গৌতম রায়
সাতচল্লিশের দেশভাগের বছরের দুর্গোৎসব, ঈদের কথা শুনেছি অনেক মুরুব্বিদের কাছে। হিন্দু বাঙালির কাছে সদ্য বিভাজিত এপার বাংলায় সেইবারের শারদোৎসব ছিল বেশ বিবর্ণ। এই পারের বাঙালি মুসলমানের সিংহভাগই ঈদ ঘিরেও সেবার খুশির মাত্রাকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন এক অব্যক্ত যন্ত্রণায়।
তারপর অনেককাল চলে গেছে। কংগ্রেস-কমিউনিস্ট, তৃণমূল-কেউই ৪৭ উত্তর কালে সম্মিলিত বাঙালির কথা ভাবেনি। বেশিরভাগের কাছেই, বাঙালি হিন্দুই, থেকে গেছে বাঙালি হিসেবে। বাঙালি মুসলমানের নিয়তি হয়েছে কেবলই ‘মুসলমান’ হিসাবে।
কমিউনিস্টদের বেশিরভাগেরই পশ্চিমবঙ্গের বুকে বাঙালি আর মুসলমানের ফারাক করার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। তাদের বেশিরভাগের কাছেই বাঙালি মানে হিন্দু। আর মুসলমান তো ‘অন্য কিছু’। বিজেপির তো কথাই নেই। কংগ্রেস-তৃণমূল ও তথৈবচ।
সেই ফারাক থেকে নিজেদের উত্তরীত করার চেষ্টা বঙ্গীয় কমিউনিস্টদের একটা বড় অংশ করেইনি। কারণ, তাদের দুই শাখারই নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল হিন্দুরাই থেকে গেছে প্রধান। তাদের একটা বড় অংশের কাছেই অন্তর থেকে কখনো মুসলমানেরা গ্রহণযোগ্য হয়নি। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস-এরা মুখে মুসলমান প্রীতি দেখালেও মন থেকে মেনে নেয় না মুসলমানকে। ভোটের দাবার চাল তাদের কাছে মুসলমান। আর বিজেপি তো ঘোষিত মুসলমান বিরোধী।
কিন্তু উৎসবের আমেজ হোক কিংবা ধর্মের আবরণ, ‘২৪ এর শারোৎসব, এমন রোদনভরা ‘শরৎ’, বাঙালি দেখেনি বুঝি কখনো আগে। আমার কাছে কিন্তু বাঙালি মানে, অবিভক্ত ময়মনসিংহের আরিগ্যার প্রতিকূল, যে বাড়িতে নেতাজী অনুগামী হেমন্ত বসু, আমার বাবার যে হেমন্ত কাকা, মানিকতলা হাউজিংয়ে ফ্ল্যাট নেয়ার জন্যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আবাসন মন্ত্রী হিসেবে আমার বাবাকে প্রায় জবরদস্তি করেছিলেন। হ্যাঁ জবরদস্তির অধিকার তার ছিল আমার বাবার প্রতি। কারণ, শ্রীরামকৃষ্ণ সহচর, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতে একাধিকবার উল্লিখিত তারকনাথ রায়, আমার বৃদ্ধ পিতামহ। যার দৌলতে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল হেমন্ত কুমারের।
সেই হেমন্ত কুমারের ছবি বাড়ির বারান্দায় ঝোলানো প্রতিকূল, তার ভয়ংকর হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংশ্রব ঘিরে আমি সরাসরি অভিযোগ জানিয়েছিলাম স্বয়ং জ্যোতি বসুকে, তখন সেই প্রতিকূলের হয়ে আমার কাছে অ্যাডভোকেসি করেছিল বিশ্বজিৎ দাস (নাম পরিবর্তিত), বৈকুণ্ঠ দাসের নাতি। সেকালের সেজে থাকা বাম, বারদির কমলার বরের স্যাঙাত।
প্রতিকূল বামফ্রন্ট সরকারের আমলের কানুনে চাকরি পেয়েছিল। কর্মরত অবস্থায় কোনো সরকারি চাকুরে প্রয়াত হলে তার স্ত্রী বা স্বামী অথবা পুত্র-কন্যাদের সরকারি চাকরি পাওয়ার আইনি অধিকার দিয়েছিল সাবেক বামফ্রন্ট সরকার। সেই আইন মোতাবেক প্রতিকূল চাকরি পায়। সেই সময়ের শাসক শিবিরের সরকারি কর্মচারীদের সংগঠনে সে নাম লেখায়। গোপনে করতে থাকে আরএসএস।
