alt

মুক্ত আলোচনা

বদরুদ্দীন উমর : কণ্ঠহীন সময়ের অনিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর

মাহরুফ চৌধুরী

: বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

বদরুদ্দীন উমর

বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে নিছক একজন ব্যক্তির নাম নয়, বরং তিনি একটি যুগান্তকারী ধারার প্রতিনিধি। তিনি কেবল একজন চিন্তক বা গবেষক নন, বরং নিজস্ব এক বৌদ্ধিক প্রতিষ্ঠান, যিনি দীর্ঘকাল যাবৎ যুক্তি, বিশ্লেষণ ও প্রতিবাদের নিরন্তর চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। নির্ভীক চিন্তা, নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং শ্রেণি-চেতনায় প্রোথিত একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যিনি সবসময় দাঁড়িয়েছেন শোষিত, নিপীড়িত ও প্রান্তিক মানুষের পক্ষে তা সে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মঞ্চ হোক কিংবা উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্র। তার জীবন ছিল এক অর্থে গ্রাম থেকে বিশ্বমঞ্চে ছড়িয়ে পড়া চিন্তার ধারাবাহিকতায় প্রবাহমান।

তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক অভিজাত প্রাগ্রসর পরিবারে, যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল অপরিসীম। কিন্তু এই সামাজিক অবস্থান তার চিন্তার স্বাধীনতাকে কখনোই বাঁধা দিতে পারেনি। বরং উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই সাংস্কৃতিক পুঁজি তিনি ব্যবহার করেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক শৃঙ্খলা ও সমাজ-রূপান্তরের এক কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে।

আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে অনেকেই সময়ের চাহিদা ও সুবিধার সঙ্গে আপস করেছেন, মতাদর্শগতভাবে ক্ষীণ হয়েছেন, কিংবা ক্ষমতার সমীপে নিরাপত্তা খুঁজেছেন। কিন্তু বদরুদ্দীন উমর ছিলেন সেই বিরল পুরুষদের একজন, যিনি নিঃসংশয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন সত্য ও ন্যায়সঙ্গত অবস্থানের পাশে। এদিক থেকে তাকে আমরা অ্যান্তোনিও গ্রামশি, ফ্রান্ৎজ ফানোঁ কিংবা এদুয়ার্দো গালিয়ানোর মতো প্রতিশ্রুতিশীল ও প্রতিরোধী বুদ্ধিজীবীদের ধারায় স্থান দিতে পারি যারা তাদের চিন্তা ও কলমকে রাজনৈতিক প্রতিরোধ এবং মুক্তির ভাষ্য হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে বুদ্ধিজীবীদের বড় একটি অংশ ক্ষমতার অনুকম্পা বা পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মতুষ্টি খুঁজে ফেরেন, সেখানে বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এক ব্যতিক্রমধর্মী আলো। চিন্তার ক্ষেত্রে তার আপসহীনতা, বিশ্লেষণে ঐতিহাসিক নিরপেক্ষতা এবং সংগ্রামী বাস্তবতার প্রতি দায়বদ্ধতা তাকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমি মানুষকে শ্রদ্ধা করি, তার অবস্থান বা মতাদর্শের জন্য নয়, শ্রদ্ধা করি তার মনুষ্যত্ব, নৈতিক দৃঢ়তা এবং আত্মমর্যাদাবোধের জন্য। মানুষের সীমাবদ্ধতা থাকবেই, কেউই মানবিক দোষত্রুটির উর্ধ্বে নয়; কিন্তু এই সীমাবদ্ধতাগুলোর ভেতর দিয়ে যে মানুষ নিজেকে অতিক্রম করতে চেষ্টা করে, যে মানুষ আদর্শের পাশে অটল থেকে জীবনের ঝুঁকি নিতে ভয় পায় না, তিনিই আমার শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হন।

বদরুদ্দীন উমর আমার কাছে তেমন একজন মানুষ। তার সঙ্গে আমার বিশ্বাস, মতাদর্শ, চিন্তাপদ্ধতি কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির বিপুল বৈপরিত্য রয়েছে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের যেদিকটি আমাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে, তা হলো তার আত্মমর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, আদর্শের কাছে আপসহীনতা এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রশ্নে আপস না করার অভ্যেস। যে সমাজে আমরা দেখতে পাই তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবীরা’ নিজস্ব অবস্থান বিকিয়ে দেন ক্ষমতা ও প্রভাবের কাছে, যারা নিজের কলম ও কণ্ঠকে ভাড়া দেন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দখলে, সেই সমাজে বদরুদ্দীন উমরের উপস্থিতি এক অনন্য ব্যতিক্রম।

আমার শৈশব থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তার চলার পথে আমি কখনো তাকে কারো পা চাটতে দেখিনি, তাকে কোনো কৌশলী আত্মসমর্পণে অংশ নিতে দেখিনি, কিংবা তাকে সুবিধাবাদী কনফরমিজমের ছায়ায় আশ্রয় নিতে দেখিনি। এই দৃঢ়তা, এই নৈতিক অনমনীয়তা তাকে আমাদের সময়ের সবচাইতে মর্যাদাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী করে তুলেছে। দর্শনের ইতিহাসে সক্রেটিস যেভাবে রাষ্ট্রক্ষমতার চোখে চোখ রেখে আত্মত্যাগ করেছিলেন, কিংবা ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিবেকানন্দ যেভাবে মনুষ্যত্বের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন তেমনি বদরুদ্দীন উমরও আমাদের কাছে হয়ে উঠেছেন প্রতিরোধের এক জীবন্ত প্রতীক। তিনি কখনো জনমোহিনী হতে চাননি, বরং সত্যভাষণে থেকেছেন একা, নীরব, দৃঢ়। তার এই স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং আত্মিক ঋজুতা আমাদের শেখায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব আসে মতের মিল নয়, নীতির দৃঢ়তা থেকে।

