alt

মুক্ত আলোচনা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: উদ্ভাবনে পাল্টে গেছে নাগরিক সেবা

আদনান ফয়সল

: রোববার, ১২ ডিসেম্বর ২০২১

প্রত্যন্ত গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক আবদুর রব। ভোরে রওনা হয়ে ৩০ কি.মি. সাইকেল চালিয়ে শহরে আসতেন মাসের বেতন তুলতে। কিন্তু ব্যাংকে এসে দেখতেন বিশাল লাইন। সেই লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে থাকে কিন্তু লাইন শেষ হয় না। মাঝে মাঝে বেতন না তুলেই সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি ফিরে যেতে হতো। গল্পটা খুব বেশিদিন আগের নয়, মাত্র এক যুগ আগের বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের মানুষের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সেবা নেওয়ার উপায় ছিল ঠিক এমনই। এক যুগের ব্যবধানে মানুষের জীবনের গল্পের ধরণটাই পাল্টে গেছে। পাল্টেছে জীবনের গতিপথ!

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের এক যুগের অভিযাত্রায় তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটেছে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন নতুন উদ্ভাবন, নাগরিক সেবা এবং সরকারি-বেসরকারি খাতের সমৃদ্ধিসহ বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে অবিস্মরণীয় বিপ্লব। সরকারের তৃণমূল পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি সেবার সম্প্রসারণের ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিসহ কারিগরি খাতে এসেছে সমৃদ্ধি। শুধু শহরে নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন বিভিন্ন নাগরিক সেবা। সাম্প্রতিক এটুআই কর্তৃক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রযুক্তিবান্ধব এই ধরনের উদ্ভাবনের ফলে ২০২১ সাল পর্যন্ত সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সময় ৯.২৬ বিলিয়ন দিন, খরচ ১১.২২ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং ৫.১৯ বিলিয়ন যাতায়াত হ্রাস পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ এর কারণে সমগ্র বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত, স্থবির হয়ে পড়েছিল অর্থনীতিসহ সকল কার্যক্রম, ঠিক তখনও প্রযুক্তিবান্ধব বিভিন্ন সেবা উদ্ভাবনের ফলে চলমান ছিল রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ। যার সুফল সরাসরি ভোগ করেছে দেশের মানুষ।

বৈশ্বিক করোনা সংকট মোকাবেলায় নাগরিকদের জন্য করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যেকোন প্রয়োজনীয় পরামর্শ, করোনা সম্পর্কিত সকল সেবার হালনাগাদ তথ্যের জন্য করোনা ইনফো পোর্টাল চালু করা হয়। এটুআই-এর উদ্যোগে করোনা বিষয়ক তথ্যসেবা, টেলিমেডিসিন সেবা, সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য জরুরী খাদ্য সহায়তা, সেলফ করোনা টেস্টিংসহ অনেক নতুন সেবা যুক্ত করা হয় জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ নম্বরে। নাগরিকদের সহজে করোনার টিকা প্রদানে সুরক্ষা প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়, যার মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৭ কোটির অধিক রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ‘হোম অফিস’ এর মাধ্যমে সচল ছিল সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দাপ্তরিক কার্যক্রম। ই-নথি কার্যক্রমের মাধ্যমে সকল সরকারি দাপ্তরিক কার্য সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা হয়। এমনকি বিচারিক কার্যক্রমেও ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে জামিনের শুনানি সম্পন্ন করেছে। ঘরে বসে দেশ-বিদেশে চাকরির নিবন্ধন, হজযাত্রার নিবন্ধন, বিভিন্ন ধরনের দাপ্তরিক ফরম, ট্যাক্স, জাতীয় পরিচয়পত্র, ভূমি রেকর্ড ডিজিটালকরণ, ই-গভর্ন্যান্স ও ই-সেবা, টেন্ডার বা দরপত্রে অংশগ্রহণ ইত্যাদি কাজকর্ম অনলাইনেই সম্পন্ন করা যাচ্ছে এখন। এছাড়া এটুআই-এর সহায়তায় ই-নামজারি, আরএস খতিয়ান সিস্টেম, অনলাইন গ্রিভেন্স রিড্রেস সিস্টেম, জিটুপি পদ্ধতিতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভাতা প্রদান ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম সরকারি বিভিন্ন সেবাকে নাগরিকদের জন্য আরও সহজ করে তুলেছে।

অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর মোবাইল ব্যাংকিং সাধারণ মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে স্বস্তি। এছাড়া ইউনিয়ন, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ডে স্থাপিত ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং-এর ফলে ব্যাংকিং কার্যক্রম পৌঁছে গেছে শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। দেশের ই-কমার্স ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে গ্রামীণ ই-কমার্স প্ল্যটফর্ম ‘একশপ’। যেখানে গ্রামীণ উৎপাদনকারীরা নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে পারছেন কোন মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই।

ই-গভর্মেন্ট বাস্তবায়নে বিদ্যমান ডাটা সেন্টারের হোস্টিং ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/প্রতিষ্ঠানের ডাটা সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে স্থাপিত ডাটা সেন্টারের সম্প্রসারণ করা হয়েছে। দূর্যোগকালীন সময়ে জাতীয় ডাটা সেন্টারের গুরুত্বপূর্ণ সেবা ও তথ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য যশোরে অবস্থিত শেখ হাসিনা সফ্টওয়্যার টেকনোলজি পার্কে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজাস্টার রিকভারি ডাটা সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আরেকটি বড় অর্জনের তালিকায় যোগ হয়েছে টিয়ার ফোর জাতীয় ডাটা সেন্টার (Tier-IV National Data Centre)। তথ্য সুরক্ষা ও অধিক হোস্টিং ক্ষমতার এই ডাটা সেন্টারটি বিশ্বের ৭ম ডাটা সেন্টার, যা আন্তর্জাতিক মানের এবং যুক্তরাষ্ট্রের আপটাইম ইনস্টিটিউট থেকে এর ডিজাইন অনুমোদিত। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে এই ডাটা সেন্টারটি স্থাপিত হয়েছে।

‘তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা নয়, শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার’-এই স্লোগানকে সামনে নিয়ে দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও সহজ করে তুলতে এটুআই-এর সহযোগিতায় তৈরি করা হয়েছে ‘শিক্ষক বাতায়ন’ ও ‘কিশোর বাতায়ন’ এর মত প্ল্যাটফর্ম। এছাড়া রয়েছে ‘মুক্তপাঠ’ নামক বাংলা ভাষায় সর্ববৃহৎ ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম। অন্যদিকে করোনার মতো সংকটময় সময়েও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে টেলিভিশন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকের মাঝে সহজ ও দ্রুত সময়ে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে উদ্ভাবন করা হয়েছে তথ্য ও প্রযুক্তিগত সেবা ‘কৃষি বাতায়ন’।

বর্তমানে বাংলাদেশ আইসিটি খাতে রপ্তানি আয় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা এক যুগ আগেও ছিল শূন্যের কোঠায়। প্রযুক্তির বিকেন্দ্রীকরণে দেশব্যাপী ৩০টি হাইটেক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে ০৯টি পার্কের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৩৩টি বিশেষায়িত ফোরআইআর ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক বা হাই-টেক পার্কে স্পেস বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বর্তমানে ১৬৬টি কোম্পানি কাজ করছে। এখানে মোবাইল ফোন সংযোজন, অপটিক্যাল ফাইবার, কিয়স্ক মেশিন, ডায়ালাইসিসি মেশিন সংযোজনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি ও পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হাইটেক পার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা বাংলাদেশকে প্রযুক্তি রপ্তানিতে অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে।

‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ এর মাধ্যমে সরকারি সহায়তা লাভের পথও সুগম হচ্ছে। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠার পর স্টার্টআপ মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে সিড স্টেজে সর্বোচ্চ এক কোটি এবং গ্রোথ গাইডেড স্টার্টআপ রাউন্ডে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। ইতোমধ্যে শতাধিক স্টার্টআপকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক এফ-কমার্সের ব্যাপক বিস্তৃতিতে মূলধারার ব্যবসায়ীরাও প্রযুক্তির সহায়তা নিতে এফ-কমার্সমুখী হচ্ছেন। এছাড়া ই-কমার্স ও এফ-কমার্স খাত প্রসারের ফলে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। আইসিটি বিভাগ তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দুয়ার তৈরি করে আসছে। বর্তমান বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে কর্মদক্ষ করে গড়ে তুলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে কাজে লাগাতে পারলে অচিরেই বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। যার ফলে স্থিতিশীলতা আসবে সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ আজ আর স্বপ্ন নয়, বরং তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবনে সেবাকে নিয়ে গিয়েছেন হাতের মুঠোয়।

নাগরিক সেবার এইসব উদ্ভাবনের ফলে বৈশ্বিক তথ্যপ্রযুক্তি অঙ্গনে বাংলাদেশ এখন এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সাউথ-সাউথ ভিশনারী অ্যাওয়ার্ড, আইসিটি সাসটেইনেবল অ্যাওয়ার্ড, ডব্লিউএসআইএস অ্যাওয়ার্ড, গ্রোবাল আইসিটি অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড এবং এ্যাপিকটা অ্যাওয়ার্ডসহ বেশকিছু সম্মানজনক স্বীকৃতি এর উদাহরণ। তরুণ প্রজন্ম কেবল চাকরিমুখী না হয়ে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় নিজেরাই গড়ে তুলছে ছোট-বড় আইটি প্রতিষ্ঠান, ই-কমার্স ব্যবসা, অ্যাপভিত্তিক সেবাসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটসহ কয়েকটি বড় প্রাপ্তি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাত, দক্ষ মানবসম্পদ।

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: উদ্ভাবনে পাল্টে গেছে নাগরিক সেবা

আদনান ফয়সল

রোববার, ১২ ডিসেম্বর ২০২১

প্রত্যন্ত গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক আবদুর রব। ভোরে রওনা হয়ে ৩০ কি.মি. সাইকেল চালিয়ে শহরে আসতেন মাসের বেতন তুলতে। কিন্তু ব্যাংকে এসে দেখতেন বিশাল লাইন। সেই লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে থাকে কিন্তু লাইন শেষ হয় না। মাঝে মাঝে বেতন না তুলেই সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি ফিরে যেতে হতো। গল্পটা খুব বেশিদিন আগের নয়, মাত্র এক যুগ আগের বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের মানুষের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সেবা নেওয়ার উপায় ছিল ঠিক এমনই। এক যুগের ব্যবধানে মানুষের জীবনের গল্পের ধরণটাই পাল্টে গেছে। পাল্টেছে জীবনের গতিপথ!

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের এক যুগের অভিযাত্রায় তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটেছে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন নতুন উদ্ভাবন, নাগরিক সেবা এবং সরকারি-বেসরকারি খাতের সমৃদ্ধিসহ বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে অবিস্মরণীয় বিপ্লব। সরকারের তৃণমূল পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি সেবার সম্প্রসারণের ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিসহ কারিগরি খাতে এসেছে সমৃদ্ধি। শুধু শহরে নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন বিভিন্ন নাগরিক সেবা। সাম্প্রতিক এটুআই কর্তৃক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রযুক্তিবান্ধব এই ধরনের উদ্ভাবনের ফলে ২০২১ সাল পর্যন্ত সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সময় ৯.২৬ বিলিয়ন দিন, খরচ ১১.২২ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং ৫.১৯ বিলিয়ন যাতায়াত হ্রাস পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ এর কারণে সমগ্র বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত, স্থবির হয়ে পড়েছিল অর্থনীতিসহ সকল কার্যক্রম, ঠিক তখনও প্রযুক্তিবান্ধব বিভিন্ন সেবা উদ্ভাবনের ফলে চলমান ছিল রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ। যার সুফল সরাসরি ভোগ করেছে দেশের মানুষ।

