শরীফ চৌহান
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য আজ আর শুধু চিকিৎসার বিষয় নয়Ñএটি এক গভীর মানবিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগত কষ্টের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা এই বিষণœতা আজ রাষ্ট্রের নিঃশব্দ ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে। ২৩ জুলাই ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ আমাদের সেই অন্ধকার গলিতে আলো ফেলবার আহ্বান জানায়।
মানসিক স্বাস্থ্য মানে কী?
মানসিক স্বাস্থ্য বোঝায়Ñএকজন মানুষ কতটা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, চাপ সামাল দিতে পারে এবং সম্পর্ক রক্ষা করে সমাজে সুস্থভাবে টিকে থাকতে পারে। এটি শারীরিক স্বাস্থ্য, সামাজিক পরিবেশ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বাস্তব চিত্র : বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কোথায় দাঁড়িয়ে? ২০১৯-২০ সালের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ীÑ প্রাপ্তবয়স্কদের ১৬.৮% এবং শিশু-কিশোরদের ১৩.৬% মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। আক্রান্তদের মাত্র ৭.২% চিকিৎসা পান। দেশে রয়েছে মাত্র ২৫০-৩০০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। অধিকাংশ জেলায় নেই কোনো ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট বা প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট। প্রয়োজনের তুলনায় মনোস্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্র, হেল্পলাইন, হাসপাতাল ও স্টাফ মারাত্মকভাবে অপর্যাপ্ত। তার ওপর ‘পাগল’ বলে অপমান, লজ্জা, কুসংস্কার এবং পারিবারিক চাপ মানুষকে চিকিৎসা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
সংকট আরও গভীর : সমাজ ও রাজনীতির ছায়া
মানসিক সমস্যার পেছনে রয়েছেÑ দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সহিংসতা। বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎহীনতা। নারী, শিশু, যৌন সংখ্যালঘু ও প্রতিবন্ধীদের নিপীড়ন। জলবায়ু উদ্বেগ, বাস্তুচ্যুতি ও আবাসন সংকট।
রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের আহ্বান : এই ভয়াবহ বাস্তবতায়, বাংলাদেশ সরকারের কাছে এখন একটি কার্যকর, আধুনিক ও মানবিক মানসিক। স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের অনিবার্য দাবি উঠেছে।
আমরা জোর দিয়ে বলছিÑ বাংলাদেশে যে স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো বিদ্যমান, তা দিয়ে কেবল ১-১ ভিত্তিক থেরাপি পদ্ধতিতে এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
বিশ্বের বহু দেশ ইতোমধ্যে এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপিÑঅর্থাৎ সঙ্গীত, শিল্পকলা, গল্প বলা, থিয়েটার ইত্যাদির মাধ্যমে দলভিত্তিক মনোচিকিৎসাÑব্যবহার করছে।
এই বিকল্প পদ্ধতি দ্রুত সময়ে অধিকসংখ্যক মানুষকে সেবা দিতে পারে; কম ব্যয়ে প্রশিক্ষিত কমিউনিটি কর্মীদের মাধ্যমে পরিচালনা করা যায়; গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অধিক উপযোগী।
‘উৎস’ ও বেসরকারি উদ্যোগ : একটি সম্ভাবনাময় পথ এই বিকল্প পদ্ধতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে ‘উৎস’ নামক সংগঠনটি। তারা বহু বছর ধরে শিশু-কিশোর, তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে এক্সপ্রেসিভ থেরাপির চর্চা করে ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করেছে।
এছাড়াও মনোভব, মাইন্ড কেয়ার, কিরণমালা, ব্র্যাক মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামসহ বহু সংস্থা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। তাদের অভিজ্ঞতা ও মডেলকে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করলে জাতীয় পর্যায়ে একটি বড় পরিবর্তন সম্ভব।
শিক্ষা ব্যবস্থায় মনোসামাজিক কাউন্সিলিং অপরিহার্য। প্রতিটি স্কুলে মনোসামাজিক কাউন্সিলর থাকতে হবে। পাঠ্যসূচিতে আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও সহানুভূতির শিক্ষা থাকতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ জরুরি।
প্রস্তাবনা : ১. এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি পদ্ধতিকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি ও বাস্তবায়ন
২. উৎসসহ সফল বেসরকারি সংগঠনগুলোর সহযোগিতায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ গড়ে তোলা।
৩. প্রতিটি জেলায় মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, হেল্পলাইন ও পরামর্শক নিয়োগ।
৪. শিক্ষা, কর্মস্থল ও মিডিয়া জগতে মনোস্বাস্থ্য-সচেতন সংস্কৃতি তৈরি।
৫. জাতীয় বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্য বরাদ্দ বৃদ্ধি ও নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন।
মানসিক স্বাস্থ্য শুধু চিকিৎসার প্রশ্ন নয়Ñএটি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সামাজিক সহানুভূতি ও নৈতিক দায়বদ্ধতার একটি পরীক্ষা। এই ২৩ জুলাই-এ আমাদের নতুন করে ভাবা উচিতÑ ‘মানুষই যদি দেশের বড় সম্পদ হয়, তাহলে তার মনই তো রাষ্ট্রের মৌল ভিত্তি’ তাই আসুন, এই দিনটিকে পরিণত করি মনোস্বাস্থ্য রক্ষায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জাগরণের সূচনায়।
[লেখক : সভাপতি, মেন্টাল হেলথ অ্যাডভোকেসি অ্যাসোসিয়েশন]
শরীফ চৌহান
বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য আজ আর শুধু চিকিৎসার বিষয় নয়Ñএটি এক গভীর মানবিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগত কষ্টের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা এই বিষণœতা আজ রাষ্ট্রের নিঃশব্দ ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে। ২৩ জুলাই ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ আমাদের সেই অন্ধকার গলিতে আলো ফেলবার আহ্বান জানায়।
মানসিক স্বাস্থ্য মানে কী?
মানসিক স্বাস্থ্য বোঝায়Ñএকজন মানুষ কতটা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, চাপ সামাল দিতে পারে এবং সম্পর্ক রক্ষা করে সমাজে সুস্থভাবে টিকে থাকতে পারে। এটি শারীরিক স্বাস্থ্য, সামাজিক পরিবেশ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বাস্তব চিত্র : বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কোথায় দাঁড়িয়ে? ২০১৯-২০ সালের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ীÑ প্রাপ্তবয়স্কদের ১৬.৮% এবং শিশু-কিশোরদের ১৩.৬% মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। আক্রান্তদের মাত্র ৭.২% চিকিৎসা পান। দেশে রয়েছে মাত্র ২৫০-৩০০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। অধিকাংশ জেলায় নেই কোনো ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট বা প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট। প্রয়োজনের তুলনায় মনোস্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্র, হেল্পলাইন, হাসপাতাল ও স্টাফ মারাত্মকভাবে অপর্যাপ্ত। তার ওপর ‘পাগল’ বলে অপমান, লজ্জা, কুসংস্কার এবং পারিবারিক চাপ মানুষকে চিকিৎসা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
সংকট আরও গভীর : সমাজ ও রাজনীতির ছায়া
মানসিক সমস্যার পেছনে রয়েছেÑ দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সহিংসতা। বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎহীনতা। নারী, শিশু, যৌন সংখ্যালঘু ও প্রতিবন্ধীদের নিপীড়ন। জলবায়ু উদ্বেগ, বাস্তুচ্যুতি ও আবাসন সংকট।
রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের আহ্বান : এই ভয়াবহ বাস্তবতায়, বাংলাদেশ সরকারের কাছে এখন একটি কার্যকর, আধুনিক ও মানবিক মানসিক। স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের অনিবার্য দাবি উঠেছে।
আমরা জোর দিয়ে বলছিÑ বাংলাদেশে যে স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো বিদ্যমান, তা দিয়ে কেবল ১-১ ভিত্তিক থেরাপি পদ্ধতিতে এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
বিশ্বের বহু দেশ ইতোমধ্যে এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপিÑঅর্থাৎ সঙ্গীত, শিল্পকলা, গল্প বলা, থিয়েটার ইত্যাদির মাধ্যমে দলভিত্তিক মনোচিকিৎসাÑব্যবহার করছে।
এই বিকল্প পদ্ধতি দ্রুত সময়ে অধিকসংখ্যক মানুষকে সেবা দিতে পারে; কম ব্যয়ে প্রশিক্ষিত কমিউনিটি কর্মীদের মাধ্যমে পরিচালনা করা যায়; গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অধিক উপযোগী।
‘উৎস’ ও বেসরকারি উদ্যোগ : একটি সম্ভাবনাময় পথ এই বিকল্প পদ্ধতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে ‘উৎস’ নামক সংগঠনটি। তারা বহু বছর ধরে শিশু-কিশোর, তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে এক্সপ্রেসিভ থেরাপির চর্চা করে ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করেছে।
এছাড়াও মনোভব, মাইন্ড কেয়ার, কিরণমালা, ব্র্যাক মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামসহ বহু সংস্থা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। তাদের অভিজ্ঞতা ও মডেলকে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করলে জাতীয় পর্যায়ে একটি বড় পরিবর্তন সম্ভব।
শিক্ষা ব্যবস্থায় মনোসামাজিক কাউন্সিলিং অপরিহার্য। প্রতিটি স্কুলে মনোসামাজিক কাউন্সিলর থাকতে হবে। পাঠ্যসূচিতে আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও সহানুভূতির শিক্ষা থাকতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ জরুরি।
প্রস্তাবনা : ১. এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি পদ্ধতিকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি ও বাস্তবায়ন
২. উৎসসহ সফল বেসরকারি সংগঠনগুলোর সহযোগিতায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ গড়ে তোলা।
৩. প্রতিটি জেলায় মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, হেল্পলাইন ও পরামর্শক নিয়োগ।
৪. শিক্ষা, কর্মস্থল ও মিডিয়া জগতে মনোস্বাস্থ্য-সচেতন সংস্কৃতি তৈরি।
৫. জাতীয় বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্য বরাদ্দ বৃদ্ধি ও নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন।
মানসিক স্বাস্থ্য শুধু চিকিৎসার প্রশ্ন নয়Ñএটি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সামাজিক সহানুভূতি ও নৈতিক দায়বদ্ধতার একটি পরীক্ষা। এই ২৩ জুলাই-এ আমাদের নতুন করে ভাবা উচিতÑ ‘মানুষই যদি দেশের বড় সম্পদ হয়, তাহলে তার মনই তো রাষ্ট্রের মৌল ভিত্তি’ তাই আসুন, এই দিনটিকে পরিণত করি মনোস্বাস্থ্য রক্ষায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জাগরণের সূচনায়।
[লেখক : সভাপতি, মেন্টাল হেলথ অ্যাডভোকেসি অ্যাসোসিয়েশন]