব্য করেন।
চট্রগ্রাম রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, ট্রেন চালানোর জন্য আগে থেকে যে কিছু আউটসাইড কাজ করতে হয়। কর্মবিরতির কারণে কোনো কাজই হয়নি। মধ্যরাতে ধর্মঘট প্রত্যাহার হওয়ার পর ভোর থেকে কাজ শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।
এ দিকে কমলাপুর স্টেশনের ব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন বুধবার সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন, রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে প্রায় ৩০ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় কমলাপুর স্টেশনে প্রায় সোয়া কোটি টাকার মতো আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
তার মতে কমলাপুর স্টেশন থেকে টিকিট বিক্রি থেকে দিনে ১ কোটি ১৫ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা আয় হয়। ধর্মঘটের কারণে সব ট্রেন বন্ধ থাকায় টিকিটের টাকাও যাত্রীদের ফেরত দিতে হয়েছে। ফলে রেল কর্তৃপক্ষের ওই টাকা ক্ষতি হয়েছে। কমলাপুর থেকে প্রতিদিন ৪২ জোড়া আন্তঃনগর এবং ২৫ জোড়া লোকাল, মেইল, কমিউটার ট্রেন চলাচল করে।
যে ভাবে ধর্মঘট প্রত্যাহার : মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় বৈঠক করার পরও আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার অনড় ছিলেন। যার কারণে কোনো সমাধান হয়নি। শেষপর্যন্ত গভীর রাতে (আড়াইটা থেকে ৩টা) রাজধানীর মিন্টু রোডে রেল উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের বাসায় বৈঠকের পর দাবি পূরণের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করলে ট্রেন চলাচল শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়।
সেখানে রেলওয়ের রানিং স্টাফ ও শ্রমিককর্মচারী নেতা মজিবুর রহমান এই ঘোষণা দেন। গভীর রাতের ওই বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতাও অংশ নিয়েছেন।
উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজল কবির খান সাংবাদিকদেরকে বলেছেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। আমি তাদের দাবি পূরণে সক্ষম হব। বিদ্যমান সুবিধা বহাল থাকবে। আগে থেকে যে সব সুবিধা চলে আসছে তা পরিবর্তন হবে না।
এ দিকে বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, রেলওয়ের রাজস্ব খাতভূক্ত গার্ড গ্রেড-২ সহকারী লোকোমোটিভ মাস্টার গ্রেড-২ পদের মাইলেজ বৈষম্য নিরসন ও নিয়োগপত্রের ১২ এর (ক) ও (খ) পর্যন্ত শর্ত বাতিলের বিষয় মতামত এবং রেলওয়ে কর্মরত রানিং স্টাফদের রানিং ভাতা এবং পেনশন ও আনুতোষিক এর প্রাপ্যতা প্রসঙ্গে বলেছেন, অর্থবিভাগ কর্তৃক ২১-৮-২০২২ তারিখের জারিকৃত পত্রের অনুচ্ছেদটি এবং অর্থ বিভাগের ২৩-১-২০২৫ জারিকৃত পত্রে রানিং অ্যালাউন্স প্রাপ্যতার বিষয় সংশোধন করা হলো।
এতে বলা হয়েছে, রানিং স্টাফে চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভ্রমণ ভাতা বা দৈনিক ভাতার পরিবর্তে রেলওয়ের এ্যাস্টাবলিশমেন্ট কোর্ড এর বিধান অনুযায়ী রানিং অ্যালাউন্স প্রাপ্য হবেন। চলস্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের জন্য রানিং অ্যালাউন্স ছাড়া অন্য কোনো ভাতা প্রাপ্য হবেন না। অর্থবিভাগের উপসচিব সৈয়দ আলী বিন হাসান ওই প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেছেন।
অপরাধ বিষয়ক আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী বলেন, যাত্রীদের জিম্মি করে আন্দোলন অমানবিক। এই ধরনের আন্দোলনকারিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষের যাত্রী হয়রানীর জন্য ক্ষতিপূরণ বা জরিমানা দেয়া উচিত বলে তিনি জানান।
রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার, সূচি এলোমেলো
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান, রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর চট্টগ্রামে ট্রেন ছাড়ার ও গন্তব্যে পৌঁছার নির্ধারিত সূচি এলোমেলো হয়েছে। বুধবার ভোর থেকে চট্টগ্রাম থেকে প্রায় সব ট্রেনই বিলম্বে স্টেশন ত্যাগ করেছে। ট্রেনগুলো ছাড়তে আধা ঘণ্টা থেকে দুই-তিন ঘণ্টা বিলম্ব হয়।
মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক দেয়াসহ কয়েক দফা দাবিতে সোমবার রাত ১২টা থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করে রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। এর ফলে সারা দেশে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দিনভর বন্ধ থাকার পর মধ্যরাতে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেন রানিং স্টাফরা।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তথ্য অনুযায়ী, কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে সকাল ৬টার ঢাকাগামী চট্টলা এক্সপ্রেস সকাল ৮টা ১০ মিনিটে ছেড়ে যায়। ঢাকামুখী সুবর্ণ এক্সপ্রেস সাড়ে ৭টার বদলে সাড়ে ৮টায় ছাড়ে। সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে চট্টগ্রাম ত্যাগের কথা ছিল। সেটি ৮টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে যায়। সকাল ৮টার চাঁদপুরগামী সাগরিকা এক্সপ্রেস গেছে ৯টা ৩৫ মিনিটে।
