alt

মুক্ত আলোচনা

আনন্দ বেদনার ঈদ উৎসব

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

: শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২

যখন ছোট ছিলাম, বাবা-মায়ের সাথে ঈদ করতে হতো গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের বাড়ি বলতে তখনকার জেলা শহরে আমার জন্মভিটায়। বাড়িতে সাত ভাই-বোনের উপস্থিতিতে রোজার ও কোরবানি ঈদ দুটোই পালিত হতো আনন্দমুখর পরিবেশে। মনে পড়ে, ঈদের বেশ আগেই আমার স্কুল শিক্ষক বাবা বাজার থেকে মোরগ, সেমাইসহ প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনে আনতেন। ছোট ভাই-বোনদের জন্য সাদামাটা জামাকাপড়। বড়দের জন্য বরাদ্দ ছিল সেই পুরনো পোশাক। মাকে ঈদে কখনো নতুন শাড়ি পরতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শেষ রজমানে ঈদের চাঁদ দেখার জন্য শহরময় ধুম পড়ে যেত।

সূর্য পশ্চিম গগনে এলিয়ে পড়তেই পাড়ার ছেলেরা বেরিয়ে পড়তো রাস্তায়। গাছের আড়াল থেকে উঁকি মেরে কে আগে চাঁদ দেখতে পায় এমন প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতো। ঘরের দোতলার ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাই-বোনেরা মিলে ঈদের সরু বাঁকা চাঁদ দেখার জন্য অপেক্ষা করতাম। চাঁদ দেখতে পেলে মা আমাদের সবাইকে চিনি গুলে সরবত বানিয়ে খাওয়াতেন। চাঁদ দেখা গেলে মসজিদে আজান হতো। কখনো ডিসি’র অফিস থেকে সাইরেন বাজিয়ে শোনানো হতো। ঈদুল আযহায় কোরবানির পশু কেনা নিয়ে আমাদের মাঝে বিস্ময়কর উত্তেজনা কাজ করতো। বাবা বেশির ভাগ সময় গরু কোরবানিতে আগ্রহী ছিলেন। আমার ছেলেবেলায় একটা মাঝারি আকারের গরু আঠারো-বিশ টাকায় পাওয়া যেত। সে গরুর সাত ভাগের এক ভাগে যে মাংস পাওয়া যেত তা দিয়ে গরিব-দুখীদের বিলিয়ে আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে খাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ ছিল। সেসময় ঈদকে সামনে রেখে জিনিষপত্রের দাম বাড়ানোর এমন অশুভ প্রতিযোগিতা ছিল না।

সকালে গোসল করে মা-বাবাকে সালাম করে ঈদের জামাতে নামাজ পড়ার একটা অদ্ভুত শিহরণ ছিল। দুটো ঈদেই মা যত্নের সাথে সেমাই রান্না করতেন। গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে সেমাই অথবা সরু চালের পায়েশের আলাদা স্বাদ ছিল। ঈদের নামাজ শেষে নতুন জামা পরে ছোটরা সেমাই খেয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়াতাম। দুপুর গড়াতেই মায়ের রান্না শেষ হয়ে যেত। এত ঝটপট রান্নায় মায়ের সাথে অন্য কেউ কুলিয়ে উঠতে পারতেন না। কম মশলায় মায়ের সযত্নে রান্না মজাদার পোলাও-মাংস খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়তাম। মায়ের হাতে আলাদা এক জাদু ছিল। আমরা ছোট তিন ভাই-বোন কখনো বাবার সাথে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যেতাম। বাসার কাজের লোকেরাও আমাদের ঘরের ঈদ উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে যেত। মা সবাইকে এই দিনে অন্যসব মেহমানের মতো নিজ হাতে পরিবেশন করে খাওয়াতেন।

