alt

opinion » post-editorial

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: রোববার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ১৬২টি দেশে এক লাখ বাংলাদেশি কর্মী আছেন। প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৩ ভাগ। পোশাক খাতকে ছাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার জন্য এটিই শীর্ষ খাত। বাংলাদেশ সত্তরের দশক থেকেই জনশক্তি রপ্তানি করছে। শুরু থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির প্রধান বাজার। আশির দশক থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়। লিবিয়া, সুদানসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশেও তখন থেকেই জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়।

নব্বইয়ের দশক থেকে দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রুনাই, মিসর, মরিশাসসহ কয়েকটি নতুন বাজার সৃষ্টি হয়। নতুন সহস্রাব্দে ব্রিটেন, ইতালি, জাপানসহ এশিয়া ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে সৃষ্টি হয় জনশক্তির চাহিদা। বিগত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ অ্যামেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের জনশক্তির বাজার উন্মুক্ত হয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, থাইল্যান্ড, স্পেন, টিউনিশিয়া, চিলি, পেরুসহ শতাধিক দেশে বাংলাদেশ বর্তমানে জনশক্তি রপ্তানি করছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বাংলাদেশর ৫০ লাখের বেশি কর্মী আছেন। শ্রমিক ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক নাগরিক ইউরোপ-অ্যামেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে উচ্চ পদে কাজ করছেন, ব্যবসা করছেন, করছেন গবেষণা এবং পড়াশুনা। সেই হিসেবে এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি এখন প্রবাস জীবনযাপন করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সরকার ১৯৭৬ সালে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) প্রতিষ্ঠা করে। এ সংস্থার উদ্দেশ্যে হলো, দেশের অভ্যন্তরীণ জনশক্তির চাহিদা পূরণসহ বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। বিএমইটি বৈদেশিক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে দেশের জনশক্তির যথাযথ ব্যবহার সংক্রান্ত কৌশল ও সামগ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। বিএমইটির অধীনে ৪২টি জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, চারটি বিভাগীয় কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, ৪৭টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চারটি ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি ও তিনটি শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ অফিস আছে। কোনো প্রবাসী কর্মী মারা গেলে লাশ পরিবহণ ও দাফনের জন্য তার পরিবার কিছু অর্থ পায়। এছাড়া ক্ষতিপূরণ বাবদও কিছু পরিমাণ টাকা দেয়া হয়। তবে যে দেশে তিনি মারা যান, সেই দেশে কর্মক্ষেত্রে মারা গেলে কী ক্ষতিপূরণ আছে, তা জানতে বা সেটা আদায় করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না।

প্রবাসীদের ‘কমন’ অভিযোগ হলো যে, তারা যখন বিদেশে কোনো বিপদে পড়েন, আইনগত ঝামেলায় পড়েন বা কোনো কারণে আহত ও অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তারা আমাদের দূতাবাসগুলোর কোনো সহায়তাই নাকি পান না। দূতাবাসগুলো তাদের পাশে না থাকায় ঐসব দেশের কর্তৃপক্ষও তাদের সম্মান বা মর্যাদা দেয় না। সৌদি আরবের কথাই ধরা যাক। সেখানে আমাদের ২০ লাখ প্রবাসীর জন্য মাত্র দুটি ‘লেবার উইং’ আছে আর আছেন ছয়জন কর্মকর্তা। প্রবাসীদের কথা, এই ছয়জনের পক্ষে এত প্রবাসী কর্মীকে সার্ভিস দেয়া সম্ভব নয়।

বিদেশে কর্মরত শ্রমিক, কর্মচারী ও পেশাজীবীরা তাদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠায়। এই অর্থ কেবল তাদের পরিবারের প্রয়োজনই মিটায় না, কিংবা তাদের জীবনযাত্রার মানই বাড়াচ্ছে না, নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ আসছে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স থেকে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মিসর, লিবিয়া, মরক্কোসহ অনেক দেশে বাংলাদেশের শ্রমিক ও পেশাজীবীরা কাজ করছেন। একইভাবে নিকট ও দূরপ্রাচ্যের মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতেও বাংলাদেশের বহু মানুষ নানা পেশায় নিয়োজিত আছে।

ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকাতেও বহু বাংলাদেশি চাকরি ও ব্যবসাসহ নানা ধরনের কাজ করছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল ৪.৭৮ লক্ষ এবং তাদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ (রেমিট্যান্স) ছিল ১৮,২০৫.০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ২০০৮ - ২০০৯ অর্থবছরে এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৯৬৮৯ মিলিয়ন ডলার।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, ২০০৮ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। ২০০৯ সালে তা ৮ম স্থানে উন্নীত হয়। এ সময় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ছিল ২য়। বিশ্ব মন্দা পরিস্থিতি সত্ত্বেও ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের কোনো সংকটের মধ্যে না পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্স।

রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রয়োজন দক্ষ কর্মী। দক্ষ কর্মী তৈরিতে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া চলবে না। দক্ষ কর্মী তৈরি করতে যা করা দরকার সেটা এখন আমাদের করতে হবে। আমাদের প্রথমত কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি তাদের প্রণোদনা দেয়ার মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়েছে। দক্ষ জনশক্তি রফতানি হলে প্রবাসী আয় বর্তমানের তুলনায় অনেক বাড়বে। অভিবাসনের ক্ষেত্রে দক্ষতার কোন বিকল্প নেই। প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ লাখ কর্মী বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে যাচ্ছে। দক্ষতার অভাবে তারা অনেক কম বেতনে চাকরি করছেন। অথচ অন্য দেশের কর্মীরা দক্ষতার কারণে বেশি বেতন পাচ্ছেন।

দেশের প্রায় এক কোটি কর্মী বিদেশে চাকরি করলেও রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে না। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ১২ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার আগের অর্থ বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অদক্ষ জনশক্তি রফতানির কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ দিন দিন নেমে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে বিদেশি ৫ থেকে ৬ লাখ দক্ষ জনশক্তি কাজ করছেন। তারা প্রায় সমপরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন। যদিও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বর্তমানের চেয়ে অনেক কম কর্মী বিদেশে চাকরি করেছে। জানা গেছে, দালাল চক্রের মাধ্যমে বিদেশে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ কর্মী যাওয়ার ফলে শুধু সংখ্যা বাড়ছে। কিন্ত রেমিট্যান্স বাড়ছে না।

রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রয়োজন দক্ষ কর্মী। দক্ষ কর্মী তৈরিতে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া চলবে না

এই অদক্ষ কর্মীর বেশিরভাগই গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাদের নানাভাবে প্রলোভনে ফেলে মধ্যস্বত্বভোগীরা হাতিয়ে নিচ্ছে বড় অঙ্কের টাকা। দালালদের লোভনীয় প্রস্তাবে অনেক বাংলাদেশি কোন প্রকার কাজ ছাড়াই এভাবে বিদেশ গিয়ে বিপদে পড়ছেন। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশের কর্মীদের মান অনেক নিচে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে লাখ লাখ কর্মী বিদেশ গেলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে না। গুণগতমান ঠিক করতে না পারলে বিদেশের শ্রমবাজারগুলো হারাতে হতে পারে।

বিএমইটি সূত্র জানিয়েছে, একজন দক্ষ কর্মীকে নিরাপদ, সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিদেশে পাঠানোর মাধ্যমেই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সম্ভব হবে। কিন্তু সেই কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে দেশে প্রবাসীরা ভালোমানের কাজ করতে পারবে না। প্রবাসীরা বিদেশে যাওয়ার আগে তাদের কর্মদক্ষতা যাচাই করতে হবে। দক্ষতার বিচারে তখন অনেক অদক্ষ কর্মী বিদেশে যেতে পারত না।

কেমন আছেন প্রবাসী বাঙালিরা? কেমন লাগে প্রবাসে স্বজন ছাড়া থাকতে। দেশ নিয়ে কি তাদের চিন্তা। এতদসংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাঙালিরা তাদের নিজেদের জীবনযাত্রা সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা নিজেদের জবানিতে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও বিভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরছেন। অনিয়ম দুর্ভোগের অবসানের লক্ষ্যে তারা আশায় দিনযাপন করছে।

আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও নিরাপদ অভিবাসন আজ এক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রবাসী গমনেচ্ছু লোকেরা অনেকটাই শাখের করাতের অবস্থার মুখোমুখি হয়। বিদেশে যাওয়ার আগে এক ধরনের দুর্ভোগ আর বিদেশে যাওয়ার পরে আসে নতুন দুর্ভোগ। প্রকৃতপক্ষে যতদিন না এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে ততদিন এই দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণের পথ থাকবে না। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য দক্ষ কর্মী ও নিরাপদ অভিবাসন এই দুটি অনুষঙ্গ ছাড়া তারা বড় বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে না।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

tab

opinion » post-editorial

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

রোববার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ১৬২টি দেশে এক লাখ বাংলাদেশি কর্মী আছেন। প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৩ ভাগ। পোশাক খাতকে ছাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার জন্য এটিই শীর্ষ খাত। বাংলাদেশ সত্তরের দশক থেকেই জনশক্তি রপ্তানি করছে। শুরু থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির প্রধান বাজার। আশির দশক থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়। লিবিয়া, সুদানসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশেও তখন থেকেই জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়।

