মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
ভোরের আলো ফোটার আগেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে একটি যন্ত্র এখন আরেকটি যন্ত্রের সঙ্গে কথা বলতে পারে। কারখানায় রোবট নিখুঁতভাবে কাপড় কাটছে, হাসপাতালে এআই রোগ নির্ণয় করছে, আর আর্থিক লেনদেন এখন সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সম্পন্ন হচ্ছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে কখনও এমন দ্রুতগতির পরিবর্তন ঘটেনি। এই বৈশ্বিক রূপান্তরের মাঝেই বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা স্মার্ট ভবিষ্যৎ অর্থনীতি।
গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে। তৈরি পোশাক শিল্প ও রেমিট্যান্স। এই দুই খাত দীর্ঘদিন ধরে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু বিশ্ব এখন শ্রমের চেয়ে প্রযুক্তিতে বেশি বিনিয়োগ করছে। অটোমেশন বাড়ছে, রোবোটিকস কমিয়ে দিচ্ছে মানবশ্রমের ভূমিকা। ফলে বাংলাদেশকে আর প্রচলিত ধারার ওপর নির্ভর করলে চলবে না; বরং ভবিষ্যৎ অর্থনীতির স্রোতে নিজেকে রূপান্তর করতে হবে দ্রুত, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে।
বাংলাদেশের ওঞ/ওঈঞ খাত এখন দেশের নতুন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। বর্তমানে এই খাতের বার্ষিক রপ্তানি প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। ওঈঞ শিল্প এখন এউচ-তে প্রায় ১.২৫% অবদান রাখছে। শুধু প্রযুক্তি খাতেই সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে ৩ লাখ মানুষ, এবং সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী কয়েক বছরে এই সংখ্যাটি ৩০ লাখে পৌঁছাতে পারে। ইতোমধ্যে দেশে প্রতিষ্ঠিত হাই-টেক পার্কগুলোতে কাজ করছে ২১ হাজারেরও বেশি তরুণ, যারা ভবিষ্যতের নতুন ডিজিটাল অর্থনীতি নির্মাণে ভূমিকা রাখছে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দ্রুত এগোচ্ছে। দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় ডিজিটাল বাজার তৈরি করেছে। অনলাইন শিক্ষা, ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স ও স্টার্টআপ সংস্কৃতি তরুণদের সামনে খুলে দিয়েছে বৈশ্বিক কর্মবাজারের নতুন দরজা। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা এখন অন্যতম বৃহৎ কর্মশক্তি।
তবে সুযোগের পাশাপাশি আছে কঠিন বাস্তবতাও। অটোমেশন ও অও-এর অগ্রগতিতে নিম্নদক্ষ শ্রমের চাহিদা দ্রুত কমছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষতা উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশ ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। তাই ঝঞঊগ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিতভিত্তিক শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে তরুণদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে কোডিং, সাইবার সিকিউরিটি, ডিজিটাল মার্কেটিং, ডেটা অ্যানালিটিকস, মেশিন লার্নিং, রোবোটিকস এবং অন্যান্য উদীয়মান প্রযুক্তিতে।
ও সেবা খাতেও শুরু হয়েছে বড় পরিবর্তন। কৃষিতে স্মার্ট সেচ, ড্রোন ব্যবহার, সেন্সর-ভিত্তিক উৎপাদন কৃষিকে আরও আধুনিক করছে। স্বাস্থ্যখাতে টেলিমেডিসিন, অও-ভিত্তিক রোগ নির্ণয়, ডিজিটাল হাসপাতাল মানুষের জীবনে নতুন স্বস্তি আনছে। আর্থিক খাতে ব্লকচেইন ও ডিজিটাল ব্যাংকিং ভবিষ্যতের লেনদেনকে আরও নির্ভুল, নিরাপদ ও স্বচ্ছ করে তুলছে।
তরুণ জনসংখ্যাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। দেশের ৩০ বছরের নিচে বয়সী জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫% যারা প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা অর্জন করলে আগামী দুই দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে। “ডিজিটাল বাংলাদেশ” থেকে “স্মার্ট বাংলাদেশ”-এই যাত্রা কেবল প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়ন নয়, বরং মানবসম্পদকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যও বটে।
বাংলাদেশের সামনে তাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আমরা কি এই পরিবর্তনের স্রোতকে শুধু অনুসরণ করবো, নাকি নেতৃত্ব দেবো? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে যে দেশ প্রযুক্তিকে ধারণ করতে পারবে, যে দেশ উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করবে, যে দেশ তরুণদের দক্ষতায় রূপান্তরিত করবে তারাই হবে ভবিষ্যৎ অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
বাংলাদেশও সেই সম্ভাবনা শক্ত হাতে ধরে আছে। এখন প্রয়োজন দূরদর্শী নীতি, সঠিক বিনিয়োগ এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা।
কারণ ভবিষ্যৎ অর্থনীতি আর কাগজের পরিকল্পনায় নয় এখন তা কোড, ডেটা, অ্যালগরিদম এবং ডিজিটাল উদ্ভাবনে লেখা হয়। আর এই নতুন ভাষাতেই বাংলাদেশের আগামী পথচলার গল্প রচিত হচ্ছে।
তহমিনা ইয়াসমিন