এ দিনে কাজের লোকদের কাউকে কিছু করতে দেওয়া হতো না। পাড়া-পড়শিরাও বাসায় এসে ধুমধাম করে খাওয়ায় শামিল হতেন। ফকির, মিসকিনদের পেটভরে খাওয়ানো হতো ভালো ভালো খাবার। একটু বড় হয়ে যখন কলেজে উঠেছি তখন বাবার অনুমতি নিয়ে বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যেতাম। সারা দিন কেটে যেত হৈ হুল্লোরে। কে কতজনের বাসায় খেতে পেরেছে তা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা লেগে যেত। বন্ধু-বান্ধবের বাসায় নিজের বাসার মতোই পেটপুরে খেতাম, কত কী মজা করতাম। বন্ধু-বান্ধবের মা-বাবারাও আমাদের পুত্রসম স্নেহ-আদরে ভরিয়ে দিতেন। ওই দিনগুলোর মজাই ছিল আলাদা।

কর্মজীবনে ঈদ উপলক্ষে ঢাকা থেকে বউ-বাচ্চা নিয়ে বাবা-মায়ের আকর্ষণে ছুটে গেছি বাড়িতে। এমনকি দেশের বাইরে থেকেও ঈদের সময়টাকে বেছে নিতাম ছুটিতে দেশে আসার জন্য। তখন মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন এমনকি বন্ধু-বান্ধবের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ মিলতো। সবার জন্য সাধ্যমতো জামাকাপড় কিনে আনতাম। ঈদের দিনটিতে বাবা-মা সন্তানকে কাছে পেয়ে যে কী খুশি হতেন তা বলে শেষ করা যাবে না। বড় হয়ে ঈদুল আযহায় বেশির ভাগ সময় খাসি কোরবানী দিতাম। নিজে হাটে দিয়ে খাসি কিনতাম, লোক ডেকে জবাই করাতাম, বাসার একটি হেলানো গাছের সাথে ঝুলিয়ে চামড়া ছাড়াতাম। নিজ হাতে কাটাকুটি করে মাংস বিলিয়ে দিতাম। আমার স্ত্রী পরম যত্নে নানা পদের মাংস রান্না করতো। বাসায় বন্ধু-বান্ধব আসতো। খেয়ে, গল্পগুজব করে চলে যেত। আমরাও কখনো যেতাম বন্ধুদের বাসায়। ছেলেময়েরা নিত্যনতুন সাজে সেজে ঘুরে বেড়াত ওদের বন্ধুদের ঘরে ঘরে। ফিরতো অনেক রাত করে।

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে, ওদের সংসার ছেলেপুলে হয়েছে। বাবা-মা গত হয়েছেন অনেক আগে। এর পরেও মাঝে মধ্যে ঈদের ছুটিতে ছেলেদের নিয়ে আমার পৈতৃক ভিটায় ছুটে যেতাম। অল্পদিনের জন্য হলেও চারিদিকের গাছপালা, ফুলে-ফলেভরা নির্জন বাড়িটি সরগরম হয়ে ওঠতো। ব্যস্ত শহরের যাঁতাকলে পিষ্ট জীবনে খানিকটা সময়ের জন্য পুরনো দিনের সব স্মৃতি ডানা মেলে দিতো। ছড়ানো ছিটানো বাংলো ধরনের বিশাল বাড়ির সামনের শ্যামল ঘাসের ওপর আমার নাতি দিনভর ছুটাছুটি করতো। পুকুরে মাছের ডুবসাঁতার দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত।

