মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
শিক্ষা মানুষের জন্মগত অধিকার। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে চেয়েছে, উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে। দীর্ঘদিন শিক্ষার ধারণা ছিল শ্রেণিকক্ষ, পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মুখোমুখি উপস্থিতি। কিন্তু প্রযুক্তি আজ সেই চার দেয়াল ভেঙে দিয়েছে। কম্পিউটার, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিক্ষাকে নিয়ে এসেছে নতুন এক দিগন্তে, যার নাম ই-লার্নিং। এটি এমন এক শিক্ষা, যার নেই কোনো সীমান্ত, নেই কোনো ভৌগোলিক বাধা।
ভাবুন, দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের এক কিশোর স্মার্টফোন হাতে বসে শিখছে পদার্থবিজ্ঞান বা ইংরেজি ভাষা; আর রাজধানীর এক ছাত্রী অনলাইনে যোগ দিচ্ছে বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারে। একসময় যা কল্পনার বিষয় ছিল, আজ তা বাস্তব। ই-লার্নিংয়ের কল্যাণে শহর-গ্রাম, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ-সবার জন্য জ্ঞানের দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। এভাবেই শিক্ষা আরও গণতান্ত্রিক ও সহজলভ্য হয়ে উঠছে।
ই-লার্নিংয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো স্বাধীনতা ও নমনীয়তা। প্রচলিত শ্রেণিকক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্লাস করতে হয়, কিন্তু অনলাইনে শিক্ষার্থী নিজের সুবিধামতো সময় বেছে নিতে পারে। ভোরের আলোতে বা রাতের নিস্তব্ধতায়-যখন ইচ্ছা শেখা সম্ভব। কোনো বিষয় ভালোভাবে না বোঝা গেলে বারবার দেখা যায়, আর যে বিষয় সহজ মনে হয় তা দ্রুত শেষ করা যায়। ফলে শেখার অভিজ্ঞতা হয় গভীর, আত্মবিশ্বাসী ও আনন্দময়।
এটি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, কর্মজীবীদের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান পৃথিবীতে কর্মক্ষেত্র দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি আসছে, নতুন দক্ষতার চাহিদা তৈরি হচ্ছে। টিকে থাকতে হলে সারাজীবন শিখতে হবে। অনলাইন শিক্ষা সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। ঘরে বসে বা অফিসের বিরতিতে অনলাইনে কোর্স করে মানুষ নতুন দক্ষতা অর্জন করছে, নিজেদের উন্নত করছে। এটিই হলো আজীবন শেখার পথ, যা ভবিষ্যতের সমাজকে আরও জ্ঞানভিত্তিক ও সক্ষম করবে।
তবে এ শিক্ষার কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ডিজিটাল বিভাজন। দেশের অনেক গ্রামে ইন্টারনেটের গতি দুর্বল, স্মার্টফোন বা কম্পিউটার নেই, বিদ্যুতের ঘাটতিও আছে। ফলে সবার কাছে সমানভাবে ই-লার্নিং পৌঁছায় না। অনলাইন শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সরাসরি সম্পর্ক কিছুটা কমে যায়। সেই আন্তরিক আলাপ, মানবিক বন্ধন বা ক্লাসরুমের পরিবেশ অনলাইনে পাওয়া কঠিন। অনেক শিক্ষার্থী আত্মনিয়ন্ত্রণে দুর্বল হয়ে একা পড়াশোনায় আগ্রহ ধরে রাখতে পারে না। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন সঠিক নীতি, মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন।
ভবিষ্যতের ই-লার্নিং আরও আধুনিক ও বিস্ময়কর হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষার্থীর প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠ সাজিয়ে দেবে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ক্লাসরুমে শিক্ষার্থী ইতিহাস শিখবে যেন সরাসরি সেই ঘটনার ভেতরে উপস্থিত। গেমিফিকেশন পড়াশোনাকে আনন্দদায়ক করে তুলবে, যেখানে খেলার ছলেই হবে শেখা। ইতোমধ্যে এসবের অনেক কিছুই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়ে গেছে। তবে প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, আমাদের মনে রাখতে হবে-শিক্ষা শুধু তথ্য অর্জনের মাধ্যম নয়। শিক্ষা হলো মানুষ তৈরি করার প্রক্রিয়া। নৈতিকতা, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধও সমানভাবে শিক্ষা দিতে হবে।
আজ ই-লার্নিং নতুন এক ভোরের আলো। এটি শুধুই একটি শিক্ষাপদ্ধতি নয়, বরং আগামী প্রজন্মের জন্য এক নতুন দিগন্ত, এক সীমাহীন সম্ভাবনা। যে জাতি এই আলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারবে, সেই জাতিই তৈরি করবে দক্ষ মানবসম্পদ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও উন্নত ভবিষ্যৎ। এখনই সময় ভাবার-শিক্ষা যেন কেবল শহরের কোলাহলে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং পৌঁছে যাক গ্রামের অন্ধকার ঘরে, যেন প্রতিটি শিশুর চোখে জ্বলে ওঠে স্বপ্নের আলো। ই-লার্নিং সেই স্বপ্ন পূরণের সেতুবন্ধন। ভবিষ্যতের শ্রেণিকক্ষ হবে সমগ্র পৃথিবী, আর প্রতিটি শিক্ষার্থী হবে বিশ্বমানব।
সাদিয়া আফরিন
