বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ‘সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের’ দাবিতে চলা আন্দোলন চলাকালে গতবছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগের বিষয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের (তথ্যানুসন্ধান দল) প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। স্বাধীন এই তদন্তের তথ্যানুসন্ধান দল ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ প্রমাণ পেয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ে সাবেক সরকার এবং তার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট সহিংস গোষ্ঠীগুলো একসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত।আন্দোলন চলাকালে ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় সরকার বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ‘প্রাণঘাতী বল প্রয়োগের’ জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে অনুমতি দিয়েছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দফতর (ওএইচসিএইচআর)২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশজুড়ে সংঘটিত ব্যাপক বিক্ষোভ এবং তার পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপব্যবহারের অভিযোগ সম্পর্কে একটি স্বাধীন ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং তদন্ত’ পরিচালনা করে।জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর তদন্ত শুরু করে এবং পাঁচ মাস পরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হলো।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) জেনেভায় প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন। এসময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ওএইচসিএইচআর-এর এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রোরি মানগোভেন। এছাড়া হাইকমিশনার অফিসের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানিও উপস্থিত ছিলেন।
তদন্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ বা এক্সিকিউটিভ সামারিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমন্ত্রণে ওএইচসিএইচআর ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশজুড়ে সংঘটিত ব্যাপক বিক্ষোভ এবং তার পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপব্যবহারের অভিযোগ সম্পর্কে একটি স্বাধীন ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং তদন্ত’ পরিচালনা করেছে। এতে সংগৃহীত সব তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খু ও স্বাধীন মূল্যায়নের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, সাবেক সরকার এবং তার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট সহিংস গোষ্ঠীগুলো সম্মিলিতভাবে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত।
এসময় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যা, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর গুরুতর আহত হওয়াসহ বলপ্রয়োগের অপব্যবহার, ব্যাপকভাবে নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক এবং নির্যাতন ও অন্যান্য ধরনের দুর্ব্যবহারসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জড়িত ছিল বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে বলে মনে করছে ওএইচসিএইচআর।
সংস্থাটি আরও বিশ্বাস করে, বিক্ষোভ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত ভিন্নমত প্রকাশ দমন করার কৌশল অনুসরণ করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নিরাপত্তা খাতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, সমন্বয় ও নির্দেশনার মাধ্যমে এই লঙ্ঘনগুলো সংঘটিত হয়েছে। এই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও উদ্বেগের বিষয়। ফলে এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ ও নির্যাতন (একটি স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ) এবং দেশীয় আইনে গুরুতর অপরাধ কিনা তা নির্ধারণের জন্য আরও ফৌজদারি তদন্ত প্রয়োজন।
যেভাবে আন্দোলনের শুরু
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের একটি রায়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত এই বিক্ষোভ শুরুর কারণ ছিল। তবে জনগণের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে আরও গভীর অসন্তোষ বিদ্যমান ছিল, যা রাজনীতি ও শাসনের ধ্বংসাত্মক ও দুর্নীতিগ্রস্ত সমস্যাগুলো থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এই সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগের ঘাটতিকে উপেক্ষা করেছে এবং প্রকৃতপক্ষে তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার বাংলাদেশি, যারা বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, পেশাগত ও ধর্মীয় পটভূমি থেকে এসেছেন, তারা অর্থপূর্ণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে এই বিক্ষোভে যোগ দেন। জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ প্রশমিত করতে এবং ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টায়,সাবেক সরকার বিক্ষোভ দমন করতে ক্রমবর্ধমান সহিংস পন্থা অবলম্বন করে এবং এটিকে পদ্ধতিগতভাবে দমন করার চেষ্টা করে।
আন্দোলনে উসকানি ও হামলা
জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে সাবেক সরকার ও আওয়ামী লীগ নিজেদের সশস্ত্র কর্মীদের সমাবেশিত করে এবং বিক্ষোভ দমনের জন্য প্রাথমিক অবস্থায় সরকারি মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ছাত্রলীগের সমর্থকদের উসকানি দেয়। তারা ভোঁতা, ধারালো অস্ত্র ও কিছু আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এবং এর আশপাশে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণকারী নারী-পুরুষের ওপর হামলা চালায়। আন্দোলনরত ছাত্ররা নিজেদের আত্মরক্ষা করলে এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার আরও গুরুতর সহিংসতার আশ্রয় নেয়। সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত একটি বড় বিক্ষোভ ও অন্যান্য স্থানে অপ্রয়োজনীয় এবং অসম শক্তি দিয়ে শান্তিপূর্ণ ছাত্র বিক্ষোভকে সহিংসভাবে দমন করে; যা ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন।
