গাজী তারেক আজিজ
বাংলাদেশ স্মরণকালের সবচেয়ে নৈরাজ্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বোধ করি। অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্র পরিচালনা যেমন ঝক্কি-ঝামেলার, লাগাতার দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন আর অবরোধ চলছে। সেই সঙ্গে জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনে দেশের অনেক জেলায় বন্যা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে- সেখানে একেক সময় একেক দিন একেক সংগঠন একেকভাবে রাজপথ দখলে রেখেছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন আর রিকশাওয়ালা তথা অটোরিকশাওয়ালারা বাদ পড়ে গেলে তো হয় না। তাই রাজপথে অবরোধ করে রীতিমতো দাবি আদায় করেই ছাড়ল।
কখনো শিক্ষক, কখনো আনসার, কখনো সনাতনী, কখনো ছাত্ররা কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আবার কখনো কলেজের আধিপত্য অটুট রাখতে যেয়ে বিবাদ বিসম্বাদ লেগে এক কলেজের ছাত্ররা যখন আরেক কলেজের সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যায় বীরদর্পে হেঁটে। তখন ভুক্তভোগী কলেজের ছাত্রদের মনোবল নিয়ে ভাবতে হলে আরেকটু রক্ষণশীল চিন্তার অধিকারী হতে হবে! তা না হলে কেন কোন পদক্ষেপ নেয়া হলো না? এমনিতেই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়াদের থেকে অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হয়ে ৩ জন রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে অন্যরা কেন পাবে না? এই যখন সর্বত্র প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজে হয়রান। যখন দাবি ওঠে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কি দোষ করলো? আর তখনই দাবি ওঠে অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হলো না? আবার কেউ কেউ বলছেন এটা এনজিও সরকার। আসলে মানুষ এতটাই স্বাধীনতা ভোগ করছে যে, মুখে যা আসছে তা-ই বলছে। যেন আটকানোর কেউ নেই। অন্যরা তো নয়ই, নিজে নিজেও কেন চিন্তা করতে ভুলে গেছে আর কয়েক দিন পর আমরা কি করব? কি বলব?
বিখ্যাত লেখক জর্জ অরওয়েল কি তাহলে ভবিষ্যৎ জেনে-বুঝেই প্রাণীদের নামে মানুষের আচরণই ফুটিয়ে তুলেছেন তার ‘এনিমেল ফার্ম’ নামক রম্যগদ্যের বইটিতে? মানুষও তাতে বুঁদ হলেন। যে বই সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় শীর্ষস্থান দখলে রেখেছে। খুঁজে ফেরেন কারা বন্য আর কারা সভ্য? স্মার্ট এআইয়ের যুগে এসে যখন মানুষ হরদম বন্য আচরণ করে চলেছে তখন বুঝতে হবে আমরা কারো না কারো হাতের পুতুল হয়েই নেচে চলেছি। কি অদ্ভুত না! আমরা কতই না দাম্ভিকতা নিয়ে বলে বেড়াই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নিয়েছি। অথচ একজন নিরক্ষর লোকের সাথেও কি চিন্তার ফারাক আছে? যদি তা-ই হবে, রিকশাওয়ালার দাবি জীবিকার তাগিদ বলেই তারা আন্দোলনের পথ বেছে নিয়ে আইন অমান্য করে শুধুই পেটের ক্ষুধা নিবারণের লক্ষ্যে। আর সরকার একটা বিহিত করবে বলে আশ্বস্ত করে তাদের শান্ত করতে পেরেছে। তারাও নিরুপায়। তাদের একেকজনের পরিবারে ছয় থেকে আটজন বা তারও বেশিÑ এ পরিস্থিতির মধ্যে কখনো ঢাকা কলেজ লেগে যায় সিটি কলেজের সাথে। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তো রয়েছেই। সেই লেগে যাওয়াও নিছক মামুলি নয়। দিনভর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। সাথে জনসাধারণের ভোগান্তি। পথচারীদের নিরাপত্তাহীনতা। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ছিল সীমাহীন উদ্বেগ উৎকন্ঠা। সে যাত্রায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চূড়ান্ত রকমের অ্যাকশনে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কতৃপক্ষ কলেজ বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন।
কেন ন্যাশনাল হাসপাতালে ছাত্রদের হামলা? সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও নজরুল কলেজ মিলে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে এই তা-বের নেপথ্যের কারণ কি? নাকি এর পেছনেও কোন চক্র কাজ করছে? তবে হালকাভাবে উড়িয়ে দেয়ার কোন কারণ নেই।