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
শিক্ষা মানুষের জন্মগত অধিকার। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে চেয়েছে, উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে। দীর্ঘদিন শিক্ষার ধারণা ছিল শ্রেণিকক্ষ, পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মুখোমুখি উপস্থিতি। কিন্তু প্রযুক্তি আজ সেই চার দেয়াল ভেঙে দিয়েছে। কম্পিউটার, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিক্ষাকে নিয়ে এসেছে নতুন এক দিগন্তে, যার নাম ই-লার্নিং। এটি এমন এক শিক্ষা, যার নেই কোনো সীমান্ত, নেই কোনো ভৌগোলিক বাধা।
ভাবুন, দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের এক কিশোর স্মার্টফোন হাতে বসে শিখছে পদার্থবিজ্ঞান বা ইংরেজি ভাষা; আর রাজধানীর এক ছাত্রী অনলাইনে যোগ দিচ্ছে বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারে। একসময় যা কল্পনার বিষয় ছিল, আজ তা বাস্তব। ই-লার্নিংয়ের কল্যাণে শহর-গ্রাম, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ-সবার জন্য জ্ঞানের দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। এভাবেই শিক্ষা আরও গণতান্ত্রিক ও সহজলভ্য হয়ে উঠছে।
ই-লার্নিংয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো স্বাধীনতা ও নমনীয়তা। প্রচলিত শ্রেণিকক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্লাস করতে হয়, কিন্তু অনলাইনে শিক্ষার্থী নিজের সুবিধামতো সময় বেছে নিতে পারে। ভোরের আলোতে বা রাতের নিস্তব্ধতায়-যখন ইচ্ছা শেখা সম্ভব। কোনো বিষয় ভালোভাবে না বোঝা গেলে বারবার দেখা যায়, আর যে বিষয় সহজ মনে হয় তা দ্রুত শেষ করা যায়। ফলে শেখার অভিজ্ঞতা হয় গভীর, আত্মবিশ্বাসী ও আনন্দময়।
এটি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, কর্মজীবীদের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান পৃথিবীতে কর্মক্ষেত্র দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি আসছে, নতুন দক্ষতার চাহিদা তৈরি হচ্ছে। টিকে থাকতে হলে সারাজীবন শিখতে হবে। অনলাইন শিক্ষা সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। ঘরে বসে বা অফিসের বিরতিতে অনলাইনে কোর্স করে মানুষ নতুন দক্ষতা অর্জন করছে, নিজেদের উন্নত করছে। এটিই হলো আজীবন শেখার পথ, যা ভবিষ্যতের সমাজকে আরও জ্ঞানভিত্তিক ও সক্ষম করবে।
তবে এ শিক্ষার কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ডিজিটাল বিভাজন। দেশের অনেক গ্রামে ইন্টারনেটের গতি দুর্বল, স্মার্টফোন বা কম্পিউটার নেই, বিদ্যুতের ঘাটতিও আছে। ফলে সবার কাছে সমানভাবে ই-লার্নিং পৌঁছায় না। অনলাইন শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সরাসরি সম্পর্ক কিছুটা কমে যায়। সেই আন্তরিক আলাপ, মানবিক বন্ধন বা ক্লাসরুমের পরিবেশ অনলাইনে পাওয়া কঠিন। অনেক শিক্ষার্থী আত্মনিয়ন্ত্রণে দুর্বল হয়ে একা পড়াশোনায় আগ্রহ ধরে রাখতে পারে না। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন সঠিক নীতি, মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন।
ভবিষ্যতের ই-লার্নিং আরও আধুনিক ও বিস্ময়কর হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষার্থীর প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠ সাজিয়ে দেবে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ক্লাসরুমে শিক্ষার্থী ইতিহাস শিখবে যেন সরাসরি সেই ঘটনার ভেতরে উপস্থিত। গেমিফিকেশন পড়াশোনাকে আনন্দদায়ক করে তুলবে, যেখানে খেলার ছলেই হবে শেখা। ইতোমধ্যে এসবের অনেক কিছুই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়ে গেছে। তবে প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, আমাদের মনে রাখতে হবে-শিক্ষা শুধু তথ্য অর্জনের মাধ্যম নয়। শিক্ষা হলো মানুষ তৈরি করার প্রক্রিয়া। নৈতিকতা, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধও সমানভাবে শিক্ষা দিতে হবে।
আজ ই-লার্নিং নতুন এক ভোরের আলো। এটি শুধুই একটি শিক্ষাপদ্ধতি নয়, বরং আগামী প্রজন্মের জন্য এক নতুন দিগন্ত, এক সীমাহীন সম্ভাবনা। যে জাতি এই আলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারবে, সেই জাতিই তৈরি করবে দক্ষ মানবসম্পদ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও উন্নত ভবিষ্যৎ। এখনই সময় ভাবার-শিক্ষা যেন কেবল শহরের কোলাহলে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং পৌঁছে যাক গ্রামের অন্ধকার ঘরে, যেন প্রতিটি শিশুর চোখে জ্বলে ওঠে স্বপ্নের আলো। ই-লার্নিং সেই স্বপ্ন পূরণের সেতুবন্ধন। ভবিষ্যতের শ্রেণিকক্ষ হবে সমগ্র পৃথিবী, আর প্রতিটি শিক্ষার্থী হবে বিশ্বমানব।
সাদিয়া আফরিন