এই ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা ঢাকা ও অন্যান্য শহরগুলো সম্পূর্ণ অচল করে দেওয়ার ডাক দেয় এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জামায়াতে ইসলামী সেটিতে সমর্থন জানায়। এর প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন সরকার বিক্ষোভকারী এবং তাদের সমন্বয়কারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা আরও বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে জীবনের অধিকার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা লঙ্ঘন হয়।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও পুলিশের হেলিকপ্টার আকাশ থেকে বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। এছাড়া সামরিক রাইফেল, ধাতুর তৈরি প্রাণঘাতী ছররা গুলিসহ শটগান ও কম প্রাণঘাতী অস্ত্রসহ পুলিশ, র্যাব এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে মোতায়েন করা হয়। এই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কেউ কেউ রাস্তা এবং কিছু স্থাপনা অবরোধ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তারা সামগ্রিকভাবে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের পরিচালনা করেছিল। এই হামলার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য কিছু বিক্ষোভকারী পাল্টা ইট ও লাঠি নিক্ষেপ করে।
বিক্ষোভকারীদের দমাতে প্রাণঘাতি বলপ্রয়োগের নির্দেশ দেয় সরকার
এই অবনতিশীল পরিবেশে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় কিছু বিক্ষোভকারী সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে উল্লেখ করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের (আন্দোলনকারী) লক্ষ্য ছিল সরকারি ভবন,পরিবহন অবকাঠামো এবং পুলিশ। ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় সরকার বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বল প্রয়োগের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে অনুমতি দেয়। ১৯ জুলাই থেকে বিক্ষোভ শেষ হওয়া পর্যন্ত, বিজিবি, র্যাব এবং পুলিশ ঢাকা এবং অন্যত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে প্রাণঘাতী গুলি চালায়, যার ফলে সংবাদ সংগ্রহ করার সাংবাদিকসহ অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যা ও আহত হয়। কিছু ক্ষেত্রে,নিরাপত্তা বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে।
তবে সহিংসতা চালিয়েও পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনী আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ এবং উত্তেজনাকর অস্থিরতার ক্রমবর্ধমান মাত্রাকে দমন করতে পারেনি বলে মনে করছেন এই স্বাধীন তদন্তকারীরা। তারা বলছেন, এরপর ২০ জুলাই সাবেক সরকার একটি সাধারণ কারফিউ জারি করে এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর সেনারা এমনও বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করেছে, যারা গুরুতর কোনও হুমকি ছিল না। যার ফলে তাদের হাতে অন্তত একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাঠে থাকা জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা বেসামরিক বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের আদেশকে অনেক সময় মানেননি। এমনকি ৩ আগস্ট একটি বড় বৈঠকে তারা সেনাপ্রধানকে জানিয়ে দেন যে, তারা (জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা) বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে চান না। এটি সত্ত্বেও,সেনাবাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের নিরাপত্তামূলক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা ওই কর্মকর্তাদের পাল্টা আক্রমণের ভয় ছাড়াই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বল প্রয়োগ করতে উৎসাহ দেয়।
এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২০ ও ২১ জুলাই অবরোধ হটিয়ে দেওয়ার জন্য নৃশংসভাবে পুলিশ এবং র্যাব বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করে এবং প্রচুর মানুষ নিহত ও আহত হয়েছিল। জুলাইয়ের শেষের দিকে, সেনাবাহিনীও ব্যাপক অভিযানে অংশ নেয়, যেখানে পুলিশ এবং র্যাব নির্বিচারে বিপুল সংখ্যক লোককে গ্রেফতার করে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্যের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি থামানোর জন্য বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং পুলিশকে ব্যবহার করার সরকারি পরিকল্পনা তৈরিতে সেনাবাহিনী এবং বিজিবি অংশ নিয়েছিল। সেই পরিকল্পনা অনুসারে, পুলিশ অনেক বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যা করেছে। কিন্তু সেনাবাহিনী এবং বিজিবির সদস্যরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিক্ষোভকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এবং বিক্ষোভে বাধা প্রদান থেকে বিরত থাকে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনে সরাসরি জড়িত
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ডিরেক্টরেট-জেনারেল অব আর্মড ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এবং পুলিশের বিশেষ শাখাগুলো- গোয়েন্দা শাখা, স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটসহ (সিটিটিসি)বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিক্ষোভ দমনের জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনে সরাসরি জড়িত। তারা গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে নজরদারির মাধ্যমে প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য অন্যদের জানিয়েছে; যাতে জুলাইয়ের শেষের দিকে সংঘটিত ব্যাপক নির্বিচারে গ্রেফতার করা যায়। গোয়েন্দা শাখা বন্দীদের কাছ থেকে তথ্য ও স্বীকারোক্তি সংগ্রহের জন্য নিয়মিতভাবে নির্বিচারে আটক ও নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। সিটিটিসি-এর সদর দফতরেও শিশুসহ নির্বিচারে আটককৃতদের অনেককে রাখা হয়েছিল। ছাত্রনেতাদের অপহরণ ও নির্বিচারে আটকে রাখার জন্য গোয়েন্দা শাখা এবং ডিজিএফআই একসঙ্গে কাজ করেছে এবং তাদের বিক্ষোভ পরিত্যাগ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছে।
এমনকি ডিজিএফআই,এনএসআই এবং গোয়েন্দা শাখার কর্মীরা জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা সেবাতেও বাধা দিয়েছে অভিযোগ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায়শই তারা হাসপাতালে রোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে, আহত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে এবং চিকিৎসা সেবা দেওয়া কর্মীদেরও ভয় দেখায়।
