জিয়াউদ্দীন আহমেদ
টানা ভারী বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা বন্যার পানিতে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের ১২টি জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। মানুষ যখন পানিতে ডুবে মরছে, না খেয়ে উপোস করছে, শাপ আর বেজি শত্রুতা ভুলে একসঙ্গে বাঁচার সংগ্রাম করছে, তখনও আমরা বন্যার কারণ নিয়ে নানা বিশ্লেষণে মেতে ছিলাম, বন্যার পানি নেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিনি। বন্যার ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যেই আমরা রাজনৈতিক মতাদর্শের ভেদাভেদ নিয়ে প্রকাশ্যে ও ভার্চুয়াল জগতে মাতামাতি করেছি। ১৯৭৬ সালে ডম্বুর ড্যাম চালু হওয়ার পূর্বে কুমিল্লায় প্রতি বছর বন্যা হতো, এখন হয় নাÑ এই অভিমত প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাতকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধুয়ে ফেলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর পানি সমস্যাটি সবার নজরে আসে। মাওলানা ভাসানীর লংমার্চ থেকে আমরা বলে আসছি, ভারত শুকনা মৌসুমে পানি আটকে রাখে, আর বর্ষার মৌসুমে রাতের আঁধারে একসঙ্গে সব গেট খুলে দেয়। আমাদের দাবি হচ্ছে, আমাদের পানির প্রয়োজন গ্রীষ্মকালে, বর্ষাকালে নয়; গ্রীষ্মকালে যখন তারা আমাদের পানি দেয় না, বর্ষাকালেও তারা পানি ছাড়তে পারবে না। এবার ফেনীর বন্যার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের ডম্বুর সøুইস গেট খুলে দেয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ডম্বুর ড্যামের ভিডিওতে ১০-১৫ গেট দিয়ে প্রবল বেগে পানি অপসারণের চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু ইন্টারনেটে দেখা গেল ডম্বুর ড্যামের মাত্র ৩টি গেট। এই ৩টি গেট খুলে দেয়ার জন্য ফেনী জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা? বিশ্বাস হচ্ছিল না।
সৃষ্ট এই বিভ্রান্তি দূর করতে শুধু ত্রিপুরার বিদ্যুৎমন্ত্রী ব্যাখ্যা দেন। ভারতীয় হাইকমিশনারও আমাদের প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করে উল্লেখ করেছেন যে, ডম্বুর ড্যামের গেট কাউকে খুলতে হয় না, পানির উচ্চতা ৯৪ মিটারের বেশি হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গেট খুলে যায় এবং পানি কমে গেলে গেট পুনরায় অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে যায়। ডম্বুর পানি ধরে রাখার কোন বাঁধ নয়, এটি একটি ড্যাম, এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ থেকে বাংলাদেশকেও বিদ্যুৎ দেয়া হয়। এই ড্যামের সম্মুখে একটি জলাধার রয়েছে, যেমন রয়েছে আমাদের কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মুখে। ডম্বুর ড্যামের সম্মুখে যে জলাধার রয়েছে তার ৯৪ মিটারের বেশি উচ্চতার পানি ধারনের সক্ষমতা নেই। পানি ৯৪ মিটারের বেশি হয়ে গেলে ড্যামের গেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, নতুবা ড্যাম ভেঙে যাবে; আর ড্যাম ভেঙে গেলে বাংলাদেশের অবস্থা হবে আরও ভয়াবহ। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ১৯৯৩ সালেও একবার বাঁধ খুলে গিয়েছিল, ৩১ বছর পর ২০২৪ সালে আবার খুলল।
ডম্বুর ড্যামটি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১২০ কিলোমিটার উজানে ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত। তাই ডম্বুর ড্যামের গেট খুলে দেয়া হলে ভারতের ১২০ কিলোমিটার প্রথমে পানিতে সয়লাব হবে এবং পরে তা বাংলাদেশে নামবে। অন্যদিকে ডম্বুর ড্যাম গোমতী নদীতে, গোমতী নদী বয়ে গেছে কুমিল্লার উপর দিয়ে, ডম্বুর ড্যামের সঙ্গে ফেনীর প্রত্যক্ষ কোন সংযোগ নেই। তাই ফেনীর বন্যার জন্য ডম্বুর ড্যামকে দায়ী করা যায় না। ফেনীর বন্যার জন্য দায়ী মুহুরী, সিলোনিয়া এবং কহুয়া নদী। মুহুরী এবং সিলেনিয়া নদী বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। মুহুরী এবং সিলোনিয়া ত্রিপুরার পাহাড়ি এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। মুহুরী নদীটি খুব বেশি চওড়া নয় এবং এই