বদরুদ্দীন উমর জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও দীপ্তিময় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবারে, যার শিকড় প্রোথিত ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, আত্মমর্যাদা ও ন্যায়ভিত্তিক রাজনীতির অভিজ্ঞানভূমিতে। তার পিতা আবুল হাশিম ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম রাজনীতিতে এক অমলিন ও দুর্বার চরিত্র। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের অন্যতম পুরোধা হিসেবে তিনি জনসাধারণের অধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন, যা প্রতিটি জনসভায় তার অগ্নিগর্ভ বক্তৃতায় প্রতিফলিত হতো। তার কণ্ঠে শুধু বক্তৃতা ছিল না ছিল তাত্ত্বিক মাধুর্য, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা; যা শ্রোতাদের অন্তরকেও আলোড়িত করত। এই গৌরবময় রাজনৈতিক বংশধারার প্রেরণা আরও গভীর থেকে উৎসারিত হয়।

বদরুদ্দীন উমরের দাদা আবুল কাসেম ছিলেন একাধারে একজন তীক্ষèবুদ্ধিসম্পন্ন সাংবাদিক, চিন্তক এবং রাজনৈতিক সংগ্রামী। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯৪ সালে বিএ পাস করেছিলেন, যা সেই সময়কার মুসলিম সমাজে শিক্ষাগত উৎকর্ষের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে তার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতায়। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের পর তিনি আইন পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে প্রমাণ করেছিলেনÑ নৈতিকতার প্রশ্নে আপস নয়, প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ উত্তর। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আবুল কাসেমের ভ্রাতা, অর্থাৎ বদরুদ্দীন উমরের চাচা আব্দুল জব্বার, ভোপালের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে পরিবারের রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে উপমহাদেশীয় পরিসরে আরও বিস্তৃত করেছিলেন। এই পরিবারে রাজনীতি ছিল কেবল ক্ষমতার খেলা নয় এটি ছিল নৈতিক দায়, ইতিহাসের সঙ্গে সক্রিয় সংলাপ এবং প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়া চিন্তার আলো।

এই প্রেক্ষাপটে আমরা বুঝতে পারি, বদরুদ্দীন উমরের চিন্তার দৃঢ়তা, আদর্শিক নিষ্ঠা এবং আপসহীনতার ভিত কেবল ব্যক্তিজীবনের আত্মপ্রত্যয় থেকেই আসেনি এটি এক দীর্ঘ ইতিহাস, উত্তরাধিকারের বর্ণময় ধারাবাহিকতা এবং চিন্তাশীলতার এক সংগ্রামী রূপান্তরের ফসল। এই বংশগৌরবের উত্তরাধিকারী হয়ে বদরুদ্দীন উমর যেন এক ব্যতিক্রমী অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। যেখানে অধিকাংশ মানুষ পারিবারিক ঐতিহ্যের জৌলুসে নিশ্চিন্ত হয়ে পড়ে থাকেন, সেখানে তিনি তা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেও নিজেকে গড়েছেন এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পথে সংগ্রামের, ত্যাগের, আত্মজিজ্ঞাসার এবং প্রতিরোধের পথে। তার জীবনের পথরেখা ছিল না সুবিধাবাদী সোপানভিত্তিক সাফল্যের খতিয়ান, বরং তা ছিল নিরলস বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের এক নিরন্তর পথচলা। তিনি কখনো স্থবির হননি, কখনো নিজেকে বিকিয়ে দেননি, কখনো কোনো প্রতিষ্ঠান, আদর্শ কিংবা ক্ষমতার সীমানায় নিজেকে সীমাবদ্ধ করেননি।

বদরুদ্দীন উমর হলেন সেই বিরল চিন্তকদের একজন, যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনকে নিছক পা-িত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্র হিসেবে দেখেন না বরং তাকে সমাজ রূপান্তরের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। তার লেখালেখি নিছক ভাষার শৌখিনতা নয়; তা ছিল তার অভিজ্ঞতা, দর্শন, রাজনৈতিক অবস্থান ও জীবনবোধের প্রতিফলন। রাজনীতি থেকে সাহিত্য, ইতিহাস থেকে সমাজতত্ত্ব যেখানেই তিনি কলম ধরেছেন, সেখানেই নিজ চোখে দেখা জীবন-বাস্তবতা, সামাজিক বৈষম্য, রাষ্ট্রীয় অসংগতি এবং শোষণের নিরাভরণ চিত্রকে নির্মোহভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সার্ত্রের ভাষায় বলতে গেলে তিনি ছিলেন এক অর্থে আমাদের সময়ের ‘সক্রিয় বুদ্ধিজীবী’ (অঙগেজি ইন্টালেকচুয়াল), যিনি নিছক বিশ্লেষক নন, বরং সক্রিয়ভাবে সমাজের দায় কাঁধে তুলে নেন। তার চিন্তা ও বচনে ছিল র্যাঁবোর মতো বিদ্রোহ, গ্রামশির মতো শ্রেণি-সচেতনতা এবং ফ্রেইরের মতো প্রগতিশীল মুক্তির আকাক্সক্ষা। বদরুদ্দীন উমরের জীবন হল একটি আয়না যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে একজন বুদ্ধিজীবীর নিষ্কলুষতা, আত্মশুদ্ধি এবং আত্মনির্মাণ। সেই আয়নায় আমরা দেখতে পাই সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল এক ব্যক্তিত্ব, যাকে কোনো সরকার, আদর্শ, গোষ্ঠী কিংবা সুবিধাবাদ কখনো তার পথচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। তিনি ছিলেন নিজের আদর্শের কাছে নিষ্ঠাবান, সময়ের কাছে দায়বদ্ধ, এবং সত্যের কাছে অবিচল। এই মুহূর্তে ৯৪ বছর বয়সি বদরুদ্দীন উমর হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কক্ষে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন। তার এই অসুস্থতা কেবল একজন প্রবীণ ব্যক্তির শারীরিক সংকট নয়; এটি বাংলাদেশের এক পর্বান্তরের সম্ভাব্য সূচনা। আমরা যারা আজকের তথাকথিত ‘উন্নয়নের’ হুজুগে চোখে ঠুলি পরে চলি, যাদের মননের জগতে বিজ্ঞাপনের ঝলকানি আর প্রচারের কৃত্রিম উন্মাদনা, তারা হয়তো উপলব্ধি করতে পারি না একজন বদরুদ্দীন উমরের প্রস্থান কী ভয়াবহ শূন্যতা রেখে যাবে আমাদের আত্মিক ও চিন্তার জগতে।

