দুদকের হাতে আসা অভিযোগে বলা হয়েছে, নূরুল হুদার কমিশন ‘নিম্নমানের’ ইভিএম কেনায় রাষ্ট্রের প্রায় ৩ হাজার ১৭২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে
‘জনগণের ভোট ছাড়া’ নির্বাচন সম্পন্ন করার মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদার বিরুদ্ধে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির’ একটি অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের হাতে আসা অভিযোগে বলা হয়েছে, নূরুল হুদা এবং তার সহযোগীরা ‘সমীক্ষা ছাড়াই’ প্রকল্প গ্রহণ করে, টেন্ডার ছাড়া এবং বাজার মূল্যের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দামে দেড় লাখ ‘নিম্নমানের’ ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনায় রাষ্ট্রের প্রায় ৩ হাজার ১৭২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া শেখ হাসিনার আমলে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ঘটনায় নূরুল হুদার সম্পৃক্ততা ছিল কিনা, তা নিয়েও অনুসন্ধান চলছে। এ অভিযোগে বলা হয়, তিনি ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে’ নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ওসি এবং স্থানীয় সংঘবদ্ধ চক্রের সহায়তায় আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নির্বাচনকে ‘প্রভাবিত’ করেছিলেন।
তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, র?্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান ও অন্যদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে দুদকের হাতে। সাবেক সচিব নূরুল হুদা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দেশের দ্বাদশ সিইসি। তার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস?্যরে কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের সব ভোট হয়। এ ইসির মেয়াদ শেষ হয় ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কিছু অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসব বিষয়ে অনুসন্ধান দলের সদস্যরা প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে পত্র পাঠিয়েছেন। তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডও সংগ্রহ করেছেন।
‘আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধান দল কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহের পর এবং অভিযোগ সংশ্লিষ্ট যারা দেশে অবস্থান করছেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সেসব বিচার বিশ্লেষণ করে অনুসন্ধান দল কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই কমিশন পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই পায় ২৫৭টি আসন।
সেবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া বিএনপি ও সমমনা দলগুলো পায় মাত্র সাতটি আসন। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে বিরোধীদের ভাষায় সে নির্বাচনের নাম হয় ‘নিশি রাতের নির্বাচন’। এ অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে প্রধান করে ৭ সদস্যের একটি দল গঠন করেছে দুদক।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, ওই নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়ম, যেমন ‘দিনের ভোট আগের রাতে’ করা, ব্যালট জালিয়াতি, কিছু কিছু কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি কাউন্ট দেখানো, ব্যাপক আর্থিক লেনদেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রার্থীকে জেতানো ইত্যাদি নানা অভিযোগ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং দুদকেও কিছু অভিযোগ জমা হয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন নথিপত্র তলব করে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু নথিপত্র দুদক হাতেও পেয়েছে।
এসব ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি মহানগর, জেলা, বিভাগীয়, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, যেমন পুলিশের আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, পুলিশের সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিক, তৎকালীন জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, জেলা প্রশাসক, জেলা রিটানিং কর্মকর্তা, বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জ ডিইজি, পুলিশ সুপার, থানার ওসি, জেলা/উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং অফিসারসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তার
‘যোগসাজশের’ কথা বলা হয়েছে দুদকের হাতে আসা অভিযোগে।
একাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল কে এম নুরুল হুদার কমিশনের অধীনে। সেই কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার বিদায় বেলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অস্তিত্ব ছিল না। যদিও সিইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে দাবি করেন।