নদীর গভীরতাও কম। সিলোনিয়া নদীর চওড়া এবং গভীরতা আরও কম। গ্রীষ্ম এবং শীতকালে এই দুটি নদী হেঁটে পাড়ি দেয়া যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টি ও উজান থেকে তীব্র বেগে পানি নামার কারণে বিগত তিন মাসে পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ায় তিনবার বন্যা হয়েছে। আগের দুটি বন্যায় ফেনীর মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীর ভেঙে যাওয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামত করার সময় পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ বন্যায় বাঁধের আরও কিছু অংশ ভেঙে যায়, ফলে উক্ত তিনটি উপজেলা দ্রুত প্লাবিত হয়।
দেশের সর্বত্র রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, যেসব এলাকায় একসময় নৌকা ছাড়া যাওয়া যেত না, এখন সেখানে বাস যায়, ট্রাক যায়। কিন্ত এসব সড়কে পর্যাপ্ত ব্রিজ দিয়ে পানি সরানোর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। দেশের জলাশয়গুলোতে গড়ে উঠেছে বসতি, গ্রামে গ্রামে বিস্তৃত খালগুলো দখলদারদের দ্বারা হয়েছে ভরাট। তাই অল্প বৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দেয়। অপ্রশস্ত মুহুরী নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে প্রতি বছর পাড় ভাঙে, আর প্রতি বছর পাড় মেরামত করা হয়, কিন্তু টেকসই বাঁধ নির্মাণের কোন ব্যবস্থা কখনো নেয়া হয়নি। তবে এটা সত্য, গোমতী হোক বা মুহুরী, পানি এসেছে ভারতের ত্রিপুরা থেকেই। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার ত্রিপুরায় বৃষ্টি হয়েছে অনেক বেশি। বিগত বছরগুলোর হিসাব মোতাবেক ত্রিপুরায় আগস্ট মাসের প্রথম ২১ দিনে বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল ২১৪ মিলিমিটার, সেখানে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫৩৮.৭ মিলিমিটার। ত্রিপুরার মানুষও বন্যাকবলিত ছিল, সেখানেও বাড়িঘর ডুবেছে, পানিতে ডুবে মানুষ মরেছে। ফেনীর সোনাগাজীতে ১৯৮৬ সালে সাড়ে তিন কিলোমিটার বাঁধে মুহুরী সেচ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়। এই বাঁধও পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার পানি দ্রুত সাগরে নেমে পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক।
ভারত ও বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। এসব নদীতে উজান দেশ ভারত বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। পাকিস্তান আমলেই ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে, এই বাঁধ নিয়ে প্রচুর বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে; মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক বেনিফিট পেতে লংমার্চ করেছেন, কিন্তু দেশের কোন উপকার হয়নি। অনেকে আবার ভারতের বাঁধগুলোর কাছাকাছি দূরত্বে বাংলাদেশের ভেতরে আরও উঁচু বাঁধ তৈরি করে ভারতকে পানিতে ডুবিয়ে রাখার কথা ভাবছেন। বহু বছর আগে এই তত্ত্বের আবিষ্কারক ইনকিলাব। কিন্তু সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার সীমান্তে উঁচু বেড়িবাঁধ না দিয়ে শুধু নদীতে উঁচু বাঁধ দিয়ে উজানের পানি ঠেকিয়ে রাখার উদ্ভট চিন্তার বাস্তবায়ন ইহকালে হবে না। উজানের পানি ভাটির দিকে গড়াবেই, পানি ভাটির দিকে গড়ায় বলেই আমাদের কাপ্তাই ড্যাম খুলে দিতে হয়েছে, পানি নিচের দিকে গড়ায় বলেই পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার বন্যার পানি গড়িয়ে সয়লাব করেছে সোনাগাজী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে পানি বণ্টনের ন্যায়সঙ্গত সমাধান না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক মহলে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলে নালিশ করে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। কারণ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ফারাক্কা বাঁধের ইস্যুটি জাতিসংঘে উত্থাপন করা হয়েছিল, কিন্তু কাজ হয়নি। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের চাপে বাংলাদেশ উত্থাপিত প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল। তারপরও আন্তর্জাতিক মহলে যেতে হবে এবং ড. ইউনূসের আমলে যাওয়াই শ্রেয় হবে। আন্তর্জাতিক মহলে কিছু না হলে শক্তি প্রয়োগ করে ভারতের সব বাঁধ ও ড্যাম ধ্বংস করা সম্ভব হবে না। এই অবস্থায় আইন উপদেষ্টার কথিত ২৬ লাখ ভারতীয় কর্মীকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার এবং ভারতের সব পণ্য বর্জন করা যায়। পণ্য বর্জন করা সম্ভব হলে ভারত একটি লাভজনক বাজার হারাবে। আরও যা করা যায় তা হলো, ভারতে চিকিৎসা করতে না যাওয়া, করিডোর বন্ধ করে দেয়া, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। আর যদি কিছুই করা সম্ভব না হয়, তাহলে ভারতের সঙ্গে আপোষ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। হ্যাঁ, মানছি, গোপনে আপোষ করে রাস্তায় এসে ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চারও হতে হবে, নতুবা ক্ষমতায় যাওয়ার পথও উন্মুক্ত থাকবে না। এই কাজটি আমরা করে আসছি পাকিস্তান আমল থেকেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মহাম্মদ ইউনূস ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে যে প্রস্তাব রেখেছেন তা হলো, বৃষ্টি বেশি হলে, পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে সীমান্তের বিরোধ নিষ্পত্তির মতো ফ্ল্যাগ মিটিং করে বাঁধ বা ড্যামের পানি ছাড়তে হবে। প্রধান উপদেষ্টার এই ফর্মূলায় ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব, কিন্তু বন্যা রোধ করা সম্ভব নয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সৌদি আরবের মরুভূমিও উজান দেশের পানি ছাড়াই প্রায়ই প্লাবিত হচ্ছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে যা করতে হবে তা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের তত্ত্বাবধানে টেকসই পাড় বাঁধার ব্যবস্থা নিতে হবে, দলীয় সরকার ক্ষমতায় এলে দুর্নীতির বাঁধ আবার ভেঙে যাবে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
টানা ভারী বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা বন্যার পানিতে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের ১২টি জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। মানুষ যখন পানিতে ডুবে মরছে, না খেয়ে উপোস করছে, শাপ আর বেজি শত্রুতা ভুলে একসঙ্গে বাঁচার সংগ্রাম করছে, তখনও আমরা বন্যার কারণ নিয়ে নানা বিশ্লেষণে মেতে ছিলাম, বন্যার পানি নেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিনি। বন্যার ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যেই আমরা রাজনৈতিক মতাদর্শের ভেদাভেদ নিয়ে প্রকাশ্যে ও ভার্চুয়াল জগতে মাতামাতি করেছি। ১৯৭৬ সালে ডম্বুর ড্যাম চালু হওয়ার পূর্বে কুমিল্লায় প্রতি বছর বন্যা হতো, এখন হয় নাÑ এই অভিমত প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাতকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধুয়ে ফেলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর পানি সমস্যাটি সবার নজরে আসে। মাওলানা ভাসানীর লংমার্চ থেকে আমরা বলে আসছি, ভারত শুকনা মৌসুমে পানি আটকে রাখে, আর বর্ষার মৌসুমে রাতের আঁধারে একসঙ্গে সব গেট খুলে দেয়। আমাদের দাবি হচ্ছে, আমাদের পানির প্রয়োজন গ্রীষ্মকালে, বর্ষাকালে নয়; গ্রীষ্মকালে যখন তারা আমাদের পানি দেয় না, বর্ষাকালেও তারা পানি ছাড়তে পারবে না। এবার ফেনীর বন্যার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের ডম্বুর সøুইস গেট খুলে দেয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ডম্বুর ড্যামের ভিডিওতে ১০-১৫ গেট দিয়ে প্রবল বেগে পানি অপসারণের চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু ইন্টারনেটে দেখা গেল ডম্বুর ড্যামের মাত্র ৩টি গেট। এই ৩টি গেট খুলে দেয়ার জন্য ফেনী জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা? বিশ্বাস হচ্ছিল না।