ঈদ উপলক্ষে ছেলেরা ধুমধামের সাথে বাজার সদায় করতো। কখনো অনেকগুলো খাসি, কখনো বা একটি গরুই কোরবানী দেওয়া হতো। পাড়ার লোকজনকে বিলানো হতো মাংস। ছেলেরা বাবা-মায়ের জন্য জামা কাপড় কিনে আনতো অনেক। এই বয়সে অতসব জামা গায়ে দেয়ার সুযোগ কম। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরোনোর সাধ্যি নেই। ছেলেমেয়ে, নাতিদের গায়ে নিত্যনতুন বাহারি সব জামা কাপড় দেখে বড্ড ভালো লাগতো। ঈদ আয়োজনে ঘরে রান্নার ধুম লেগে যেত। পুত্রবধুরা যেসব খাবার রান্না করতো সবগুলোর নামও আমি জানি না। দুপুরে রান্না শেষ হলে সবাই মিলেমিশে খাওয়া হতো। ছেলেরা ওদের স্ত্রীপুত্র নিয়ে সারাদিন বন্ধুদের বাসায় ঘুরে বেড়াতো। বাসায় ছিল দিনভর ছেলেদের বন্ধু-বান্ধবের আসা-যাওয়া। সরগরম হয়ে উঠতো সারা ঘর।

কর্মব্যস্ত জীবনে ওদের কটা দিনের ছুটি কাটানোর আনন্দ দেখে বড্ড ভালো লাগতো। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজন ঈদের দিনে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বিশ্রামেই কাটিয়ে দিতাম সারাটা দিন। শুধু বাবা-মায়ের স্মৃতি বার বার ভেসে ওঠতো। তারা বেঁচে থাকলে কত যে খুশি হতেন। সুখের দিনগুলোর কিছুই দেখে যেতে পারলেন না তারা।

এখন প্রায় সব ঈদেই কাটে ঢাকায়। ছেলেদের হাতে একদম সময় নেই। আমার পক্ষে এখন আর একা কোনো উৎসব আয়োজন করা সম্ভব নয়। তাই ঈদে আর আমার চিনচেনা মফঃস্বল শহরের ছায়াঘেরা সেই পুরনো বাড়িতে ধুম পড়ে না। খবরটা শুনে পাড়ার লোকজন হতাশ হয়ে যান। বাসার আশেপাশের বেশ কিছু লোকজন আমায় কাছে পেলে বেজায় খুশি হন। বিশেষ করে দীর্ঘকাল যারা আমার বাবা-মায়ের সেবাযত্ন করেছে। আমার উপর তাদের একটা দাবি রয়েছে। তারা যে সারা বছর দুটো ঈদের দিনেরই অপেক্ষায় থাকে। এ মানুষগুলো বড্ড অসহায়। গতর খেটে খায়।

এতদিনের গড়ে-ওঠা রেওয়াজ এখন বদলে গেছে। তাদের দাবি বা অবদার যা-ই বলি এর মূল্য অনেক। আজকাল ঢাকার বাসায় ঈদের কেনাকাটা শুরু হয় রমজানের শুরু থেকে। পোশাক, জুতা, সাজগোজের জিনিষপত্রে ভরে যায় ঘর। এতো জিনিষপত্র লাগে আজকালকার ছেলেমেয়েদের! গরু, খাসি আর মুরগীর মাংসে দুটো ফ্রিজ ভরে রাখে ঈদের আগের থেকে। এতো সব রান্না হয় ঈদের দিনে! ঘরভর্তি কাজের লোক। ওরাই বেশির ভাগ রান্না বান্না করে। সারাদিন ঘাম ঝরায়। কিন্তু ক্লান্ত দেহে খেতে পারে না তেমন। হয়তো বাড়িতে রেখে আসা অভাবের সংসারে স্বামী-সন্তানের কথা ভেবে গলা দিয়ে নামতে চায় না কিছু।