এই মানুষটি ছিলেন আমাদের সময়ের বিবেক, এক চলমান প্রতিরোধের ভাষ্য। যে প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনকে কেবল জাতিসত্তার অধিকার হিসেবে নয়, বরং শ্রেণি-অভিসন্ধির আলোয় পুনর্বিন্যস্ত করে বিশ্লেষণ করেছে তার পুরোভাগে ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। তিনি ভাষাকে রাজনীতির বাহন হিসেবে, সংস্কৃতিকে শ্রেণিসংগ্রামের অন্তর্গত উপাদান হিসেবে দেখেছেন। তিনি যেভাবে সমাজ বিশ্লেষণে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে বাংলার বাস্তবতায় খাপ খাইয়ে তুলে ধরেছেন, তাতে তার অবস্থান আমাদের চিন্তার ভূগোলের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। এই সময়ে, যখন কর্পোরেট ও দলীয় বিভাজনের দ্বারা আত্মসমালোচনার জায়গা সংকুচিত, চিন্তার মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে, তখন বদরুদ্দীন উমরের মতো একজন নির্ভীক, দার্শনিক মননের ধারক এবং ইতিহাস-সচেতন বুদ্ধিজীবীর অনুপস্থিতি এক ভয়াবহ সংকেত। তার চলে যাওয়া মানে শুধু একজন মানুষ হারিয়ে যাওয়া নয়। এর মানে হলো একটি ধারাবাহিক প্রতিরোধ-সচেতন চিন্তার ধারার পরিসমাপ্তি, একটি বিবেকী কণ্ঠের অবসান।

তিনি নিছক ইতিহাসবিদ, সাহিত্য সমালোচক বা সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একান্তভাবে আমাদের বদরুদ্দীন উমরÑ যিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শিখিয়েছেন কিভাবে যুক্তি দিয়ে, ন্যায় দিয়ে, নৈতিক সাহস দিয়ে একটি শোষণমূলক বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। তার শারীরিক দুর্বলতার খবরে কেবল মন খারাপ হয় না, হৃদয়ের গভীরে এক দীর্ঘশ্বাস ওঠে- এই সমাজ কি তার চিন্তা, চেতনা ও প্রজ্ঞাকে ধারণ করতে পেরেছে? তার প্রস্থান কি আমাদের আত্মিক দৈন্যকে আরও অনাবৃত করে তুলবে?

আজ তার বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা আমাদের এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় যে, আমরা এক ভয়াবহ বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের মধ্যে আছি। চিন্তার স্বচ্ছতা, নৈতিক দৃঢ়তা, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা এবং নেতৃত্বের সাহস সবই যেন ক্রমেই বিলুপ্তির পথে। বদরুদ্দীন উমরের মতো মানুষেরা, যারা তাদের চিন্তা ও জীবনকে একটি সমগ্রত্বে রূপ দিয়েছিলেন, যখন একে একে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নেন, তখন তা কেবল প্রজন্মান্তরের একটি বোধের অবসান নয়- তা হয়ে ওঠে মুক্তচিন্তার সাংস্কৃতিক শূন্যতার আলামত।

উমরের অনুপস্থিতির প্রেক্ষাপটে আমরা চেয়ে দেখি পেছনে পড়ে থাকে একদল কথিত ‘বুদ্ধিজীবী’ যাদের কণ্ঠে নেই সত্য উচ্চারণের সাহস, যাদের বিবেচনায় নেই নৈতিক দৃঢ়তা, যাঁদের লেখায় নেই দর্শনের আলো বা ইতিহাসের গভীরতা। তারা সময়ের সুবিধাবাদী ঢেউয়ে দুলতে দুলতে হয়ে উঠেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক ফড়িয়া- কখনো দলীয় প্রচারক, কখনো কর্পোরেট মুখপাত্র। তাদের চিন্তার শিকড় নেই ইতিহাসে, তাদের উচ্চারণে নেই জনগণের ভাষা। বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এক অর্থে সেই ‘সংকট-চিহ্নিত সময়ের’ প্রতিরোধী কণ্ঠ, যার উপস্থিতি আমাদের চিন্তাজগতে একটি ভারসাম্য এনে দিত। যখন এমন ব্যক্তিত্বেরা একে একে চলে যান, তখন সমাজজীবনে নেমে আসে এক গভীর রুদ্ধতা যা গ্রামশির ভাষায় ‘শূন্যতা’ (ইন্টার্রেগনাম) তথা পুরোনো আদর্শ মরছে, নতুন কিছু এখনও জন্ম নেয়নি, আর সেই ফাঁকে বেড়ে ওঠে বিকৃত চেতনার কুৎসিত বিকল্পগুলো। আমরা আজ সেই শূন্যতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি।

তার মতো মানুষদের হারানো মানে শুধু স্মৃতি হারানো নয়। তা হলো বিবেক হারানো, দিকনির্দেশ হারানো, সাহসী উচ্চারণ হারানো। আর এই শূন্যতার স্থান দখল করে নিচ্ছে চিন্তার ক্লান্ত বাণিজ্য, বুদ্ধির লিজ ও আদর্শের করপোরেট সংস্করণ। এই ভয়াবহ বাস্তবতা আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার জন্য যথেষ্ট নয় কি?