এ ছাড়া জামালপুরগামী বিজয় এক্সপ্রেস সকাল ৯টায় ছাড়ার সূচি থাকলে সেটি সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম স্টেশন ত্যাগ করেছে। সকাল ৭টার কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন ১০টা ০৫ মিনিটে ছেড়ে যায়। তবে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকাগামী মহানগর এক্সপ্রেস নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী ছেড়ে গেছে। এর আগে, সকাল সাড়ে ৭টায় ও ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী দুটি শাটল ট্রেন রেলস্টেশন ছেড়ে যায়। কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে প্রথম ট্রেন আসে চাঁদপুর থেকে মেঘনা এক্সপ্রেস ভোর সাড়ে ৫টায়।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম রেলস্টেশন ছেড়ে যাওয়া লোকাল ট্রেনগুলো ছাড়তেও আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছে। দুপুরে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, কর্মবিরতির কারণে আউটসাইড ওয়ার্ক বন্ধ থাকায় সকালের দিকে শিডিউলে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫
রেলওয়ের রানিং স্টাফ ও কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ডাকা ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে মঙ্গলবার ২৮শে জানুয়ারি গভীর রাতে। এরপর ২৯শে জানুয়ারি বুধবার সকাল থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও সিডিউলে বিপর্যয় ঘটেছে। এতেও বুধবার ও যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। রানিং স্টাফদের প্রায় ৩০ ঘণ্টার ধর্মঘটে ট্রেন বন্ধের কারণে এক দিনে ক্ষতি সোয়া কোটি টাকা হয়েছে বলে কমলাপুর রেল স্টেশনের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন।
অন্যদিকে বুধবার সরকারের অর্থ বিভাগ থেকে রেলের রানিং স্টাফদের অ্যালাউন্স সুবিধা বহাল রেখে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, রানিং স্টাফ হিসেবে চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভ্রমণ ভাতা বা দৈনিক ভাতার পরিবর্তে রেলওয়ের এস্টাবলিশমেন্ট কোর্ডের বিধান অনুযায়ী রানিং অ্যালাউন্স প্রাপ্য হবেন। চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের জন্য রানিং অ্যালাউন্স ছাড়া অন্য কোনো ভাতা প্রাপ্য হবেন না।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, মঙ্গলবার দিনভর আলোচনার পরও কোনো সমাধানে পৌঁছতে না পারায় মধ্যরাতে যোগাযোগ ও রেল উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের বাসায় বৈঠকের পর চলমান কর্মবিরতি বা ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়। রাত ৩টার দিরে ট্রেন চলাচল শুরুর ঘোষণা দেন রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান।
এরপর ৩০ ঘণ্টা পর বুধবার সকাল থেকে ফের ট্রেন চলাচল শুরু হয়। তখন ট্রেনের সূচিতে বিপর্যয় দেখা দেয়। কোনো ট্রেন নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে যেতে পারেনি। কমলাপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্টেশনের গার্ড, লোকমাস্টার, সহকারী লোকমাস্টার, টিটি ও রেলের রানিং স্টাফরা ট্রেন চলাচলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সারাদেশে রেলওয়ের ১৭শ’র বেশি রানিং স্টাফ কাজ করছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, দৈনিক কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা হলেও রানিং স্টাফদের গড়ে দিনে ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সে জন্য তাদের আগে দেয়া হত বিশেষ আর্থিক সুবিধা, যাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয়, মাইলেজ। মাইলেজ রানিং স্টাফদের বেতনেরই অংশ। প্রতি ১শ’ কিলোমিটার ট্রেন চললে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক দিনের বেসিকের সমপরিমান টাকা অতিরিক্ত পেত। ৮ ঘণ্টা এক দিনের কর্মদিবস ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ হয় আড়াই থেকে তিন মাসের সমপরিমান। তাদের বেতনও সেই ভাবে দেয়া হত।
