alt

উপ-সম্পাদকীয়

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

: বৃহস্পতিবার, ০৫ নভেম্বর ২০২০

বর্জ্যরে আধুনিক ও নিরাপদ অপসারণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা বাংলাদেশের অন্যতম পরিবেশগত সমস্যা। ক্ষুদ্র আয়তনের দেশটিতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানা। চলমান উন্নয়নের ধারায় ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র, শিল্পকারখানা, কৃষিক্ষেত্র, শোধনাগার, কসাইখানা এবং উন্মুক্ত স্থান থেকে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ কঠিন ও তরল আবর্জনা প্রতিনিয়ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে জটিল করে তুলছে। রান্নাঘরের পরিত্যক্ত আবর্জনা, হাটবাজারের পচনশীল শাকসবজি, কলকারখানার তৈলাক্ত পদার্থ, কসাইখানার রক্ত, ছাপাখানার রং, হাসপাতালের বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থের নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত না হওয়ায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হয়ে উঠছে আরও ঝুঁকিপূর্ণ। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এবং আধুনিক জীবনযাপনে ব্যবহৃত অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, প্যাকেটজাত খাবারের কৌটা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিধি বিস্তৃত করে চলছে। ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজধানী ঢাকায় কঠিন বর্জ্য অপসারণে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা নেই। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মহানগরের ২০ মিলিয়ন মানুষের বিপুল পরিমাণ গৃহস্থালি বর্জ্য প্রতিনিয়ত এখানে সেখানে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা থেকে উৎপন্ন বর্জ্যরে পরিমাণও বিপুল। ঢাকা মেগাসিটিতে প্রতিদিন প্রায় ৫০০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মাত্র অর্ধেকের কিছু বেশি পরিমাণ বর্জ্য নিয়মিত সংগ্রহ করে শহরের দূরে স্তূপ করে রাখা হয়। বাকিটা খোলা ডাস্টবিনে অথবা রাস্তার পাশে স্তূপাকৃত হয়ে পড়ে থাকে। অপচনশীল কঠিন পদার্থ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করছে। কঠিন ও তরল উভয় বর্জ্যরে ক্ষেত্রেই রোগ বিস্তারকারী ব্যাকটেরিয়া ও বিষাক্ত ধাতব পদার্থসমূহ জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

বাংলাদেশে কঠিন বর্জ্য পরিচালন ব্যবস্থা আজও মানুষের শ্রমনির্ভর। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোটবড় শহরগুলোতে এখনও মানুষ কঠিন ও আধা কঠিন আবর্জনা সংগ্রহ করে ডাস্টবিনে ফেলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বর্জ্যরে তুলনায় ডাস্টবিনের সংখ্যাও কম। মানুষের অজ্ঞতা ও অসাবধানতার কারণে ডাস্টবিনগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। বর্ষা মৌসুমে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। কঠিন বর্জ্য রাস্তার পার্শ্বস্থ ড্রেনে পড়ে তরল বর্জ্য ব্যবস্থাকে একেবারে অচল করে দেয়। দেশের বেশিরভাগ স্থানে পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত সিউয়ার এবং ড্রেন নেই। ফলে তরল বর্জের নিরাপদ অপসারণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরে খাল, নদীর মতো প্রাকৃতিক জলাধারগুলো শুকিয়ে গেছে অথবা অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। ফলে তরল বর্জ্যরে অপসারণের স্বাভাবিক বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের তরলবর্জ্য অপসারণ বা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আরও নাজুক। গৃহস্থালি বর্জ্য নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় তা ঘরবাড়ির আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এসব দূষিত তরল বর্জ্য কালক্রমে পুকুর, খাল অথবা নদীতে গিয়ে পড়ে এবং নদীদূষণের কারণ হয়। ভূপৃষ্ঠস্থ দূষিত পানির প্রভাবে সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানিও ধীরে ধীরে দূষিত হতে থাকে। এসব পানি পান করে পানিবাহিত রোগের বিস্তার ঘটে। শহরাঞ্চলের ছিন্নমূল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সেখানে অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে বসবাসকারী লাখো কোটি মানুষের জন্য সেনিটেশন ব্যবস্থা নেই। এসব ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসন করা ছাড়া সেখানকার পয়ঃনিষ্কাশন সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