‘জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সিটিং এমপিদের বিষয়ে তাদের নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা সম্ভব ছিল বলে মনে করি না। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এতেই বোঝা যায় নির্বাচন কেমন হয়েছে। এভাবে না-অবাধ, না-সুষ্ঠু, না-নিরপেক্ষ, না-আইনানুগ, না-গ্রহণযোগ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। সে অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই পরের তিনটি নির্বাচন হয়। প্রশ্নবিদ্ধ ওই তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। গতবছর ডিসেম্বরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল করে রায় দেয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর পথ তৈরি হয়।
অবাধ ও নিরপেক্ষতা ‘নিশ্চিত করতে না পারায়’ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিন জাতীয় নির্বাচনে ‘জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে’ বলে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয় ওই রায়ে।
বছর সাতেক আগে নির্বাচন কমিশনের কেনা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মান ঠিকঠাক ছিল কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করছে দুদক। তৎকালীন নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালে এক লাখ ৫০ হাজার ইভিএম কেনে। এর মধ্য এক লাখ ৫০০ মেশিন ব্যবহারের অনুপযোগী বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৬১৮টি ইভিএম রয়েছে ইসিতে। প্রায় ৮৬ হাজার রয়েছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ)। ১০ আঞ্চলিক কার্যালয়ে রয়েছে প্রায় ৬২ হাজার ইভিএম।
গত জানুয়ারিতে দুদকের এক অভিযানে ১ হাজার ৫৯৯টি মেশিনের কোনো হদিস না পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ডিজি আক্তার হোসেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, মেশিনগুলো ‘অযত্ন-অবহেলায়’ পড়ে রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে থাকা ৬১৮টি মেশিনের মধ্যে দৈব চয়নের ভিত্তিতে কয়েকটি মেশিনের ‘অপারেশনাল ক্যাপাসিটি’ যাচাই করে ত্রুটি দেখা গেছে, যা ‘নিম্নমানের মেশিন কেনার’ ইঙ্গিত দেয়। দুদক টিমের সঙ্গে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরাও মেশিনগুলো ‘মানসম্মত নয়’ বলে মত দেন।
এক যুগ আগে বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহারের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে তা নিয়ে চলছে বিতর্ক। আওয়ামী লীগ সরকার ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে থাকলেও তার ঘোরবিরোধী ছিল বিএনপি। দলটির নেতাদের ভাষ্য ছিল, যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণে ব্যাপক কারচুপির সুযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হলেও ২০২২ সালে দায়িত্ব নেয়া কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করে।
ওই বছরের মে মাসে অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এ কায়কোবাদসহ একদল প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞকে ইভিএম দেখিয়ে ভোটগ্রহণে তা ব্যবহারের সম্মতি নেয় ইসি। ইভিএমের কার্যক্রম দেখে ইসির সঙ্গে ২০২২ সালের ২৫ মে মতবিনিময়ের পর ভোটে যন্ত্রগুলো ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন জাফর ইকবাল ও কায়কোবাদ।
জাফর ইকবাল সেদিন বলেছিলেন, ‘ইভিএম নিয়ে ডেমনস্ট্রেশন পুরোটাই দেখেছি। তার ভেতরের খুঁটিনাটি, টেকনিক্যাল বিষয় যা আছে, তাও জেনে নিয়েছি। সবশেষ আমাদের জন্য রাখা মেশিনটি খুলে দেখেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কনভিন্সড হয়েছি। অত্যন্ত চমৎকার মেশিন।’ ইভিএমের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলকেও যন্ত্রটি ব্যবহারের পক্ষে সায় দেয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
আর বুয়েটের শিক্ষক কায়কোবাদ ইভিএমের প্রতি আস্থা রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘এর প্রতিটি অংশ এমনভাবে কাস্টমাইজড, একজন ইচ্ছে করলে সেখানে পরিবর্তন করতে পারবে না। ‘কোনো মেশিনকে শতভাগ বিশ্বাস করা যাবে না। তবে এখানে যেটা করা হয়েছে মেশিন লেভেলে আর কোনো কাজ নেই, আর ম্যানিপুলেশনের কোনো সুযোগ নেই।’ তাদের ওই মতের ওপর আস্থা রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তখনকার সিইসি হাবিবুল আউয়াল। ইভিএম সংক্রান্ত অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছে দুদকের তিন সদস্যের একটি দল, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াত। অভিযোগ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে নথিপত্র তলব করে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠিও পাঠিয়েছেন তিনি।