এ ছাড়াও মূল বেতনের হিসেবে অবসর কালিন ভাতা যা হয়, তার সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ৭৫ শতাংশ টাকা বেশি দিয়ে তাদের পেনশন দেয়া হত। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে রানিং স্টাফদের সেই সুবিধা বাতিল করা হয়। এরপর থেকে রেলওয়ের রানিং ষ্টাফরা আন্দোলন করে আসছিল। অবশেষে সোমবার রাত ১২টার পর থেকে তারা আবার ধর্মঘটে যান।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, রানিং ষ্টাফদের কর্মবিরতির প্রত্যাহারের পর সারাদেশের ট্রেন চলচল শুরু হলেও বিপর্যয় দেখা দেয়। ঢাকায় কোচ না থাকায় সিলেট রুটের জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুড়িমারী রুটের বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রা বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ।
সরজমিনে বুধবার ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল ১০টা পর্যন্ত জয়দেবপুর কমিউটার, রাজশাহী রুটের দূমকেতু এক্সপ্রেস, সোনারবাংলা এক্সপ্রেস, কক্সবাজারগামী পর্যটন এক্সপ্রেস, তিস্তা এক্সপ্রেসসহ ১০টি ট্রেন ছেড়ে গেলেও প্রতিটি ট্রেন ছেড়েছে নির্ধারিত সময়ের একঘণ্টা পর। সবচেয়ে বেশি বিলম্ব হয়েছে পারাবত এক্সপ্রেস।
কমলাপুর থেকে সকাল সাড়ে ৬টার পারাবত এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা থাকলেও তা ১০টা পর্যন্ত ছাড়া সম্ভব হয়নি।
সকাল সোয়া ৮টার মহুয়া কমিউটার, সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে চট্রগ্রাম রুটের কর্ণফুলী কমিউটার, সকাল ৯টা ১০ মিনিটের রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। তবে সিডিউল বিপর্যয়ের কারনে ১০টা পর্যন্ত ট্রেনগুলো ছাড়তে পারেনি। তখন বহুযাত্রী প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিল।
সিলেটগামী পারাবাত এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী রাবেয়া বেগম উপস্থিত সাংবাদিকদেরকে জানান, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ট্রেন ছিল। দেরি হবে জেনে সকাল ৮টায় তিনি স্টেশেনে পৌঁছান। স্টেশনে গিয়ে জানতে পারেন ট্রেন সকাল ১০টার পরে ছাড়বে।
পারাবত এক্সপ্রেসের আরেকজন যাত্রী জানিয়েছেন, ভোরে জানতে পেরেছি কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরপর ভোর ৫টার দিকে ওই যাত্রী স্টেশনে যান। ট্রেন ছাড়েনি। এরপর অপেক্ষার পালা শুরু হয়।
কমলাপুর স্টেশনের ম্যানেজার শাহাদাত হোসেন সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন, ট্রেনগুলো নির্ধারিত সময়ে ছাড়ার চেষ্টা করেছেন। তবে প্রস্তুতি নিতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। ট্রেনের ইঞ্জিন চালু করা, কোচগুলো পরিষ্কার করে রেডি করতে সময় লাগছে। এই সব কারণে ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব হয়েছে।
এ ছাড়াও গভীরাতে ট্রেন চলাচল শুরুর বিষয় অনেকেই জানতো না। টিকিট কাটা যাত্রীদের অন্তত মোবাইল ফোনে ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানানোর ব্যবস্থা করলে ভালো হতো বলে অনেকেই মন্তব্য করেন।
চট্রগ্রাম রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, ট্রেন চালানোর জন্য আগে থেকে যে কিছু আউটসাইড কাজ করতে হয়। কর্মবিরতির কারণে কোনো কাজই হয়নি। মধ্যরাতে ধর্মঘট প্রত্যাহার হওয়ার পর ভোর থেকে কাজ শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।
এ দিকে কমলাপুর স্টেশনের ব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন বুধবার সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন, রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে প্রায় ৩০ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় কমলাপুর স্টেশনে প্রায় সোয়া কোটি টাকার মতো আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
তার মতে কমলাপুর স্টেশন থেকে টিকিট বিক্রি থেকে দিনে ১ কোটি ১৫ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা আয় হয়। ধর্মঘটের কারণে সব ট্রেন বন্ধ থাকায় টিকিটের টাকাও যাত্রীদের ফেরত দিতে হয়েছে। ফলে রেল কর্তৃপক্ষের ওই টাকা ক্ষতি হয়েছে। কমলাপুর থেকে প্রতিদিন ৪২ জোড়া আন্তঃনগর এবং ২৫ জোড়া লোকাল, মেইল, কমিউটার ট্রেন চলাচল করে।
যে ভাবে ধর্মঘট প্রত্যাহার : মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় বৈঠক করার পরও আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার অনড় ছিলেন। যার কারণে কোনো সমাধান হয়নি। শেষপর্যন্ত গভীর রাতে (আড়াইটা থেকে ৩টা) রাজধানীর মিন্টু রোডে রেল উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের বাসায় বৈঠকের পর দাবি পূরণের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করলে ট্রেন চলাচল শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়।