একটি এলাকার কঠিন, আধা কঠিন ও তরল বর্জ্যকে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা বর্জ্য পরিচালন। বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন আবর্জনা সংগ্রহ, স্থানান্তর, প্রক্রিয়াকরণ এবং চূড়ান্ত অপসারণ কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পাদন করা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য। সারা দেশে যেখানে বাৎসরিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ১.৪ সেখানে শহরাঞ্চলে বেড়ে চলছে শতকরা ৩.৪ হারে। সে হিসাবে ২০২০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৪০ মিলিয়ন অর্থাৎ বর্তমান সময়ের দ্বিগুণ। বর্জ্যকে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করা হচ্ছে পরিবেশ সুরক্ষার অন্যতম প্রধান উপায়। পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার বিকল্প নেই। এলাকার জনস্বাস্থ্য, কারিগরি এবং অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সফল কার্যকারিতা নির্ভর করে। আঞ্চলিক পরিবেশ এবং এলাকার জনগণের প্রাত্যহিক জীবনযাপন পদ্ধতি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

বর্জ্যরে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিতকরণে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই। কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ করে অপসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি শহরে-বন্দরে প্রয়োজনীয়-সংখ্যক হেভি লোডার সরবরাহ করার প্রয়োজন পড়ে। শহরের কঠিন বর্জ্য প্রতিদিন ভোরে ঢাকনাযুক্ত বিশেষ ট্রাকে সংগ্রহ করে নিরাপদ অপসারণের ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠিন বর্জ্য সংগ্রহের জন্য রাস্তার পাশে ঢাকনাযুক্ত সঠিক মাপের ডাস্টবিন স্থাপন করতে হবে। জনগণকেও প্লাস্টিক ব্যাগে আবদ্ধ করে কঠিন বর্জ্য উক্ত ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা একত্রিকরণের জন্য সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা স্থানীয়ভাবে জনশক্তি নিয়োগে সহায়তা করতে পারে।

জনগণ ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনকে বিপুল পরিমাণ অর্থ কর দেয়। এর বিনিময়ে সেবা পাওয়া তাদের নাগরিক অধিকার। তরল বর্জ্য অপসারণের নিমিত্তে ওয়াসাকে সঠিক মাপের উন্মুক্ত ড্রেন ও ভূগর্ভস্থ সিউয়ার নির্মাণ করতে হবে। বাসাবাড়ির অভ্যন্তরীণ ড্রেনকে এইসব সিউয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ঘরবাড়িতে সেপটিক ট্যাংক ও হাউস ড্রেন নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা জরুরি। এসব ড্রেনকে সঠিকভাবে মেইন সিউয়ারের সঙ্গে সংযোগ দিতে হবে। নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য জনবল কাঠামো বিস্তৃত করতে হবে। বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি সহজে নিষ্কাশিত হওয়ার জন্য রাখতে হবে স্টর্ম সিউয়ার। দখল হয়ে যাওয়া নদী ও খাল উদ্ধার করে তা পুনর্খননের ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্জ্যরে মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ থাকে জৈব পদার্থ এবং শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ জলীয় কণা বিদ্যমান থাকে। কাজেই বর্জ্যকে নিরাপদ স্থানে অপসারণ করার পূর্বে বর্জ্যরে স্বাস্থ্যসম্মত বিশোধন (ট্রিটমেন্ট) করা জরুরি।

কঠিন বর্জ্যকে পুনরাবর্তন (রিসাইক্লিং) করার জন্য আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত প্রকল্প হাতে নেয়া আবশ্যক। তরল বর্জ্য যাতে পরিবেশ ঝুঁকির কারণ না হয় সে জন্য পর্যাপ্ত উন্নত ডিজাইনের সিউয়ার ও উম্মুক্ত ড্রেন লাইন স্থাপনসহ সিউয়েজ পরিশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। ঢাকা মহানগরীর বর্জ্য বর্তমানে যে স্থান ভরাট করা জন্য ব্যবহৃত হয় তা আগামীর জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়।

