মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
মানুষ গড়ার কারিগররাই আজ গভীর হতাশায় নিমজ্জিত। প্রাথমিক শিক্ষা যে কোনো জাতির ভবিষ্যতের মূল ভিত্তি। একটি শিশু যখন প্রথম বিদ্যালয়ে যায়, তখন থেকেই তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শেখার যাত্রা শুরু হয়। এই সময়েই তাকে শেখানো হয় -কীভাবে চিন্তা করতে হয়, ভবিষ্যতের স্বপ্ন গড়তে হয় এবং সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পেতে হয়। আর এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন প্রাথমিক শিক্ষকরা। কিন্তু আজ বাস্তবতা হলো, এই মানুষ গড়ার কারিগররাই চরম বঞ্চনা ও অবহেলার অন্ধকারে আটকে আছেন।
সরকার প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ-এতে সন্দেহ নেই। শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলছে, নতুন ভবন ও আধুনিক শ্রেণিকক্ষ নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-শুধু অবকাঠামো নির্মাণ আর প্রশিক্ষণে বিপুল অর্থ ব্যয়ে কি শিক্ষার মান বাড়ে? যদি শিক্ষক নিজেই মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন, তাঁর মনে যদি জমে ওঠে ক্ষোভ, তবে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কতটা কার্যকরভাবে তিনি শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করতে পারবেন? বাস্তব সমস্যাগুলো সামনে এনে এই প্রশ্নগুলো আরও জোরালো হয়ে ওঠছে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের বঞ্চনার সবচেয়ে স্পষ্ট চিত্র হলো একই মন্ত্রণালয়ে দুই ধরনের বেতন কাঠামো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রিধারী এবং জাতীয় কারিকুলাম পড়ান, অথচ তাঁরা পান ত্রয়োদশ গ্রেড, যা সাধারণত এসএসসি বা এইচএসসি পাস তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের গ্রেড। অন্যদিকে, একই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পাচ্ছেন দশম গ্রেড। একই কাজ, একই যোগ্যতা, একই প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে এমন বৈষম্য কি ন্যায়সংগত? আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি এই বৈষম্য শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। শিক্ষকের আত্মমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হলে তাঁর পেশার প্রতি আগ্রহ কমে যায়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পদোন্নতির স্থবিরতা। দীর্ঘদিন ধরে বিভাগীয় পদোন্নতি বন্ধ, প্রাপ্য টাইমস্কেল-১০ ও ১৬ বছরের সুবিধা-না পাওয়ায় শিক্ষকরা এক স্থবির জীবনে ঠেলে পড়েছেন। বছরের পর বছর একই পদে, একই বেতনে কাজ করতে করতে তাঁদের মনে জমেছে গভীর হতাশা। বর্তমানে পদোন্নতি-সংক্রান্ত মামলা হাইকোর্টে চলমান থাকায় বিষয়টি আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সরকার একটু নজর দিলেই এই অচলাবস্থা দূর করা সম্ভব। কিন্তু যতদিন এভাবে অস্থিরতা ও ক্ষোভের পরিবেশ বজায় থাকবে, ততদিন শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার গতি বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে। শিক্ষক যদি নিজেই বঞ্চনার শিকার হন, তবে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে পেশার প্রতি শ্রদ্ধা ও দেশগড়ার স্বপ্ন বোনা তাঁর পক্ষে কেন কঠিন হবে না?
শিক্ষক সংকট ও শিক্ষা উপকরণের অভাবও প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় বাধা। অনেক স্কুলে অনুমোদিত পদের তুলনায় শিক্ষক কম থাকায় একজন শিক্ষককে একাধিক শ্রেণির ক্লাস নিতে হয়। এতে কোনো শ্রেণিই শিক্ষকের পূর্ণ মনোযোগ পায় না। আধুনিক শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় চার্ট, মডেল, খেলাধুলাভিত্তিক উপকরণ ও ডিজিটাল সামগ্রী অনেক স্কুলেই অপ্রতুল। ফলে প্রশিক্ষণে শেখা আধুনিক পদ্ধতি বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ ক্ষেত্রেও অভিভাবকের সচেতনতার ঘাটতি একটি বড় সমস্যা। অর্থনৈতিক চাপ, শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অনীহা বা অজ্ঞতা-সব মিলিয়ে অনেক অভিভাবকই সন্তানের পড়াশোনায় পর্যাপ্ত মনোযোগ দেন না। শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, হোমওয়ার্ক তদারকি করা, স্কুলের নিয়ম মেনে চলা-এসব ক্ষেত্রে অনেকেই পিছিয়ে পড়েন। ফলে শিক্ষার মানোন্নয়ন একটি অসম্পূর্ণ প্রচেষ্টায় পরিণত হয়।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন নতুন করে জোরালো হয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষার ঠিক আগেই তাঁদের দাবিগুলো সরকারের কানে পৌঁছানো জরুরি। প্রধান দাবিগুলো হলো-দশম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি নিশ্চিত করা এবং বকেয়া টাইমস্কেল দ্রুত প্রদান।
সরকার প্রশিক্ষণে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে-এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু একই সঙ্গে শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করাও সমান জরুরি। শিক্ষক যখন আর্থিক ও মানসিকভাবে স্বচ্ছল ও সম্মানিত বোধ করবেন, তখনই তিনি আন্তরিকতা নিয়ে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করতে পারবেন। তাই শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রথম শর্ত হলো শিক্ষককে ক্লাসমুখী করা-বৈষম্য দূর করে, মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে।
আসাদুজ্জামান খান মুকুল
সাভার, হেমগঞ্জ বাজার, নান্দাইল, ময়মনসিংহ
