অরূপরতন চৌধুরী
এইডস হলো এইচআইভি (হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) থেকে সৃষ্ট একটি ভয়াবহ রোগ। এটি প্রতিরোধ যোগ্য মরণব্যাধি। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয়। বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশে^ প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। বর্তমানে এইচআইভি আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৪৯। বিশ্বে প্রতিদিন ৪ হাজার মানুষ এইচআইভি এইডসে আক্রান্ত হচ্ছে। এবং বিশ্বে প্রতি মিনিটে ৪ জন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, এর মধ্যে মারা যাচ্ছে ১ জন। এইচআইভি এইডসের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর দিনটিকে ডড়ৎষফ অওউঝ উধু হিসেবে পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো- ‘Let Communities Lead’।
এইচআইভি এইডস জন্মগত বা রোগ ছোঁয়াচে রোগ নয়। যে কোনো ব্যক্তিই (বিশেষ করে তরুণ, যুব সমাজ) এইচআইভি সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিতে থাকে। এইচআইভি বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকে। যেমন: আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক স্থাপন সেটা হতে পারে- যোনিপথ, মুখ কিংবা পায়ুপথে। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ, আক্রান্ত মা হতে তার শিশুতে, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সূচ সিরিঞ্জ অন্যজন ব্যবহারের মাধ্যমেও এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ে। রক্ত পরীক্ষায় এইচআইভি পজেটিভদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মানুষ এইডস এ আক্রান্ত হয়ে থাকেন বিশেষ করে যাদের শরীরে ‘টি’ সেলের সংখ্যা প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে ২০০ বা এর নিচে নেমে আসে।
এইচআইভি একটি অতি ক্ষুদ্র জীবাণু যা মানবদেহে প্রবেশ করে শরীরের স্বাভাবিক রোগ-প্রতিরোধব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। ফলে আক্রান্ত মানুষের শরীরে এক বা একাধিক রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। এ রোগের লক্ষণ পেতে কয়েক মাস থেকে ১০ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এ রোগের লক্ষণ/উপসর্গসমূহকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১) প্রারম্ভিক সংক্রমণ এবং অ্যান্টিবডি তৈরি, ২) উপসর্গহীন বাহক, ৩) এইডসসম্পর্কিত জটিলতা, ৪) এইডস। উপসর্গ হিসেবে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে প্রথমে জ্বর, গলা ব্যথা, শরীরের চামড়ায় দাগ দেখা দেয়। অনেকের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর পর্যন্ত কোন উপসর্গ না-ও থাকতে পারে। নীরোগ বা উপসর্গহীন এবং স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের অধিকারী থাকেন, যদিও তারা এ রোগ বহন করে অন্যকে সংক্রমণ করতে সক্ষম। একবার সংক্রমিত হলে সারা জীবন সংক্রমিত থাকেন। এ রোগ নির্মূলে এখন অবধি কোন ওষুধ বের হয়নি। এরপরে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় এবং শরীরের গ্রন্থিগুলো দুলতে থাকে। পরবর্তীতে প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হওয়ার জন্য নানারকম জীবাণু শরীরে বাসা বাঁধে। একসময় দেখা দেয়- ডায়রিয়া, জ্বর, গা-হাত-পা ব্যথা, ওজন কমা, প্লীহা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি রোগ লক্ষণসমূহের শেষ স্তর হলো এইডস। সুযোগসন্ধানী জীবাণুর মারাত্মক সংক্রমণ ঘটলে রোগী ক্যান্সার দ্বারা আক্রান্ত হন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মক কমে যায় এবং রোগী ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে।
জাতীয় এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের তথ্যনুয়ায়ী ২০২১ সালের তথ্যনুযায়ী বাংলাদশে এই রোগের আক্রান্তের সংখ্যা ১৪০০০। এর মধ্যে চিকিৎসার আওতায় এসেছেন ৮৪ শতাংশ। ২০২০ সালে দেশে এইডস আক্রান্ত হয়ে ২০৫ জন মৃত্যুবরণ করেন। এ যাবত প্রায় ২০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এইডস এর কারণে। সংখ্যার দিক থেকে আক্রান্ত বা মৃতের পরিমাণ কম মনে হলেও এইচআইভি এইডস এর ঝুঁকি নেহায়েত কম নয়। কারণ সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে। মাদকসেবী এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দেশে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে। যা উদ্বেগজনক! উপরন্তু, আতঙ্কের বিষয় হলো- আমাদের পাশর্^বর্তী দেশ ভারত ও মায়ানমার এইডস রোগের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে এ দেশের ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন শ্রেণীর সাধারণ মানুষের যোগাযোগ আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১২ লাখ ৯১ হাজার ৬৯ জনের এইচআইভি/এইডস শনাক্তকরণ পরীক্ষা হয়েছে। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৫৮৯। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ১৮৬ জন (২৬%) সাধারণ জনগণ, রোহিঙ্গা ১৮৮ জন (২৬%), বিদেশফেরত প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্য ১৪৪ জন (২০%), ইনজেকশনের মাধ্যমে শিরায় মাদক গ্রহণকারী ৬১ জন (৮%), নারী যৌনকর্মী ১৭ জন (২%), সমকামী ৬৭ জন (৯%), পুরুষ যৌনকর্মী ৫৩ জন (৭%) ও ট্রান্সজেন্ডার ১৩ জন (২%)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশের ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ নারীই এইডস বিষয়ে অবগত নন, কিন্তু এইডস রোগের অন্তত একটি বাহক সম্পর্কে অবগত ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। ৩৬ শতাংশ নারী সবগুলো বাহক সম্পর্কে অবগত। ২০১৬ সালে এ হার ছিল ২৯ শতাংশ। সচেতনতার হার বৃদ্ধি ইতিবাচক কিন্তু, আরও বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক। এটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়ায়। সুতরাং আমাদের দেহে স্পটভিত্তিক ট্রান্সমিশন বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশ অনেক সামাজিক সমস্যা বিদ্যমান। তার মধ্যে মাদকাসক্তি বড় একটি সমস্যা এবং এটি বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকদ্রব্য, ধূমপান ও তামাক সেবন মানুষের অকাল মৃত্যু এবং স্বাস্থ্যহানির অন্যতম প্রধান কারণ। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিপৎগামিতাও সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। বাংলাদেশে ৪৯% মানুষের বয়স ২৪ বা এর নিচে। অর্থাৎ- ৪৯% জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। বেসরকারি হিসাব মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। মাদকসেবীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ।
ধারণা করা হচ্ছে- আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকাসক্ত ব্যক্তির আসক্তি তাকে মানসিক ও শারীরিক রোগসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার আশঙ্কা সৃষ্টি করে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন রোগের মতো এইচআইভি এইডসের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা মাদক গ্রহনকালীন সময়ে অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন ও ঝুকির্পূন আচরণ করে, যেমন- অনিরাপদ ও একাধিক যৌন সম্পর্ক, সুই/সিরিঞ্জের শেয়ার করে মাদক গ্রহণ ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন রোগের মতো মাদকনিরভর্শীল ব্যক্তিরা এইডসের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত এইচআইভি এইডসের জন্য ঝুঁকির্পূণ গোষ্ঠীর বড় অংশ হচ্ছে যারা সুই ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করে।
মাদকাসক্তদের শাসন, ঘৃণা বা অবহেলা না করে তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে নিরাময় কেন্দ্রে পরিপূর্ণ চিকিৎসা দিতে হবে। যাতে তারা সমাজের বোঝা না হয়ে সুস্থ হয়ে আবার পরিবারে ফিরে আসতে পারে। তাই পিতা-মাতার প্রতি অনুরোধ আপনার সন্তানকে মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে লুকিয়ে রাখবেন না, ঘৃণা করবেন না বরং তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান। তাকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দিন। সঠিক চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে একদিন তারাই সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।
আর এই মাদকের ভয়াবহতা কমাতে না পারলে দেশের অনেক সমস্যাকে উসকে দিতে পারে তার মধ্যে অন্যতম হলো- এইচআইভি এইডস। কেননা, তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তির সংখ্যা বেশি এবং এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী মানুষ বাড়ছে। মাদকাসক্তির মতো বড় সামাজিক সমস্যা রুখতে এবং প্রাণঘাতী রোগ এইচআইভি এইডস প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি গণমানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো অত্যাবশ্যক। এইচআইভি আক্রান্তদের মধ্যে বৈষম্য রুখতে জাতীয় আইন/নীতির বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। এছাড়া এইচআইভি সংক্রমণ রুখতে দেশের অনন্ত সব সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে, বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও স্থলবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। সর্বোপরি, মানুষ সচেতন না হলে এই ঝুঁকি এড়ানো কঠিন।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও
নেশা নিরোধ সংস্থা]
অরূপরতন চৌধুরী
বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩
এইডস হলো এইচআইভি (হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) থেকে সৃষ্ট একটি ভয়াবহ রোগ। এটি প্রতিরোধ যোগ্য মরণব্যাধি। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয়। বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশে^ প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। বর্তমানে এইচআইভি আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৪৯। বিশ্বে প্রতিদিন ৪ হাজার মানুষ এইচআইভি এইডসে আক্রান্ত হচ্ছে। এবং বিশ্বে প্রতি মিনিটে ৪ জন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, এর মধ্যে মারা যাচ্ছে ১ জন। এইচআইভি এইডসের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর দিনটিকে ডড়ৎষফ অওউঝ উধু হিসেবে পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো- ‘Let Communities Lead’।
এইচআইভি এইডস জন্মগত বা রোগ ছোঁয়াচে রোগ নয়। যে কোনো ব্যক্তিই (বিশেষ করে তরুণ, যুব সমাজ) এইচআইভি সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিতে থাকে। এইচআইভি বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকে। যেমন: আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক স্থাপন সেটা হতে পারে- যোনিপথ, মুখ কিংবা পায়ুপথে। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ, আক্রান্ত মা হতে তার শিশুতে, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সূচ সিরিঞ্জ অন্যজন ব্যবহারের মাধ্যমেও এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ে। রক্ত পরীক্ষায় এইচআইভি পজেটিভদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মানুষ এইডস এ আক্রান্ত হয়ে থাকেন বিশেষ করে যাদের শরীরে ‘টি’ সেলের সংখ্যা প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে ২০০ বা এর নিচে নেমে আসে।
এইচআইভি একটি অতি ক্ষুদ্র জীবাণু যা মানবদেহে প্রবেশ করে শরীরের স্বাভাবিক রোগ-প্রতিরোধব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। ফলে আক্রান্ত মানুষের শরীরে এক বা একাধিক রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। এ রোগের লক্ষণ পেতে কয়েক মাস থেকে ১০ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এ রোগের লক্ষণ/উপসর্গসমূহকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১) প্রারম্ভিক সংক্রমণ এবং অ্যান্টিবডি তৈরি, ২) উপসর্গহীন বাহক, ৩) এইডসসম্পর্কিত জটিলতা, ৪) এইডস। উপসর্গ হিসেবে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে প্রথমে জ্বর, গলা ব্যথা, শরীরের চামড়ায় দাগ দেখা দেয়। অনেকের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর পর্যন্ত কোন উপসর্গ না-ও থাকতে পারে। নীরোগ বা উপসর্গহীন এবং স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের অধিকারী থাকেন, যদিও তারা এ রোগ বহন করে অন্যকে সংক্রমণ করতে সক্ষম। একবার সংক্রমিত হলে সারা জীবন সংক্রমিত থাকেন। এ রোগ নির্মূলে এখন অবধি কোন ওষুধ বের হয়নি। এরপরে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় এবং শরীরের গ্রন্থিগুলো দুলতে থাকে। পরবর্তীতে প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হওয়ার জন্য নানারকম জীবাণু শরীরে বাসা বাঁধে। একসময় দেখা দেয়- ডায়রিয়া, জ্বর, গা-হাত-পা ব্যথা, ওজন কমা, প্লীহা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি রোগ লক্ষণসমূহের শেষ স্তর হলো এইডস। সুযোগসন্ধানী জীবাণুর মারাত্মক সংক্রমণ ঘটলে রোগী ক্যান্সার দ্বারা আক্রান্ত হন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মক কমে যায় এবং রোগী ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে।
জাতীয় এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের তথ্যনুয়ায়ী ২০২১ সালের তথ্যনুযায়ী বাংলাদশে এই রোগের আক্রান্তের সংখ্যা ১৪০০০। এর মধ্যে চিকিৎসার আওতায় এসেছেন ৮৪ শতাংশ। ২০২০ সালে দেশে এইডস আক্রান্ত হয়ে ২০৫ জন মৃত্যুবরণ করেন। এ যাবত প্রায় ২০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এইডস এর কারণে। সংখ্যার দিক থেকে আক্রান্ত বা মৃতের পরিমাণ কম মনে হলেও এইচআইভি এইডস এর ঝুঁকি নেহায়েত কম নয়। কারণ সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে। মাদকসেবী এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দেশে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে। যা উদ্বেগজনক! উপরন্তু, আতঙ্কের বিষয় হলো- আমাদের পাশর্^বর্তী দেশ ভারত ও মায়ানমার এইডস রোগের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে এ দেশের ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন শ্রেণীর সাধারণ মানুষের যোগাযোগ আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১২ লাখ ৯১ হাজার ৬৯ জনের এইচআইভি/এইডস শনাক্তকরণ পরীক্ষা হয়েছে। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৫৮৯। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ১৮৬ জন (২৬%) সাধারণ জনগণ, রোহিঙ্গা ১৮৮ জন (২৬%), বিদেশফেরত প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্য ১৪৪ জন (২০%), ইনজেকশনের মাধ্যমে শিরায় মাদক গ্রহণকারী ৬১ জন (৮%), নারী যৌনকর্মী ১৭ জন (২%), সমকামী ৬৭ জন (৯%), পুরুষ যৌনকর্মী ৫৩ জন (৭%) ও ট্রান্সজেন্ডার ১৩ জন (২%)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশের ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ নারীই এইডস বিষয়ে অবগত নন, কিন্তু এইডস রোগের অন্তত একটি বাহক সম্পর্কে অবগত ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। ৩৬ শতাংশ নারী সবগুলো বাহক সম্পর্কে অবগত। ২০১৬ সালে এ হার ছিল ২৯ শতাংশ। সচেতনতার হার বৃদ্ধি ইতিবাচক কিন্তু, আরও বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক। এটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়ায়। সুতরাং আমাদের দেহে স্পটভিত্তিক ট্রান্সমিশন বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশ অনেক সামাজিক সমস্যা বিদ্যমান। তার মধ্যে মাদকাসক্তি বড় একটি সমস্যা এবং এটি বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকদ্রব্য, ধূমপান ও তামাক সেবন মানুষের অকাল মৃত্যু এবং স্বাস্থ্যহানির অন্যতম প্রধান কারণ। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিপৎগামিতাও সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। বাংলাদেশে ৪৯% মানুষের বয়স ২৪ বা এর নিচে। অর্থাৎ- ৪৯% জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। বেসরকারি হিসাব মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। মাদকসেবীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ।
ধারণা করা হচ্ছে- আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকাসক্ত ব্যক্তির আসক্তি তাকে মানসিক ও শারীরিক রোগসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার আশঙ্কা সৃষ্টি করে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন রোগের মতো এইচআইভি এইডসের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা মাদক গ্রহনকালীন সময়ে অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন ও ঝুকির্পূন আচরণ করে, যেমন- অনিরাপদ ও একাধিক যৌন সম্পর্ক, সুই/সিরিঞ্জের শেয়ার করে মাদক গ্রহণ ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন রোগের মতো মাদকনিরভর্শীল ব্যক্তিরা এইডসের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত এইচআইভি এইডসের জন্য ঝুঁকির্পূণ গোষ্ঠীর বড় অংশ হচ্ছে যারা সুই ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করে।
মাদকাসক্তদের শাসন, ঘৃণা বা অবহেলা না করে তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে নিরাময় কেন্দ্রে পরিপূর্ণ চিকিৎসা দিতে হবে। যাতে তারা সমাজের বোঝা না হয়ে সুস্থ হয়ে আবার পরিবারে ফিরে আসতে পারে। তাই পিতা-মাতার প্রতি অনুরোধ আপনার সন্তানকে মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে লুকিয়ে রাখবেন না, ঘৃণা করবেন না বরং তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান। তাকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দিন। সঠিক চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে একদিন তারাই সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।
আর এই মাদকের ভয়াবহতা কমাতে না পারলে দেশের অনেক সমস্যাকে উসকে দিতে পারে তার মধ্যে অন্যতম হলো- এইচআইভি এইডস। কেননা, তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তির সংখ্যা বেশি এবং এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী মানুষ বাড়ছে। মাদকাসক্তির মতো বড় সামাজিক সমস্যা রুখতে এবং প্রাণঘাতী রোগ এইচআইভি এইডস প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি গণমানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো অত্যাবশ্যক। এইচআইভি আক্রান্তদের মধ্যে বৈষম্য রুখতে জাতীয় আইন/নীতির বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। এছাড়া এইচআইভি সংক্রমণ রুখতে দেশের অনন্ত সব সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে, বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও স্থলবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। সর্বোপরি, মানুষ সচেতন না হলে এই ঝুঁকি এড়ানো কঠিন।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও
নেশা নিরোধ সংস্থা]