২০০১ সাল নাগাদ এক চায়ের দোকানের আড্ডায় প্রতিকূলের মুখ থেকে শুনি শাখা । গুজরাট গণহত্যার আগে আরএসএস ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন একটা আলোচনাই ছিল না। সেই প্রতিকূলের বিরুদ্ধে যখন আমি জ্যোতিবাবুর কাছে সরাসরি অভিযোগ করি, তখন রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের যে বামপন্থি সংগঠন, কো অর্ডিনেশন কমিটি, তার রাজ্য নেতৃত্ব খুব দৃঢ় অবস্থান নিলেও, সংগঠনটির স্থানীয় নেতৃত্ব বাঁচিয়ে দেয় এই আরএসএসের শাখা করা ছেলেটিকে কেবলমাত্র তাদের ও সংগঠনে থাকার দরুণ। বৈকুণ্ঠ দাসের নাতি ও আমাকে বলে, কি দরকার। ছেড়ে দাও।
একটা বামপন্থি সংগঠনে সরাসরি আরএসএস করা প্রতিকূল, যার সম্পর্কে কো অর্ডিনেশনের রাজ্য নেতৃত্বকে সরাসরি বললেন জ্যোতি বসুর মতো ব্যক্তিত্ব, সংগঠনের স্থানীয় লোকদের বদান্যতায় সে থেকে গেল নিরাপদ। না তার সংগঠন কোনো ব্যবস্থা নিলÑনা প্রশাসনিক ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো। গুজরাট গণহত্যায় মুসলমানের রক্তে হাত রাঙিয়ে নরেন্দ্র মোদি যখন আবার জিতে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হলেন, প্রতিকূল ফোনে আমাকে বলল, বাধাই হো। তখন ও সে ফর্মালি বামপন্থি কর্মচারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। গোপনে আরএসএস করে। আর প্রকাশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়গানে মুখর।
২০১১ তে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের আগেই যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তাতে প্রতিকূলদের পক্ষে খুল্লামখুল্লা মমতার হয়ে কাজ করাটা এতটুকু সমস্যার বিষয় ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে খুব সহজেই বলতে হয়, বিরোধীদের বাধা দেয়া ঘিরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার নিয়ে যেসব অভিযোগ তখন তোলা হতো, সেই সমস্ত অভিযোগই ছিল রাজনৈতিক ভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
ফলে খাতায় কলমে কো অর্ডিনেশন করে (কারণ, যদি কোনো মতে সরকারটা টিকে যেত, তবে এই প্রতিকূল হয়ে উঠত, সরকার রক্ষার কাজে সব থেকে আত্মনিবেদিত কমরেড) প্রতিকূলের পক্ষে তৃণমূল- আরএসএস- বিজেপির ত্রিবেণী সঙ্গমে বেণী না ভিজিয়ে অবগাহনে এতটুকু অসুবিধা হয়নি।
২০১১ র পরে খুল্লামখুল্লা শাসকের লোক প্রতিকূল। আর শাসকের লোক হয়ে, শাসকর প্রভাব কাজে লাগিয়ে প্রশাসনকে মুসলমান শূন্য করবার যে গোপন কর্মসূচি রয়েছে আরএসএসের, সেই কর্মসূচি রূপায়ণে এই প্রতিকূল এখন একজন হাতে কলমে সফল নেতা।
প্রতিকূল রাজ্য সরকারের যে দপ্তরে কর্মরত, সেই দপ্তরটিতে এখন মুসলমান কর্মচারীদের হেনস্তা করবার জন্যে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে একটা অলিখিত বোঝাপড়া হয়েছে। কিছু একটা ছলছুতো, কোনো একটা অজুহাত বের করে কর্মরত মুসলমান সহকর্মীদের হেনস্তা এখন ওই দপ্তরটির একটা নিয়মিত অভ্যাস। আরএস-বিজেপির মুসলমানকে ভাতে মারবার যে রাজনৈতিক পরিকল্পনা, তাকে রূপায়িত করতে তৃণমূল কংগ্রেস এখন সব রকম ভাবে সায় দিচ্ছে।
