ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
সিলেট জেলার ছয়টির মধ্যে চারটি আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর সিলেট-২ আসন ছাড়া অন্য তিনটি আসনে বিএনপির মধ্যে অস্থিতরতা বিরাজ করছে। এরমধ্যে স্বস্তির আসন সিলেট-২-এর প্রার্থী নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর পত্নী তাহসিনা রুশদির লুনা এরইমধ্যে হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার জিয়ারতের মাধ্যেম নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। এ আসনটিতে যাতে বিরোধ দেখা না দেয়; এর আগেই আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ূন কবিরকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব পদ দিয়ে ‘পুরস্কৃত’ করা হয়।
আরিফুল হককে ঢাকায় তলব
আ’লীগের মতো সিলেট-৩ আসনে প্রবাসী প্রার্থী
সিলেট-৬ আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী নেই
স্বস্তিতে সিলেট-২ আসনে ইলিয়াসপত্নী লুনা
তবে সিলেট-১, সিলেট-৩ ও সিলেট-৬ আসনের প্রার্থী নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। সিলেট-১ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে নিজের জনপ্রিয়তার জানান দিচ্ছিলেন। তবে এ আসনে মনোনয়ন দেয়া হয় আরেক উপদেষ্টা খন্দকার মুক্তাদীরকে। অন্যদিকে সিলেট-৩ আসনে আওয়ামী লীগ আমলের মতো মনোনয়ন দেয়া হয় যুক্তরাজ্য প্রবাসী এবং সেখানকার বিএনপি সভাপতি এম এ মালিককে। তিনি বিগত আমলে ‘শেখ রেহানার মনোনীত প্রার্থী বা ব্যবসায়িক পার্টনার’ আনোয়ারুজ্জামান বা হাবিবুর রহমান হাবিবের মতোই হঠাৎ দেশে এসে মনোনয়ন পেয়ে যান। আর সিলেট-৬ আসনে যার কোনো নামই ছিল না; তিনিই পেলেন মনোনয়ন। সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী। সিলেট-১
সিলেট-১ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন সাবেক মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী। সম্প্রতি ঘটা করে শোডাউন দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করেছিলেন তিনি। দলের গ্রিন সিগন্যালের কথাও উঠেছিল আরিফ অনুসারীদের মুখে। সে সময় নীরব ছিলেন অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির আরেক উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। শোডাউন ও আনিুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা না দিয়েই নীরবে কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত দলও ভরসা রেখেছে তার ওপর। সিলেট-১ আসনে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরকে চূড়ান্ত করেছে দল।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে আরিফুল হক কয়েক দফায় আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। স্থানীয় পর্যায়ে সমর্থন জোগাড়েও ছিলেন বেশ সক্রিয়। তার ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছিলেন, নগরীর তৃণমূল বিএনপি ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আরিফুলের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি।
তবে শেষ পর্যন্ত দল বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের ওপরই আস্থা রেখেছে দল। মুক্তাদির ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। তিনি ওই নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে পরাজিত হন। তবে ভোটে কারচুপি ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে সে সময় ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন মুক্তাদির।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে পাওয়ায় সিলেট-১ আসনে বিএনপির সুযোগ তৈরি হয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থীও এ আসনে থাকলেও বরাবরই মূল আলোচনায় থাকেন বিএনপি প্রার্থীরা। এজন্যই এ আসন নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের দুই উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ও আরিফুল হক চৌধুরী সরব ছিলেন। দলীয় মনোনয়ন পেতে দুজনেই ছিলেন বেশ তৎপর। তবে আরিফ একাধিকবার দলের গ্রিন সিগন্যালের কথা বললেও নীরব ছিলেন মুক্তাদির।
এদিকে মুক্তাদিরকে প্রার্থী ঘোষণার পর আরিফুল হক চৌধুরীকে জরুরি তলবে ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়। আরিফুল হক চৌধুরী ফোনে জানান, ‘সংগঠনের কাজে ঢাকায় আছি। পরে বিস্তারিত জানাবো।’
দলের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আরিফুল হক চৌধুরীকে জরুরি আলোচনার জন্য ঢাকায় ডাকা হয়েছে। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে কিছুটা হতাশ হয়েছেন আরিফুল হক চৌধুরী। কারণ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, তিনি নিশ্চিত ছিলেন মনোনয়ন পাবেন।