দুদকের হাতে আসা অভিযোগে বলা হয়েছে, নূরুল হুদার কমিশন ‘নিম্নমানের’ ইভিএম কেনায় রাষ্ট্রের প্রায় ৩ হাজার ১৭২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে
মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
‘জনগণের ভোট ছাড়া’ নির্বাচন সম্পন্ন করার মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদার বিরুদ্ধে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির’ একটি অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের হাতে আসা অভিযোগে বলা হয়েছে, নূরুল হুদা এবং তার সহযোগীরা ‘সমীক্ষা ছাড়াই’ প্রকল্প গ্রহণ করে, টেন্ডার ছাড়া এবং বাজার মূল্যের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দামে দেড় লাখ ‘নিম্নমানের’ ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনায় রাষ্ট্রের প্রায় ৩ হাজার ১৭২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া শেখ হাসিনার আমলে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ঘটনায় নূরুল হুদার সম্পৃক্ততা ছিল কিনা, তা নিয়েও অনুসন্ধান চলছে। এ অভিযোগে বলা হয়, তিনি ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে’ নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ওসি এবং স্থানীয় সংঘবদ্ধ চক্রের সহায়তায় আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নির্বাচনকে ‘প্রভাবিত’ করেছিলেন।
তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, র?্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান ও অন্যদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে দুদকের হাতে। সাবেক সচিব নূরুল হুদা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দেশের দ্বাদশ সিইসি। তার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস?্যরে কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের সব ভোট হয়। এ ইসির মেয়াদ শেষ হয় ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কিছু অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসব বিষয়ে অনুসন্ধান দলের সদস্যরা প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে পত্র পাঠিয়েছেন। তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডও সংগ্রহ করেছেন।
‘আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধান দল কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহের পর এবং অভিযোগ সংশ্লিষ্ট যারা দেশে অবস্থান করছেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সেসব বিচার বিশ্লেষণ করে অনুসন্ধান দল কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই কমিশন পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই পায় ২৫৭টি আসন।
সেবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া বিএনপি ও সমমনা দলগুলো পায় মাত্র সাতটি আসন। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে বিরোধীদের ভাষায় সে নির্বাচনের নাম হয় ‘নিশি রাতের নির্বাচন’। এ অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে প্রধান করে ৭ সদস্যের একটি দল গঠন করেছে দুদক।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, ওই নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়ম, যেমন ‘দিনের ভোট আগের রাতে’ করা, ব্যালট জালিয়াতি, কিছু কিছু কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি কাউন্ট দেখানো, ব্যাপক আর্থিক লেনদেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রার্থীকে জেতানো ইত্যাদি নানা অভিযোগ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং দুদকেও কিছু অভিযোগ জমা হয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন নথিপত্র তলব করে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু নথিপত্র দুদক হাতেও পেয়েছে।
এসব ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি মহানগর, জেলা, বিভাগীয়, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, যেমন পুলিশের আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, পুলিশের সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিক, তৎকালীন জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, জেলা প্রশাসক, জেলা রিটানিং কর্মকর্তা, বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জ ডিইজি, পুলিশ সুপার, থানার ওসি, জেলা/উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং অফিসারসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তার
‘যোগসাজশের’ কথা বলা হয়েছে দুদকের হাতে আসা অভিযোগে।
একাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল কে এম নুরুল হুদার কমিশনের অধীনে। সেই কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার বিদায় বেলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অস্তিত্ব ছিল না। যদিও সিইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে দাবি করেন।