জীবনটা বড্ড রহস্যময়। কিন্তু এতো সব রান্না, খাবারের লোক কোথায়! দিনশেষে সব ফ্রিজভর্তি কওে রাখা। ছেলেপুলেদের বন্ধুবান্ধবও আজকাল খুব একটা আসে না বাসায়। কারো হাতে তেমন সময় নেই। সবাই ব্যস্ত যে যার কাজে। সবাই যান্ত্রিক জীবনের যাঁতাকলে যেন পিষ্ট। সারা বছরের কর্মক্লান্ত শরীরে হয়তো ঈদের দিনগুলোতে একটু বিশ্রাম ভোগ করতে চায়। অবসর চায় দেহ-মন। তাই আজকালকার ছেলেমেয়েরা ঈদের চাঁদ দেখার জন্য ভিড় করে না। চাঁদ দেখে মিষ্টিমুখ করার পড়ে না ধুম। শুধু ড্রইংরুমে বসে টিভি’র খবর শোনে কবে হবে ঈদ। ঈদের দিনে বাসায় লোকজনের আনাগোনা নেই তেমন। খেয়ে দেয়ে যে যার ঘরে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় ঈদের পুরোটা দিন। এ যেন এক নিরানন্দ ঈদ উৎসব!

রাজধানী ঢাকার একটি জনাকীর্ণ এলাকার পঞ্চম তলার একটি ফ্লাটের বারান্দায় বসে আমি অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে থাকে ব্যস্ত শহরটি। রাস্তায় গাড়ি চলাচল কমে যায় ক্রমশ। সবাই চলে যায় যে যার গ্রামের বাড়িতে। সে এক অদৃশ্য মায়ার টান। সবাই বলে, এ নাকি নাড়ির টান। এই ব্যস্ত শহরের একঘেয়ে জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও গাঁয়ের সেই চিরচেনা দৃশ্য, পরিচিত মুখ খুঁজে পেয়ে আনন্দে বিভোর হয়ে যেতে চায়। পরম আনন্দ-উৎসবে নিকটাত্মীয়ের সান্নিধ্যে ওদের কেটে যায় কটা দিন। গ্রামীণ জীবনে হয়ত এখনও কিছুটা প্রাণ আছে। খানিকটা হলেও আছে ঈদ উৎসবের আনন্দ রয়ে গেছে। আমি আমার শৈশব কৈশোর যৌবনের ঈদের সেই ফেলে-আসা মধুর দিনগুলির কথা ভেবে শুধু দীর্ঘশ^াস ফেলি।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

আনন্দ বেদনার ঈদ উৎসব

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২

যখন ছোট ছিলাম, বাবা-মায়ের সাথে ঈদ করতে হতো গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের বাড়ি বলতে তখনকার জেলা শহরে আমার জন্মভিটায়। বাড়িতে সাত ভাই-বোনের উপস্থিতিতে রোজার ও কোরবানি ঈদ দুটোই পালিত হতো আনন্দমুখর পরিবেশে। মনে পড়ে, ঈদের বেশ আগেই আমার স্কুল শিক্ষক বাবা বাজার থেকে মোরগ, সেমাইসহ প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনে আনতেন। ছোট ভাই-বোনদের জন্য সাদামাটা জামাকাপড়। বড়দের জন্য বরাদ্দ ছিল সেই পুরনো পোশাক। মাকে ঈদে কখনো নতুন শাড়ি পরতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শেষ রজমানে ঈদের চাঁদ দেখার জন্য শহরময় ধুম পড়ে যেত।

সূর্য পশ্চিম গগনে এলিয়ে পড়তেই পাড়ার ছেলেরা বেরিয়ে পড়তো রাস্তায়। গাছের আড়াল থেকে উঁকি মেরে কে আগে চাঁদ দেখতে পায় এমন প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতো। ঘরের দোতলার ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাই-বোনেরা মিলে ঈদের সরু বাঁকা চাঁদ দেখার জন্য অপেক্ষা করতাম। চাঁদ দেখতে পেলে মা আমাদের সবাইকে চিনি গুলে সরবত বানিয়ে খাওয়াতেন। চাঁদ দেখা গেলে মসজিদে আজান হতো। কখনো ডিসি’র অফিস থেকে সাইরেন বাজিয়ে শোনানো হতো। ঈদুল আযহায় কোরবানির পশু কেনা নিয়ে আমাদের মাঝে বিস্ময়কর উত্তেজনা কাজ করতো। বাবা বেশির ভাগ সময় গরু কোরবানিতে আগ্রহী ছিলেন। আমার ছেলেবেলায় একটা মাঝারি আকারের গরু আঠারো-বিশ টাকায় পাওয়া যেত। সে গরুর সাত ভাগের এক ভাগে যে মাংস পাওয়া যেত তা দিয়ে গরিব-দুখীদের বিলিয়ে আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে খাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ ছিল। সেসময় ঈদকে সামনে রেখে জিনিষপত্রের দাম বাড়ানোর এমন অশুভ প্রতিযোগিতা ছিল না।