এই মুহূর্তে আমাদের অন্তরের প্রার্থনাÑ বদরুদ্দীন উমর যেন আরও কিছুদিন আমাদের মাঝে থাকেন। তার প্রজ্ঞা, তার নৈতিক স্থিরতা এবং তার অনমনীয় মনোবল যেন আমাদের এই দুর্বিনীত সময়ের আঁধারে একটুখানি দীপ্তির রেখা হয়ে বিরাজ করেন। আমরা চাই, তিনি আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিন- কিভাবে দুর্বল, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে হয়; কিভাবে সাহসের সঙ্গে চিন্তার দীপ্তি ছড়িয়ে দিতে হয়; কিভাবে সত্য উচ্চারণে, শাসক ও শোষকের চোখে চোখ রেখে, অকপট থাকা যায়। কিন্তু তবুও আমরা জানি, সময় কোনো কিছুর জন্য প্রতীক্ষা করে না। মাইকেল মধুসূদন দত্তরে ভাষায় বলতে হয়Ñ জন্মিলে মরিতে হবে/ অমর কে কোথা কবে/ চিরস্থির কবে নীড়, হায় রে, জীবন-নদে? তার অনুপস্থিতি যদি সত্যিই আসন্ন হয়, তবে প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনেÑ আমরা কি প্রস্তুত তার উত্তরাধিকার বহন করার জন্য? বদরুদ্দীন উমর কেবল একজন চিন্তক নন; তিনি একটি পথ, একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি নৈতিক অনুশাসন। তার আদর্শ, তার লেখনী, এবং তার জীবনভর সংগ্রামী চেতনা এখন আমাদের কাছে শুধুমাত্র শ্রদ্ধার বিষয় নয়; এগুলো আমাদের বিবেকের পরীক্ষা। আমরা কি পারবো তার মতো সত্যের পাশে দাঁড়াতে? পারবো কি সুবিধার মোহে না ভেসে, শোষণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, যুক্তি ও সাহসে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে? আজ সময় আমাদের সামনে এই প্রশ্ন তুলে ধরে- শুধু বুদ্ধিজীবীদের নয়, সমস্ত নাগরিকের কাছে। বদরুদ্দীন উমরের উত্তরাধিকার বহন মানে শুধু স্মরণ নয়, তা এক নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই আমরা তাকে জীবিত রাখবো আমাদের চেতনায়, সাহসে এবং সংগ্রামের অনন্ত অঙ্গীকারে। যদি সত্যিই আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি, তবে আমাদের দায়িত্ব কেবল তার নাম স্মরণ করা নয়, তার চিন্তা, সংগ্রাম এবং আদর্শিক দৃঢ়তাকে পুনরুজ্জীবিত করা। বদরুদ্দীন উমরের জীবন ও কাজ ছিল যে প্রশ্নমালা দিয়ে ভরাÑ তোমরা কিভাবে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করো? রাষ্ট্র ও সমাজে কার পক্ষে থাকবে? বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা মানে কী? এই প্রশ্নগুলোকে আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনে দাঁড় করাতে হবে, আলোড়িত করতে হবে, এবং উত্তর খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তার দেখানো পথ, তার লেখা বই, তার তাত্ত্বিক অবস্থান এসব কিছুই হতে পারে নতুন প্রজন্মের জন্য এক জাগরণ-মন্ত্র, এক অন্তর্জাগতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার হাতিয়ার। নয়তো আমরা কেবল তার প্রস্থান নিয়ে শোক প্রকাশ করবো, দীর্ঘশ্বাস ফেলবো, অথচ আমাদের বাস্তবিক অবস্থান হবে এক শূন্যতার ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা। ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ালে দেখা যাবে আমরা কেবল একজন ‘বড় মাপের গাছ-মানুষ’-এর পতনে কাতর হয়েছি, কিন্তু সে গাছের বীজ রোপণ করিনি। আমরা স্মৃতিচারণ করেছি, কিন্তু অনুসরণ করিনি; শ্রদ্ধা জানিয়েছি, কিন্তু উত্তরাধিকার বহন করিনি। তার অবর্তমানে আমাদের ভূমিকা হবে এক নতুন পরীক্ষার ক্ষেত্র।

আমরা কি এই উত্তরাধিকারকে চিন্তার আলোয় বাঁচিয়ে রাখতে পারবো? নাকি তাকে কেবল একটি বিগতযুগের প্রতীক করে রেখে, নিজেদের নিশ্চুপতা আর সুবিধাবাদে আচ্ছন্ন হয়ে যাবো? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা যেভাবে দেব, সেটাই ঠিক করে দেবে বদরুদ্দীন উমরের আসল মর্যাদাÑ তিনি কি শুধু স্মৃতিতে থাকবেন, না চেতনায়ও।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

চীনের তিব্বত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প : আচরণগত অর্থনীতির আলোকে ভারত ও বাংলাদেশের উদ্বেগ

বর্ষায় সাপের উপদ্রব ও আমাদের করণীয়

মুল্যস্ফীতি: বাংলাদেশের বাজারে কি একে বশে আনা সম্ভব?

মানসিক স্বাস্থ্য : একটি মানবিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন

এ অবহেলার শেষ কোথায়?