প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি উস্কে দিয়ে ব্যাপকভাবে তান্ডবলীলা চালানোর পিছনে অভিযোগ রয়েছে এক কলেজের শিক্ষার্থী কর্তৃক অন্য কলেজের শিক্ষার্থীদের মারধর। আদতে যদি তা হয়েও থাকে তার কি কোন আইনানুগ প্রতিকার সম্ভব ছিল না? কেন এই তান্ডব চালাতে হবে? যেখানে ন্যাশনাল হাসপাতাল নিরাপদ নয়। যেখানে কলেজের মতো বিদ্যাপীঠকে টার্গেট করে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে তাদের কাছে আর জাতি কী প্রত্যাশা করতে পারে? তারা শিক্ষিত হয়ে কর্মস্থলে কি করবেন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে তাদের ভবিষ্যৎ কেমন হতে চলেছে অনুমান করতে খুব বেগ পোহাতে হয় না।
মোল্লা কলেজে যে তা-ব দেখেছি, যে লুটপাট দেখেছি সেই অবস্থা সাম্প্রতিক কেবল গণভবন আর সংসদ ভবনেই রয়েছে। তবে গত ৫ আগস্ট পরবর্তী সারাদেশে যে লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে তার তুলনায় কম কি কিছু? এখন তো স্বৈরাচারী ব্যবস্থা নেই! তাহলে এখনো কেন থামানো যাচ্ছে না সংঘাত-সংঘর্ষ আর লুটপাট? অতি শীঘ্রই বন্ধ হোক প্রত্যাশা করি। তার আগে মোল্লা কলেজের অনুমান ৭০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়তো পোষানো যাবে; কিন্তু বিভিন্ন শিক্ষার্থীর সার্টিফিকেট, মূল্যবান ডকুমেন্টস তছনছ করায় সেই ক্ষত পুষিয়ে ওঠা যে খুব সহজ হবে না। সেটা কর্মক্ষেত্রে গেলেই এসব শিক্ষার্থী হয়তো বুঝতে পারবে। তা-ই বলে মোল্লা কলেজের ছাত্রদের ভালো বলার অবকাশ নেই। তারাও নজরুল কলেজ কিংবা সোহরাওয়ার্দী কলেজে যা করেছে তার ক্ষত পোষানো যাবে না। হয়তো সেই আর্থিক ক্ষতি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।
কারওয়ানবাজার এলাকা বেশ গরম প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার পত্রিকা দুটিকে মেজবান পার্টির আক্রমণ থেকে বাঁচাতে। অভিযোগ এই দুটি পত্রিকা ভারতের ‘পারপাস সার্ভ’ করার। এই অভিযোগে গরুর গায়ে ‘মতি গরু’ লিখে জবাই করেছে প্রথম আলো পত্রিকা অফিসের সামনে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছেন গণমাধ্যমের ওপর হামলা হলে কঠোর পদক্ষেপ নেবে সরকার। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে মনে হচ্ছে।
সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে চট্টগ্রাম বিভাগকে প্রাধান্য দিয়ে উপদেষ্টাদের সিংহভাগ এই বিভাগ থেকে নেয়া হয়েছে। এখন দাবি উঠতে শুরু করেছে উত্তরবঙ্গ থেকে উপদেষ্টা নেয়ার, তা না হলে উত্তরবঙ্গ বিচ্ছিন্ন করার হুশিয়ারি দেয়া রয়েছে। যদিও সরকার সেই দাবিও আমলে নেয়নি। তাতে কি দাঁড়ায় একটা রাজনৈতিক সরকারের যেমন অঞ্চলভেদে পছন্দ-অপছন্দ অথবা কাজের সুবিধার্থে মন্ত্রী নিয়োগের প্রচলন রয়েছে- এই অন্তর্র্বতী সরকারের ওপরও একই চাপ দেয়াতে সরকারের কাজের গতি কিছুটা হলেও শ্লথ হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই।
এবার কথা শোনা যাচ্ছে অভ্যুত্থানের নেতারা একটা রাজনৈতিক দল গঠনের পথে হাঁটছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যতদিন পরিবারতন্ত্র বহাল থাকছে ততদিন আর যা-ই হোক নতুন যে কোন দলের জন্য রাজনীতির মাঠ এতটা সহজ হবে বলেও মনে হচ্ছে না। কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন তথা গণঅভ্যুত্থানের ফসল সরকার পতন। এরই ধারাবাহিকতায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী একটা অবস্থান নিয়ে সব রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য ও গোপন নীলনকশার ফল যখন ফলতে শুরু করার অপেক্ষায় ছিল এই মুহূর্তের সবচেয়ে বৃহৎ দল বিএনপি- ঠিক তখনই আকস্মিক রাজনৈতিক দলের ঘোষণা এবং প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নাগরিক কমিটি গঠনে কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে বিএনপিকে; কিন্তু নাগরিক কমিটি তথা বিপ্লবের নায়কদের জন্য কি রাজনীতির মাঠ এতটা সহজ হবে? এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। যদিও ফ্রন্ট লাইনে থেকে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ও নেপথ্যের কুশীলবদের বুদ্ধি পরামর্শ আর্থিক সহযোগিতা নেয়া। এখন কি সেটায় একটু হলেও ভাটা পড়বে না? তাহলে বিএনপি যে এতদিন চিন্তা করে রেখেছিল নির্বাচন অনুষ্ঠান যত দ্রুত হবে ততই সরকার গঠনের দ্বারপ্রান্তে। সেটায় কি ছেদ পড়লো না কিছুটা হলেও?