এমন পরিস্থিতিতে প্রসিকিউটরিয়াল কর্তৃপক্ষ বা বিচার বিভাগও কোনও অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়নি, যাতে নির্বিচারে আটক ও নির্যাতনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যায়, বা এই ধরনের কাজ করে এমন কোনও কর্মকর্তাকে জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, প্রতিবেদনে বলা হয়।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলো গোপন করার জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক এবং সংগঠিত প্রচেষ্টার অংশ ছিল গোয়েন্দা পরিষেবাগুলো। মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের সঙ্গে একত্রে এনটিএমসি কাজ করেছে, যাতে বিক্ষোভকারীদের কার্যক্রম সংগঠিত করতে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা যায়। একইসঙ্গে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে চলমান লঙ্ঘনের মাত্রা এবং এর তথ্য প্রচারের ক্ষমতা সীমিত করার জন্য কৌশলগতভাবে সময়োপযোগী এবং ইন্টারনেট বন্ধ করার জন্য মন্ত্রিপরিষদের আদেশ কার্যকর করে।
সমান্তরালভাবে ডিজিএফআই, এনএসআই এবং র্যাব মিডিয়া আউটলেটগুলোকে গণবিক্ষোভ এবং তাদের সহিংস দমন সম্পর্কে সম্পূর্ণ এবং সঠিকভাবে রিপোর্ট না করার জন্য চাপ দেয়। ডিজিএফআই তাদের নীরবতা নিশ্চিত করতে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের পরিবার এবং আইনজীবীদের ভয় দেখাতে পুলিশের সঙ্গে কাজ করে।
জড়িত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সূত্রের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হতে সক্ষম হয়েছে যে, পুলিশ, আধাসামরিক, সামরিক এবং গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সহিংস কর্মীদের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করার জন্য যে সমন্বিত এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা, সেটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্পূর্ণ জ্ঞান, সমন্বয় এবং নির্দেশনার মাধ্যমে ঘটেছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য পৃথকভাবে কাজ করে। উভয়েই একাধিক সূত্র থেকে সরেজমিন পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত প্রতিবেদন পেয়েছেন।
ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সাক্ষ্যের বরাত দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২১ জুলাই এবং আগস্টের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যে প্রতিবেদনগুলো দিয়েছেন, সেগুলোতে নির্দিষ্টভাবে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। উভয় রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন, যা থেকে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে সরাসরি জানতে পেরেছেন। এছাড়া, বিজিবি, র্যাব, ডিজিএফআই, পুলিশ এবং এর ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্বিচারে আটকসহ বিক্ষোভকারী এবং অন্যান্য সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত এবং তাদের বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের কার্যক্রমের অনুমোদন ও নির্দেশনা প্রদানের জন্য সরাসরি আদেশ এবং অন্যান্য নির্দেশ জারি করেছে এই রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
২০২৪ সালের আগস্টের শুরুতে সাবেক সরকার যখন ক্রমবর্ধমানভাবে দেশের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল,সেসময় জনতা প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য গুরুতর প্রতিশোধমূলক সহিংসতায় জড়ায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।এতে বলা হয়, তাদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এবং আওয়ামী লীগের প্রকৃত বা অনুভূত সমর্থকরা। পুলিশ এবং মিডিয়াকে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে দেখা হয়েছিল। বিক্ষোভের সময় এবং পরে, হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা, আহমদিয়া মুসলমান এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী গোষ্ঠীগুলোও জনতার সহিংস আক্রমণের শিকার হয় এবং তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া এবং কিছু উপাসনালয়ে আক্রমণ করা হয়।
ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্য থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ, জমি সংক্রান্ত স্থানীয় সাম্প্রদায়িক বিরোধ এবং আন্তঃব্যক্তিক ইস্যুতে বিভিন্ন এবং একই ধরনের উদ্দেশ্যের কারণে আক্রমণগুলো হয়েছিল বলে মনে করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন। তারা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে,কিছু জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি সমর্থক, সদস্য এবং স্থানীয় নেতারা প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং স্বতন্ত্র ধর্মীয় ও অধিবাসী গোষ্ঠীর উপর হামলার সাথে জড়িত ছিল।
ওএইচসিএইচআর-এর কাছে যে তথ্যগুলো রয়েছে, সেগুলোর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, তবে এসব ঘটনা সংঘটনে রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় নেতারা জড়িত ছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায় না। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোকে লক্ষ্য করে সহিংসতার ঘটনায় নিন্দা জানানোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনী বা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত গুরুতর লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের জন্য তদন্ত বা জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কোনও প্রকৃত প্রচেষ্টা আগের সরকার করেছে বলেও মনে করে না ওএইচসিএইচআর।
পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা শুরু করেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- তারা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) পাশাপাশি নিয়মিত আদালতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
তবে এই প্রচেষ্টাগুলো এরইমধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে স্বীকার করে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশন বলছে, এর কারণ হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী এবং বিচার বিভাগের আগে থেকে বিদ্যমান কাঠামোগত ঘাটতি; পুলিশি অসদাচরণ যেমন গণ মামলার ক্ষেত্রে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা; যারা অভিযোগের সম্মুখীন কিন্তু আগের অবস্থানে রয়ে গেছে এমন কিছু নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের দ্বারা ক্রমাগত ভীতি প্রদর্শন এবং প্রমাণ নষ্ট করা; এবং সেইসাথে অন্যান্য আইসিটি এবং নিয়মিত আদালত সম্পর্কিত সমস্যার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় এখনও অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,‘স্বতন্ত্র ধর্মীয় ও অধিবাসী গোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় ১০০ জনকে গ্রেফতার করার কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে প্রতিশোধমূলক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত অনেক অপরাধীরা এখনও দায়মুক্তি ভোগ করছে।
