মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
বাল্যবিয়ে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর গভীরে প্রোথিত একটি গুরুতর সমস্যা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে চলেছে। আইনগতভাবে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ে এবং ২১ বছরের কম বয়সী ছেলের বিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও, দেশের গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত এর চিত্র হতাশাজনক। আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন ইউনিসেফ এবং ইউএনএফপিএ-এর তথ্য অনুযায়ী, বাল্যবিবাহের হারে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থানে রয়েছে, যা আমাদের সামাজিক সচেতনতার অভাব এবং আইনের দুর্বল বাস্তবায়নের দিকেই ইঙ্গিত করে। এই প্রথা কেবল একটি সামাজিক ত্রুটি নয়, এটি অপরিণত বয়সের ছেলেমেয়েদের, বিশেষত মেয়েদের, মৌলিক অধিকার, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাজীবনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বাল্যবিবাহের বিস্তারের পেছনে রয়েছে বহু জটিল ও আন্তঃসম্পর্কিত কারণ। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো দারিদ্র। বহু দরিদ্র পরিবারে মেয়েকে একটি অর্থনৈতিক বোঝা হিসেবে দেখা হয় এবং যৌতুকের ভয় বা ভরণপোষণের দায়ভার থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে অল্প বয়সেই তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া, শিক্ষার অভাব একটি বড় ভূমিকা পালন করে; যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি, সেখানে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নেই। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, বিশেষ করে ইভটিজিং বা যৌন হয়রানির ভয়, অনেক অভিভাবককে বাধ্য করে মেয়ের ‘সম্মান’ রক্ষার্থে দ্রুত তার বিয়ে দিতে। পাশাপাশি, পুরনো সামাজিক কুসংস্কার, প্রথা ও লিঙ্গ বৈষম্য-যেখানে মেয়েকে পরগাছা বা অন্যের সম্পত্তি মনে করা হয়-এই প্রথাকে জিইয়ে রাখে। এই সমস্ত কারণ একত্রিত হয়ে সমাজের নিম্নবর্গীয় অংশকে বাল্যবিবাহের দিকে ঠেলে দেয়।
এই অভিশাপের ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং মারাত্মক। বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীরা প্রায়শই শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোগে। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার বাড়ে, জন্ম নেওয়া শিশুরাও অপুষ্টি ও স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মায়। অল্পবয়সী মায়েরা সাধারণত দুর্বল পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে অজ্ঞতার শিকার হন। শিক্ষাজীবন অকালে শেষ হয়ে যাওয়ায় এই মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থেকে যায়, তাদের দক্ষতা বিকাশের পথ রুদ্ধ হয় এবং তারা আরও বেশি দারিদ্রের শিকার হয়। দাম্পত্য জীবনেও তারা প্রায়শই পারিবারিক সহিংসতা, নির্যাতন ও কলহের শিকার হয়, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং বিবাহবিচ্ছেদের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এভাবে বাল্যবিয়ে কেবল ব্যক্তিজীবনের ক্ষতি করে না, বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবসম্পদ এবং সার্বিক সামাজিক স্থিতিশীলতার পথেও বাধা সৃষ্টি করে।
এই মারাত্মক সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সমন্বিত ও বহুমুখী পদক্ষেপ অপরিহার্য। প্রথমত, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-এর যথাযথ ও কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে কাজী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং প্রয়োজনে শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বাল্যবিবাহের কুফল, মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এবং নারীশিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে প্রচার-প্রচারণা জোরদার করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, নারীশিক্ষা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। মেয়েদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখতে হবে এবং তাদের কারিগরি ও জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। দারিদ্র?্য দূরীকরণে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হবে। স্থানীয় সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকর্মী ও ধর্মীয় নেতাসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া বাল্যবিবাহের মতো পুরোনো প্রথাকে নির্মূল করা সম্ভব নয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমেই কেবল একটি বাল্যবিয়েমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যেখানে প্রতিটি শিশু তার শৈশব ও সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারবে।
জান্নাতুল ফেরদৌস জেরিন
ঢাকা