সকালে গোসল করে মা-বাবাকে সালাম করে ঈদের জামাতে নামাজ পড়ার একটা অদ্ভুত শিহরণ ছিল। দুটো ঈদেই মা যত্নের সাথে সেমাই রান্না করতেন। গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে সেমাই অথবা সরু চালের পায়েশের আলাদা স্বাদ ছিল। ঈদের নামাজ শেষে নতুন জামা পরে ছোটরা সেমাই খেয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়াতাম। দুপুর গড়াতেই মায়ের রান্না শেষ হয়ে যেত। এত ঝটপট রান্নায় মায়ের সাথে অন্য কেউ কুলিয়ে উঠতে পারতেন না। কম মশলায় মায়ের সযত্নে রান্না মজাদার পোলাও-মাংস খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়তাম। মায়ের হাতে আলাদা এক জাদু ছিল। আমরা ছোট তিন ভাই-বোন কখনো বাবার সাথে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যেতাম। বাসার কাজের লোকেরাও আমাদের ঘরের ঈদ উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে যেত। মা সবাইকে এই দিনে অন্যসব মেহমানের মতো নিজ হাতে পরিবেশন করে খাওয়াতেন।

এ দিনে কাজের লোকদের কাউকে কিছু করতে দেওয়া হতো না। পাড়া-পড়শিরাও বাসায় এসে ধুমধাম করে খাওয়ায় শামিল হতেন। ফকির, মিসকিনদের পেটভরে খাওয়ানো হতো ভালো ভালো খাবার। একটু বড় হয়ে যখন কলেজে উঠেছি তখন বাবার অনুমতি নিয়ে বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যেতাম। সারা দিন কেটে যেত হৈ হুল্লোরে। কে কতজনের বাসায় খেতে পেরেছে তা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা লেগে যেত। বন্ধু-বান্ধবের বাসায় নিজের বাসার মতোই পেটপুরে খেতাম, কত কী মজা করতাম। বন্ধু-বান্ধবের মা-বাবারাও আমাদের পুত্রসম স্নেহ-আদরে ভরিয়ে দিতেন। ওই দিনগুলোর মজাই ছিল আলাদা।

কর্মজীবনে ঈদ উপলক্ষে ঢাকা থেকে বউ-বাচ্চা নিয়ে বাবা-মায়ের আকর্ষণে ছুটে গেছি বাড়িতে। এমনকি দেশের বাইরে থেকেও ঈদের সময়টাকে বেছে নিতাম ছুটিতে দেশে আসার জন্য। তখন মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন এমনকি বন্ধু-বান্ধবের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ মিলতো। সবার জন্য সাধ্যমতো জামাকাপড় কিনে আনতাম। ঈদের দিনটিতে বাবা-মা সন্তানকে কাছে পেয়ে যে কী খুশি হতেন তা বলে শেষ করা যাবে না। বড় হয়ে ঈদুল আযহায় বেশির ভাগ সময় খাসি কোরবানী দিতাম। নিজে হাটে দিয়ে খাসি কিনতাম, লোক ডেকে জবাই করাতাম, বাসার একটি হেলানো গাছের সাথে ঝুলিয়ে চামড়া ছাড়াতাম। নিজ হাতে কাটাকুটি করে মাংস বিলিয়ে দিতাম। আমার স্ত্রী পরম যত্নে নানা পদের মাংস রান্না করতো। বাসায় বন্ধু-বান্ধব আসতো। খেয়ে, গল্পগুজব করে চলে যেত। আমরাও কখনো যেতাম বন্ধুদের বাসায়। ছেলেময়েরা নিত্যনতুন সাজে সেজে ঘুরে বেড়াত ওদের বন্ধুদের ঘরে ঘরে। ফিরতো অনেক রাত করে।