সরকারি ও বেসরকারি সূত্রের দ্বারা সংকলিত মৃত্যুর রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে, অন্যান্য উপলব্ধ প্রমাণের সমন্বয়ে ওএইচসিএইচআর মূল্যায়ন করে যে, বিক্ষোভের সময় ১ হাজার ৪০০ জনের মতো মানুষ নিহত হতে পারে, যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা ব্যবহৃত সামরিক রাইফেল এবং শটগানের প্রাণঘাতী ধাতব ছররা গুলি দ্বারা নিহত হয়েছিল। আরও হাজার হাজার গুরুতর আহত হয়েছে এবং এদের অনেকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছে।
রিপোর্ট করা মৃত্যুর পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করে যে, নিহতদের প্রায় ১২-১৩ শতাংশ শিশু। পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীও শিশুদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা, ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গুত্ব, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অমানবিক পরিস্থিতিতে আটক, নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের খারাপ আচরণের নিশানা করেছে।
প্রথম দিকের বিক্ষোভের অগ্রভাগে থাকার কারণে, নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হামলার শিকার হয় নারী ও মেয়েরাও। তারা বিশেষভাবে যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে লিঙ্গ-ভিত্তিক শারীরিক সহিংসতা, ধর্ষণের হুমকি এবং কিছু নথিভুক্ত মামলা অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ওএইচসিএইচআর প্রতিশোধমূলক সহিংসতা হিসেবে ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতার হুমকির রিপোর্টও পেয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা এবং বাংলাদেশে যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার উল্লেখযোগ্য কম প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, ওএইচসিএইচআর বিশ্বাস করে যে যৌন সহিংসতার সম্পূর্ণ হিসেবে নথিভুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। সংস্থাটি মনে করে যে এই ধরনের অপকর্মের সম্পূর্ণ হিসাব এবং প্রভাব নিশ্চিত করতে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য আরও গভীরতর তদন্ত প্রয়োজন।
পুরোনো আইন ও নীতি, দুর্নীতিমুক্ত শাসন কাঠামো, এবং আইনের শাসনের ক্ষয়ের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে। সহজেই প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে অসম শক্তির ব্যবহার, পুলিশের এর সামরিকীকরণ, নিরাপত্তা ও বিচার খাতের রাজনৈতিকীকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তি ঘটেছে এসব কারণে। সাবেক সরকার শান্তিপূর্ণ নাগরিক ও রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করার জন্য একটি বিস্তৃত আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর নির্ভর করেছিল এবং সেটির ব্যাপ্তি বাড়িয়েছিল। এসব উপাদানের জন্য সরকারবিরোধীদের বিশৃঙ্খলামূলক এবং কেও কেও এমনকি প্রতিবাদের জন্য সহিংস কর্মকাণ্ডের দিকে পরিচালিত হয়েছিল।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশ
ওএইচসিএইচআর এর ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন ওই সময়কালে ঘটে যাওয়া লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের গুরুতর মাত্রা এবং তাদের অন্তর্নিহিত মূল কারণগুলি দুর করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ এবং উল্লেখযোগ্য দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের প্রয়োজন যাতে একই ধরনের গুরুতর লঙ্ঘন পুনরায় না ঘটে। এই লক্ষ্যে, ওএইচসিএইচআর এই প্রতিবেদনে বিশদ বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা ও বিচার খাতের সংস্কার, অনেক দমনমূলক আইন ও নীতি বাতিল, অন্যান্য আইনগুলোকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানসম্পন্ন করার জন্য সংশোধন, প্রাতিষ্ঠানিক ও শাসন খাতের সংস্কার, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর পরিবর্তন, এবং অর্থনৈতিক সুশাসন যাতে করে বাংলাদেশের সকল মানুষের অন্তর্ভুক্তি ও মানবাধিকার সুরক্ষা ও সম্মান নিশ্চিত হয়।
এই ক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ন্যায্য এবং স্বাধীন ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ব্যাপক প্রতিকারের পদ্ধতি যা জাতীয় সমস্যার সমাধানে উৎসাহিত করবে। একটি সামগ্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রেক্ষাপট-ভিত্তিক ক্রান্তিকালীন বিচার প্রক্রিয়া বিকাশের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সংলাপ এবং পরামর্শের সুপারিশ করে ওএইচসিএইচআর। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে ও একটি বৃহত্তর ভুক্তভোগী-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবচেয়ে বড় অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। এই ধরনের প্রক্রিয়া সামাজিক সংহতি, জাতীয় নিরাময় এবং সম্প্রদায়ের পুনর্মিলনকে সমর্থন করবে।
ওএইচসিএইচআর দায়বদ্ধতা সমর্থন করার লক্ষ্যে প্রতিবাদের সাথে সম্পর্কিত লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের আরও স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্তের সুপারিশ করে। এই প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার জন্য ওএইচসিএইচআর বাংলাদেশকে সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত রয়েছে।
ওএইচসিএইচআর জানিয়েছে, তাদের প্রতিবেদন এবং সুপারিশগুলো বাংলাদেশে এবং অনলাইনে ভুক্তভোগী এবং অন্যান্য সাক্ষীদের সঙ্গে পরিচালিত ২৩০টিরও বেশি গভীর সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। সরকার, নিরাপত্তা খাত এবং রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তাদের সাথে আরও ৩৬টি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে প্রাসঙ্গিক ঘটনাগুলির প্রত্যক্ষ জ্ঞান রয়েছে এমন অনেক সাবেক এবং বর্তমান জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা রয়েছে। প্রমাণীকৃত ভিডিও এবং ফটো, মেডিক্যাল ফরেনসিক বিশ্লেষণ এবং অস্ত্র বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে অনুসন্ধানগুলো সংগতিপূর্ণ– এটি নিশ্চিত করা হয়েছে।
একটি ঘটনা বা আচরণের ধরন ঘটেছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত ভিত্তি আছে; এমনভাবে ওএইচসিএইচআর অনুসন্ধান করেছে। প্রমাণের এই মানটি ফৌজদারি কার্যধারায় অপরাধ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় মানদণ্ডের চেয়ে কম তবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা আরও ফৌজদারি তদন্তের সুযোগ রয়েছে।
বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ‘সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের’ দাবিতে চলা আন্দোলন চলাকালে গতবছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগের বিষয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের (তথ্যানুসন্ধান দল) প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। স্বাধীন এই তদন্তের তথ্যানুসন্ধান দল ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ প্রমাণ পেয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ে সাবেক সরকার এবং তার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট সহিংস গোষ্ঠীগুলো একসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত।আন্দোলন চলাকালে ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় সরকার বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ‘প্রাণঘাতী বল প্রয়োগের’ জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে অনুমতি দিয়েছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দফতর (ওএইচসিএইচআর)২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশজুড়ে সংঘটিত ব্যাপক বিক্ষোভ এবং তার পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপব্যবহারের অভিযোগ সম্পর্কে একটি স্বাধীন ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং তদন্ত’ পরিচালনা করে।জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর তদন্ত শুরু করে এবং পাঁচ মাস পরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হলো।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) জেনেভায় প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন। এসময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ওএইচসিএইচআর-এর এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রোরি মানগোভেন। এছাড়া হাইকমিশনার অফিসের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানিও উপস্থিত ছিলেন।
তদন্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ বা এক্সিকিউটিভ সামারিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমন্ত্রণে ওএইচসিএইচআর ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশজুড়ে সংঘটিত ব্যাপক বিক্ষোভ এবং তার পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপব্যবহারের অভিযোগ সম্পর্কে একটি স্বাধীন ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং তদন্ত’ পরিচালনা করেছে। এতে সংগৃহীত সব তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খু ও স্বাধীন মূল্যায়নের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, সাবেক সরকার এবং তার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট সহিংস গোষ্ঠীগুলো সম্মিলিতভাবে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত।
এসময় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যা, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর গুরুতর আহত হওয়াসহ বলপ্রয়োগের অপব্যবহার, ব্যাপকভাবে নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক এবং নির্যাতন ও অন্যান্য ধরনের দুর্ব্যবহারসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জড়িত ছিল বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে বলে মনে করছে ওএইচসিএইচআর।
সংস্থাটি আরও বিশ্বাস করে, বিক্ষোভ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত ভিন্নমত প্রকাশ দমন করার কৌশল অনুসরণ করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নিরাপত্তা খাতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, সমন্বয় ও নির্দেশনার মাধ্যমে এই লঙ্ঘনগুলো সংঘটিত হয়েছে। এই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও উদ্বেগের বিষয়। ফলে এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ ও নির্যাতন (একটি স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ) এবং দেশীয় আইনে গুরুতর অপরাধ কিনা তা নির্ধারণের জন্য আরও ফৌজদারি তদন্ত প্রয়োজন।
যেভাবে আন্দোলনের শুরু
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের একটি রায়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত এই বিক্ষোভ শুরুর কারণ ছিল। তবে জনগণের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে আরও গভীর অসন্তোষ বিদ্যমান ছিল, যা রাজনীতি ও শাসনের ধ্বংসাত্মক ও দুর্নীতিগ্রস্ত সমস্যাগুলো থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এই সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগের ঘাটতিকে উপেক্ষা করেছে এবং প্রকৃতপক্ষে তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার বাংলাদেশি, যারা বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, পেশাগত ও ধর্মীয় পটভূমি থেকে এসেছেন, তারা অর্থপূর্ণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে এই বিক্ষোভে যোগ দেন। জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ প্রশমিত করতে এবং ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টায়,সাবেক সরকার বিক্ষোভ দমন করতে ক্রমবর্ধমান সহিংস পন্থা অবলম্বন করে এবং এটিকে পদ্ধতিগতভাবে দমন করার চেষ্টা করে।
আন্দোলনে উসকানি ও হামলা
জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে সাবেক সরকার ও আওয়ামী লীগ নিজেদের সশস্ত্র কর্মীদের সমাবেশিত করে এবং বিক্ষোভ দমনের জন্য প্রাথমিক অবস্থায় সরকারি মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ছাত্রলীগের সমর্থকদের উসকানি দেয়। তারা ভোঁতা, ধারালো অস্ত্র ও কিছু আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এবং এর আশপাশে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণকারী নারী-পুরুষের ওপর হামলা চালায়। আন্দোলনরত ছাত্ররা নিজেদের আত্মরক্ষা করলে এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার আরও গুরুতর সহিংসতার আশ্রয় নেয়। সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত একটি বড় বিক্ষোভ ও অন্যান্য স্থানে অপ্রয়োজনীয় এবং অসম শক্তি দিয়ে শান্তিপূর্ণ ছাত্র বিক্ষোভকে সহিংসভাবে দমন করে; যা ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন।