এদিকে গতকাল সোমবার প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর রাতেই নগরীর কুমারপাড়াস্থ তার বাসায় দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভিড় জমে। অনেকেই প্রস্তাব করেন, সিলেট-৪ আসনে যেহেতু এখনও দল প্রার্থী ঘোষণা করেনি, তাই তিনি চাইলে সেখান থেকে প্রার্থী হতে পারেন। তবে আরিফুল হক চৌধুরী সে প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেন।
সিলেট-৩
এ আসনে বিগত আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও যুক্তরাজ্য প্রবাসীকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। একসময় এ আসনটি জাতীয় পার্টির দখলে থাকলেও পরবর্তীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই বড় দলের প্রার্থী এ আসনে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক দুই নির্বাচনে এ আসনের মনোনয়ন প্রক্রিয়া স্থানীয় নেতৃত্বের অবদানকে প্রায় পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের হাতে চলে গেছে।
চার বছর আগে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় নেতাদের পাশ কাটিয়ে মনোনয়ন দেয়া হয় প্রবাসী ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমানকে। স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন একেবারেই অপরিচিত মুখ। তখন এ পদক্ষেপটি রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। স্থানীয়পর্যায়ের নেতারা মনে করেছিলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে দলের কাজে নিয়োজিত থেকেও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন।
কিন্তু রাজনৈতিক কৌশল ও ঘনিষ্ঠ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেবার হাবিবুরের মনোনয়নটি নিশ্চিত হয়। সিলেট সিটির সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, শেখ রেহানার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এই আসনটি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাবিবুর রহমানকে উপহার দেন।
এ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ধারা এবার বিএনপিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। স্থানীয় নেতারা আশা করেছিলেন, দল তাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ ও কাজকে সম্মান জানাবে। কিন্তু সেই আশা আবারও ভেঙেছে। স্থানীয়দের পাশ কাটিয়ে মনোনয়ন পেলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী এম এ মালিক। তিনি যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এবং তারেক রহমানের ঘনিষ্টজন। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিতে তার অবদান নেতাকর্মীদের চোখে পড়েনি। এ আসনে দীর্ঘদিন ধরে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন
জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আব্দুল আহাদ জামালসহ অনেক স্থানীয় নেতা। তারা মনে করতেন, তাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ এবং এলাকার জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে তাদের প্রার্থী করা উচিত। কিন্তু ভাগ্য তাদের সঙ্গে ছিল না। তবে শেষ হাসি হাসলেন এম এ মালিক।
স্থানীয় নেতাদের ত্যাগ, দীর্ঘদিনের শ্রম ও জনসংযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে আওয়ামী লীগের মতো বিএনপি যুক্তরাজ্য প্রবাসীর ওপরই এ আসনটি ছেড়ে দিলো। এর আগে আওয়ামী লীগের মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী ও বিএনপির শফি আহমদ চৌধুরী এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই দুজনও ছিলেন প্রবাসী। তবে তারা স্থানীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন থেকে ব্যাপক সক্রিয় ছিলেন।
স্থানীয়দের মতে, সিলেট-৩ আসনে প্রবাসীদের মনোনয়ন দেয়া হয়ে থাকে মূলত দুই কারণে; প্রথমত, তাদের অর্থনৈতিক শক্তি ও রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক। দ্বিতীয়ত, দলীয় কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তাদের প্রভাবশালী অবস্থান। এ ধরনের প্রক্রিয়া স্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করছে এবং দলীয় একতাকে দুর্বল করছে বলে তৃণমূলের নেতারা মনে করেন।
স্থানীয় নেতারা মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় উপেক্ষিত হওয়ায় হতাশ। তাদের পরিচিত, দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতা বাদ পড়ায় স্থানীয় জনগণ বঞ্চিত বোধ করছেন। স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও ত্যাগী নেতাদের মতে, প্রবাসীদের মনোনয়ন দেয়া হলে দলের নীতি ও সংহতি দুর্বল হয়। এছাড়াও, তারা বলছেন, প্রবাসী প্রার্থীরা অনেক সময় স্থানীয় জনগণের সমস্যা ও প্রয়োজনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকেন না।
অন্যদিকে, প্রবাসী প্রার্থীরা সাধারণত বড় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে আসেন, যা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সিলেট-৩ আসনে এই প্রবণতা প্রমাণ করেছে, যে স্থানীয় নেতৃত্বকে অনেক সময় তুচ্ছ মনে করা হয় এবং প্রার্থীদের নির্বাচন কেন্দ্রীয় প্রভাব ও অর্থনৈতিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে।