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে, ওদের সংসার ছেলেপুলে হয়েছে। বাবা-মা গত হয়েছেন অনেক আগে। এর পরেও মাঝে মধ্যে ঈদের ছুটিতে ছেলেদের নিয়ে আমার পৈতৃক ভিটায় ছুটে যেতাম। অল্পদিনের জন্য হলেও চারিদিকের গাছপালা, ফুলে-ফলেভরা নির্জন বাড়িটি সরগরম হয়ে ওঠতো। ব্যস্ত শহরের যাঁতাকলে পিষ্ট জীবনে খানিকটা সময়ের জন্য পুরনো দিনের সব স্মৃতি ডানা মেলে দিতো। ছড়ানো ছিটানো বাংলো ধরনের বিশাল বাড়ির সামনের শ্যামল ঘাসের ওপর আমার নাতি দিনভর ছুটাছুটি করতো। পুকুরে মাছের ডুবসাঁতার দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত।

ঈদ উপলক্ষে ছেলেরা ধুমধামের সাথে বাজার সদায় করতো। কখনো অনেকগুলো খাসি, কখনো বা একটি গরুই কোরবানী দেওয়া হতো। পাড়ার লোকজনকে বিলানো হতো মাংস। ছেলেরা বাবা-মায়ের জন্য জামা কাপড় কিনে আনতো অনেক। এই বয়সে অতসব জামা গায়ে দেয়ার সুযোগ কম। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরোনোর সাধ্যি নেই। ছেলেমেয়ে, নাতিদের গায়ে নিত্যনতুন বাহারি সব জামা কাপড় দেখে বড্ড ভালো লাগতো। ঈদ আয়োজনে ঘরে রান্নার ধুম লেগে যেত। পুত্রবধুরা যেসব খাবার রান্না করতো সবগুলোর নামও আমি জানি না। দুপুরে রান্না শেষ হলে সবাই মিলেমিশে খাওয়া হতো। ছেলেরা ওদের স্ত্রীপুত্র নিয়ে সারাদিন বন্ধুদের বাসায় ঘুরে বেড়াতো। বাসায় ছিল দিনভর ছেলেদের বন্ধু-বান্ধবের আসা-যাওয়া। সরগরম হয়ে উঠতো সারা ঘর।

কর্মব্যস্ত জীবনে ওদের কটা দিনের ছুটি কাটানোর আনন্দ দেখে বড্ড ভালো লাগতো। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজন ঈদের দিনে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বিশ্রামেই কাটিয়ে দিতাম সারাটা দিন। শুধু বাবা-মায়ের স্মৃতি বার বার ভেসে ওঠতো। তারা বেঁচে থাকলে কত যে খুশি হতেন। সুখের দিনগুলোর কিছুই দেখে যেতে পারলেন না তারা।

এখন প্রায় সব ঈদেই কাটে ঢাকায়। ছেলেদের হাতে একদম সময় নেই। আমার পক্ষে এখন আর একা কোনো উৎসব আয়োজন করা সম্ভব নয়। তাই ঈদে আর আমার চিনচেনা মফঃস্বল শহরের ছায়াঘেরা সেই পুরনো বাড়িতে ধুম পড়ে না। খবরটা শুনে পাড়ার লোকজন হতাশ হয়ে যান। বাসার আশেপাশের বেশ কিছু লোকজন আমায় কাছে পেলে বেজায় খুশি হন। বিশেষ করে দীর্ঘকাল যারা আমার বাবা-মায়ের সেবাযত্ন করেছে। আমার উপর তাদের একটা দাবি রয়েছে। তারা যে সারা বছর দুটো ঈদের দিনেরই অপেক্ষায় থাকে। এ মানুষগুলো বড্ড অসহায়। গতর খেটে খায়।