প্রতিকূলের দপ্তরের এক হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট পদমর্যাদার কর্মী, মুসলমান, তাকে একদম জাল পেতে, ষয়যন্ত্র করে প্রথমে ফাঁসানো হয়। সেই ষড়যন্ত্রের জালটা এত গোপনে এবং এত সুচতুর ভাবে বিস্তার করা হয় যে, ‘স্যাট’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মীদের ঘিরে অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয় এখানে বিবেচিত হয়। সেখানে ওই হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট পদমর্যার মানুষটিকে কেবল নাস্তানাবুদই হতে হয়।
ফলশ্রুতি? হ্যাঁ, সেই হেড অ্যাসিস্ট্যান্টটি সাময়িক সাসপেন্ড হয়েছেন এবং নিজের ঘরের দোরে, সেই পদে বদলি হয়ে এসেছেন প্রতিকূল।
পূর্বতন হেড অ্যাসিস্ট্যান্টটির অপরাধ ছিল, জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট রেজিস্টির ওই অফিসটিতে তিনি ঘুষের রাজত্ব বন্ধ করে দিয়েছিলেন প্রায়। ফলে যা হবার তাইই হয়েছে। ঘুঘুর বাসা ভাড়তে গেলে সেখানে একটা অসাধারণ কর্মী ঐক্য তো তৈরি হবেই! ঘুষ বন্ধ হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে? এমন কথা নৈব নৈব চ।
তবে ঘুষ বন্ধ করতে কৃতসংলপ্ত মানুষটিকে ঘিরে এই ধর্মভিত্তিক বিদ্বেষ ছড়ানো, এই কাজটি এখন গোটা পশ্চিমবঙ্গের কর্মজগতের প্রায় প্রতিটি স্তরে চলছে। মুখে সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি প্রীতিসূচক কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে গোটা ভারত জুড়ে মুসলমানদের ভাতে মারবার যে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিন্দুত্ববাদীরা চালাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে সেই কর্মসূচি দিল্লির শাসক আর নবান্নের শাসক মিলে মিশে একযোগে রূপায়িত করে চলেছে।
যে অদ্ভুত বিভাজনের খেলা গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে আরএসএস-বিজেপি আর তৃণমূল একযোগে চালাচ্ছে তার কিছু বেদনাবিহ্বল পরিণতি আমরা সাম্প্রতিক শারোদৎসবের সময়কালে পেলাম। তৃণমূল প্রভাবিত একটা দুর্গাপূজাতে নবীজির এক কল্পিত ছবি প্রদর্শিত হলে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার শ্যামপুর থানা এলাকায়। এলাকাটি মুসলমান জনবসতিপূর্ণ। সেখানে তৃণমূল প্রভাবিত একটি দুর্গাপূজাতে মনীষীদের ছবি প্রদর্শিত করবার নাম করে কারও একটি আঁকা কল্পিত নবীজির ছবি প্রদর্শিত হয়।
সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রবল আপত্তিতে সেই কল্পিত ছবিটি সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটি মিশ্র ধর্মীয় জনবসতিপূর্ণ এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, প্রায় জন্মাবধিই জানে, কোন বিষয়টি মুসলমানের ভাবাবেগে আঘাত দেবে। একই রকম ভাবে মুসলমান সমাজের মানুষেরাও জানে, কি সে আঘাত পেতে পারে হিন্দুরা।
সংঘাতের এই পরিবেশ এেিয় চলাই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সমাজের চিরন্তন ঐতিহ্য। তা হলে প্রশ্ন হলো, অমন গর্হিত কা- কেন হলো হাওড়া জেলার প্রান্তিক একটি এলাকাতে?
শারদোৎসবের সময়কালে হাওড়াতে যে ঘটেছে কেন, তা জানবার অধিকার বাংলার তথা ভারতের নাগরিকের থাকবে না? লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি বা তার সহযোগী, তৃণমূল কংগ্রেসকে হারাতে মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙাতে যা ঘটেছে তা জানবার অধিকার কেন সাধারণ নাগরিকদের থাকবে না? সমাজ মাধ্যম থেকে জানতে পারা যাচ্ছে যে, ওই সময়কালে বেলডাঙ্গা সন্নিহিত অঞ্চলে মুর্শিদাবাদ জেলার একটা বড় অংশে এবং মুর্শিদাবাদের সন্নিকষ্ট নদিয়া জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ছিল।
তথ্য জানার অধিকার অনুযায়ী একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আমার জানবার অধিকার আছে যে, কেন, কোন কারণে এই সময়কালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ জেলার একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হলো। এসব জানবার দাবি আমরা জানাতেই পারি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেউ এই দাবির প্রতি কখনো কোনো রকম কর্ণপাত করেনি। করছে না। বা ভবিষ্যতেও করবে না।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যদি এভাবে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সুযোগ সাধারণ মানুষকে না পেতে দেয়া হয়, তাহলে তার কি পরিণাম রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পড়তে পারে- এ সম্পর্কে আশা করি কোনো পক্ষের শাসকদের মধ্যেই কোনরকম অজানা, অচেনা এবং সংশয়াতীর্ণ মনোভাব বা মানসিকতা নেই।
তাহলে কেন এমন পরিস্থিতি করা হচ্ছে? এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কোন রাজনৈতিক দল, বা কোন্ ব্যক্তি, বিশেষ রকমের প্রভাব সম্পন্ন কোন গোষ্ঠী, ব্যক্তি বা অধিপতি দায়ী?
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ ]
গৌতম রায়
শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪
সাতচল্লিশের দেশভাগের বছরের দুর্গোৎসব, ঈদের কথা শুনেছি অনেক মুরুব্বিদের কাছে। হিন্দু বাঙালির কাছে সদ্য বিভাজিত এপার বাংলায় সেইবারের শারদোৎসব ছিল বেশ বিবর্ণ। এই পারের বাঙালি মুসলমানের সিংহভাগই ঈদ ঘিরেও সেবার খুশির মাত্রাকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন এক অব্যক্ত যন্ত্রণায়।
তারপর অনেককাল চলে গেছে। কংগ্রেস-কমিউনিস্ট, তৃণমূল-কেউই ৪৭ উত্তর কালে সম্মিলিত বাঙালির কথা ভাবেনি। বেশিরভাগের কাছেই, বাঙালি হিন্দুই, থেকে গেছে বাঙালি হিসেবে। বাঙালি মুসলমানের নিয়তি হয়েছে কেবলই ‘মুসলমান’ হিসাবে।
কমিউনিস্টদের বেশিরভাগেরই পশ্চিমবঙ্গের বুকে বাঙালি আর মুসলমানের ফারাক করার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। তাদের বেশিরভাগের কাছেই বাঙালি মানে হিন্দু। আর মুসলমান তো ‘অন্য কিছু’। বিজেপির তো কথাই নেই। কংগ্রেস-তৃণমূল ও তথৈবচ।
সেই ফারাক থেকে নিজেদের উত্তরীত করার চেষ্টা বঙ্গীয় কমিউনিস্টদের একটা বড় অংশ করেইনি। কারণ, তাদের দুই শাখারই নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল হিন্দুরাই থেকে গেছে প্রধান। তাদের একটা বড় অংশের কাছেই অন্তর থেকে কখনো মুসলমানেরা গ্রহণযোগ্য হয়নি। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস-এরা মুখে মুসলমান প্রীতি দেখালেও মন থেকে মেনে নেয় না মুসলমানকে। ভোটের দাবার চাল তাদের কাছে মুসলমান। আর বিজেপি তো ঘোষিত মুসলমান বিরোধী।