অপেক্ষায় আছি ছাত্রদের তৈরি দল নিয়ে কতটুকু বিচক্ষণতা দেখিয়ে কতটুকু পথ পাড়ি দিতে পারে। নাকি একই ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খায়। বাংলাদেশের মানুষ কতটুকু প্রস্তুত আরেকটি নতুন দল এবং জাতীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করতে। ছাত্রদের দল মাঠে এলে কার লাভ কার ক্ষতি এই বিবেচনার চেয়েও বেশিমাত্রায় বিবেচ্য বিষয় হবে কতটুকু মানুষের কল্যাণে কাজ করবে।
আমাদের অতীত থেকে যা দেখেছি তা হচ্ছে- যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ। অথবা যেই লাউ সেই কদু! যদিও দপ্তরবিহীন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গৃহযুদ্ধের কথা বলছেন। সেই গৃহযুদ্ধ কে কার বিরুদ্ধে করবে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। ইঙ্গিতবহ এই কথাটিও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশ স্মরণকালের সবচেয়ে নৈরাজ্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বোধ করি। অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্র পরিচালনা যেমন ঝক্কি-ঝামেলার, লাগাতার দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন আর অবরোধ চলছে। সেই সঙ্গে জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনে দেশের অনেক জেলায় বন্যা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে- সেখানে একেক সময় একেক দিন একেক সংগঠন একেকভাবে রাজপথ দখলে রেখেছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন আর রিকশাওয়ালা তথা অটোরিকশাওয়ালারা বাদ পড়ে গেলে তো হয় না। তাই রাজপথে অবরোধ করে রীতিমতো দাবি আদায় করেই ছাড়ল।
কখনো শিক্ষক, কখনো আনসার, কখনো সনাতনী, কখনো ছাত্ররা কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আবার কখনো কলেজের আধিপত্য অটুট রাখতে যেয়ে বিবাদ বিসম্বাদ লেগে এক কলেজের ছাত্ররা যখন আরেক কলেজের সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যায় বীরদর্পে হেঁটে। তখন ভুক্তভোগী কলেজের ছাত্রদের মনোবল নিয়ে ভাবতে হলে আরেকটু রক্ষণশীল চিন্তার অধিকারী হতে হবে! তা না হলে কেন কোন পদক্ষেপ নেয়া হলো না? এমনিতেই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়াদের থেকে অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হয়ে ৩ জন রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে অন্যরা কেন পাবে না? এই যখন সর্বত্র প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজে হয়রান। যখন দাবি ওঠে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কি দোষ করলো? আর তখনই দাবি ওঠে অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হলো না? আবার কেউ কেউ বলছেন এটা এনজিও সরকার। আসলে মানুষ এতটাই স্বাধীনতা ভোগ করছে যে, মুখে যা আসছে তা-ই বলছে। যেন আটকানোর কেউ নেই। অন্যরা তো নয়ই, নিজে নিজেও কেন চিন্তা করতে ভুলে গেছে আর কয়েক দিন পর আমরা কি করব? কি বলব?