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
মানুষ গড়ার কারিগররাই আজ গভীর হতাশায় নিমজ্জিত। প্রাথমিক শিক্ষা যে কোনো জাতির ভবিষ্যতের মূল ভিত্তি। একটি শিশু যখন প্রথম বিদ্যালয়ে যায়, তখন থেকেই তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শেখার যাত্রা শুরু হয়। এই সময়েই তাকে শেখানো হয় -কীভাবে চিন্তা করতে হয়, ভবিষ্যতের স্বপ্ন গড়তে হয় এবং সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পেতে হয়। আর এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন প্রাথমিক শিক্ষকরা। কিন্তু আজ বাস্তবতা হলো, এই মানুষ গড়ার কারিগররাই চরম বঞ্চনা ও অবহেলার অন্ধকারে আটকে আছেন।
সরকার প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ-এতে সন্দেহ নেই। শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলছে, নতুন ভবন ও আধুনিক শ্রেণিকক্ষ নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-শুধু অবকাঠামো নির্মাণ আর প্রশিক্ষণে বিপুল অর্থ ব্যয়ে কি শিক্ষার মান বাড়ে? যদি শিক্ষক নিজেই মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন, তাঁর মনে যদি জমে ওঠে ক্ষোভ, তবে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কতটা কার্যকরভাবে তিনি শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করতে পারবেন? বাস্তব সমস্যাগুলো সামনে এনে এই প্রশ্নগুলো আরও জোরালো হয়ে ওঠছে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের বঞ্চনার সবচেয়ে স্পষ্ট চিত্র হলো একই মন্ত্রণালয়ে দুই ধরনের বেতন কাঠামো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রিধারী এবং জাতীয় কারিকুলাম পড়ান, অথচ তাঁরা পান ত্রয়োদশ গ্রেড, যা সাধারণত এসএসসি বা এইচএসসি পাস তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের গ্রেড। অন্যদিকে, একই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পাচ্ছেন দশম গ্রেড। একই কাজ, একই যোগ্যতা, একই প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে এমন বৈষম্য কি ন্যায়সংগত? আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি এই বৈষম্য শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। শিক্ষকের আত্মমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হলে তাঁর পেশার প্রতি আগ্রহ কমে যায়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পদোন্নতির স্থবিরতা। দীর্ঘদিন ধরে বিভাগীয় পদোন্নতি বন্ধ, প্রাপ্য টাইমস্কেল-১০ ও ১৬ বছরের সুবিধা-না পাওয়ায় শিক্ষকরা এক স্থবির জীবনে ঠেলে পড়েছেন। বছরের পর বছর একই পদে, একই বেতনে কাজ করতে করতে তাঁদের মনে জমেছে গভীর হতাশা। বর্তমানে পদোন্নতি-সংক্রান্ত মামলা হাইকোর্টে চলমান থাকায় বিষয়টি আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সরকার একটু নজর দিলেই এই অচলাবস্থা দূর করা সম্ভব। কিন্তু যতদিন এভাবে অস্থিরতা ও ক্ষোভের পরিবেশ বজায় থাকবে, ততদিন শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার গতি বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে। শিক্ষক যদি নিজেই বঞ্চনার শিকার হন, তবে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে পেশার প্রতি শ্রদ্ধা ও দেশগড়ার স্বপ্ন বোনা তাঁর পক্ষে কেন কঠিন হবে না?
শিক্ষক সংকট ও শিক্ষা উপকরণের অভাবও প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় বাধা। অনেক স্কুলে অনুমোদিত পদের তুলনায় শিক্ষক কম থাকায় একজন শিক্ষককে একাধিক শ্রেণির ক্লাস নিতে হয়। এতে কোনো শ্রেণিই শিক্ষকের পূর্ণ মনোযোগ পায় না। আধুনিক শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় চার্ট, মডেল, খেলাধুলাভিত্তিক উপকরণ ও ডিজিটাল সামগ্রী অনেক স্কুলেই অপ্রতুল। ফলে প্রশিক্ষণে শেখা আধুনিক পদ্ধতি বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ ক্ষেত্রেও অভিভাবকের সচেতনতার ঘাটতি একটি বড় সমস্যা। অর্থনৈতিক চাপ, শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অনীহা বা অজ্ঞতা-সব মিলিয়ে অনেক অভিভাবকই সন্তানের পড়াশোনায় পর্যাপ্ত মনোযোগ দেন না। শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, হোমওয়ার্ক তদারকি করা, স্কুলের নিয়ম মেনে চলা-এসব ক্ষেত্রে অনেকেই পিছিয়ে পড়েন। ফলে শিক্ষার মানোন্নয়ন একটি অসম্পূর্ণ প্রচেষ্টায় পরিণত হয়।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন নতুন করে জোরালো হয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষার ঠিক আগেই তাঁদের দাবিগুলো সরকারের কানে পৌঁছানো জরুরি। প্রধান দাবিগুলো হলো-দশম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি নিশ্চিত করা এবং বকেয়া টাইমস্কেল দ্রুত প্রদান।
সরকার প্রশিক্ষণে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে-এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু একই সঙ্গে শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করাও সমান জরুরি। শিক্ষক যখন আর্থিক ও মানসিকভাবে স্বচ্ছল ও সম্মানিত বোধ করবেন, তখনই তিনি আন্তরিকতা নিয়ে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করতে পারবেন। তাই শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রথম শর্ত হলো শিক্ষককে ক্লাসমুখী করা-বৈষম্য দূর করে, মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে।
আসাদুজ্জামান খান মুকুল
সাভার, হেমগঞ্জ বাজার, নান্দাইল, ময়মনসিংহ