এই ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা ঢাকা ও অন্যান্য শহরগুলো সম্পূর্ণ অচল করে দেওয়ার ডাক দেয় এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জামায়াতে ইসলামী সেটিতে সমর্থন জানায়। এর প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন সরকার বিক্ষোভকারী এবং তাদের সমন্বয়কারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা আরও বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে জীবনের অধিকার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা লঙ্ঘন হয়।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও পুলিশের হেলিকপ্টার আকাশ থেকে বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। এছাড়া সামরিক রাইফেল, ধাতুর তৈরি প্রাণঘাতী ছররা গুলিসহ শটগান ও কম প্রাণঘাতী অস্ত্রসহ পুলিশ, র্যাব এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে মোতায়েন করা হয়। এই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কেউ কেউ রাস্তা এবং কিছু স্থাপনা অবরোধ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তারা সামগ্রিকভাবে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের পরিচালনা করেছিল। এই হামলার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য কিছু বিক্ষোভকারী পাল্টা ইট ও লাঠি নিক্ষেপ করে।
বিক্ষোভকারীদের দমাতে প্রাণঘাতি বলপ্রয়োগের নির্দেশ দেয় সরকার
এই অবনতিশীল পরিবেশে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় কিছু বিক্ষোভকারী সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে উল্লেখ করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের (আন্দোলনকারী) লক্ষ্য ছিল সরকারি ভবন,পরিবহন অবকাঠামো এবং পুলিশ। ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় সরকার বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বল প্রয়োগের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে অনুমতি দেয়। ১৯ জুলাই থেকে বিক্ষোভ শেষ হওয়া পর্যন্ত, বিজিবি, র্যাব এবং পুলিশ ঢাকা এবং অন্যত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে প্রাণঘাতী গুলি চালায়, যার ফলে সংবাদ সংগ্রহ করার সাংবাদিকসহ অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যা ও আহত হয়। কিছু ক্ষেত্রে,নিরাপত্তা বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে।
তবে সহিংসতা চালিয়েও পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনী আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ এবং উত্তেজনাকর অস্থিরতার ক্রমবর্ধমান মাত্রাকে দমন করতে পারেনি বলে মনে করছেন এই স্বাধীন তদন্তকারীরা। তারা বলছেন, এরপর ২০ জুলাই সাবেক সরকার একটি সাধারণ কারফিউ জারি করে এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর সেনারা এমনও বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করেছে, যারা গুরুতর কোনও হুমকি ছিল না। যার ফলে তাদের হাতে অন্তত একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাঠে থাকা জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা বেসামরিক বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের আদেশকে অনেক সময় মানেননি। এমনকি ৩ আগস্ট একটি বড় বৈঠকে তারা সেনাপ্রধানকে জানিয়ে দেন যে, তারা (জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা) বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে চান না। এটি সত্ত্বেও,সেনাবাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের নিরাপত্তামূলক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা ওই কর্মকর্তাদের পাল্টা আক্রমণের ভয় ছাড়াই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বল প্রয়োগ করতে উৎসাহ দেয়।
এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২০ ও ২১ জুলাই অবরোধ হটিয়ে দেওয়ার জন্য নৃশংসভাবে পুলিশ এবং র্যাব বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করে এবং প্রচুর মানুষ নিহত ও আহত হয়েছিল। জুলাইয়ের শেষের দিকে, সেনাবাহিনীও ব্যাপক অভিযানে অংশ নেয়, যেখানে পুলিশ এবং র্যাব নির্বিচারে বিপুল সংখ্যক লোককে গ্রেফতার করে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্যের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি থামানোর জন্য বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং পুলিশকে ব্যবহার করার সরকারি পরিকল্পনা তৈরিতে সেনাবাহিনী এবং বিজিবি অংশ নিয়েছিল। সেই পরিকল্পনা অনুসারে, পুলিশ অনেক বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যা করেছে। কিন্তু সেনাবাহিনী এবং বিজিবির সদস্যরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিক্ষোভকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এবং বিক্ষোভে বাধা প্রদান থেকে বিরত থাকে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনে সরাসরি জড়িত
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ডিরেক্টরেট-জেনারেল অব আর্মড ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এবং পুলিশের বিশেষ শাখাগুলো- গোয়েন্দা শাখা, স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটসহ (সিটিটিসি)বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিক্ষোভ দমনের জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনে সরাসরি জড়িত। তারা গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে নজরদারির মাধ্যমে প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য অন্যদের জানিয়েছে; যাতে জুলাইয়ের শেষের দিকে সংঘটিত ব্যাপক নির্বিচারে গ্রেফতার করা যায়। গোয়েন্দা শাখা বন্দীদের কাছ থেকে তথ্য ও স্বীকারোক্তি সংগ্রহের জন্য নিয়মিতভাবে নির্বিচারে আটক ও নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। সিটিটিসি-এর সদর দফতরেও শিশুসহ নির্বিচারে আটককৃতদের অনেককে রাখা হয়েছিল। ছাত্রনেতাদের অপহরণ ও নির্বিচারে আটকে রাখার জন্য গোয়েন্দা শাখা এবং ডিজিএফআই একসঙ্গে কাজ করেছে এবং তাদের বিক্ষোভ পরিত্যাগ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছে।
এমনকি ডিজিএফআই,এনএসআই এবং গোয়েন্দা শাখার কর্মীরা জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা সেবাতেও বাধা দিয়েছে অভিযোগ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায়শই তারা হাসপাতালে রোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে, আহত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে এবং চিকিৎসা সেবা দেওয়া কর্মীদেরও ভয় দেখায়।