বৈশ্বিক করোনা সংকট মোকাবেলায় নাগরিকদের জন্য করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যেকোন প্রয়োজনীয় পরামর্শ, করোনা সম্পর্কিত সকল সেবার হালনাগাদ তথ্যের জন্য করোনা ইনফো পোর্টাল চালু করা হয়। এটুআই-এর উদ্যোগে করোনা বিষয়ক তথ্যসেবা, টেলিমেডিসিন সেবা, সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য জরুরী খাদ্য সহায়তা, সেলফ করোনা টেস্টিংসহ অনেক নতুন সেবা যুক্ত করা হয় জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ নম্বরে। নাগরিকদের সহজে করোনার টিকা প্রদানে সুরক্ষা প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়, যার মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৭ কোটির অধিক রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ‘হোম অফিস’ এর মাধ্যমে সচল ছিল সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দাপ্তরিক কার্যক্রম। ই-নথি কার্যক্রমের মাধ্যমে সকল সরকারি দাপ্তরিক কার্য সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা হয়। এমনকি বিচারিক কার্যক্রমেও ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে জামিনের শুনানি সম্পন্ন করেছে। ঘরে বসে দেশ-বিদেশে চাকরির নিবন্ধন, হজযাত্রার নিবন্ধন, বিভিন্ন ধরনের দাপ্তরিক ফরম, ট্যাক্স, জাতীয় পরিচয়পত্র, ভূমি রেকর্ড ডিজিটালকরণ, ই-গভর্ন্যান্স ও ই-সেবা, টেন্ডার বা দরপত্রে অংশগ্রহণ ইত্যাদি কাজকর্ম অনলাইনেই সম্পন্ন করা যাচ্ছে এখন। এছাড়া এটুআই-এর সহায়তায় ই-নামজারি, আরএস খতিয়ান সিস্টেম, অনলাইন গ্রিভেন্স রিড্রেস সিস্টেম, জিটুপি পদ্ধতিতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভাতা প্রদান ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম সরকারি বিভিন্ন সেবাকে নাগরিকদের জন্য আরও সহজ করে তুলেছে।

অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর মোবাইল ব্যাংকিং সাধারণ মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে স্বস্তি। এছাড়া ইউনিয়ন, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ডে স্থাপিত ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং-এর ফলে ব্যাংকিং কার্যক্রম পৌঁছে গেছে শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। দেশের ই-কমার্স ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে গ্রামীণ ই-কমার্স প্ল্যটফর্ম ‘একশপ’। যেখানে গ্রামীণ উৎপাদনকারীরা নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে পারছেন কোন মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই।

ই-গভর্মেন্ট বাস্তবায়নে বিদ্যমান ডাটা সেন্টারের হোস্টিং ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/প্রতিষ্ঠানের ডাটা সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে স্থাপিত ডাটা সেন্টারের সম্প্রসারণ করা হয়েছে। দূর্যোগকালীন সময়ে জাতীয় ডাটা সেন্টারের গুরুত্বপূর্ণ সেবা ও তথ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য যশোরে অবস্থিত শেখ হাসিনা সফ্টওয়্যার টেকনোলজি পার্কে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজাস্টার রিকভারি ডাটা সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আরেকটি বড় অর্জনের তালিকায় যোগ হয়েছে টিয়ার ফোর জাতীয় ডাটা সেন্টার (Tier-IV National Data Centre)। তথ্য সুরক্ষা ও অধিক হোস্টিং ক্ষমতার এই ডাটা সেন্টারটি বিশ্বের ৭ম ডাটা সেন্টার, যা আন্তর্জাতিক মানের এবং যুক্তরাষ্ট্রের আপটাইম ইনস্টিটিউট থেকে এর ডিজাইন অনুমোদিত। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে এই ডাটা সেন্টারটি স্থাপিত হয়েছে।