কালো জাদুর কুসংস্কার : এক অন্ধকার হত্যাযজ্ঞের মুখোশ

ভোক্তা সচেতনতাই নিরাপদ খাদ্যের মূল চাবিকাঠি

ছবি

মোগল আমলের স্থাপত্য মির্জাপুর শাহী মসজিদ

পলিথিনের পাপ, প্রকৃতির প্রতিশোধ

হারিয়ে যাওয়া অভিযোগকৃত চেকের মামলা

জার্মানীতে এসবি ৬২ সম্মেলন : বাংলাদেশের নজর অর্থায়নের ন্যায্যতায়

ছবি

শতবর্ষ পরেও যার প্রয়োজন ফুরোয় না : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

আদিবাসী মুণ্ডা ভাষার বাঁচার আর্তনাদ

মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা : এক হারানো সম্ভাবনার খোঁজে

বিশ্ব রেড ক্রস দিবস

আত্মরক্ষার খালি-হাতের ইতিহাস ও আধুনিক বিস্তার

বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর : সমাজ সংস্কারের পথিকৃৎ

ছবি

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস “বিজয় বসন্ত“গ্রন্থের লেখক

পয়লা বৈশাখ : বাঙালির সংহতি চেতনার সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কমরেড রূপনারায়ণ রায়

সাংবাদিক-সাহিত্যিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু কথা

রেসলিং

কোটা সমাচার

বাজেট ২০২৪-২৫: তথ্যপ্রযুক্তি খাতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যাত্রা শুরু হোক এবার

সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১: উন্নত ও সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের মহাকাশ জয়

ছবি

নাটোরের সম্ভাব্য জিআই পণ্য

রিলিফ

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

tab

মুক্ত আলোচনা

বদরুদ্দীন উমর : কণ্ঠহীন সময়ের অনিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর

মাহরুফ চৌধুরী

বদরুদ্দীন উমর

বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে নিছক একজন ব্যক্তির নাম নয়, বরং তিনি একটি যুগান্তকারী ধারার প্রতিনিধি। তিনি কেবল একজন চিন্তক বা গবেষক নন, বরং নিজস্ব এক বৌদ্ধিক প্রতিষ্ঠান, যিনি দীর্ঘকাল যাবৎ যুক্তি, বিশ্লেষণ ও প্রতিবাদের নিরন্তর চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। নির্ভীক চিন্তা, নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং শ্রেণি-চেতনায় প্রোথিত একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যিনি সবসময় দাঁড়িয়েছেন শোষিত, নিপীড়িত ও প্রান্তিক মানুষের পক্ষে তা সে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মঞ্চ হোক কিংবা উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্র। তার জীবন ছিল এক অর্থে গ্রাম থেকে বিশ্বমঞ্চে ছড়িয়ে পড়া চিন্তার ধারাবাহিকতায় প্রবাহমান।

তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক অভিজাত প্রাগ্রসর পরিবারে, যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল অপরিসীম। কিন্তু এই সামাজিক অবস্থান তার চিন্তার স্বাধীনতাকে কখনোই বাঁধা দিতে পারেনি। বরং উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই সাংস্কৃতিক পুঁজি তিনি ব্যবহার করেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক শৃঙ্খলা ও সমাজ-রূপান্তরের এক কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে।

আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে অনেকেই সময়ের চাহিদা ও সুবিধার সঙ্গে আপস করেছেন, মতাদর্শগতভাবে ক্ষীণ হয়েছেন, কিংবা ক্ষমতার সমীপে নিরাপত্তা খুঁজেছেন। কিন্তু বদরুদ্দীন উমর ছিলেন সেই বিরল পুরুষদের একজন, যিনি নিঃসংশয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন সত্য ও ন্যায়সঙ্গত অবস্থানের পাশে। এদিক থেকে তাকে আমরা অ্যান্তোনিও গ্রামশি, ফ্রান্ৎজ ফানোঁ কিংবা এদুয়ার্দো গালিয়ানোর মতো প্রতিশ্রুতিশীল ও প্রতিরোধী বুদ্ধিজীবীদের ধারায় স্থান দিতে পারি যারা তাদের চিন্তা ও কলমকে রাজনৈতিক প্রতিরোধ এবং মুক্তির ভাষ্য হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে বুদ্ধিজীবীদের বড় একটি অংশ ক্ষমতার অনুকম্পা বা পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মতুষ্টি খুঁজে ফেরেন, সেখানে বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এক ব্যতিক্রমধর্মী আলো। চিন্তার ক্ষেত্রে তার আপসহীনতা, বিশ্লেষণে ঐতিহাসিক নিরপেক্ষতা এবং সংগ্রামী বাস্তবতার প্রতি দায়বদ্ধতা তাকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমি মানুষকে শ্রদ্ধা করি, তার অবস্থান বা মতাদর্শের জন্য নয়, শ্রদ্ধা করি তার মনুষ্যত্ব, নৈতিক দৃঢ়তা এবং আত্মমর্যাদাবোধের জন্য। মানুষের সীমাবদ্ধতা থাকবেই, কেউই মানবিক দোষত্রুটির উর্ধ্বে নয়; কিন্তু এই সীমাবদ্ধতাগুলোর ভেতর দিয়ে যে মানুষ নিজেকে অতিক্রম করতে চেষ্টা করে, যে মানুষ আদর্শের পাশে অটল থেকে জীবনের ঝুঁকি নিতে ভয় পায় না, তিনিই আমার শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হন।

বদরুদ্দীন উমর আমার কাছে তেমন একজন মানুষ। তার সঙ্গে আমার বিশ্বাস, মতাদর্শ, চিন্তাপদ্ধতি কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির বিপুল বৈপরিত্য রয়েছে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের যেদিকটি আমাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে, তা হলো তার আত্মমর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, আদর্শের কাছে আপসহীনতা এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রশ্নে আপস না করার অভ্যেস। যে সমাজে আমরা দেখতে পাই তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবীরা’ নিজস্ব অবস্থান বিকিয়ে দেন ক্ষমতা ও প্রভাবের কাছে, যারা নিজের কলম ও কণ্ঠকে ভাড়া দেন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দখলে, সেই সমাজে বদরুদ্দীন উমরের উপস্থিতি এক অনন্য ব্যতিক্রম।