এমন পরিস্থিতিতে প্রসিকিউটরিয়াল কর্তৃপক্ষ বা বিচার বিভাগও কোনও অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়নি, যাতে নির্বিচারে আটক ও নির্যাতনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যায়, বা এই ধরনের কাজ করে এমন কোনও কর্মকর্তাকে জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, প্রতিবেদনে বলা হয়।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলো গোপন করার জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক এবং সংগঠিত প্রচেষ্টার অংশ ছিল গোয়েন্দা পরিষেবাগুলো। মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের সঙ্গে একত্রে এনটিএমসি কাজ করেছে, যাতে বিক্ষোভকারীদের কার্যক্রম সংগঠিত করতে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা যায়। একইসঙ্গে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে চলমান লঙ্ঘনের মাত্রা এবং এর তথ্য প্রচারের ক্ষমতা সীমিত করার জন্য কৌশলগতভাবে সময়োপযোগী এবং ইন্টারনেট বন্ধ করার জন্য মন্ত্রিপরিষদের আদেশ কার্যকর করে।
সমান্তরালভাবে ডিজিএফআই, এনএসআই এবং র্যাব মিডিয়া আউটলেটগুলোকে গণবিক্ষোভ এবং তাদের সহিংস দমন সম্পর্কে সম্পূর্ণ এবং সঠিকভাবে রিপোর্ট না করার জন্য চাপ দেয়। ডিজিএফআই তাদের নীরবতা নিশ্চিত করতে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের পরিবার এবং আইনজীবীদের ভয় দেখাতে পুলিশের সঙ্গে কাজ করে।
জড়িত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সূত্রের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হতে সক্ষম হয়েছে যে, পুলিশ, আধাসামরিক, সামরিক এবং গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সহিংস কর্মীদের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করার জন্য যে সমন্বিত এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা, সেটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্পূর্ণ জ্ঞান, সমন্বয় এবং নির্দেশনার মাধ্যমে ঘটেছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য পৃথকভাবে কাজ করে। উভয়েই একাধিক সূত্র থেকে সরেজমিন পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত প্রতিবেদন পেয়েছেন।
ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সাক্ষ্যের বরাত দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২১ জুলাই এবং আগস্টের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যে প্রতিবেদনগুলো দিয়েছেন, সেগুলোতে নির্দিষ্টভাবে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। উভয় রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন, যা থেকে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে সরাসরি জানতে পেরেছেন। এছাড়া, বিজিবি, র্যাব, ডিজিএফআই, পুলিশ এবং এর ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্বিচারে আটকসহ বিক্ষোভকারী এবং অন্যান্য সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত এবং তাদের বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের কার্যক্রমের অনুমোদন ও নির্দেশনা প্রদানের জন্য সরাসরি আদেশ এবং অন্যান্য নির্দেশ জারি করেছে এই রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
২০২৪ সালের আগস্টের শুরুতে সাবেক সরকার যখন ক্রমবর্ধমানভাবে দেশের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল,সেসময় জনতা প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য গুরুতর প্রতিশোধমূলক সহিংসতায় জড়ায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।এতে বলা হয়, তাদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এবং আওয়ামী লীগের প্রকৃত বা অনুভূত সমর্থকরা। পুলিশ এবং মিডিয়াকে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে দেখা হয়েছিল। বিক্ষোভের সময় এবং পরে, হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা, আহমদিয়া মুসলমান এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী গোষ্ঠীগুলোও জনতার সহিংস আক্রমণের শিকার হয় এবং তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া এবং কিছু উপাসনালয়ে আক্রমণ করা হয়।
ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্য থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ, জমি সংক্রান্ত স্থানীয় সাম্প্রদায়িক বিরোধ এবং আন্তঃব্যক্তিক ইস্যুতে বিভিন্ন এবং একই ধরনের উদ্দেশ্যের কারণে আক্রমণগুলো হয়েছিল বলে মনে করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন। তারা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে,কিছু জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি সমর্থক, সদস্য এবং স্থানীয় নেতারা প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং স্বতন্ত্র ধর্মীয় ও অধিবাসী গোষ্ঠীর উপর হামলার সাথে জড়িত ছিল।
ওএইচসিএইচআর-এর কাছে যে তথ্যগুলো রয়েছে, সেগুলোর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, তবে এসব ঘটনা সংঘটনে রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় নেতারা জড়িত ছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায় না। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোকে লক্ষ্য করে সহিংসতার ঘটনায় নিন্দা জানানোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনী বা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত গুরুতর লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের জন্য তদন্ত বা জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কোনও প্রকৃত প্রচেষ্টা আগের সরকার করেছে বলেও মনে করে না ওএইচসিএইচআর।
পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা শুরু করেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- তারা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) পাশাপাশি নিয়মিত আদালতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
তবে এই প্রচেষ্টাগুলো এরইমধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে স্বীকার করে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশন বলছে, এর কারণ হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী এবং বিচার বিভাগের আগে থেকে বিদ্যমান কাঠামোগত ঘাটতি; পুলিশি অসদাচরণ যেমন গণ মামলার ক্ষেত্রে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা; যারা অভিযোগের সম্মুখীন কিন্তু আগের অবস্থানে রয়ে গেছে এমন কিছু নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের দ্বারা ক্রমাগত ভীতি প্রদর্শন এবং প্রমাণ নষ্ট করা; এবং সেইসাথে অন্যান্য আইসিটি এবং নিয়মিত আদালত সম্পর্কিত সমস্যার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় এখনও অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,‘স্বতন্ত্র ধর্মীয় ও অধিবাসী গোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় ১০০ জনকে গ্রেফতার করার কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে প্রতিশোধমূলক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত অনেক অপরাধীরা এখনও দায়মুক্তি ভোগ করছে।