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫
ভোরের আলো ফোটার আগেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে একটি যন্ত্র এখন আরেকটি যন্ত্রের সঙ্গে কথা বলতে পারে। কারখানায় রোবট নিখুঁতভাবে কাপড় কাটছে, হাসপাতালে এআই রোগ নির্ণয় করছে, আর আর্থিক লেনদেন এখন সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সম্পন্ন হচ্ছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে কখনও এমন দ্রুতগতির পরিবর্তন ঘটেনি। এই বৈশ্বিক রূপান্তরের মাঝেই বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা স্মার্ট ভবিষ্যৎ অর্থনীতি।
গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে। তৈরি পোশাক শিল্প ও রেমিট্যান্স। এই দুই খাত দীর্ঘদিন ধরে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু বিশ্ব এখন শ্রমের চেয়ে প্রযুক্তিতে বেশি বিনিয়োগ করছে। অটোমেশন বাড়ছে, রোবোটিকস কমিয়ে দিচ্ছে মানবশ্রমের ভূমিকা। ফলে বাংলাদেশকে আর প্রচলিত ধারার ওপর নির্ভর করলে চলবে না; বরং ভবিষ্যৎ অর্থনীতির স্রোতে নিজেকে রূপান্তর করতে হবে দ্রুত, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে।
বাংলাদেশের ওঞ/ওঈঞ খাত এখন দেশের নতুন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। বর্তমানে এই খাতের বার্ষিক রপ্তানি প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। ওঈঞ শিল্প এখন এউচ-তে প্রায় ১.২৫% অবদান রাখছে। শুধু প্রযুক্তি খাতেই সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে ৩ লাখ মানুষ, এবং সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী কয়েক বছরে এই সংখ্যাটি ৩০ লাখে পৌঁছাতে পারে। ইতোমধ্যে দেশে প্রতিষ্ঠিত হাই-টেক পার্কগুলোতে কাজ করছে ২১ হাজারেরও বেশি তরুণ, যারা ভবিষ্যতের নতুন ডিজিটাল অর্থনীতি নির্মাণে ভূমিকা রাখছে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দ্রুত এগোচ্ছে। দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় ডিজিটাল বাজার তৈরি করেছে। অনলাইন শিক্ষা, ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স ও স্টার্টআপ সংস্কৃতি তরুণদের সামনে খুলে দিয়েছে বৈশ্বিক কর্মবাজারের নতুন দরজা। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা এখন অন্যতম বৃহৎ কর্মশক্তি।
তবে সুযোগের পাশাপাশি আছে কঠিন বাস্তবতাও। অটোমেশন ও অও-এর অগ্রগতিতে নিম্নদক্ষ শ্রমের চাহিদা দ্রুত কমছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষতা উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশ ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। তাই ঝঞঊগ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিতভিত্তিক শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে তরুণদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে কোডিং, সাইবার সিকিউরিটি, ডিজিটাল মার্কেটিং, ডেটা অ্যানালিটিকস, মেশিন লার্নিং, রোবোটিকস এবং অন্যান্য উদীয়মান প্রযুক্তিতে।
ও সেবা খাতেও শুরু হয়েছে বড় পরিবর্তন। কৃষিতে স্মার্ট সেচ, ড্রোন ব্যবহার, সেন্সর-ভিত্তিক উৎপাদন কৃষিকে আরও আধুনিক করছে। স্বাস্থ্যখাতে টেলিমেডিসিন, অও-ভিত্তিক রোগ নির্ণয়, ডিজিটাল হাসপাতাল মানুষের জীবনে নতুন স্বস্তি আনছে। আর্থিক খাতে ব্লকচেইন ও ডিজিটাল ব্যাংকিং ভবিষ্যতের লেনদেনকে আরও নির্ভুল, নিরাপদ ও স্বচ্ছ করে তুলছে।
তরুণ জনসংখ্যাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। দেশের ৩০ বছরের নিচে বয়সী জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫% যারা প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা অর্জন করলে আগামী দুই দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে। “ডিজিটাল বাংলাদেশ” থেকে “স্মার্ট বাংলাদেশ”-এই যাত্রা কেবল প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়ন নয়, বরং মানবসম্পদকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যও বটে।
বাংলাদেশের সামনে তাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আমরা কি এই পরিবর্তনের স্রোতকে শুধু অনুসরণ করবো, নাকি নেতৃত্ব দেবো? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে যে দেশ প্রযুক্তিকে ধারণ করতে পারবে, যে দেশ উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করবে, যে দেশ তরুণদের দক্ষতায় রূপান্তরিত করবে তারাই হবে ভবিষ্যৎ অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
বাংলাদেশও সেই সম্ভাবনা শক্ত হাতে ধরে আছে। এখন প্রয়োজন দূরদর্শী নীতি, সঠিক বিনিয়োগ এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা।
কারণ ভবিষ্যৎ অর্থনীতি আর কাগজের পরিকল্পনায় নয় এখন তা কোড, ডেটা, অ্যালগরিদম এবং ডিজিটাল উদ্ভাবনে লেখা হয়। আর এই নতুন ভাষাতেই বাংলাদেশের আগামী পথচলার গল্প রচিত হচ্ছে।
তহমিনা ইয়াসমিন