আমার শৈশব থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তার চলার পথে আমি কখনো তাকে কারো পা চাটতে দেখিনি, তাকে কোনো কৌশলী আত্মসমর্পণে অংশ নিতে দেখিনি, কিংবা তাকে সুবিধাবাদী কনফরমিজমের ছায়ায় আশ্রয় নিতে দেখিনি। এই দৃঢ়তা, এই নৈতিক অনমনীয়তা তাকে আমাদের সময়ের সবচাইতে মর্যাদাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী করে তুলেছে। দর্শনের ইতিহাসে সক্রেটিস যেভাবে রাষ্ট্রক্ষমতার চোখে চোখ রেখে আত্মত্যাগ করেছিলেন, কিংবা ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিবেকানন্দ যেভাবে মনুষ্যত্বের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন তেমনি বদরুদ্দীন উমরও আমাদের কাছে হয়ে উঠেছেন প্রতিরোধের এক জীবন্ত প্রতীক। তিনি কখনো জনমোহিনী হতে চাননি, বরং সত্যভাষণে থেকেছেন একা, নীরব, দৃঢ়। তার এই স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং আত্মিক ঋজুতা আমাদের শেখায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব আসে মতের মিল নয়, নীতির দৃঢ়তা থেকে।

বদরুদ্দীন উমর জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও দীপ্তিময় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবারে, যার শিকড় প্রোথিত ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, আত্মমর্যাদা ও ন্যায়ভিত্তিক রাজনীতির অভিজ্ঞানভূমিতে। তার পিতা আবুল হাশিম ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম রাজনীতিতে এক অমলিন ও দুর্বার চরিত্র। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের অন্যতম পুরোধা হিসেবে তিনি জনসাধারণের অধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন, যা প্রতিটি জনসভায় তার অগ্নিগর্ভ বক্তৃতায় প্রতিফলিত হতো। তার কণ্ঠে শুধু বক্তৃতা ছিল না ছিল তাত্ত্বিক মাধুর্য, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা; যা শ্রোতাদের অন্তরকেও আলোড়িত করত। এই গৌরবময় রাজনৈতিক বংশধারার প্রেরণা আরও গভীর থেকে উৎসারিত হয়।

বদরুদ্দীন উমরের দাদা আবুল কাসেম ছিলেন একাধারে একজন তীক্ষèবুদ্ধিসম্পন্ন সাংবাদিক, চিন্তক এবং রাজনৈতিক সংগ্রামী। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯৪ সালে বিএ পাস করেছিলেন, যা সেই সময়কার মুসলিম সমাজে শিক্ষাগত উৎকর্ষের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে তার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতায়। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের পর তিনি আইন পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে প্রমাণ করেছিলেনÑ নৈতিকতার প্রশ্নে আপস নয়, প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ উত্তর। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আবুল কাসেমের ভ্রাতা, অর্থাৎ বদরুদ্দীন উমরের চাচা আব্দুল জব্বার, ভোপালের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে পরিবারের রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে উপমহাদেশীয় পরিসরে আরও বিস্তৃত করেছিলেন। এই পরিবারে রাজনীতি ছিল কেবল ক্ষমতার খেলা নয় এটি ছিল নৈতিক দায়, ইতিহাসের সঙ্গে সক্রিয় সংলাপ এবং প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়া চিন্তার আলো।

এই প্রেক্ষাপটে আমরা বুঝতে পারি, বদরুদ্দীন উমরের চিন্তার দৃঢ়তা, আদর্শিক নিষ্ঠা এবং আপসহীনতার ভিত কেবল ব্যক্তিজীবনের আত্মপ্রত্যয় থেকেই আসেনি এটি এক দীর্ঘ ইতিহাস, উত্তরাধিকারের বর্ণময় ধারাবাহিকতা এবং চিন্তাশীলতার এক সংগ্রামী রূপান্তরের ফসল। এই বংশগৌরবের উত্তরাধিকারী হয়ে বদরুদ্দীন উমর যেন এক ব্যতিক্রমী অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। যেখানে অধিকাংশ মানুষ পারিবারিক ঐতিহ্যের জৌলুসে নিশ্চিন্ত হয়ে পড়ে থাকেন, সেখানে তিনি তা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেও নিজেকে গড়েছেন এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পথে সংগ্রামের, ত্যাগের, আত্মজিজ্ঞাসার এবং প্রতিরোধের পথে। তার জীবনের পথরেখা ছিল না সুবিধাবাদী সোপানভিত্তিক সাফল্যের খতিয়ান, বরং তা ছিল নিরলস বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের এক নিরন্তর পথচলা। তিনি কখনো স্থবির হননি, কখনো নিজেকে বিকিয়ে দেননি, কখনো কোনো প্রতিষ্ঠান, আদর্শ কিংবা ক্ষমতার সীমানায় নিজেকে সীমাবদ্ধ করেননি।