সৃষ্ট এই বিভ্রান্তি দূর করতে শুধু ত্রিপুরার বিদ্যুৎমন্ত্রী ব্যাখ্যা দেন। ভারতীয় হাইকমিশনারও আমাদের প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করে উল্লেখ করেছেন যে, ডম্বুর ড্যামের গেট কাউকে খুলতে হয় না, পানির উচ্চতা ৯৪ মিটারের বেশি হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গেট খুলে যায় এবং পানি কমে গেলে গেট পুনরায় অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে যায়। ডম্বুর পানি ধরে রাখার কোন বাঁধ নয়, এটি একটি ড্যাম, এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ থেকে বাংলাদেশকেও বিদ্যুৎ দেয়া হয়। এই ড্যামের সম্মুখে একটি জলাধার রয়েছে, যেমন রয়েছে আমাদের কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মুখে। ডম্বুর ড্যামের সম্মুখে যে জলাধার রয়েছে তার ৯৪ মিটারের বেশি উচ্চতার পানি ধারনের সক্ষমতা নেই। পানি ৯৪ মিটারের বেশি হয়ে গেলে ড্যামের গেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, নতুবা ড্যাম ভেঙে যাবে; আর ড্যাম ভেঙে গেলে বাংলাদেশের অবস্থা হবে আরও ভয়াবহ। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ১৯৯৩ সালেও একবার বাঁধ খুলে গিয়েছিল, ৩১ বছর পর ২০২৪ সালে আবার খুলল।
ডম্বুর ড্যামটি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১২০ কিলোমিটার উজানে ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত। তাই ডম্বুর ড্যামের গেট খুলে দেয়া হলে ভারতের ১২০ কিলোমিটার প্রথমে পানিতে সয়লাব হবে এবং পরে তা বাংলাদেশে নামবে। অন্যদিকে ডম্বুর ড্যাম গোমতী নদীতে, গোমতী নদী বয়ে গেছে কুমিল্লার উপর দিয়ে, ডম্বুর ড্যামের সঙ্গে ফেনীর প্রত্যক্ষ কোন সংযোগ নেই। তাই ফেনীর বন্যার জন্য ডম্বুর ড্যামকে দায়ী করা যায় না। ফেনীর বন্যার জন্য দায়ী মুহুরী, সিলোনিয়া এবং কহুয়া নদী। মুহুরী এবং সিলেনিয়া নদী বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। মুহুরী এবং সিলোনিয়া ত্রিপুরার পাহাড়ি এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। মুহুরী নদীটি খুব বেশি চওড়া নয় এবং এই নদীর গভীরতাও কম। সিলোনিয়া নদীর চওড়া এবং গভীরতা আরও কম। গ্রীষ্ম এবং শীতকালে এই দুটি নদী হেঁটে পাড়ি দেয়া যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টি ও উজান থেকে তীব্র বেগে পানি নামার কারণে বিগত তিন মাসে পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ায় তিনবার বন্যা হয়েছে। আগের দুটি বন্যায় ফেনীর মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীর ভেঙে যাওয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামত করার সময় পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ বন্যায় বাঁধের আরও কিছু অংশ ভেঙে যায়, ফলে উক্ত তিনটি উপজেলা দ্রুত প্লাবিত হয়।
দেশের সর্বত্র রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, যেসব এলাকায় একসময় নৌকা ছাড়া যাওয়া যেত না, এখন সেখানে বাস যায়, ট্রাক যায়। কিন্ত এসব সড়কে পর্যাপ্ত ব্রিজ দিয়ে পানি সরানোর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। দেশের জলাশয়গুলোতে গড়ে উঠেছে বসতি, গ্রামে গ্রামে বিস্তৃত খালগুলো দখলদারদের দ্বারা হয়েছে ভরাট। তাই অল্প বৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দেয়। অপ্রশস্ত মুহুরী নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে প্রতি বছর পাড় ভাঙে, আর প্রতি বছর পাড় মেরামত করা হয়, কিন্তু টেকসই বাঁধ নির্মাণের কোন ব্যবস্থা কখনো নেয়া হয়নি। তবে এটা সত্য, গোমতী হোক বা মুহুরী, পানি এসেছে ভারতের ত্রিপুরা থেকেই। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার ত্রিপুরায় বৃষ্টি হয়েছে অনেক বেশি। বিগত বছরগুলোর হিসাব মোতাবেক ত্রিপুরায় আগস্ট মাসের প্রথম ২১ দিনে বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল ২১৪ মিলিমিটার, সেখানে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫৩৮.৭ মিলিমিটার। ত্রিপুরার মানুষও বন্যাকবলিত ছিল, সেখানেও বাড়িঘর ডুবেছে, পানিতে ডুবে মানুষ মরেছে। ফেনীর সোনাগাজীতে ১৯৮৬ সালে সাড়ে তিন কিলোমিটার বাঁধে মুহুরী সেচ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়। এই বাঁধও পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার পানি দ্রুত সাগরে নেমে পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক।