‘জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সিটিং এমপিদের বিষয়ে তাদের নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা সম্ভব ছিল বলে মনে করি না। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এতেই বোঝা যায় নির্বাচন কেমন হয়েছে। এভাবে না-অবাধ, না-সুষ্ঠু, না-নিরপেক্ষ, না-আইনানুগ, না-গ্রহণযোগ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। সে অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই পরের তিনটি নির্বাচন হয়। প্রশ্নবিদ্ধ ওই তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। গতবছর ডিসেম্বরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল করে রায় দেয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর পথ তৈরি হয়।
অবাধ ও নিরপেক্ষতা ‘নিশ্চিত করতে না পারায়’ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিন জাতীয় নির্বাচনে ‘জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে’ বলে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয় ওই রায়ে।
বছর সাতেক আগে নির্বাচন কমিশনের কেনা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মান ঠিকঠাক ছিল কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করছে দুদক। তৎকালীন নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালে এক লাখ ৫০ হাজার ইভিএম কেনে। এর মধ্য এক লাখ ৫০০ মেশিন ব্যবহারের অনুপযোগী বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৬১৮টি ইভিএম রয়েছে ইসিতে। প্রায় ৮৬ হাজার রয়েছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ)। ১০ আঞ্চলিক কার্যালয়ে রয়েছে প্রায় ৬২ হাজার ইভিএম।
গত জানুয়ারিতে দুদকের এক অভিযানে ১ হাজার ৫৯৯টি মেশিনের কোনো হদিস না পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ডিজি আক্তার হোসেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, মেশিনগুলো ‘অযত্ন-অবহেলায়’ পড়ে রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে থাকা ৬১৮টি মেশিনের মধ্যে দৈব চয়নের ভিত্তিতে কয়েকটি মেশিনের ‘অপারেশনাল ক্যাপাসিটি’ যাচাই করে ত্রুটি দেখা গেছে, যা ‘নিম্নমানের মেশিন কেনার’ ইঙ্গিত দেয়। দুদক টিমের সঙ্গে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরাও মেশিনগুলো ‘মানসম্মত নয়’ বলে মত দেন।
এক যুগ আগে বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহারের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে তা নিয়ে চলছে বিতর্ক। আওয়ামী লীগ সরকার ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে থাকলেও তার ঘোরবিরোধী ছিল বিএনপি। দলটির নেতাদের ভাষ্য ছিল, যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণে ব্যাপক কারচুপির সুযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হলেও ২০২২ সালে দায়িত্ব নেয়া কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করে।
ওই বছরের মে মাসে অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এ কায়কোবাদসহ একদল প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞকে ইভিএম দেখিয়ে ভোটগ্রহণে তা ব্যবহারের সম্মতি নেয় ইসি। ইভিএমের কার্যক্রম দেখে ইসির সঙ্গে ২০২২ সালের ২৫ মে মতবিনিময়ের পর ভোটে যন্ত্রগুলো ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন জাফর ইকবাল ও কায়কোবাদ।
জাফর ইকবাল সেদিন বলেছিলেন, ‘ইভিএম নিয়ে ডেমনস্ট্রেশন পুরোটাই দেখেছি। তার ভেতরের খুঁটিনাটি, টেকনিক্যাল বিষয় যা আছে, তাও জেনে নিয়েছি। সবশেষ আমাদের জন্য রাখা মেশিনটি খুলে দেখেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কনভিন্সড হয়েছি। অত্যন্ত চমৎকার মেশিন।’ ইভিএমের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলকেও যন্ত্রটি ব্যবহারের পক্ষে সায় দেয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
আর বুয়েটের শিক্ষক কায়কোবাদ ইভিএমের প্রতি আস্থা রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘এর প্রতিটি অংশ এমনভাবে কাস্টমাইজড, একজন ইচ্ছে করলে সেখানে পরিবর্তন করতে পারবে না। ‘কোনো মেশিনকে শতভাগ বিশ্বাস করা যাবে না। তবে এখানে যেটা করা হয়েছে মেশিন লেভেলে আর কোনো কাজ নেই, আর ম্যানিপুলেশনের কোনো সুযোগ নেই।’ তাদের ওই মতের ওপর আস্থা রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তখনকার সিইসি হাবিবুল আউয়াল। ইভিএম সংক্রান্ত অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছে দুদকের তিন সদস্যের একটি দল, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াত। অভিযোগ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে নথিপত্র তলব করে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠিও পাঠিয়েছেন তিনি।