বর্তমানে ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগে বিভক্ত। ডিডিসি (উত্তর) রয়েছে ৩৬টি ওয়ার্ড এবং ডিডিসি (দক্ষিণ) সিটি করপোরেশনের ৫৬টি ওয়ার্ড। ঢাকা সিটির ৫৫টি ওয়ার্ডের বর্জ্য ঢাকার মাতুয়াইলে এবং ৩৬টি ওয়ার্ডের বর্জ্য আমিনবাজারে জমি ভরাটের কাজে স্তূপ করে রাখা হয়। বর্জ্যরে রিসাইক্লিং বর্জ্যরে পরিমাণ সীমিত রেখে স্তূপাকৃত স্থানের সংকুলানে সহায়তা করতে পারে। শহরে টোকাই বা ভাঙারি বিক্রেতারা রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা বা ডাস্টবিন থেকে প্লাস্টিক বা ধাতব জাতীয় বর্জ্য পদার্থগুলোকে সংগ্রহের পর তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তাদের এই কাজ বর্জ্য অপসারণ এবং রিসাইক্লিং কাজে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখে। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলে বর্জ্য অপসারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমশক্তিকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সক্রিয় রাখতে দেশের আপামর জনগণকে সচেতন করে তোলার কোন বিকল্প নেই। কেননা জনগণের সহযোগিতা ছাড়া সিটি করপোরেশন একার পক্ষে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সচল রাখা সম্ভব নয়। ‘বর্জ্য’ শব্দকে সংজ্ঞায়িত করলে তা সময় বা ঋতু নির্বিশেষে একটি অর্থনৈতিক মূল্যহীন, বাজার চাহিদাবিহীন দ্রব্যকে বুঝালেও এর সঠিক রিসাইক্লিংয়ের পরে তা অতিপ্রয়োজনীয় সার ও জ্বালানিতে রূপান্তরিত হতে পারে, বাজারে যার চাহিদা ও অর্থনৈতিক মূল্য অপরিসীম।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট]

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ

আমেরিকার অলিগার্কি পতনের আখ্যান

রম্যগদ্য : ‘উহু উহু, তোরে মাফ করা যায় না...’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট : সংকোচন, সংকট ও সম্ভাবনার প্রতিফলন

আম রপ্তানি : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

সামাজিকমাধ্যম গুরুত্বহীন নয়

জমির শ্রেণী চেনার উপায় ও পরিবর্তনের নিয়ম-কানুন

বাংলাদেশ : “রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ”

নতুন নোট, নতুন বিতর্ক

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশা ও উপজেলা পর্যায়ের অদক্ষতা : কে নেবে দায়িত্ব?

তরল সম্পর্কের গোলকধাঁধা

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

বাজেটে বৈষম্য কমানোর কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন আছে কি

চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে

রম্যগদ্য : ‘নির্বাচন, না নীর-বচন...’

প্লাস্টিক দূষণ নয়, প্রকৃতির পাশে দাঁড়ান

কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ত্যাগের মহিমায় ঈদুল আজহা

নাম ও মর্যাদা : অর্থবহ নামকরণে বৈষম্য রোধের আহ্বান

ডিজিটাল পুঁজিবাদের যুগে নগর বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামো

পারিবারিক শিক্ষা ও রাষ্ট্রসংস্কার : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের পথরেখা

প্রসঙ্গ : রাজধানীর যানজট

নবায়নযোগ্য জ্বালানি : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ছবি

তাহলে একাত্তরে হয়নিকো কোনো অপরাধ!

ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ

আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য কৌশলে বাস্তববাদী বাঁক

রম্যগদ্য : ‘জনগণের ভালোবাসা কি আমার ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়াইবো?’

ভালো থাকার কঠিন কলা : কিছু সরল সত্য

নীরব ঘাতক তামাক

পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা

নিয়ন্ত্রণহীন নেটজগৎ ও ফেইসবুক : সমাজে বিভ্রান্তির ডিজিটাল উৎপত্তি

বস্তিবাসী নারী : অদৃশ্য শক্তির আখ্যান

চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল : বিতর্ক, নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন

সংস্কারের ভবিষ্যত কী?

বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড় চায় না তো কেউ, প্রকৃতির নিয়মে আসে কিন্তু তাই!

কেন থমকে আছে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

বৃহস্পতিবার, ০৫ নভেম্বর ২০২০

বর্জ্যরে আধুনিক ও নিরাপদ অপসারণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা বাংলাদেশের অন্যতম পরিবেশগত সমস্যা। ক্ষুদ্র আয়তনের দেশটিতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানা। চলমান উন্নয়নের ধারায় ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র, শিল্পকারখানা, কৃষিক্ষেত্র, শোধনাগার, কসাইখানা এবং উন্মুক্ত স্থান থেকে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ কঠিন ও তরল আবর্জনা প্রতিনিয়ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে জটিল করে তুলছে। রান্নাঘরের পরিত্যক্ত আবর্জনা, হাটবাজারের পচনশীল শাকসবজি, কলকারখানার তৈলাক্ত পদার্থ, কসাইখানার রক্ত, ছাপাখানার রং, হাসপাতালের বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থের নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত না হওয়ায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হয়ে উঠছে আরও ঝুঁকিপূর্ণ। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এবং আধুনিক জীবনযাপনে ব্যবহৃত অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, প্যাকেটজাত খাবারের কৌটা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিধি বিস্তৃত করে চলছে। ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজধানী ঢাকায় কঠিন বর্জ্য অপসারণে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা নেই। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মহানগরের ২০ মিলিয়ন মানুষের বিপুল পরিমাণ গৃহস্থালি বর্জ্য প্রতিনিয়ত এখানে সেখানে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা থেকে উৎপন্ন বর্জ্যরে পরিমাণও বিপুল। ঢাকা মেগাসিটিতে প্রতিদিন প্রায় ৫০০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মাত্র অর্ধেকের কিছু বেশি পরিমাণ বর্জ্য নিয়মিত সংগ্রহ করে শহরের দূরে স্তূপ করে রাখা হয়। বাকিটা খোলা ডাস্টবিনে অথবা রাস্তার পাশে স্তূপাকৃত হয়ে পড়ে থাকে। অপচনশীল কঠিন পদার্থ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করছে। কঠিন ও তরল উভয় বর্জ্যরে ক্ষেত্রেই রোগ বিস্তারকারী ব্যাকটেরিয়া ও বিষাক্ত ধাতব পদার্থসমূহ জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

বাংলাদেশে কঠিন বর্জ্য পরিচালন ব্যবস্থা আজও মানুষের শ্রমনির্ভর। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোটবড় শহরগুলোতে এখনও মানুষ কঠিন ও আধা কঠিন আবর্জনা সংগ্রহ করে ডাস্টবিনে ফেলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বর্জ্যরে তুলনায় ডাস্টবিনের সংখ্যাও কম। মানুষের অজ্ঞতা ও অসাবধানতার কারণে ডাস্টবিনগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। বর্ষা মৌসুমে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। কঠিন বর্জ্য রাস্তার পার্শ্বস্থ ড্রেনে পড়ে তরল বর্জ্য ব্যবস্থাকে একেবারে অচল করে দেয়। দেশের বেশিরভাগ স্থানে পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত সিউয়ার এবং ড্রেন নেই। ফলে তরল বর্জের নিরাপদ অপসারণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরে খাল, নদীর মতো প্রাকৃতিক জলাধারগুলো শুকিয়ে গেছে অথবা অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। ফলে তরল বর্জ্যরে অপসারণের স্বাভাবিক বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের তরলবর্জ্য অপসারণ বা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আরও নাজুক। গৃহস্থালি বর্জ্য নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় তা ঘরবাড়ির আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এসব দূষিত তরল বর্জ্য কালক্রমে পুকুর, খাল অথবা নদীতে গিয়ে পড়ে এবং নদীদূষণের কারণ হয়। ভূপৃষ্ঠস্থ দূষিত পানির প্রভাবে সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানিও ধীরে ধীরে দূষিত হতে থাকে। এসব পানি পান করে পানিবাহিত রোগের বিস্তার ঘটে। শহরাঞ্চলের ছিন্নমূল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সেখানে অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে বসবাসকারী লাখো কোটি মানুষের জন্য সেনিটেশন ব্যবস্থা নেই। এসব ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসন করা ছাড়া সেখানকার পয়ঃনিষ্কাশন সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

একটি এলাকার কঠিন, আধা কঠিন ও তরল বর্জ্যকে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা বর্জ্য পরিচালন। বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন আবর্জনা সংগ্রহ, স্থানান্তর, প্রক্রিয়াকরণ এবং চূড়ান্ত অপসারণ কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পাদন করা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য। সারা দেশে যেখানে বাৎসরিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ১.৪ সেখানে শহরাঞ্চলে বেড়ে চলছে শতকরা ৩.৪ হারে। সে হিসাবে ২০২০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৪০ মিলিয়ন অর্থাৎ বর্তমান সময়ের দ্বিগুণ। বর্জ্যকে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করা হচ্ছে পরিবেশ সুরক্ষার অন্যতম প্রধান উপায়। পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার বিকল্প নেই। এলাকার জনস্বাস্থ্য, কারিগরি এবং অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সফল কার্যকারিতা নির্ভর করে। আঞ্চলিক পরিবেশ এবং এলাকার জনগণের প্রাত্যহিক জীবনযাপন পদ্ধতি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

বর্জ্যরে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিতকরণে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই। কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ করে অপসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি শহরে-বন্দরে প্রয়োজনীয়-সংখ্যক হেভি লোডার সরবরাহ করার প্রয়োজন পড়ে। শহরের কঠিন বর্জ্য প্রতিদিন ভোরে ঢাকনাযুক্ত বিশেষ ট্রাকে সংগ্রহ করে নিরাপদ অপসারণের ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠিন বর্জ্য সংগ্রহের জন্য রাস্তার পাশে ঢাকনাযুক্ত সঠিক মাপের ডাস্টবিন স্থাপন করতে হবে। জনগণকেও প্লাস্টিক ব্যাগে আবদ্ধ করে কঠিন বর্জ্য উক্ত ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা একত্রিকরণের জন্য সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা স্থানীয়ভাবে জনশক্তি নিয়োগে সহায়তা করতে পারে।

জনগণ ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনকে বিপুল পরিমাণ অর্থ কর দেয়। এর বিনিময়ে সেবা পাওয়া তাদের নাগরিক অধিকার। তরল বর্জ্য অপসারণের নিমিত্তে ওয়াসাকে সঠিক মাপের উন্মুক্ত ড্রেন ও ভূগর্ভস্থ সিউয়ার নির্মাণ করতে হবে। বাসাবাড়ির অভ্যন্তরীণ ড্রেনকে এইসব সিউয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ঘরবাড়িতে সেপটিক ট্যাংক ও হাউস ড্রেন নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা জরুরি। এসব ড্রেনকে সঠিকভাবে মেইন সিউয়ারের সঙ্গে সংযোগ দিতে হবে। নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য জনবল কাঠামো বিস্তৃত করতে হবে। বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি সহজে নিষ্কাশিত হওয়ার জন্য রাখতে হবে স্টর্ম সিউয়ার। দখল হয়ে যাওয়া নদী ও খাল উদ্ধার করে তা পুনর্খননের ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্জ্যরে মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ থাকে জৈব পদার্থ এবং শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ জলীয় কণা বিদ্যমান থাকে। কাজেই বর্জ্যকে নিরাপদ স্থানে অপসারণ করার পূর্বে বর্জ্যরে স্বাস্থ্যসম্মত বিশোধন (ট্রিটমেন্ট) করা জরুরি।

কঠিন বর্জ্যকে পুনরাবর্তন (রিসাইক্লিং) করার জন্য আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত প্রকল্প হাতে নেয়া আবশ্যক। তরল বর্জ্য যাতে পরিবেশ ঝুঁকির কারণ না হয় সে জন্য পর্যাপ্ত উন্নত ডিজাইনের সিউয়ার ও উম্মুক্ত ড্রেন লাইন স্থাপনসহ সিউয়েজ পরিশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। ঢাকা মহানগরীর বর্জ্য বর্তমানে যে স্থান ভরাট করা জন্য ব্যবহৃত হয় তা আগামীর জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়।

বর্তমানে ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগে বিভক্ত। ডিডিসি (উত্তর) রয়েছে ৩৬টি ওয়ার্ড এবং ডিডিসি (দক্ষিণ) সিটি করপোরেশনের ৫৬টি ওয়ার্ড। ঢাকা সিটির ৫৫টি ওয়ার্ডের বর্জ্য ঢাকার মাতুয়াইলে এবং ৩৬টি ওয়ার্ডের বর্জ্য আমিনবাজারে জমি ভরাটের কাজে স্তূপ করে রাখা হয়। বর্জ্যরে রিসাইক্লিং বর্জ্যরে পরিমাণ সীমিত রেখে স্তূপাকৃত স্থানের সংকুলানে সহায়তা করতে পারে। শহরে টোকাই বা ভাঙারি বিক্রেতারা রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা বা ডাস্টবিন থেকে প্লাস্টিক বা ধাতব জাতীয় বর্জ্য পদার্থগুলোকে সংগ্রহের পর তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তাদের এই কাজ বর্জ্য অপসারণ এবং রিসাইক্লিং কাজে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখে। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলে বর্জ্য অপসারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমশক্তিকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সক্রিয় রাখতে দেশের আপামর জনগণকে সচেতন করে তোলার কোন বিকল্প নেই। কেননা জনগণের সহযোগিতা ছাড়া সিটি করপোরেশন একার পক্ষে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সচল রাখা সম্ভব নয়। ‘বর্জ্য’ শব্দকে সংজ্ঞায়িত করলে তা সময় বা ঋতু নির্বিশেষে একটি অর্থনৈতিক মূল্যহীন, বাজার চাহিদাবিহীন দ্রব্যকে বুঝালেও এর সঠিক রিসাইক্লিংয়ের পরে তা অতিপ্রয়োজনীয় সার ও জ্বালানিতে রূপান্তরিত হতে পারে, বাজারে যার চাহিদা ও অর্থনৈতিক মূল্য অপরিসীম।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট]

back to top