ভারত ও বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। এসব নদীতে উজান দেশ ভারত বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। পাকিস্তান আমলেই ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে, এই বাঁধ নিয়ে প্রচুর বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে; মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক বেনিফিট পেতে লংমার্চ করেছেন, কিন্তু দেশের কোন উপকার হয়নি। অনেকে আবার ভারতের বাঁধগুলোর কাছাকাছি দূরত্বে বাংলাদেশের ভেতরে আরও উঁচু বাঁধ তৈরি করে ভারতকে পানিতে ডুবিয়ে রাখার কথা ভাবছেন। বহু বছর আগে এই তত্ত্বের আবিষ্কারক ইনকিলাব। কিন্তু সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার সীমান্তে উঁচু বেড়িবাঁধ না দিয়ে শুধু নদীতে উঁচু বাঁধ দিয়ে উজানের পানি ঠেকিয়ে রাখার উদ্ভট চিন্তার বাস্তবায়ন ইহকালে হবে না। উজানের পানি ভাটির দিকে গড়াবেই, পানি ভাটির দিকে গড়ায় বলেই আমাদের কাপ্তাই ড্যাম খুলে দিতে হয়েছে, পানি নিচের দিকে গড়ায় বলেই পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার বন্যার পানি গড়িয়ে সয়লাব করেছে সোনাগাজী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে পানি বণ্টনের ন্যায়সঙ্গত সমাধান না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক মহলে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলে নালিশ করে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। কারণ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ফারাক্কা বাঁধের ইস্যুটি জাতিসংঘে উত্থাপন করা হয়েছিল, কিন্তু কাজ হয়নি। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের চাপে বাংলাদেশ উত্থাপিত প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল। তারপরও আন্তর্জাতিক মহলে যেতে হবে এবং ড. ইউনূসের আমলে যাওয়াই শ্রেয় হবে। আন্তর্জাতিক মহলে কিছু না হলে শক্তি প্রয়োগ করে ভারতের সব বাঁধ ও ড্যাম ধ্বংস করা সম্ভব হবে না। এই অবস্থায় আইন উপদেষ্টার কথিত ২৬ লাখ ভারতীয় কর্মীকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার এবং ভারতের সব পণ্য বর্জন করা যায়। পণ্য বর্জন করা সম্ভব হলে ভারত একটি লাভজনক বাজার হারাবে। আরও যা করা যায় তা হলো, ভারতে চিকিৎসা করতে না যাওয়া, করিডোর বন্ধ করে দেয়া, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। আর যদি কিছুই করা সম্ভব না হয়, তাহলে ভারতের সঙ্গে আপোষ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। হ্যাঁ, মানছি, গোপনে আপোষ করে রাস্তায় এসে ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চারও হতে হবে, নতুবা ক্ষমতায় যাওয়ার পথও উন্মুক্ত থাকবে না। এই কাজটি আমরা করে আসছি পাকিস্তান আমল থেকেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মহাম্মদ ইউনূস ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে যে প্রস্তাব রেখেছেন তা হলো, বৃষ্টি বেশি হলে, পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে সীমান্তের বিরোধ নিষ্পত্তির মতো ফ্ল্যাগ মিটিং করে বাঁধ বা ড্যামের পানি ছাড়তে হবে। প্রধান উপদেষ্টার এই ফর্মূলায় ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব, কিন্তু বন্যা রোধ করা সম্ভব নয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সৌদি আরবের মরুভূমিও উজান দেশের পানি ছাড়াই প্রায়ই প্লাবিত হচ্ছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে যা করতে হবে তা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের তত্ত্বাবধানে টেকসই পাড় বাঁধার ব্যবস্থা নিতে হবে, দলীয় সরকার ক্ষমতায় এলে দুর্নীতির বাঁধ আবার ভেঙে যাবে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি]