alt

উপ-সম্পাদকীয়

শান্তির সংস্কৃতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মতিউর রহমান

: সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা বাংলাদেশে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, যা শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে, জাতিসংঘ শান্তি দিবসের থিম বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য শান্তি ও সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার এক অনন্য সুযোগ তৈরি করে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে দেশটি বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনা মোকাবিলা করেছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এবং অর্থনৈতিক অসমতা বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তবুও দেশের জনগণ সর্বদা শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য কাজ করে গেছে, যা শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছে।

আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর উদযাপিত হয়, যা বিশ্বব্যাপী সংঘাতমুক্ত এক পৃথিবী গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যাশার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এই দিনটি বিশ্ববাসীকে শান্তি, ঐক্য এবং অহিংসার প্রতি পুনর্নবীকরণ করার সুযোগ করে দেয়। ১৯৮১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রথমবারের মতো এই দিনটি উদযাপনের ঘোষণা দেয় এবং সেই থেকে এটি শান্তি ও সহযোগিতার বিশ্বব্যাপী একটি মাইলফলক হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই দিবসটি সংঘাতমুক্ত সমাজ গঠনে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতিগত স্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক শান্তি দিবসের থিম নির্ধারণ করা হয়েছিল ‘শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা’, যা সময়ের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে যেখানে রাজনৈতিক মেরুকরণ, সংঘাত, শরণার্থী সংকট এবং সামাজিক অস্থিরতা প্রতিদিন বাড়ছে, সেখানে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই থিমের মূল লক্ষ্য হলো সমাজের প্রতিটি স্তরে শান্তি ও অহিংসার বীজ বপন করা, যা কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং প্রতিটি ব্যক্তির প্রতিদিনের কাজকর্ম এবং সম্পর্কের মধ্যেও প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

আন্তর্জাতিক শান্তি দিবসের ইতিহাস প্রায় চার দশকের পুরনো। ১৯৮১ সালে সাধারণ পরিষদ ২১ সেপ্টেম্বরকে শান্তি ও অহিংসার প্রতীক হিসেবে ঘোষণা করে, এবং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক শান্তির প্রচেষ্টায় আরও একটি ধাপ সংযোজন করে। শুরুতে শান্তি দিবসটি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের উদ্বোধন উপলক্ষে পালিত হতো। কিন্তু ২০০১ সালে জাতিসংঘ ২১ সেপ্টেম্বরকে যুদ্ধবিরতি এবং অহিংসার দিন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, যা একটি নির্দিষ্ট দিনে বিশ্বব্যাপী শান্তির আহ্বান জানায়।

২০২৪ সালের থিম ‘শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা’ মানুষকে তার প্রতিদিনের জীবনে শান্তির মূল্যবোধ লালন করতে উৎসাহিত করে। এটি শুধু সামরিক সংঘাতের অবসান নয়, বরং এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক শান্তির প্রতিও আহ্বান জানায়। একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, সহনশীলতা এবং সংলাপের মাধ্যমে বৈষম্য ও বিভাজন দূর করা সম্ভব। সমাজের প্রতিটি স্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতা অপরিহার্য। এই থিমটি শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সহনশীলতার মাধ্যমে একটি ইতিবাচক সমাজ গড়ে তোলার আহ্বান জানায়, যেখানে মানুষ হিংসার পরিবর্তে সংলাপ ও সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান খোঁজে।

শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সামাজিক ঐক্য। বাংলাদেশের সমাজ বহুমাত্রিক এবং বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতির মানুষের সমন্বয়ে গঠিত। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে সামাজিক সমঝোতা ও সংহতি বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হলে সমাজে সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রেখে ঐক্যের পথে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য।

এছাড়া বাংলাদেশের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিভাজন ও সংঘাত দেশের শান্তি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ এবং সমঝোতা বাড়াতে হবে। অহিংস রাজনীতির চর্চা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে রাজনৈতিক দলগুলো শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে কাজ করতে পারে। জাতীয় রাজনীতিতে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা হলে তা বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রা ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

শান্তির সংস্কৃতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অর্থনৈতিক সমতা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দরিদ্রতা এবং সামাজিক বৈষম্য শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে এখনও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না, যা সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে। অর্থনৈতিক সমতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং দরিদ্র মানুষের জন্য উন্নয়নমূলক উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে।

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগও শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হয়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে সামাজিক পুঁজির বিকাশ এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন শান্তির পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য স্থানীয় জনগণের সহায়তা, সরকার এবং এনজিওদের কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন।

নারীর ক্ষমতায়নও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি করলেও, এখনো অনেক ক্ষেত্রে তারা সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। নারী শিক্ষার প্রসার এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে।

শান্তির সংস্কৃতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যুব সমাজের ভূমিকা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যুবক, যারা দেশের ভবিষ্যৎ গঠন করবে। যুব সমাজকে শান্তির মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যে নৈতিকতা, সহনশীলতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলা গেলে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে যুব সমাজকে সংঘাত নিরসন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মূল্যবোধে দীক্ষিত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমকে একটি ইতিবাচক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে শান্তি ও সহনশীলতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। সাংবাদিকতা ও মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে অহিংসা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রচার করা যেতে পারে। একই সঙ্গে, সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষ এবং বিভাজন সৃষ্টিকারী প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাও অপরিহার্য।

আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস ২০২৪-এর ‘শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা’ থিমটি বাংলাদেশে একটি সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান। দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শান্তির মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া দরকার। শান্তি প্রতিষ্ঠার এই পথে সরকার, এনজিও, যুবসমাজ, মিডিয়া এবং সর্বস্তরের জনগণ একসঙ্গে কাজ করলে বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথকে সুগম করবে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তিগত যুদ্ধ

বন্যাপরবর্তী কৃষি উৎপাদনে সময়োপযোগী সহায়তা প্রদান

গুণগত উন্নয়নই সমাজের প্রকৃত উন্নতির চাবিকাঠি

বিশেষ শিশু ও বিশেষ শিক্ষালয়

বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অধিকার

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি

প্রসঙ্গ : আনসার বাহিনী

মব লিঞ্চিং আইনের শাসনের পরিপন্থি

মব জাস্টিসের মতো বর্বরতা বন্ধ হোক

বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে রাজনীতি

জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক

জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক

ভূমি অধিগ্রহণে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে কী করবেন?

ছবি

নিবেদিত প্রাণ এক কৃষিবিজ্ঞানী

জনমনে স্বস্তি ফিরুক

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ

মাদকের বিরুদ্ধে লড়তে হবে

রম্যগদ্য : আমার আসল আব্বা গো, তুমি কোই

মানুষের পর কারা হবে বিশ্বজয়ী

স্বাস্থ্য খাতে ফার্মাসিস্টদের অবদান

টেকসই রাষ্ট্রীয় সংস্কারে শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যাহত বিনির্মাণের বিকল্প নাই

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়নের ভূমিকা

বিশ্ব নরসুন্দর দিবস

মধু পূর্ণিমা ও প্রাসঙ্গিক কথা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

ছয়টি কমিশন গঠিত হলো কিন্তু শিক্ষা কোথায়?

বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শান্তির সংস্কৃতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মতিউর রহমান

সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা বাংলাদেশে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, যা শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে, জাতিসংঘ শান্তি দিবসের থিম বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য শান্তি ও সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার এক অনন্য সুযোগ তৈরি করে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে দেশটি বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনা মোকাবিলা করেছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এবং অর্থনৈতিক অসমতা বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তবুও দেশের জনগণ সর্বদা শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য কাজ করে গেছে, যা শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছে।

আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর উদযাপিত হয়, যা বিশ্বব্যাপী সংঘাতমুক্ত এক পৃথিবী গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যাশার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এই দিনটি বিশ্ববাসীকে শান্তি, ঐক্য এবং অহিংসার প্রতি পুনর্নবীকরণ করার সুযোগ করে দেয়। ১৯৮১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রথমবারের মতো এই দিনটি উদযাপনের ঘোষণা দেয় এবং সেই থেকে এটি শান্তি ও সহযোগিতার বিশ্বব্যাপী একটি মাইলফলক হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই দিবসটি সংঘাতমুক্ত সমাজ গঠনে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতিগত স্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক শান্তি দিবসের থিম নির্ধারণ করা হয়েছিল ‘শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা’, যা সময়ের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে যেখানে রাজনৈতিক মেরুকরণ, সংঘাত, শরণার্থী সংকট এবং সামাজিক অস্থিরতা প্রতিদিন বাড়ছে, সেখানে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই থিমের মূল লক্ষ্য হলো সমাজের প্রতিটি স্তরে শান্তি ও অহিংসার বীজ বপন করা, যা কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং প্রতিটি ব্যক্তির প্রতিদিনের কাজকর্ম এবং সম্পর্কের মধ্যেও প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

