বিভূতী ভূষণ মাহাতো
‘গাও ছড়ব নেহি, জাঙ্গাল ছড়ব নেহি,
মাই-মাটি ছড়ব নেহি, লাড়াই ছড়ব নেহি।’
ভারতের জঙ্গলমহল (লালগড়) আদিবাসী এলাকায় কারখানা স্থাপনের জন্য আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদে রচিত গানের অংশবিশেষ এটি। আদিবাসীরা নিজেদের জমি-জায়গা-জঙ্গল রক্ষায় লড়াই করতে প্রস্তুত সব সময়।
ভূমি, বনের সাথে আদিবাসীদের সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের। আদিবাসীরা ভূমি ও অরণ্যের সন্তান। এজন্য আদিবাসীদের ভূমিপুত্র বলা হয়ে থাকে। আদিবাসীদের ভূমি ও বন রক্ষার লড়াই ঐতিহাসিক সময় থেকেই চলছে। ভূমি ও বন রক্ষায় সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ, টঙ্কবিরোধী বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, মধুপুরের শালবন রক্ষা আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। এখনো আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলন করতে গিয়ে অনেককে আত্মত্যাগ দিতে হয়েছে। সিধু মুর্মু, কানু মুর্মু, বীরসা মুন্ডা, রাসিমনি হাজং, চলেশ রিছিল, আলফ্রেড সরেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আদিবাসীদের অধিকার সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা না পেলেও আংশিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।
১.
১৮৫৫ সাল। তৎকালীন ইংরেজ শাসক ও শাসকদের সহযোগিতাকারী জমিদার, পুলিশ, সুদখোরদের হাত থেকে ভূমি ও নিজেদের অধিকার রক্ষায় শোষণ-বঞ্চনার শিকার সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূচনা করে।
বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে জমি ও বনের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুন্ডাদের আন্দোলন সংঘটিত হয়। বেঠবেগারী বন্ধ ও জমির খাজনার বিরুদ্ধে গড়ে উঠে বিশাল আন্দোলন। ভারতের রাঁচির মুন্ডা গ্রামের হাজার হাজার মুন্ডারগণ জমায়েত হয়। খাজনা বৃদ্ধি ও বনের সম্পদের ওপর তাদের অধিকার ফিরে পেতে ১৮৮৯ সালের দিকে আবারও মুন্ডারা বিদ্রোহ শুরু করে। এ সময় জমিদারদের কাছারিগুলো পুড়িয়ে দেয় এবং কর্মচারীদের হত্যা করে। বহু মুন্ডার আত্মত্যাগের বিদ্রোহের মাধ্যমে সরকারের টনক নড়ে। সরকার মুন্ডা অঞ্চলের সমস্ত জমির জরিপ করে জমি ও বনভূমির উপর আদিবাসীদের আংশিকভাবে অধিকার স্বীকার করে নেয় এবং বেগার খাটা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।
২.
আলফ্রেড সরেনের ভূমির অধিকারের আন্দোলনের সাথে ওপরে বর্ণিত আন্দোলন বা বিদ্রোহগুলোর মিল রয়েছে। আদিবাসীদের ভূমির অধিকাররের আন্দোলন করতে গিয়ে আলফ্রেড সরেন ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট ভূমিদস্যুদের হামলায় নির্মমভাবে নিহত হন। নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুরের ভূমিহীন মানুষের জন্য খাসজমির বন্দোবস্তের আন্দোলন করছিলেন। তিনি জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ভীমপুর ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। আলফ্রেড সরেন আদিবাসী তথা ভূমিহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। সেটাই হয়তো তাকে জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে।
২০০০ সালের ১৮ আগস্ট। ভীমপুর গ্রামের আদিবাসীরা সকালের কাজকর্ম সেরে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়েছে। ভীমপুর হচ্ছে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার একটি গ্রাম। সেদিন সকালের আকাশে সূর্যের হাসি খেলা করছিল। কেউ কী জনতো যে, এই আকাশেই কালো মেঘ অপেক্ষা করছে ভীমপুর গ্রামের আদিবাসীদের জন্য। বেলা ১১টায় সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলা শুরু হয় ১৩টি আদিবাসী পরিবারের ওপর। স্থানীয় ভূমিদস্যু সন্ত্রাসী হাতেম আলী ও সীতেশ ভট্টাচার্য ওরফে গদাই এর ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের তা-বলীলা চলতে থাকে আদিবাসী পল্লীতে। একের পর এক ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। ভাংচুর করতে থাকে বাড়িঘর। সন্ত্রাসীদের পাশবিক নির্যাতনের থেকে বৃদ্ধ, শিশু, নারী কেউই বাদ যায়নি। শিশুদের নিক্ষেপ করে পাশের পুকুরে, বৃদ্ধ ও মধ্যবয়স্কদের ফেলা হয় দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে, আলফ্রেড সরেনের বড়ভাইয়ের গর্ভবতী স্ত্রী পানসরির পেটে লাথি মেরে মেরে ফেলে গর্ভের অনাগত সন্তান। এই নির্যাতন মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। চারিদিকে তখন আদিবাসীদের চিৎকার আর্তনাদ আর আগুনের লেলিহান শিখায় ভরে যায় ভীমপুরের আকাশ-বাতাস। খুনিরা খুঁজতে থাকে আলফ্রেড সরেনকে। আলফ্রেড সরেনের বোন ভাইকে বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল পাশের বাড়ির ধানের বস্তার আড়ালে। কিন্তু সেখানেও আগুন দেয় সন্ত্রাসীরা। প্রাণ বাঁচাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি আলফ্রেড সরেন। সেদিন খুনিদের রামদা, বল্লম, চাইনিজ কুড়ালের একের পর এক আঘাত পড়তে থাকে আলফ্রেড সরেনের শরীরে। রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায় ভীমপুর আদিবাসী পল্লীর মাটি। বোন রেবেকা সরেন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দেখেছে ভাইকে হত্যার দৃশ্য। অনেক আকুতি-মিনতি করেও খুনিদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি আলফ্রেড সরেনের জীবন। বর্শার ফলার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে তার নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সেই লুটিয়ে পড়া নিথর দেহ আর উঠে দাঁড়ায়নি কখনই। আর বলেনি ভূমিহীন মানুষের অধিকারের কথা। সন্ত্রাসীদের দেয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ১৩টি আদিবাসী পরিবারের ঘর। হামলায় গুরুতর আহত হয় ৩০/৩৫ জন আদিবাসী। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টাব্যাপী এই নারকীয় হত্যাকা- ও ধ্বংসযজ্ঞ চললেও পুলিশ প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছিল সেদিন। ঘটনাস্থল থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নওহাটা পুলিশ ফাঁড়িতে বারবার খবর দেয়া হলেও সেদিন পুলিশ ভীমপুরের আদিবাসীদের রক্ষায় এগিয়ে যায়নি।
আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা করেন। ওই মামলায় মহাদেবপুর থানা পুলিশ তদন্ত শেষে ৯১ জন আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পুলিশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতারও করেছিল। নওগাঁ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করে। মামলার প্রধান ২ আসামি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাতেম আলী ও সীতেশ ভট্টাচার্য ওরফে গদাইসহ ৬০ জন জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য মামলাটির স্থগিতাদেশ দেন। এ সুযোগে আদালত থেকে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসে। মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। আসামিরা জামিনে বের হয়ে বিভিন্ন সময়ে আলফ্রেড সরেনের পরিবার ও সাক্ষীদের হুমকি দিয়ে চলছে। ইতোমধ্যেই অনেকে সেখান থেকে অন্যত্র চলে গেছে ও দেশত্যাগ করেছে। এমনকি নিহত আলফ্রেড সরেনের স্ত্রী-সন্তানও এখন সেখানে থাকে না।
আলফ্রেড সরেনের সংগ্রাম ছিল ভূমিহীন ও আদিবাসী মানুষের অধিকার আদায়ের। তার বাড়ির পাশেই প্রায় ৯৫ একর খাসজমি রয়েছে। সেই খাসজমি ভূমিহীন ও আদিবাসীদের বন্দোবস্তের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন। আর সেজন্যই তাকে খুন হতে হয়। আজও সেই জমির অধিকাংশই খুনিরাই ভোগদখল করে আছে। কিন্তু বিচার হয়নি আলফ্রেড সরেন হত্যার। নওগাঁ জেলা ও দায়রা আদালত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উক্ত প্রায় ৯৫ একর খাসজমির ৬৩ বিঘা জমি আলফ্রেড সরেন ও গংদের অনুকূলে বন্দোবস্ত দেয়। কিন্তু ভূমিদস্যুদের পক্ষে হয়ে মহাদেবপুর থানা পুলিশ প্রশাসন আলফ্রেড সরেনের বোন রেবেকা সরেনের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করে নামমাত্র ৩০ বিঘা জমি আদিবাসীদের ব্যবহারের অনুমতি দেয়। বর্তমানে আদিবাসীরা সেখানকার ৩০ বিঘা জমি ভোগদখল করছেন। বাকি জমি আলফ্রেড সরেনের হত্যাকারীরা ভোগদখল করছে।
আদিবাসীদের ভূমির অধিকার আন্দোলনের বীর শহীদ আলফ্রেড সরেনের আত্মত্যাগ আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আলফ্রেড সরেনের আত্মত্যাগ আদিবাসীদের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
[লেখক : কেন্দ্রীয় সদস্য, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ]
bivuti.ais@gmail.com
বিভূতী ভূষণ মাহাতো
সোমবার, ১৭ আগস্ট ২০২০
‘গাও ছড়ব নেহি, জাঙ্গাল ছড়ব নেহি,
মাই-মাটি ছড়ব নেহি, লাড়াই ছড়ব নেহি।’
ভারতের জঙ্গলমহল (লালগড়) আদিবাসী এলাকায় কারখানা স্থাপনের জন্য আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদে রচিত গানের অংশবিশেষ এটি। আদিবাসীরা নিজেদের জমি-জায়গা-জঙ্গল রক্ষায় লড়াই করতে প্রস্তুত সব সময়।
ভূমি, বনের সাথে আদিবাসীদের সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের। আদিবাসীরা ভূমি ও অরণ্যের সন্তান। এজন্য আদিবাসীদের ভূমিপুত্র বলা হয়ে থাকে। আদিবাসীদের ভূমি ও বন রক্ষার লড়াই ঐতিহাসিক সময় থেকেই চলছে। ভূমি ও বন রক্ষায় সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ, টঙ্কবিরোধী বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, মধুপুরের শালবন রক্ষা আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। এখনো আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলন করতে গিয়ে অনেককে আত্মত্যাগ দিতে হয়েছে। সিধু মুর্মু, কানু মুর্মু, বীরসা মুন্ডা, রাসিমনি হাজং, চলেশ রিছিল, আলফ্রেড সরেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আদিবাসীদের অধিকার সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা না পেলেও আংশিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।
১.
১৮৫৫ সাল। তৎকালীন ইংরেজ শাসক ও শাসকদের সহযোগিতাকারী জমিদার, পুলিশ, সুদখোরদের হাত থেকে ভূমি ও নিজেদের অধিকার রক্ষায় শোষণ-বঞ্চনার শিকার সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূচনা করে।
বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে জমি ও বনের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুন্ডাদের আন্দোলন সংঘটিত হয়। বেঠবেগারী বন্ধ ও জমির খাজনার বিরুদ্ধে গড়ে উঠে বিশাল আন্দোলন। ভারতের রাঁচির মুন্ডা গ্রামের হাজার হাজার মুন্ডারগণ জমায়েত হয়। খাজনা বৃদ্ধি ও বনের সম্পদের ওপর তাদের অধিকার ফিরে পেতে ১৮৮৯ সালের দিকে আবারও মুন্ডারা বিদ্রোহ শুরু করে। এ সময় জমিদারদের কাছারিগুলো পুড়িয়ে দেয় এবং কর্মচারীদের হত্যা করে। বহু মুন্ডার আত্মত্যাগের বিদ্রোহের মাধ্যমে সরকারের টনক নড়ে। সরকার মুন্ডা অঞ্চলের সমস্ত জমির জরিপ করে জমি ও বনভূমির উপর আদিবাসীদের আংশিকভাবে অধিকার স্বীকার করে নেয় এবং বেগার খাটা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।
২.
আলফ্রেড সরেনের ভূমির অধিকারের আন্দোলনের সাথে ওপরে বর্ণিত আন্দোলন বা বিদ্রোহগুলোর মিল রয়েছে। আদিবাসীদের ভূমির অধিকাররের আন্দোলন করতে গিয়ে আলফ্রেড সরেন ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট ভূমিদস্যুদের হামলায় নির্মমভাবে নিহত হন। নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুরের ভূমিহীন মানুষের জন্য খাসজমির বন্দোবস্তের আন্দোলন করছিলেন। তিনি জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ভীমপুর ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। আলফ্রেড সরেন আদিবাসী তথা ভূমিহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। সেটাই হয়তো তাকে জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে।
২০০০ সালের ১৮ আগস্ট। ভীমপুর গ্রামের আদিবাসীরা সকালের কাজকর্ম সেরে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়েছে। ভীমপুর হচ্ছে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার একটি গ্রাম। সেদিন সকালের আকাশে সূর্যের হাসি খেলা করছিল। কেউ কী জনতো যে, এই আকাশেই কালো মেঘ অপেক্ষা করছে ভীমপুর গ্রামের আদিবাসীদের জন্য। বেলা ১১টায় সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলা শুরু হয় ১৩টি আদিবাসী পরিবারের ওপর। স্থানীয় ভূমিদস্যু সন্ত্রাসী হাতেম আলী ও সীতেশ ভট্টাচার্য ওরফে গদাই এর ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের তা-বলীলা চলতে থাকে আদিবাসী পল্লীতে। একের পর এক ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। ভাংচুর করতে থাকে বাড়িঘর। সন্ত্রাসীদের পাশবিক নির্যাতনের থেকে বৃদ্ধ, শিশু, নারী কেউই বাদ যায়নি। শিশুদের নিক্ষেপ করে পাশের পুকুরে, বৃদ্ধ ও মধ্যবয়স্কদের ফেলা হয় দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে, আলফ্রেড