এতদিনের গড়ে-ওঠা রেওয়াজ এখন বদলে গেছে। তাদের দাবি বা অবদার যা-ই বলি এর মূল্য অনেক। আজকাল ঢাকার বাসায় ঈদের কেনাকাটা শুরু হয় রমজানের শুরু থেকে। পোশাক, জুতা, সাজগোজের জিনিষপত্রে ভরে যায় ঘর। এতো জিনিষপত্র লাগে আজকালকার ছেলেমেয়েদের! গরু, খাসি আর মুরগীর মাংসে দুটো ফ্রিজ ভরে রাখে ঈদের আগের থেকে। এতো সব রান্না হয় ঈদের দিনে! ঘরভর্তি কাজের লোক। ওরাই বেশির ভাগ রান্না বান্না করে। সারাদিন ঘাম ঝরায়। কিন্তু ক্লান্ত দেহে খেতে পারে না তেমন। হয়তো বাড়িতে রেখে আসা অভাবের সংসারে স্বামী-সন্তানের কথা ভেবে গলা দিয়ে নামতে চায় না কিছু।

জীবনটা বড্ড রহস্যময়। কিন্তু এতো সব রান্না, খাবারের লোক কোথায়! দিনশেষে সব ফ্রিজভর্তি কওে রাখা। ছেলেপুলেদের বন্ধুবান্ধবও আজকাল খুব একটা আসে না বাসায়। কারো হাতে তেমন সময় নেই। সবাই ব্যস্ত যে যার কাজে। সবাই যান্ত্রিক জীবনের যাঁতাকলে যেন পিষ্ট। সারা বছরের কর্মক্লান্ত শরীরে হয়তো ঈদের দিনগুলোতে একটু বিশ্রাম ভোগ করতে চায়। অবসর চায় দেহ-মন। তাই আজকালকার ছেলেমেয়েরা ঈদের চাঁদ দেখার জন্য ভিড় করে না। চাঁদ দেখে মিষ্টিমুখ করার পড়ে না ধুম। শুধু ড্রইংরুমে বসে টিভি’র খবর শোনে কবে হবে ঈদ। ঈদের দিনে বাসায় লোকজনের আনাগোনা নেই তেমন। খেয়ে দেয়ে যে যার ঘরে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় ঈদের পুরোটা দিন। এ যেন এক নিরানন্দ ঈদ উৎসব!

রাজধানী ঢাকার একটি জনাকীর্ণ এলাকার পঞ্চম তলার একটি ফ্লাটের বারান্দায় বসে আমি অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে থাকে ব্যস্ত শহরটি। রাস্তায় গাড়ি চলাচল কমে যায় ক্রমশ। সবাই চলে যায় যে যার গ্রামের বাড়িতে। সে এক অদৃশ্য মায়ার টান। সবাই বলে, এ নাকি নাড়ির টান। এই ব্যস্ত শহরের একঘেয়ে জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও গাঁয়ের সেই চিরচেনা দৃশ্য, পরিচিত মুখ খুঁজে পেয়ে আনন্দে বিভোর হয়ে যেতে চায়। পরম আনন্দ-উৎসবে নিকটাত্মীয়ের সান্নিধ্যে ওদের কেটে যায় কটা দিন। গ্রামীণ জীবনে হয়ত এখনও কিছুটা প্রাণ আছে। খানিকটা হলেও আছে ঈদ উৎসবের আনন্দ রয়ে গেছে। আমি আমার শৈশব কৈশোর যৌবনের ঈদের সেই ফেলে-আসা মধুর দিনগুলির কথা ভেবে শুধু দীর্ঘশ^াস ফেলি।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]

back to top