‘তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা নয়, শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার’-এই স্লোগানকে সামনে নিয়ে দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও সহজ করে তুলতে এটুআই-এর সহযোগিতায় তৈরি করা হয়েছে ‘শিক্ষক বাতায়ন’ ও ‘কিশোর বাতায়ন’ এর মত প্ল্যাটফর্ম। এছাড়া রয়েছে ‘মুক্তপাঠ’ নামক বাংলা ভাষায় সর্ববৃহৎ ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম। অন্যদিকে করোনার মতো সংকটময় সময়েও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে টেলিভিশন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকের মাঝে সহজ ও দ্রুত সময়ে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে উদ্ভাবন করা হয়েছে তথ্য ও প্রযুক্তিগত সেবা ‘কৃষি বাতায়ন’।

বর্তমানে বাংলাদেশ আইসিটি খাতে রপ্তানি আয় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা এক যুগ আগেও ছিল শূন্যের কোঠায়। প্রযুক্তির বিকেন্দ্রীকরণে দেশব্যাপী ৩০টি হাইটেক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে ০৯টি পার্কের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৩৩টি বিশেষায়িত ফোরআইআর ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক বা হাই-টেক পার্কে স্পেস বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বর্তমানে ১৬৬টি কোম্পানি কাজ করছে। এখানে মোবাইল ফোন সংযোজন, অপটিক্যাল ফাইবার, কিয়স্ক মেশিন, ডায়ালাইসিসি মেশিন সংযোজনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি ও পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হাইটেক পার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা বাংলাদেশকে প্রযুক্তি রপ্তানিতে অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে।

‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ এর মাধ্যমে সরকারি সহায়তা লাভের পথও সুগম হচ্ছে। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠার পর স্টার্টআপ মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে সিড স্টেজে সর্বোচ্চ এক কোটি এবং গ্রোথ গাইডেড স্টার্টআপ রাউন্ডে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। ইতোমধ্যে শতাধিক স্টার্টআপকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক এফ-কমার্সের ব্যাপক বিস্তৃতিতে মূলধারার ব্যবসায়ীরাও প্রযুক্তির সহায়তা নিতে এফ-কমার্সমুখী হচ্ছেন। এছাড়া ই-কমার্স ও এফ-কমার্স খাত প্রসারের ফলে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। আইসিটি বিভাগ তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দুয়ার তৈরি করে আসছে। বর্তমান বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে কর্মদক্ষ করে গড়ে তুলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে কাজে লাগাতে পারলে অচিরেই বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। যার ফলে স্থিতিশীলতা আসবে সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ আজ আর স্বপ্ন নয়, বরং তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবনে সেবাকে নিয়ে গিয়েছেন হাতের মুঠোয়।

নাগরিক সেবার এইসব উদ্ভাবনের ফলে বৈশ্বিক তথ্যপ্রযুক্তি অঙ্গনে বাংলাদেশ এখন এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সাউথ-সাউথ ভিশনারী অ্যাওয়ার্ড, আইসিটি সাসটেইনেবল অ্যাওয়ার্ড, ডব্লিউএসআইএস অ্যাওয়ার্ড, গ্রোবাল আইসিটি অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড এবং এ্যাপিকটা অ্যাওয়ার্ডসহ বেশকিছু সম্মানজনক স্বীকৃতি এর উদাহরণ। তরুণ প্রজন্ম কেবল চাকরিমুখী না হয়ে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় নিজেরাই গড়ে তুলছে ছোট-বড় আইটি প্রতিষ্ঠান, ই-কমার্স ব্যবসা, অ্যাপভিত্তিক সেবাসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটসহ কয়েকটি বড় প্রাপ্তি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাত, দক্ষ মানবসম্পদ।

back to top