আন্তর্জাতিক শান্তি দিবসের ইতিহাস প্রায় চার দশকের পুরনো। ১৯৮১ সালে সাধারণ পরিষদ ২১ সেপ্টেম্বরকে শান্তি ও অহিংসার প্রতীক হিসেবে ঘোষণা করে, এবং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক শান্তির প্রচেষ্টায় আরও একটি ধাপ সংযোজন করে। শুরুতে শান্তি দিবসটি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের উদ্বোধন উপলক্ষে পালিত হতো। কিন্তু ২০০১ সালে জাতিসংঘ ২১ সেপ্টেম্বরকে যুদ্ধবিরতি এবং অহিংসার দিন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, যা একটি নির্দিষ্ট দিনে বিশ্বব্যাপী শান্তির আহ্বান জানায়।

২০২৪ সালের থিম ‘শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা’ মানুষকে তার প্রতিদিনের জীবনে শান্তির মূল্যবোধ লালন করতে উৎসাহিত করে। এটি শুধু সামরিক সংঘাতের অবসান নয়, বরং এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক শান্তির প্রতিও আহ্বান জানায়। একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, সহনশীলতা এবং সংলাপের মাধ্যমে বৈষম্য ও বিভাজন দূর করা সম্ভব। সমাজের প্রতিটি স্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতা অপরিহার্য। এই থিমটি শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সহনশীলতার মাধ্যমে একটি ইতিবাচক সমাজ গড়ে তোলার আহ্বান জানায়, যেখানে মানুষ হিংসার পরিবর্তে সংলাপ ও সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান খোঁজে।

শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সামাজিক ঐক্য। বাংলাদেশের সমাজ বহুমাত্রিক এবং বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতির মানুষের সমন্বয়ে গঠিত। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে সামাজিক সমঝোতা ও সংহতি বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হলে সমাজে সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রেখে ঐক্যের পথে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য।

এছাড়া বাংলাদেশের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিভাজন ও সংঘাত দেশের শান্তি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ এবং সমঝোতা বাড়াতে হবে। অহিংস রাজনীতির চর্চা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে রাজনৈতিক দলগুলো শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে কাজ করতে পারে। জাতীয় রাজনীতিতে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা হলে তা বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রা ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

শান্তির সংস্কৃতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অর্থনৈতিক সমতা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দরিদ্রতা এবং সামাজিক বৈষম্য শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে এখনও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না, যা সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে। অর্থনৈতিক সমতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং দরিদ্র মানুষের জন্য উন্নয়নমূলক উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে।

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগও শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হয়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে সামাজিক পুঁজির বিকাশ এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন শান্তির পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য স্থানীয় জনগণের সহায়তা, সরকার এবং এনজিওদের কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন।

নারীর ক্ষমতায়নও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি করলেও, এখনো অনেক ক্ষেত্রে তারা সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। নারী শিক্ষার প্রসার এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে।

শান্তির সংস্কৃতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যুব সমাজের ভূমিকা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যুবক, যারা দেশের ভবিষ্যৎ গঠন করবে। যুব সমাজকে শান্তির মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যে নৈতিকতা, সহনশীলতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলা গেলে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে যুব সমাজকে সংঘাত নিরসন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মূল্যবোধে দীক্ষিত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমকে একটি ইতিবাচক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে শান্তি ও সহনশীলতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। সাংবাদিকতা ও মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে অহিংসা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রচার করা যেতে পারে। একই সঙ্গে, সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষ এবং বিভাজন সৃষ্টিকারী প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাও অপরিহার্য।

আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস ২০২৪-এর ‘শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা’ থিমটি বাংলাদেশে একটি সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান। দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শান্তির মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া দরকার। শান্তি প্রতিষ্ঠার এই পথে সরকার, এনজিও, যুবসমাজ, মিডিয়া এবং সর্বস্তরের জনগণ একসঙ্গে কাজ করলে বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথকে সুগম করবে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top