সেখানে রেলওয়ের রানিং স্টাফ ও শ্রমিককর্মচারী নেতা মজিবুর রহমান এই ঘোষণা দেন। গভীর রাতের ওই বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতাও অংশ নিয়েছেন।
উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজল কবির খান সাংবাদিকদেরকে বলেছেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। আমি তাদের দাবি পূরণে সক্ষম হব। বিদ্যমান সুবিধা বহাল থাকবে। আগে থেকে যে সব সুবিধা চলে আসছে তা পরিবর্তন হবে না।
এ দিকে বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, রেলওয়ের রাজস্ব খাতভূক্ত গার্ড গ্রেড-২ সহকারী লোকোমোটিভ মাস্টার গ্রেড-২ পদের মাইলেজ বৈষম্য নিরসন ও নিয়োগপত্রের ১২ এর (ক) ও (খ) পর্যন্ত শর্ত বাতিলের বিষয় মতামত এবং রেলওয়ে কর্মরত রানিং স্টাফদের রানিং ভাতা এবং পেনশন ও আনুতোষিক এর প্রাপ্যতা প্রসঙ্গে বলেছেন, অর্থবিভাগ কর্তৃক ২১-৮-২০২২ তারিখের জারিকৃত পত্রের অনুচ্ছেদটি এবং অর্থ বিভাগের ২৩-১-২০২৫ জারিকৃত পত্রে রানিং অ্যালাউন্স প্রাপ্যতার বিষয় সংশোধন করা হলো।
এতে বলা হয়েছে, রানিং স্টাফে চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভ্রমণ ভাতা বা দৈনিক ভাতার পরিবর্তে রেলওয়ের এ্যাস্টাবলিশমেন্ট কোর্ড এর বিধান অনুযায়ী রানিং অ্যালাউন্স প্রাপ্য হবেন। চলস্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের জন্য রানিং অ্যালাউন্স ছাড়া অন্য কোনো ভাতা প্রাপ্য হবেন না। অর্থবিভাগের উপসচিব সৈয়দ আলী বিন হাসান ওই প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেছেন।
অপরাধ বিষয়ক আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী বলেন, যাত্রীদের জিম্মি করে আন্দোলন অমানবিক। এই ধরনের আন্দোলনকারিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষের যাত্রী হয়রানীর জন্য ক্ষতিপূরণ বা জরিমানা দেয়া উচিত বলে তিনি জানান।
রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার, সূচি এলোমেলো
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান, রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর চট্টগ্রামে ট্রেন ছাড়ার ও গন্তব্যে পৌঁছার নির্ধারিত সূচি এলোমেলো হয়েছে। বুধবার ভোর থেকে চট্টগ্রাম থেকে প্রায় সব ট্রেনই বিলম্বে স্টেশন ত্যাগ করেছে। ট্রেনগুলো ছাড়তে আধা ঘণ্টা থেকে দুই-তিন ঘণ্টা বিলম্ব হয়।
মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক দেয়াসহ কয়েক দফা দাবিতে সোমবার রাত ১২টা থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করে রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। এর ফলে সারা দেশে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দিনভর বন্ধ থাকার পর মধ্যরাতে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেন রানিং স্টাফরা।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তথ্য অনুযায়ী, কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে সকাল ৬টার ঢাকাগামী চট্টলা এক্সপ্রেস সকাল ৮টা ১০ মিনিটে ছেড়ে যায়। ঢাকামুখী সুবর্ণ এক্সপ্রেস সাড়ে ৭টার বদলে সাড়ে ৮টায় ছাড়ে। সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে চট্টগ্রাম ত্যাগের কথা ছিল। সেটি ৮টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে যায়। সকাল ৮টার চাঁদপুরগামী সাগরিকা এক্সপ্রেস গেছে ৯টা ৩৫ মিনিটে।
এ ছাড়া জামালপুরগামী বিজয় এক্সপ্রেস সকাল ৯টায় ছাড়ার সূচি থাকলে সেটি সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম স্টেশন ত্যাগ করেছে। সকাল ৭টার কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন ১০টা ০৫ মিনিটে ছেড়ে যায়। তবে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকাগামী মহানগর এক্সপ্রেস নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী ছেড়ে গেছে। এর আগে, সকাল সাড়ে ৭টায় ও ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী দুটি শাটল ট্রেন রেলস্টেশন ছেড়ে যায়। কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে প্রথম ট্রেন আসে চাঁদপুর থেকে মেঘনা এক্সপ্রেস ভোর সাড়ে ৫টায়।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম রেলস্টেশন ছেড়ে যাওয়া লোকাল ট্রেনগুলো ছাড়তেও আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছে। দুপুরে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, কর্মবিরতির কারণে আউটসাইড ওয়ার্ক বন্ধ থাকায় সকালের দিকে শিডিউলে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।