কিন্তু উৎসবের আমেজ হোক কিংবা ধর্মের আবরণ, ‘২৪ এর শারোৎসব, এমন রোদনভরা ‘শরৎ’, বাঙালি দেখেনি বুঝি কখনো আগে। আমার কাছে কিন্তু বাঙালি মানে, অবিভক্ত ময়মনসিংহের আরিগ্যার প্রতিকূল, যে বাড়িতে নেতাজী অনুগামী হেমন্ত বসু, আমার বাবার যে হেমন্ত কাকা, মানিকতলা হাউজিংয়ে ফ্ল্যাট নেয়ার জন্যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আবাসন মন্ত্রী হিসেবে আমার বাবাকে প্রায় জবরদস্তি করেছিলেন। হ্যাঁ জবরদস্তির অধিকার তার ছিল আমার বাবার প্রতি। কারণ, শ্রীরামকৃষ্ণ সহচর, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতে একাধিকবার উল্লিখিত তারকনাথ রায়, আমার বৃদ্ধ পিতামহ। যার দৌলতে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল হেমন্ত কুমারের।
সেই হেমন্ত কুমারের ছবি বাড়ির বারান্দায় ঝোলানো প্রতিকূল, তার ভয়ংকর হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংশ্রব ঘিরে আমি সরাসরি অভিযোগ জানিয়েছিলাম স্বয়ং জ্যোতি বসুকে, তখন সেই প্রতিকূলের হয়ে আমার কাছে অ্যাডভোকেসি করেছিল বিশ্বজিৎ দাস (নাম পরিবর্তিত), বৈকুণ্ঠ দাসের নাতি। সেকালের সেজে থাকা বাম, বারদির কমলার বরের স্যাঙাত।
প্রতিকূল বামফ্রন্ট সরকারের আমলের কানুনে চাকরি পেয়েছিল। কর্মরত অবস্থায় কোনো সরকারি চাকুরে প্রয়াত হলে তার স্ত্রী বা স্বামী অথবা পুত্র-কন্যাদের সরকারি চাকরি পাওয়ার আইনি অধিকার দিয়েছিল সাবেক বামফ্রন্ট সরকার। সেই আইন মোতাবেক প্রতিকূল চাকরি পায়। সেই সময়ের শাসক শিবিরের সরকারি কর্মচারীদের সংগঠনে সে নাম লেখায়। গোপনে করতে থাকে আরএসএস।
২০০১ সাল নাগাদ এক চায়ের দোকানের আড্ডায় প্রতিকূলের মুখ থেকে শুনি শাখা । গুজরাট গণহত্যার আগে আরএসএস ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন একটা আলোচনাই ছিল না। সেই প্রতিকূলের বিরুদ্ধে যখন আমি জ্যোতিবাবুর কাছে সরাসরি অভিযোগ করি, তখন রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের যে বামপন্থি সংগঠন, কো অর্ডিনেশন কমিটি, তার রাজ্য নেতৃত্ব খুব দৃঢ় অবস্থান নিলেও, সংগঠনটির স্থানীয় নেতৃত্ব বাঁচিয়ে দেয় এই আরএসএসের শাখা করা ছেলেটিকে কেবলমাত্র তাদের ও সংগঠনে থাকার দরুণ। বৈকুণ্ঠ দাসের নাতি ও আমাকে বলে, কি দরকার। ছেড়ে দাও।
একটা বামপন্থি সংগঠনে সরাসরি আরএসএস করা প্রতিকূল, যার সম্পর্কে কো অর্ডিনেশনের রাজ্য নেতৃত্বকে সরাসরি বললেন জ্যোতি বসুর মতো ব্যক্তিত্ব, সংগঠনের স্থানীয় লোকদের বদান্যতায় সে থেকে গেল নিরাপদ। না তার সংগঠন কোনো ব্যবস্থা নিলÑনা প্রশাসনিক ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো। গুজরাট গণহত্যায় মুসলমানের রক্তে হাত রাঙিয়ে নরেন্দ্র মোদি যখন আবার জিতে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হলেন, প্রতিকূল ফোনে আমাকে বলল, বাধাই হো। তখন ও সে ফর্মালি বামপন্থি কর্মচারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। গোপনে আরএসএস করে। আর প্রকাশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়গানে মুখর।