বদরুদ্দীন উমর হলেন সেই বিরল চিন্তকদের একজন, যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনকে নিছক পা-িত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্র হিসেবে দেখেন না বরং তাকে সমাজ রূপান্তরের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। তার লেখালেখি নিছক ভাষার শৌখিনতা নয়; তা ছিল তার অভিজ্ঞতা, দর্শন, রাজনৈতিক অবস্থান ও জীবনবোধের প্রতিফলন। রাজনীতি থেকে সাহিত্য, ইতিহাস থেকে সমাজতত্ত্ব যেখানেই তিনি কলম ধরেছেন, সেখানেই নিজ চোখে দেখা জীবন-বাস্তবতা, সামাজিক বৈষম্য, রাষ্ট্রীয় অসংগতি এবং শোষণের নিরাভরণ চিত্রকে নির্মোহভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সার্ত্রের ভাষায় বলতে গেলে তিনি ছিলেন এক অর্থে আমাদের সময়ের ‘সক্রিয় বুদ্ধিজীবী’ (অঙগেজি ইন্টালেকচুয়াল), যিনি নিছক বিশ্লেষক নন, বরং সক্রিয়ভাবে সমাজের দায় কাঁধে তুলে নেন। তার চিন্তা ও বচনে ছিল র্যাঁবোর মতো বিদ্রোহ, গ্রামশির মতো শ্রেণি-সচেতনতা এবং ফ্রেইরের মতো প্রগতিশীল মুক্তির আকাক্সক্ষা। বদরুদ্দীন উমরের জীবন হল একটি আয়না যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে একজন বুদ্ধিজীবীর নিষ্কলুষতা, আত্মশুদ্ধি এবং আত্মনির্মাণ। সেই আয়নায় আমরা দেখতে পাই সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল এক ব্যক্তিত্ব, যাকে কোনো সরকার, আদর্শ, গোষ্ঠী কিংবা সুবিধাবাদ কখনো তার পথচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। তিনি ছিলেন নিজের আদর্শের কাছে নিষ্ঠাবান, সময়ের কাছে দায়বদ্ধ, এবং সত্যের কাছে অবিচল। এই মুহূর্তে ৯৪ বছর বয়সি বদরুদ্দীন উমর হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কক্ষে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন। তার এই অসুস্থতা কেবল একজন প্রবীণ ব্যক্তির শারীরিক সংকট নয়; এটি বাংলাদেশের এক পর্বান্তরের সম্ভাব্য সূচনা। আমরা যারা আজকের তথাকথিত ‘উন্নয়নের’ হুজুগে চোখে ঠুলি পরে চলি, যাদের মননের জগতে বিজ্ঞাপনের ঝলকানি আর প্রচারের কৃত্রিম উন্মাদনা, তারা হয়তো উপলব্ধি করতে পারি না একজন বদরুদ্দীন উমরের প্রস্থান কী ভয়াবহ শূন্যতা রেখে যাবে আমাদের আত্মিক ও চিন্তার জগতে।

এই মানুষটি ছিলেন আমাদের সময়ের বিবেক, এক চলমান প্রতিরোধের ভাষ্য। যে প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনকে কেবল জাতিসত্তার অধিকার হিসেবে নয়, বরং শ্রেণি-অভিসন্ধির আলোয় পুনর্বিন্যস্ত করে বিশ্লেষণ করেছে তার পুরোভাগে ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। তিনি ভাষাকে রাজনীতির বাহন হিসেবে, সংস্কৃতিকে শ্রেণিসংগ্রামের অন্তর্গত উপাদান হিসেবে দেখেছেন। তিনি যেভাবে সমাজ বিশ্লেষণে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে বাংলার বাস্তবতায় খাপ খাইয়ে তুলে ধরেছেন, তাতে তার অবস্থান আমাদের চিন্তার ভূগোলের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। এই সময়ে, যখন কর্পোরেট ও দলীয় বিভাজনের দ্বারা আত্মসমালোচনার জায়গা সংকুচিত, চিন্তার মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে, তখন বদরুদ্দীন উমরের মতো একজন নির্ভীক, দার্শনিক মননের ধারক এবং ইতিহাস-সচেতন বুদ্ধিজীবীর অনুপস্থিতি এক ভয়াবহ সংকেত। তার চলে যাওয়া মানে শুধু একজন মানুষ হারিয়ে যাওয়া নয়। এর মানে হলো একটি ধারাবাহিক প্রতিরোধ-সচেতন চিন্তার ধারার পরিসমাপ্তি, একটি বিবেকী কণ্ঠের অবসান।

তিনি নিছক ইতিহাসবিদ, সাহিত্য সমালোচক বা সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একান্তভাবে আমাদের বদরুদ্দীন উমরÑ যিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শিখিয়েছেন কিভাবে যুক্তি দিয়ে, ন্যায় দিয়ে, নৈতিক সাহস দিয়ে একটি শোষণমূলক বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। তার শারীরিক দুর্বলতার খবরে কেবল মন খারাপ হয় না, হৃদয়ের গভীরে এক দীর্ঘশ্বাস ওঠে- এই সমাজ কি তার চিন্তা, চেতনা ও প্রজ্ঞাকে ধারণ করতে পেরেছে? তার প্রস্থান কি আমাদের আত্মিক দৈন্যকে আরও অনাবৃত করে তুলবে?

আজ তার বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা আমাদের এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় যে, আমরা এক ভয়াবহ বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের মধ্যে আছি। চিন্তার স্বচ্ছতা, নৈতিক দৃঢ়তা, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা এবং নেতৃত্বের সাহস সবই যেন ক্রমেই বিলুপ্তির পথে। বদরুদ্দীন উমরের মতো মানুষেরা, যারা তাদের চিন্তা ও জীবনকে একটি সমগ্রত্বে রূপ দিয়েছিলেন, যখন একে একে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নেন, তখন তা কেবল প্রজন্মান্তরের একটি বোধের অবসান নয়- তা হয়ে ওঠে মুক্তচিন্তার সাংস্কৃতিক শূন্যতার আলামত।

উমরের অনুপস্থিতির প্রেক্ষাপটে আমরা চেয়ে দেখি পেছনে পড়ে থাকে একদল কথিত ‘বুদ্ধিজীবী’ যাদের কণ্ঠে নেই সত্য উচ্চারণের সাহস, যাদের বিবেচনায় নেই নৈতিক দৃঢ়তা, যাঁদের লেখায় নেই দর্শনের আলো বা ইতিহাসের গভীরতা। তারা সময়ের সুবিধাবাদী ঢেউয়ে দুলতে দুলতে হয়ে উঠেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক ফড়িয়া- কখনো দলীয় প্রচারক, কখনো কর্পোরেট মুখপাত্র। তাদের চিন্তার শিকড় নেই ইতিহাসে, তাদের উচ্চারণে নেই জনগণের ভাষা। বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এক অর্থে সেই ‘সংকট-চিহ্নিত সময়ের’ প্রতিরোধী কণ্ঠ, যার উপস্থিতি আমাদের চিন্তাজগতে একটি ভারসাম্য এনে দিত। যখন এমন ব্যক্তিত্বেরা একে একে চলে যান, তখন সমাজজীবনে নেমে আসে এক গভীর রুদ্ধতা যা গ্রামশির ভাষায় ‘শূন্যতা’ (ইন্টার্রেগনাম) তথা পুরোনো আদর্শ মরছে, নতুন কিছু এখনও জন্ম নেয়নি, আর সেই ফাঁকে বেড়ে ওঠে বিকৃত চেতনার কুৎসিত বিকল্পগুলো। আমরা আজ সেই শূন্যতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি।