সিলেট-৬
সিলেট-৬ আসনটিকে অন্যরকমভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রয়াত ড. সৈয়দ মকবুল হাসেন। এছাড়া দুটি উপজেলা মিলিয়ে গঠিত এ আসনের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান অনেকটা মজবুত। এ আসনে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় নেতা মো. সেলিম উদ্দিনকে। কিছুদিন আগে আরেক উপজেলা বিয়ানীবাজারে তার সমর্থনে বিশাল শোডাউন হয়। তিনি শক্তিশালী একজন প্রার্থী হিসেবে স্থানীয়রা মে করছেন। এ আসনে দীর্ঘদিন ধরে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন ফয়সল আহমদ চৌধুরী (গতবার মনোনয়ন পেয়েছিলেন), জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কাহের শামীম। প্রতিদিন তাদের গণসংযােগ বা সভায় শত শত নেতাকর্মী উপস্থিত থাকেন। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে এক মনোনয়ন পাওয়ার তালিকায় ছিলেন হেভিওয়েট হিসেবে ফয়সল আহমদ চৌধুরী। এরপর আবুল কাহের শামীম। তবে এ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয় জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরীকে। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াও চমকের মতো মনে হচ্ছে।
সিলেট-২
সিলেট-২ আসনে মাঝখানে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। বলা হচ্ছিল, হঠাৎ করে যুক্তরাজ্য থেকে আসা তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ূন কবিরকে প্রার্থী করা হবে। ফলে নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম এ ইলিয়াস আলীর পত্নী তাহসিনা রুশদির লুনার সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। একপর্যায়ে হুমায়ূন কবিরকে দলের যুগ্ম মহাসচিব পদ দিয়ে ‘পুরস্কৃত’ করা হয়। ফলে অনেকটা স্বস্থি নেমে আসে। আর মনোনয়ন পান ইলিয়াস পত্নী লুনা। তাকে অভিনন্দনও জানিয়েছেন হুমায়ূন কবির। ফলে স্বস্তিতে থেকে হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে তিনি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। মঙ্গলবার,(০৪ নভেম্বর ২০২৫) সকালে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলা বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের নেতারা।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫
সিলেট জেলার ছয়টির মধ্যে চারটি আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর সিলেট-২ আসন ছাড়া অন্য তিনটি আসনে বিএনপির মধ্যে অস্থিতরতা বিরাজ করছে। এরমধ্যে স্বস্তির আসন সিলেট-২-এর প্রার্থী নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর পত্নী তাহসিনা রুশদির লুনা এরইমধ্যে হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার জিয়ারতের মাধ্যেম নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। এ আসনটিতে যাতে বিরোধ দেখা না দেয়; এর আগেই আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ূন কবিরকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব পদ দিয়ে ‘পুরস্কৃত’ করা হয়।
আরিফুল হককে ঢাকায় তলব
আ’লীগের মতো সিলেট-৩ আসনে প্রবাসী প্রার্থী
সিলেট-৬ আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী নেই
স্বস্তিতে সিলেট-২ আসনে ইলিয়াসপত্নী লুনা
তবে সিলেট-১, সিলেট-৩ ও সিলেট-৬ আসনের প্রার্থী নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। সিলেট-১ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে নিজের জনপ্রিয়তার জানান দিচ্ছিলেন। তবে এ আসনে মনোনয়ন দেয়া হয় আরেক উপদেষ্টা খন্দকার মুক্তাদীরকে। অন্যদিকে সিলেট-৩ আসনে আওয়ামী লীগ আমলের মতো মনোনয়ন দেয়া হয় যুক্তরাজ্য প্রবাসী এবং সেখানকার বিএনপি সভাপতি এম এ মালিককে। তিনি বিগত আমলে ‘শেখ রেহানার মনোনীত প্রার্থী বা ব্যবসায়িক পার্টনার’ আনোয়ারুজ্জামান বা হাবিবুর রহমান হাবিবের মতোই হঠাৎ দেশে এসে মনোনয়ন পেয়ে যান। আর সিলেট-৬ আসনে যার কোনো নামই ছিল না; তিনিই পেলেন মনোনয়ন। সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী। সিলেট-১
সিলেট-১ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন সাবেক মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী। সম্প্রতি ঘটা করে শোডাউন দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করেছিলেন তিনি। দলের গ্রিন সিগন্যালের কথাও উঠেছিল আরিফ অনুসারীদের মুখে। সে সময় নীরব ছিলেন অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির আরেক উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। শোডাউন ও আনিুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা না দিয়েই নীরবে কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত দলও ভরসা রেখেছে তার ওপর। সিলেট-১ আসনে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরকে চূড়ান্ত করেছে দল।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে আরিফুল হক কয়েক দফায় আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। স্থানীয় পর্যায়ে সমর্থন জোগাড়েও ছিলেন বেশ সক্রিয়। তার ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছিলেন, নগরীর তৃণমূল বিএনপি ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আরিফুলের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি।