২০১১ তে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের আগেই যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তাতে প্রতিকূলদের পক্ষে খুল্লামখুল্লা মমতার হয়ে কাজ করাটা এতটুকু সমস্যার বিষয় ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে খুব সহজেই বলতে হয়, বিরোধীদের বাধা দেয়া ঘিরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার নিয়ে যেসব অভিযোগ তখন তোলা হতো, সেই সমস্ত অভিযোগই ছিল রাজনৈতিক ভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
ফলে খাতায় কলমে কো অর্ডিনেশন করে (কারণ, যদি কোনো মতে সরকারটা টিকে যেত, তবে এই প্রতিকূল হয়ে উঠত, সরকার রক্ষার কাজে সব থেকে আত্মনিবেদিত কমরেড) প্রতিকূলের পক্ষে তৃণমূল- আরএসএস- বিজেপির ত্রিবেণী সঙ্গমে বেণী না ভিজিয়ে অবগাহনে এতটুকু অসুবিধা হয়নি।
২০১১ র পরে খুল্লামখুল্লা শাসকের লোক প্রতিকূল। আর শাসকের লোক হয়ে, শাসকর প্রভাব কাজে লাগিয়ে প্রশাসনকে মুসলমান শূন্য করবার যে গোপন কর্মসূচি রয়েছে আরএসএসের, সেই কর্মসূচি রূপায়ণে এই প্রতিকূল এখন একজন হাতে কলমে সফল নেতা।
প্রতিকূল রাজ্য সরকারের যে দপ্তরে কর্মরত, সেই দপ্তরটিতে এখন মুসলমান কর্মচারীদের হেনস্তা করবার জন্যে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে একটা অলিখিত বোঝাপড়া হয়েছে। কিছু একটা ছলছুতো, কোনো একটা অজুহাত বের করে কর্মরত মুসলমান সহকর্মীদের হেনস্তা এখন ওই দপ্তরটির একটা নিয়মিত অভ্যাস। আরএস-বিজেপির মুসলমানকে ভাতে মারবার যে রাজনৈতিক পরিকল্পনা, তাকে রূপায়িত করতে তৃণমূল কংগ্রেস এখন সব রকম ভাবে সায় দিচ্ছে।
প্রতিকূলের দপ্তরের এক হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট পদমর্যাদার কর্মী, মুসলমান, তাকে একদম জাল পেতে, ষয়যন্ত্র করে প্রথমে ফাঁসানো হয়। সেই ষড়যন্ত্রের জালটা এত গোপনে এবং এত সুচতুর ভাবে বিস্তার করা হয় যে, ‘স্যাট’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মীদের ঘিরে অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয় এখানে বিবেচিত হয়। সেখানে ওই হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট পদমর্যার মানুষটিকে কেবল নাস্তানাবুদই হতে হয়।
ফলশ্রুতি? হ্যাঁ, সেই হেড অ্যাসিস্ট্যান্টটি সাময়িক সাসপেন্ড হয়েছেন এবং নিজের ঘরের দোরে, সেই পদে বদলি হয়ে এসেছেন প্রতিকূল।
পূর্বতন হেড অ্যাসিস্ট্যান্টটির অপরাধ ছিল, জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট রেজিস্টির ওই অফিসটিতে তিনি ঘুষের রাজত্ব বন্ধ করে দিয়েছিলেন প্রায়। ফলে যা হবার তাইই হয়েছে। ঘুঘুর বাসা ভাড়তে গেলে সেখানে একটা অসাধারণ কর্মী ঐক্য তো তৈরি হবেই! ঘুষ বন্ধ হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে? এমন কথা নৈব নৈব চ।
তবে ঘুষ বন্ধ করতে কৃতসংলপ্ত মানুষটিকে ঘিরে এই ধর্মভিত্তিক বিদ্বেষ ছড়ানো, এই কাজটি এখন গোটা পশ্চিমবঙ্গের কর্মজগতের প্রায় প্রতিটি স্তরে চলছে। মুখে সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি প্রীতিসূচক কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে গোটা ভারত জুড়ে মুসলমানদের ভাতে মারবার যে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিন্দুত্ববাদীরা চালাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে সেই কর্মসূচি দিল্লির শাসক আর নবান্নের শাসক মিলে মিশে একযোগে রূপায়িত করে চলেছে।