বিখ্যাত লেখক জর্জ অরওয়েল কি তাহলে ভবিষ্যৎ জেনে-বুঝেই প্রাণীদের নামে মানুষের আচরণই ফুটিয়ে তুলেছেন তার ‘এনিমেল ফার্ম’ নামক রম্যগদ্যের বইটিতে? মানুষও তাতে বুঁদ হলেন। যে বই সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় শীর্ষস্থান দখলে রেখেছে। খুঁজে ফেরেন কারা বন্য আর কারা সভ্য? স্মার্ট এআইয়ের যুগে এসে যখন মানুষ হরদম বন্য আচরণ করে চলেছে তখন বুঝতে হবে আমরা কারো না কারো হাতের পুতুল হয়েই নেচে চলেছি। কি অদ্ভুত না! আমরা কতই না দাম্ভিকতা নিয়ে বলে বেড়াই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নিয়েছি। অথচ একজন নিরক্ষর লোকের সাথেও কি চিন্তার ফারাক আছে? যদি তা-ই হবে, রিকশাওয়ালার দাবি জীবিকার তাগিদ বলেই তারা আন্দোলনের পথ বেছে নিয়ে আইন অমান্য করে শুধুই পেটের ক্ষুধা নিবারণের লক্ষ্যে। আর সরকার একটা বিহিত করবে বলে আশ্বস্ত করে তাদের শান্ত করতে পেরেছে। তারাও নিরুপায়। তাদের একেকজনের পরিবারে ছয় থেকে আটজন বা তারও বেশিÑ এ পরিস্থিতির মধ্যে কখনো ঢাকা কলেজ লেগে যায় সিটি কলেজের সাথে। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তো রয়েছেই। সেই লেগে যাওয়াও নিছক মামুলি নয়। দিনভর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। সাথে জনসাধারণের ভোগান্তি। পথচারীদের নিরাপত্তাহীনতা। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ছিল সীমাহীন উদ্বেগ উৎকন্ঠা। সে যাত্রায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চূড়ান্ত রকমের অ্যাকশনে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কতৃপক্ষ কলেজ বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন।
কেন ন্যাশনাল হাসপাতালে ছাত্রদের হামলা? সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও নজরুল কলেজ মিলে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে এই তা-বের নেপথ্যের কারণ কি? নাকি এর পেছনেও কোন চক্র কাজ করছে? তবে হালকাভাবে উড়িয়ে দেয়ার কোন কারণ নেই।
প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি উস্কে দিয়ে ব্যাপকভাবে তান্ডবলীলা চালানোর পিছনে অভিযোগ রয়েছে এক কলেজের শিক্ষার্থী কর্তৃক অন্য কলেজের শিক্ষার্থীদের মারধর। আদতে যদি তা হয়েও থাকে তার কি কোন আইনানুগ প্রতিকার সম্ভব ছিল না? কেন এই তান্ডব চালাতে হবে? যেখানে ন্যাশনাল হাসপাতাল নিরাপদ নয়। যেখানে কলেজের মতো বিদ্যাপীঠকে টার্গেট করে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে তাদের কাছে আর জাতি কী প্রত্যাশা করতে পারে? তারা শিক্ষিত হয়ে কর্মস্থলে কি করবেন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে তাদের ভবিষ্যৎ কেমন হতে চলেছে অনুমান করতে খুব বেগ পোহাতে হয় না।
মোল্লা কলেজে যে তা-ব দেখেছি, যে লুটপাট দেখেছি সেই অবস্থা সাম্প্রতিক কেবল গণভবন আর সংসদ ভবনেই রয়েছে। তবে গত ৫ আগস্ট পরবর্তী সারাদেশে যে লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে তার তুলনায় কম কি কিছু? এখন তো স্বৈরাচারী ব্যবস্থা নেই! তাহলে এখনো কেন থামানো যাচ্ছে না সংঘাত-সংঘর্ষ আর লুটপাট? অতি শীঘ্রই বন্ধ হোক প্রত্যাশা করি। তার আগে মোল্লা কলেজের অনুমান ৭০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়তো পোষানো যাবে; কিন্তু বিভিন্ন শিক্ষার্থীর সার্টিফিকেট, মূল্যবান ডকুমেন্টস তছনছ করায় সেই ক্ষত পুষিয়ে ওঠা যে খুব সহজ হবে না। সেটা কর্মক্ষেত্রে গেলেই এসব শিক্ষার্থী হয়তো বুঝতে পারবে। তা-ই বলে মোল্লা কলেজের ছাত্রদের ভালো বলার অবকাশ নেই। তারাও নজরুল কলেজ কিংবা সোহরাওয়ার্দী কলেজে যা করেছে তার ক্ষত পোষানো যাবে না। হয়তো সেই আর্থিক ক্ষতি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।