সরেনের বড়ভাইয়ের গর্ভবতী স্ত্রী পানসরির পেটে লাথি মেরে মেরে ফেলে গর্ভের অনাগত সন্তান। এই নির্যাতন মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। চারিদিকে তখন আদিবাসীদের চিৎকার আর্তনাদ আর আগুনের লেলিহান শিখায় ভরে যায় ভীমপুরের আকাশ-বাতাস। খুনিরা খুঁজতে থাকে আলফ্রেড সরেনকে। আলফ্রেড সরেনের বোন ভাইকে বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল পাশের বাড়ির ধানের বস্তার আড়ালে। কিন্তু সেখানেও আগুন দেয় সন্ত্রাসীরা। প্রাণ বাঁচাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি আলফ্রেড সরেন। সেদিন খুনিদের রামদা, বল্লম, চাইনিজ কুড়ালের একের পর এক আঘাত পড়তে থাকে আলফ্রেড সরেনের শরীরে। রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায় ভীমপুর আদিবাসী পল্লীর মাটি। বোন রেবেকা সরেন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দেখেছে ভাইকে হত্যার দৃশ্য। অনেক আকুতি-মিনতি করেও খুনিদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি আলফ্রেড সরেনের জীবন। বর্শার ফলার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে তার নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সেই লুটিয়ে পড়া নিথর দেহ আর উঠে দাঁড়ায়নি কখনই। আর বলেনি ভূমিহীন মানুষের অধিকারের কথা। সন্ত্রাসীদের দেয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ১৩টি আদিবাসী পরিবারের ঘর। হামলায় গুরুতর আহত হয় ৩০/৩৫ জন আদিবাসী। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টাব্যাপী এই নারকীয় হত্যাকা- ও ধ্বংসযজ্ঞ চললেও পুলিশ প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছিল সেদিন। ঘটনাস্থল থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নওহাটা পুলিশ ফাঁড়িতে বারবার খবর দেয়া হলেও সেদিন পুলিশ ভীমপুরের আদিবাসীদের রক্ষায় এগিয়ে যায়নি।
আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা করেন। ওই মামলায় মহাদেবপুর থানা পুলিশ তদন্ত শেষে ৯১ জন আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পুলিশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতারও করেছিল। নওগাঁ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করে। মামলার প্রধান ২ আসামি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাতেম আলী ও সীতেশ ভট্টাচার্য ওরফে গদাইসহ ৬০ জন জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য মামলাটির স্থগিতাদেশ দেন। এ সুযোগে আদালত থেকে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসে। মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। আসামিরা জামিনে বের হয়ে বিভিন্ন সময়ে আলফ্রেড সরেনের পরিবার ও সাক্ষীদের হুমকি দিয়ে চলছে। ইতোমধ্যেই অনেকে সেখান থেকে অন্যত্র চলে গেছে ও দেশত্যাগ করেছে। এমনকি নিহত আলফ্রেড সরেনের স্ত্রী-সন্তানও এখন সেখানে থাকে না।
আলফ্রেড সরেনের সংগ্রাম ছিল ভূমিহীন ও আদিবাসী মানুষের অধিকার আদায়ের। তার বাড়ির পাশেই প্রায় ৯৫ একর খাসজমি রয়েছে। সেই খাসজমি ভূমিহীন ও আদিবাসীদের বন্দোবস্তের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন। আর সেজন্যই তাকে খুন হতে হয়। আজও সেই জমির অধিকাংশই খুনিরাই ভোগদখল করে আছে। কিন্তু বিচার হয়নি আলফ্রেড সরেন হত্যার। নওগাঁ জেলা ও দায়রা আদালত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উক্ত প্রায় ৯৫ একর খাসজমির ৬৩ বিঘা জমি আলফ্রেড সরেন ও গংদের অনুকূলে বন্দোবস্ত দেয়। কিন্তু ভূমিদস্যুদের পক্ষে হয়ে মহাদেবপুর থানা পুলিশ প্রশাসন আলফ্রেড সরেনের বোন রেবেকা সরেনের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করে নামমাত্র ৩০ বিঘা জমি আদিবাসীদের ব্যবহারের অনুমতি দেয়। বর্তমানে আদিবাসীরা সেখানকার ৩০ বিঘা জমি ভোগদখল করছেন। বাকি জমি আলফ্রেড সরেনের হত্যাকারীরা ভোগদখল করছে।
আদিবাসীদের ভূমির অধিকার আন্দোলনের বীর শহীদ আলফ্রেড সরেনের আত্মত্যাগ আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আলফ্রেড সরেনের আত্মত্যাগ আদিবাসীদের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
[লেখক : কেন্দ্রীয় সদস্য, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ]
bivuti.ais@gmail.com