তার মতো মানুষদের হারানো মানে শুধু স্মৃতি হারানো নয়। তা হলো বিবেক হারানো, দিকনির্দেশ হারানো, সাহসী উচ্চারণ হারানো। আর এই শূন্যতার স্থান দখল করে নিচ্ছে চিন্তার ক্লান্ত বাণিজ্য, বুদ্ধির লিজ ও আদর্শের করপোরেট সংস্করণ। এই ভয়াবহ বাস্তবতা আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার জন্য যথেষ্ট নয় কি?

এই মুহূর্তে আমাদের অন্তরের প্রার্থনাÑ বদরুদ্দীন উমর যেন আরও কিছুদিন আমাদের মাঝে থাকেন। তার প্রজ্ঞা, তার নৈতিক স্থিরতা এবং তার অনমনীয় মনোবল যেন আমাদের এই দুর্বিনীত সময়ের আঁধারে একটুখানি দীপ্তির রেখা হয়ে বিরাজ করেন। আমরা চাই, তিনি আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিন- কিভাবে দুর্বল, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে হয়; কিভাবে সাহসের সঙ্গে চিন্তার দীপ্তি ছড়িয়ে দিতে হয়; কিভাবে সত্য উচ্চারণে, শাসক ও শোষকের চোখে চোখ রেখে, অকপট থাকা যায়। কিন্তু তবুও আমরা জানি, সময় কোনো কিছুর জন্য প্রতীক্ষা করে না। মাইকেল মধুসূদন দত্তরে ভাষায় বলতে হয়Ñ জন্মিলে মরিতে হবে/ অমর কে কোথা কবে/ চিরস্থির কবে নীড়, হায় রে, জীবন-নদে? তার অনুপস্থিতি যদি সত্যিই আসন্ন হয়, তবে প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনেÑ আমরা কি প্রস্তুত তার উত্তরাধিকার বহন করার জন্য? বদরুদ্দীন উমর কেবল একজন চিন্তক নন; তিনি একটি পথ, একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি নৈতিক অনুশাসন। তার আদর্শ, তার লেখনী, এবং তার জীবনভর সংগ্রামী চেতনা এখন আমাদের কাছে শুধুমাত্র শ্রদ্ধার বিষয় নয়; এগুলো আমাদের বিবেকের পরীক্ষা। আমরা কি পারবো তার মতো সত্যের পাশে দাঁড়াতে? পারবো কি সুবিধার মোহে না ভেসে, শোষণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, যুক্তি ও সাহসে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে? আজ সময় আমাদের সামনে এই প্রশ্ন তুলে ধরে- শুধু বুদ্ধিজীবীদের নয়, সমস্ত নাগরিকের কাছে। বদরুদ্দীন উমরের উত্তরাধিকার বহন মানে শুধু স্মরণ নয়, তা এক নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই আমরা তাকে জীবিত রাখবো আমাদের চেতনায়, সাহসে এবং সংগ্রামের অনন্ত অঙ্গীকারে। যদি সত্যিই আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি, তবে আমাদের দায়িত্ব কেবল তার নাম স্মরণ করা নয়, তার চিন্তা, সংগ্রাম এবং আদর্শিক দৃঢ়তাকে পুনরুজ্জীবিত করা। বদরুদ্দীন উমরের জীবন ও কাজ ছিল যে প্রশ্নমালা দিয়ে ভরাÑ তোমরা কিভাবে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করো? রাষ্ট্র ও সমাজে কার পক্ষে থাকবে? বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা মানে কী? এই প্রশ্নগুলোকে আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনে দাঁড় করাতে হবে, আলোড়িত করতে হবে, এবং উত্তর খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তার দেখানো পথ, তার লেখা বই, তার তাত্ত্বিক অবস্থান এসব কিছুই হতে পারে নতুন প্রজন্মের জন্য এক জাগরণ-মন্ত্র, এক অন্তর্জাগতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার হাতিয়ার। নয়তো আমরা কেবল তার প্রস্থান নিয়ে শোক প্রকাশ করবো, দীর্ঘশ্বাস ফেলবো, অথচ আমাদের বাস্তবিক অবস্থান হবে এক শূন্যতার ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা। ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ালে দেখা যাবে আমরা কেবল একজন ‘বড় মাপের গাছ-মানুষ’-এর পতনে কাতর হয়েছি, কিন্তু সে গাছের বীজ রোপণ করিনি। আমরা স্মৃতিচারণ করেছি, কিন্তু অনুসরণ করিনি; শ্রদ্ধা জানিয়েছি, কিন্তু উত্তরাধিকার বহন করিনি। তার অবর্তমানে আমাদের ভূমিকা হবে এক নতুন পরীক্ষার ক্ষেত্র।

আমরা কি এই উত্তরাধিকারকে চিন্তার আলোয় বাঁচিয়ে রাখতে পারবো? নাকি তাকে কেবল একটি বিগতযুগের প্রতীক করে রেখে, নিজেদের নিশ্চুপতা আর সুবিধাবাদে আচ্ছন্ন হয়ে যাবো? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা যেভাবে দেব, সেটাই ঠিক করে দেবে বদরুদ্দীন উমরের আসল মর্যাদাÑ তিনি কি শুধু স্মৃতিতে থাকবেন, না চেতনায়ও।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

back to top