কারওয়ানবাজার এলাকা বেশ গরম প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার পত্রিকা দুটিকে মেজবান পার্টির আক্রমণ থেকে বাঁচাতে। অভিযোগ এই দুটি পত্রিকা ভারতের ‘পারপাস সার্ভ’ করার। এই অভিযোগে গরুর গায়ে ‘মতি গরু’ লিখে জবাই করেছে প্রথম আলো পত্রিকা অফিসের সামনে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছেন গণমাধ্যমের ওপর হামলা হলে কঠোর পদক্ষেপ নেবে সরকার। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে মনে হচ্ছে।
সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে চট্টগ্রাম বিভাগকে প্রাধান্য দিয়ে উপদেষ্টাদের সিংহভাগ এই বিভাগ থেকে নেয়া হয়েছে। এখন দাবি উঠতে শুরু করেছে উত্তরবঙ্গ থেকে উপদেষ্টা নেয়ার, তা না হলে উত্তরবঙ্গ বিচ্ছিন্ন করার হুশিয়ারি দেয়া রয়েছে। যদিও সরকার সেই দাবিও আমলে নেয়নি। তাতে কি দাঁড়ায় একটা রাজনৈতিক সরকারের যেমন অঞ্চলভেদে পছন্দ-অপছন্দ অথবা কাজের সুবিধার্থে মন্ত্রী নিয়োগের প্রচলন রয়েছে- এই অন্তর্র্বতী সরকারের ওপরও একই চাপ দেয়াতে সরকারের কাজের গতি কিছুটা হলেও শ্লথ হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই।
এবার কথা শোনা যাচ্ছে অভ্যুত্থানের নেতারা একটা রাজনৈতিক দল গঠনের পথে হাঁটছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যতদিন পরিবারতন্ত্র বহাল থাকছে ততদিন আর যা-ই হোক নতুন যে কোন দলের জন্য রাজনীতির মাঠ এতটা সহজ হবে বলেও মনে হচ্ছে না। কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন তথা গণঅভ্যুত্থানের ফসল সরকার পতন। এরই ধারাবাহিকতায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী একটা অবস্থান নিয়ে সব রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য ও গোপন নীলনকশার ফল যখন ফলতে শুরু করার অপেক্ষায় ছিল এই মুহূর্তের সবচেয়ে বৃহৎ দল বিএনপি- ঠিক তখনই আকস্মিক রাজনৈতিক দলের ঘোষণা এবং প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নাগরিক কমিটি গঠনে কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে বিএনপিকে; কিন্তু নাগরিক কমিটি তথা বিপ্লবের নায়কদের জন্য কি রাজনীতির মাঠ এতটা সহজ হবে? এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। যদিও ফ্রন্ট লাইনে থেকে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ও নেপথ্যের কুশীলবদের বুদ্ধি পরামর্শ আর্থিক সহযোগিতা নেয়া। এখন কি সেটায় একটু হলেও ভাটা পড়বে না? তাহলে বিএনপি যে এতদিন চিন্তা করে রেখেছিল নির্বাচন অনুষ্ঠান যত দ্রুত হবে ততই সরকার গঠনের দ্বারপ্রান্তে। সেটায় কি ছেদ পড়লো না কিছুটা হলেও?
অপেক্ষায় আছি ছাত্রদের তৈরি দল নিয়ে কতটুকু বিচক্ষণতা দেখিয়ে কতটুকু পথ পাড়ি দিতে পারে। নাকি একই ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খায়। বাংলাদেশের মানুষ কতটুকু প্রস্তুত আরেকটি নতুন দল এবং জাতীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করতে। ছাত্রদের দল মাঠে এলে কার লাভ কার ক্ষতি এই বিবেচনার চেয়েও বেশিমাত্রায় বিবেচ্য বিষয় হবে কতটুকু মানুষের কল্যাণে কাজ করবে।
আমাদের অতীত থেকে যা দেখেছি তা হচ্ছে- যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ। অথবা যেই লাউ সেই কদু! যদিও দপ্তরবিহীন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গৃহযুদ্ধের কথা বলছেন। সেই গৃহযুদ্ধ কে কার বিরুদ্ধে করবে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। ইঙ্গিতবহ এই কথাটিও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]