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫
বাল্যবিয়ে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর গভীরে প্রোথিত একটি গুরুতর সমস্যা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে চলেছে। আইনগতভাবে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ে এবং ২১ বছরের কম বয়সী ছেলের বিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও, দেশের গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত এর চিত্র হতাশাজনক। আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন ইউনিসেফ এবং ইউএনএফপিএ-এর তথ্য অনুযায়ী, বাল্যবিবাহের হারে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থানে রয়েছে, যা আমাদের সামাজিক সচেতনতার অভাব এবং আইনের দুর্বল বাস্তবায়নের দিকেই ইঙ্গিত করে। এই প্রথা কেবল একটি সামাজিক ত্রুটি নয়, এটি অপরিণত বয়সের ছেলেমেয়েদের, বিশেষত মেয়েদের, মৌলিক অধিকার, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাজীবনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বাল্যবিবাহের বিস্তারের পেছনে রয়েছে বহু জটিল ও আন্তঃসম্পর্কিত কারণ। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো দারিদ্র। বহু দরিদ্র পরিবারে মেয়েকে একটি অর্থনৈতিক বোঝা হিসেবে দেখা হয় এবং যৌতুকের ভয় বা ভরণপোষণের দায়ভার থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে অল্প বয়সেই তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া, শিক্ষার অভাব একটি বড় ভূমিকা পালন করে; যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি, সেখানে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নেই। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, বিশেষ করে ইভটিজিং বা যৌন হয়রানির ভয়, অনেক অভিভাবককে বাধ্য করে মেয়ের ‘সম্মান’ রক্ষার্থে দ্রুত তার বিয়ে দিতে। পাশাপাশি, পুরনো সামাজিক কুসংস্কার, প্রথা ও লিঙ্গ বৈষম্য-যেখানে মেয়েকে পরগাছা বা অন্যের সম্পত্তি মনে করা হয়-এই প্রথাকে জিইয়ে রাখে। এই সমস্ত কারণ একত্রিত হয়ে সমাজের নিম্নবর্গীয় অংশকে বাল্যবিবাহের দিকে ঠেলে দেয়।
এই অভিশাপের ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং মারাত্মক। বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীরা প্রায়শই শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোগে। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার বাড়ে, জন্ম নেওয়া শিশুরাও অপুষ্টি ও স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মায়। অল্পবয়সী মায়েরা সাধারণত দুর্বল পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে অজ্ঞতার শিকার হন। শিক্ষাজীবন অকালে শেষ হয়ে যাওয়ায় এই মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থেকে যায়, তাদের দক্ষতা বিকাশের পথ রুদ্ধ হয় এবং তারা আরও বেশি দারিদ্রের শিকার হয়। দাম্পত্য জীবনেও তারা প্রায়শই পারিবারিক সহিংসতা, নির্যাতন ও কলহের শিকার হয়, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং বিবাহবিচ্ছেদের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এভাবে বাল্যবিয়ে কেবল ব্যক্তিজীবনের ক্ষতি করে না, বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবসম্পদ এবং সার্বিক সামাজিক স্থিতিশীলতার পথেও বাধা সৃষ্টি করে।
এই মারাত্মক সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সমন্বিত ও বহুমুখী পদক্ষেপ অপরিহার্য। প্রথমত, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-এর যথাযথ ও কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে কাজী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং প্রয়োজনে শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বাল্যবিবাহের কুফল, মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এবং নারীশিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে প্রচার-প্রচারণা জোরদার করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, নারীশিক্ষা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। মেয়েদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখতে হবে এবং তাদের কারিগরি ও জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। দারিদ্র?্য দূরীকরণে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হবে। স্থানীয় সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকর্মী ও ধর্মীয় নেতাসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া বাল্যবিবাহের মতো পুরোনো প্রথাকে নির্মূল করা সম্ভব নয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমেই কেবল একটি বাল্যবিয়েমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যেখানে প্রতিটি শিশু তার শৈশব ও সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারবে।
জান্নাতুল ফেরদৌস জেরিন
ঢাকা