নব্বইয়ের দশক থেকে দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রুনাই, মিসর, মরিশাসসহ কয়েকটি নতুন বাজার সৃষ্টি হয়। নতুন সহস্রাব্দে ব্রিটেন, ইতালি, জাপানসহ এশিয়া ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে সৃষ্টি হয় জনশক্তির চাহিদা। বিগত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ অ্যামেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের জনশক্তির বাজার উন্মুক্ত হয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, থাইল্যান্ড, স্পেন, টিউনিশিয়া, চিলি, পেরুসহ শতাধিক দেশে বাংলাদেশ বর্তমানে জনশক্তি রপ্তানি করছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বাংলাদেশর ৫০ লাখের বেশি কর্মী আছেন। শ্রমিক ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক নাগরিক ইউরোপ-অ্যামেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে উচ্চ পদে কাজ করছেন, ব্যবসা করছেন, করছেন গবেষণা এবং পড়াশুনা। সেই হিসেবে এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি এখন প্রবাস জীবনযাপন করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সরকার ১৯৭৬ সালে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) প্রতিষ্ঠা করে। এ সংস্থার উদ্দেশ্যে হলো, দেশের অভ্যন্তরীণ জনশক্তির চাহিদা পূরণসহ বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। বিএমইটি বৈদেশিক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে দেশের জনশক্তির যথাযথ ব্যবহার সংক্রান্ত কৌশল ও সামগ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। বিএমইটির অধীনে ৪২টি জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, চারটি বিভাগীয় কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, ৪৭টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চারটি ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি ও তিনটি শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ অফিস আছে। কোনো প্রবাসী কর্মী মারা গেলে লাশ পরিবহণ ও দাফনের জন্য তার পরিবার কিছু অর্থ পায়। এছাড়া ক্ষতিপূরণ বাবদও কিছু পরিমাণ টাকা দেয়া হয়। তবে যে দেশে তিনি মারা যান, সেই দেশে কর্মক্ষেত্রে মারা গেলে কী ক্ষতিপূরণ আছে, তা জানতে বা সেটা আদায় করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না।

প্রবাসীদের ‘কমন’ অভিযোগ হলো যে, তারা যখন বিদেশে কোনো বিপদে পড়েন, আইনগত ঝামেলায় পড়েন বা কোনো কারণে আহত ও অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তারা আমাদের দূতাবাসগুলোর কোনো সহায়তাই নাকি পান না। দূতাবাসগুলো তাদের পাশে না থাকায় ঐসব দেশের কর্তৃপক্ষও তাদের সম্মান বা মর্যাদা দেয় না। সৌদি আরবের কথাই ধরা যাক। সেখানে আমাদের ২০ লাখ প্রবাসীর জন্য মাত্র দুটি ‘লেবার উইং’ আছে আর আছেন ছয়জন কর্মকর্তা। প্রবাসীদের কথা, এই ছয়জনের পক্ষে এত প্রবাসী কর্মীকে সার্ভিস দেয়া সম্ভব নয়।

বিদেশে কর্মরত শ্রমিক, কর্মচারী ও পেশাজীবীরা তাদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠায়। এই অর্থ কেবল তাদের পরিবারের প্রয়োজনই মিটায় না, কিংবা তাদের জীবনযাত্রার মানই বাড়াচ্ছে না, নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ আসছে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স থেকে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মিসর, লিবিয়া, মরক্কোসহ অনেক দেশে বাংলাদেশের শ্রমিক ও পেশাজীবীরা কাজ করছেন। একইভাবে নিকট ও দূরপ্রাচ্যের মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতেও বাংলাদেশের বহু মানুষ নানা পেশায় নিয়োজিত আছে।

ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকাতেও বহু বাংলাদেশি চাকরি ও ব্যবসাসহ নানা ধরনের কাজ করছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল ৪.৭৮ লক্ষ এবং তাদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ (রেমিট্যান্স) ছিল ১৮,২০৫.০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ২০০৮ - ২০০৯ অর্থবছরে এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৯৬৮৯ মিলিয়ন ডলার।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, ২০০৮ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। ২০০৯ সালে তা ৮ম স্থানে উন্নীত হয়। এ সময় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ছিল ২য়। বিশ্ব মন্দা পরিস্থিতি সত্ত্বেও ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের কোনো সংকটের মধ্যে না পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্স।

রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রয়োজন দক্ষ কর্মী। দক্ষ কর্মী তৈরিতে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া চলবে না। দক্ষ কর্মী তৈরি করতে যা করা দরকার সেটা এখন আমাদের করতে হবে। আমাদের প্রথমত কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি তাদের প্রণোদনা দেয়ার মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়েছে। দক্ষ জনশক্তি রফতানি হলে প্রবাসী আয় বর্তমানের তুলনায় অনেক বাড়বে। অভিবাসনের ক্ষেত্রে দক্ষতার কোন বিকল্প নেই। প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ লাখ কর্মী বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে যাচ্ছে। দক্ষতার অভাবে তারা অনেক কম বেতনে চাকরি করছেন। অথচ অন্য দেশের কর্মীরা দক্ষতার কারণে বেশি বেতন পাচ্ছেন।

দেশের প্রায় এক কোটি কর্মী বিদেশে চাকরি করলেও রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে না। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ১২ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার আগের অর্থ বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অদক্ষ জনশক্তি রফতানির কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ দিন দিন নেমে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে বিদেশি ৫ থেকে ৬ লাখ দক্ষ জনশক্তি কাজ করছেন। তারা প্রায় সমপরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন। যদিও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বর্তমানের চেয়ে অনেক কম কর্মী বিদেশে চাকরি করেছে। জানা গেছে, দালাল চক্রের মাধ্যমে বিদেশে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ কর্মী যাওয়ার ফলে শুধু সংখ্যা বাড়ছে। কিন্ত রেমিট্যান্স বাড়ছে না।

রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রয়োজন দক্ষ কর্মী। দক্ষ কর্মী তৈরিতে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া চলবে না

এই অদক্ষ কর্মীর বেশিরভাগই গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাদের নানাভাবে প্রলোভনে ফেলে মধ্যস্বত্বভোগীরা হাতিয়ে নিচ্ছে বড় অঙ্কের টাকা। দালালদের লোভনীয় প্রস্তাবে অনেক বাংলাদেশি কোন প্রকার কাজ ছাড়াই এভাবে বিদেশ গিয়ে বিপদে পড়ছেন। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশের কর্মীদের মান অনেক নিচে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে লাখ লাখ কর্মী বিদেশ গেলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে না। গুণগতমান ঠিক করতে না পারলে বিদেশের শ্রমবাজারগুলো হারাতে হতে পারে।

বিএমইটি সূত্র জানিয়েছে, একজন দক্ষ কর্মীকে নিরাপদ, সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিদেশে পাঠানোর মাধ্যমেই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সম্ভব হবে। কিন্তু সেই কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে দেশে প্রবাসীরা ভালোমানের কাজ করতে পারবে না। প্রবাসীরা বিদেশে যাওয়ার আগে তাদের কর্মদক্ষতা যাচাই করতে হবে। দক্ষতার বিচারে তখন অনেক অদক্ষ কর্মী বিদেশে যেতে পারত না।

কেমন আছেন প্রবাসী বাঙালিরা? কেমন লাগে প্রবাসে স্বজন ছাড়া থাকতে। দেশ নিয়ে কি তাদের চিন্তা। এতদসংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাঙালিরা তাদের নিজেদের জীবনযাত্রা সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা নিজেদের জবানিতে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও বিভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরছেন। অনিয়ম দুর্ভোগের অবসানের লক্ষ্যে তারা আশায় দিনযাপন করছে।

আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও নিরাপদ অভিবাসন আজ এক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রবাসী গমনেচ্ছু লোকেরা অনেকটাই শাখের করাতের অবস্থার মুখোমুখি হয়। বিদেশে যাওয়ার আগে এক ধরনের দুর্ভোগ আর বিদেশে যাওয়ার পরে আসে নতুন দুর্ভোগ। প্রকৃতপক্ষে যতদিন না এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে ততদিন এই দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণের পথ থাকবে না। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য দক্ষ কর্মী ও নিরাপদ অভিবাসন এই দুটি অনুষঙ্গ ছাড়া তারা বড় বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে না।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top