সরকারি ও বেসরকারি সূত্রের দ্বারা সংকলিত মৃত্যুর রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে, অন্যান্য উপলব্ধ প্রমাণের সমন্বয়ে ওএইচসিএইচআর মূল্যায়ন করে যে, বিক্ষোভের সময় ১ হাজার ৪০০ জনের মতো মানুষ নিহত হতে পারে, যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা ব্যবহৃত সামরিক রাইফেল এবং শটগানের প্রাণঘাতী ধাতব ছররা গুলি দ্বারা নিহত হয়েছিল। আরও হাজার হাজার গুরুতর আহত হয়েছে এবং এদের অনেকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছে।
রিপোর্ট করা মৃত্যুর পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করে যে, নিহতদের প্রায় ১২-১৩ শতাংশ শিশু। পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীও শিশুদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা, ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গুত্ব, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অমানবিক পরিস্থিতিতে আটক, নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের খারাপ আচরণের নিশানা করেছে।
প্রথম দিকের বিক্ষোভের অগ্রভাগে থাকার কারণে, নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হামলার শিকার হয় নারী ও মেয়েরাও। তারা বিশেষভাবে যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে লিঙ্গ-ভিত্তিক শারীরিক সহিংসতা, ধর্ষণের হুমকি এবং কিছু নথিভুক্ত মামলা অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ওএইচসিএইচআর প্রতিশোধমূলক সহিংসতা হিসেবে ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতার হুমকির রিপোর্টও পেয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা এবং বাংলাদেশে যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার উল্লেখযোগ্য কম প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, ওএইচসিএইচআর বিশ্বাস করে যে যৌন সহিংসতার সম্পূর্ণ হিসেবে নথিভুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। সংস্থাটি মনে করে যে এই ধরনের অপকর্মের সম্পূর্ণ হিসাব এবং প্রভাব নিশ্চিত করতে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য আরও গভীরতর তদন্ত প্রয়োজন।
পুরোনো আইন ও নীতি, দুর্নীতিমুক্ত শাসন কাঠামো, এবং আইনের শাসনের ক্ষয়ের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে। সহজেই প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে অসম শক্তির ব্যবহার, পুলিশের এর সামরিকীকরণ, নিরাপত্তা ও বিচার খাতের রাজনৈতিকীকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তি ঘটেছে এসব কারণে। সাবেক সরকার শান্তিপূর্ণ নাগরিক ও রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করার জন্য একটি বিস্তৃত আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর নির্ভর করেছিল এবং সেটির ব্যাপ্তি বাড়িয়েছিল। এসব উপাদানের জন্য সরকারবিরোধীদের বিশৃঙ্খলামূলক এবং কেও কেও এমনকি প্রতিবাদের জন্য সহিংস কর্মকাণ্ডের দিকে পরিচালিত হয়েছিল।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশ
ওএইচসিএইচআর এর ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন ওই সময়কালে ঘটে যাওয়া লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের গুরুতর মাত্রা এবং তাদের অন্তর্নিহিত মূল কারণগুলি দুর করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ এবং উল্লেখযোগ্য দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের প্রয়োজন যাতে একই ধরনের গুরুতর লঙ্ঘন পুনরায় না ঘটে। এই লক্ষ্যে, ওএইচসিএইচআর এই প্রতিবেদনে বিশদ বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা ও বিচার খাতের সংস্কার, অনেক দমনমূলক আইন ও নীতি বাতিল, অন্যান্য আইনগুলোকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানসম্পন্ন করার জন্য সংশোধন, প্রাতিষ্ঠানিক ও শাসন খাতের সংস্কার, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর পরিবর্তন, এবং অর্থনৈতিক সুশাসন যাতে করে বাংলাদেশের সকল মানুষের অন্তর্ভুক্তি ও মানবাধিকার সুরক্ষা ও সম্মান নিশ্চিত হয়।
এই ক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ন্যায্য এবং স্বাধীন ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ব্যাপক প্রতিকারের পদ্ধতি যা জাতীয় সমস্যার সমাধানে উৎসাহিত করবে। একটি সামগ্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রেক্ষাপট-ভিত্তিক ক্রান্তিকালীন বিচার প্রক্রিয়া বিকাশের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সংলাপ এবং পরামর্শের সুপারিশ করে ওএইচসিএইচআর। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে ও একটি বৃহত্তর ভুক্তভোগী-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবচেয়ে বড় অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। এই ধরনের প্রক্রিয়া সামাজিক সংহতি, জাতীয় নিরাময় এবং সম্প্রদায়ের পুনর্মিলনকে সমর্থন করবে।
ওএইচসিএইচআর দায়বদ্ধতা সমর্থন করার লক্ষ্যে প্রতিবাদের সাথে সম্পর্কিত লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের আরও স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্তের সুপারিশ করে। এই প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার জন্য ওএইচসিএইচআর বাংলাদেশকে সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত রয়েছে।
ওএইচসিএইচআর জানিয়েছে, তাদের প্রতিবেদন এবং সুপারিশগুলো বাংলাদেশে এবং অনলাইনে ভুক্তভোগী এবং অন্যান্য সাক্ষীদের সঙ্গে পরিচালিত ২৩০টিরও বেশি গভীর সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। সরকার, নিরাপত্তা খাত এবং রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তাদের সাথে আরও ৩৬টি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে প্রাসঙ্গিক ঘটনাগুলির প্রত্যক্ষ জ্ঞান রয়েছে এমন অনেক সাবেক এবং বর্তমান জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা রয়েছে। প্রমাণীকৃত ভিডিও এবং ফটো, মেডিক্যাল ফরেনসিক বিশ্লেষণ এবং অস্ত্র বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে অনুসন্ধানগুলো সংগতিপূর্ণ– এটি নিশ্চিত করা হয়েছে।
একটি ঘটনা বা আচরণের ধরন ঘটেছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত ভিত্তি আছে; এমনভাবে ওএইচসিএইচআর অনুসন্ধান করেছে। প্রমাণের এই মানটি ফৌজদারি কার্যধারায় অপরাধ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় মানদণ্ডের চেয়ে কম তবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা আরও ফৌজদারি তদন্তের সুযোগ রয়েছে।