তবে শেষ পর্যন্ত দল বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের ওপরই আস্থা রেখেছে দল। মুক্তাদির ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। তিনি ওই নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে পরাজিত হন। তবে ভোটে কারচুপি ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে সে সময় ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন মুক্তাদির।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে পাওয়ায় সিলেট-১ আসনে বিএনপির সুযোগ তৈরি হয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থীও এ আসনে থাকলেও বরাবরই মূল আলোচনায় থাকেন বিএনপি প্রার্থীরা। এজন্যই এ আসন নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের দুই উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ও আরিফুল হক চৌধুরী সরব ছিলেন। দলীয় মনোনয়ন পেতে দুজনেই ছিলেন বেশ তৎপর। তবে আরিফ একাধিকবার দলের গ্রিন সিগন্যালের কথা বললেও নীরব ছিলেন মুক্তাদির।
এদিকে মুক্তাদিরকে প্রার্থী ঘোষণার পর আরিফুল হক চৌধুরীকে জরুরি তলবে ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়। আরিফুল হক চৌধুরী ফোনে জানান, ‘সংগঠনের কাজে ঢাকায় আছি। পরে বিস্তারিত জানাবো।’
দলের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আরিফুল হক চৌধুরীকে জরুরি আলোচনার জন্য ঢাকায় ডাকা হয়েছে। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে কিছুটা হতাশ হয়েছেন আরিফুল হক চৌধুরী। কারণ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, তিনি নিশ্চিত ছিলেন মনোনয়ন পাবেন।
এদিকে গতকাল সোমবার প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর রাতেই নগরীর কুমারপাড়াস্থ তার বাসায় দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভিড় জমে। অনেকেই প্রস্তাব করেন, সিলেট-৪ আসনে যেহেতু এখনও দল প্রার্থী ঘোষণা করেনি, তাই তিনি চাইলে সেখান থেকে প্রার্থী হতে পারেন। তবে আরিফুল হক চৌধুরী সে প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেন।
সিলেট-৩
এ আসনে বিগত আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও যুক্তরাজ্য প্রবাসীকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। একসময় এ আসনটি জাতীয় পার্টির দখলে থাকলেও পরবর্তীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই বড় দলের প্রার্থী এ আসনে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক দুই নির্বাচনে এ আসনের মনোনয়ন প্রক্রিয়া স্থানীয় নেতৃত্বের অবদানকে প্রায় পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের হাতে চলে গেছে।
চার বছর আগে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় নেতাদের পাশ কাটিয়ে মনোনয়ন দেয়া হয় প্রবাসী ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমানকে। স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন একেবারেই অপরিচিত মুখ। তখন এ পদক্ষেপটি রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। স্থানীয়পর্যায়ের নেতারা মনে করেছিলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে দলের কাজে নিয়োজিত থেকেও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন।
কিন্তু রাজনৈতিক কৌশল ও ঘনিষ্ঠ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেবার হাবিবুরের মনোনয়নটি নিশ্চিত হয়। সিলেট সিটির সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, শেখ রেহানার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এই আসনটি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাবিবুর রহমানকে উপহার দেন।
এ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ধারা এবার বিএনপিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। স্থানীয় নেতারা আশা করেছিলেন, দল তাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ ও কাজকে সম্মান জানাবে। কিন্তু সেই আশা আবারও ভেঙেছে। স্থানীয়দের পাশ কাটিয়ে মনোনয়ন পেলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী এম এ মালিক। তিনি যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এবং তারেক রহমানের ঘনিষ্টজন। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিতে তার অবদান নেতাকর্মীদের চোখে পড়েনি। এ আসনে দীর্ঘদিন ধরে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন
জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আব্দুল আহাদ জামালসহ অনেক স্থানীয় নেতা। তারা মনে করতেন, তাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ এবং এলাকার জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে তাদের প্রার্থী করা উচিত। কিন্তু ভাগ্য তাদের সঙ্গে ছিল না। তবে শেষ হাসি হাসলেন এম এ মালিক।
স্থানীয় নেতাদের ত্যাগ, দীর্ঘদিনের শ্রম ও জনসংযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে আওয়ামী লীগের মতো বিএনপি যুক্তরাজ্য প্রবাসীর ওপরই এ আসনটি ছেড়ে দিলো। এর আগে আওয়ামী লীগের মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী ও বিএনপির শফি আহমদ চৌধুরী এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই দুজনও ছিলেন প্রবাসী। তবে তারা স্থানীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন থেকে ব্যাপক সক্রিয় ছিলেন।
স্থানীয়দের মতে, সিলেট-৩ আসনে প্রবাসীদের মনোনয়ন দেয়া হয়ে থাকে মূলত দুই কারণে; প্রথমত, তাদের অর্থনৈতিক শক্তি ও রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক। দ্বিতীয়ত, দলীয় কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তাদের প্রভাবশালী অবস্থান। এ ধরনের প্রক্রিয়া স্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করছে এবং দলীয় একতাকে দুর্বল করছে বলে তৃণমূলের নেতারা মনে করেন।
স্থানীয় নেতারা মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় উপেক্ষিত হওয়ায় হতাশ। তাদের পরিচিত, দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতা বাদ পড়ায় স্থানীয় জনগণ বঞ্চিত বোধ করছেন। স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও ত্যাগী নেতাদের মতে, প্রবাসীদের মনোনয়ন দেয়া হলে দলের নীতি ও সংহতি দুর্বল হয়। এছাড়াও, তারা বলছেন, প্রবাসী প্রার্থীরা অনেক সময় স্থানীয় জনগণের সমস্যা ও প্রয়োজনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকেন না।
অন্যদিকে, প্রবাসী প্রার্থীরা সাধারণত বড় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে আসেন, যা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সিলেট-৩ আসনে এই প্রবণতা প্রমাণ করেছে, যে স্থানীয় নেতৃত্বকে অনেক সময় তুচ্ছ মনে করা হয় এবং প্রার্থীদের নির্বাচন কেন্দ্রীয় প্রভাব ও অর্থনৈতিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে।
সিলেট-৬
সিলেট-৬ আসনটিকে অন্যরকমভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রয়াত ড. সৈয়দ মকবুল হাসেন। এছাড়া দুটি উপজেলা মিলিয়ে গঠিত এ আসনের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান অনেকটা মজবুত। এ আসনে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় নেতা মো. সেলিম উদ্দিনকে। কিছুদিন আগে আরেক উপজেলা বিয়ানীবাজারে তার সমর্থনে বিশাল শোডাউন হয়। তিনি শক্তিশালী একজন প্রার্থী হিসেবে স্থানীয়রা মে করছেন। এ আসনে দীর্ঘদিন ধরে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন ফয়সল আহমদ চৌধুরী (গতবার মনোনয়ন পেয়েছিলেন), জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কাহের শামীম। প্রতিদিন তাদের গণসংযােগ বা সভায় শত শত নেতাকর্মী উপস্থিত থাকেন। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে এক মনোনয়ন পাওয়ার তালিকায় ছিলেন হেভিওয়েট হিসেবে ফয়সল আহমদ চৌধুরী। এরপর আবুল কাহের শামীম। তবে এ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয় জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরীকে। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াও চমকের মতো মনে হচ্ছে।
সিলেট-২
সিলেট-২ আসনে মাঝখানে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। বলা হচ্ছিল, হঠাৎ করে যুক্তরাজ্য থেকে আসা তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ূন কবিরকে প্রার্থী করা হবে। ফলে নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম এ ইলিয়াস আলীর পত্নী তাহসিনা রুশদির লুনার সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। একপর্যায়ে হুমায়ূন কবিরকে দলের যুগ্ম মহাসচিব পদ দিয়ে ‘পুরস্কৃত’ করা হয়। ফলে অনেকটা স্বস্থি নেমে আসে। আর মনোনয়ন পান ইলিয়াস পত্নী লুনা। তাকে অভিনন্দনও জানিয়েছেন হুমায়ূন কবির। ফলে স্বস্তিতে থেকে হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে তিনি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। মঙ্গলবার,(০৪ নভেম্বর ২০২৫) সকালে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলা বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের নেতারা।