যে অদ্ভুত বিভাজনের খেলা গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে আরএসএস-বিজেপি আর তৃণমূল একযোগে চালাচ্ছে তার কিছু বেদনাবিহ্বল পরিণতি আমরা সাম্প্রতিক শারোদৎসবের সময়কালে পেলাম। তৃণমূল প্রভাবিত একটা দুর্গাপূজাতে নবীজির এক কল্পিত ছবি প্রদর্শিত হলে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার শ্যামপুর থানা এলাকায়। এলাকাটি মুসলমান জনবসতিপূর্ণ। সেখানে তৃণমূল প্রভাবিত একটি দুর্গাপূজাতে মনীষীদের ছবি প্রদর্শিত করবার নাম করে কারও একটি আঁকা কল্পিত নবীজির ছবি প্রদর্শিত হয়।
সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রবল আপত্তিতে সেই কল্পিত ছবিটি সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটি মিশ্র ধর্মীয় জনবসতিপূর্ণ এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, প্রায় জন্মাবধিই জানে, কোন বিষয়টি মুসলমানের ভাবাবেগে আঘাত দেবে। একই রকম ভাবে মুসলমান সমাজের মানুষেরাও জানে, কি সে আঘাত পেতে পারে হিন্দুরা।
সংঘাতের এই পরিবেশ এেিয় চলাই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সমাজের চিরন্তন ঐতিহ্য। তা হলে প্রশ্ন হলো, অমন গর্হিত কা- কেন হলো হাওড়া জেলার প্রান্তিক একটি এলাকাতে?
শারদোৎসবের সময়কালে হাওড়াতে যে ঘটেছে কেন, তা জানবার অধিকার বাংলার তথা ভারতের নাগরিকের থাকবে না? লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি বা তার সহযোগী, তৃণমূল কংগ্রেসকে হারাতে মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙাতে যা ঘটেছে তা জানবার অধিকার কেন সাধারণ নাগরিকদের থাকবে না? সমাজ মাধ্যম থেকে জানতে পারা যাচ্ছে যে, ওই সময়কালে বেলডাঙ্গা সন্নিহিত অঞ্চলে মুর্শিদাবাদ জেলার একটা বড় অংশে এবং মুর্শিদাবাদের সন্নিকষ্ট নদিয়া জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ছিল।
তথ্য জানার অধিকার অনুযায়ী একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আমার জানবার অধিকার আছে যে, কেন, কোন কারণে এই সময়কালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ জেলার একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হলো। এসব জানবার দাবি আমরা জানাতেই পারি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেউ এই দাবির প্রতি কখনো কোনো রকম কর্ণপাত করেনি। করছে না। বা ভবিষ্যতেও করবে না।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যদি এভাবে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সুযোগ সাধারণ মানুষকে না পেতে দেয়া হয়, তাহলে তার কি পরিণাম রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পড়তে পারে- এ সম্পর্কে আশা করি কোনো পক্ষের শাসকদের মধ্যেই কোনরকম অজানা, অচেনা এবং সংশয়াতীর্ণ মনোভাব বা মানসিকতা নেই।
তাহলে কেন এমন পরিস্থিতি করা হচ্ছে? এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কোন রাজনৈতিক দল, বা কোন্ ব্যক্তি, বিশেষ রকমের প্রভাব সম্পন্ন কোন গোষ্ঠী, ব্যক্তি বা অধিপতি দায়ী?
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ ]