alt

উপ-সম্পাদকীয়

কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি ও করণীয়

সাজেদুল ইসলাম

: শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, প্রায় ৪৭.৪২ লাখ মানুষ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২.৪%, শারীরিক বা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী, অন্য কথায় প্রতিবন্ধী মানুষ। বিবিএস সমীক্ষা (২০২২) এর ফলাফল অনুসারে, দেশে ৩.২৯% পুরুষ এবং ২.৩৪% মহিলার কোনো না কোনো ধরনের অক্ষমতা রয়েছে এবং তাদের মধ্যে বেশির ভাগই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, কুষ্ঠ রোগ মানুষের মধ্যে প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টির জন্য দায়ী অন্যতম একটি প্রধান কারণ। তবে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্তকরণ এবং সময়মতো চিকিৎসা করা গেলে এই ধরনের প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, কুষ্ঠ-সম্পর্কিত প্রতিবন্ধিতার ঘটনা হ্রাস করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, তা হল কুষ্ঠ রোগের প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং আক্রান্তদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা। সেজন্য জনসাধারণকে অবহিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা উচিত যে, কুষ্ঠ রোগের প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী জটিলতাগুলোকে প্রতিরোধ করে। কুষ্ঠ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, জন্মগত, বংশগত বা অভিশাপের ফল নয়। চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠরোগ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগের কারণে পঙ্গু হলে হাত ও পায়ের কার্যক্রম অচল হয়ে যায়, যন্ত্রণাপূর্ণ ঘা ও ইনফেকশন দেখা দেয়, এমনকি অন্ধত্বও দেখা দেয়। কুষ্ঠ সাধারণত আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক ¯œায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙুল বাঁকা হওয়া, মুখের প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘাঁ ইত্যাদি বিকলাঙ্গতা দেখা দেয় এবং রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা ও বৈষম্য প্রকটরূপে দেখা দেয়। ন্যাশনাল লেপ্রসি প্রোগ্রাম (এনএলপি) এর তথ্য অনুসারে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বার্ষিক প্রায় ৩০০০ থেকে ৩৫০০ নতুন কুষ্ঠ রোগ শনাক্ত করা হলেও প্রকৃত সংখ্যাটি এই সংখ্যার দ্বিগুণ।

দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ এর মতে, প্রায় ৬% থেকে ৮% কুষ্ঠ রোগী পরে সময়মতো এবং মানসম্পন্ন চিকিৎসার অভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। এছাড়া ৫% রোগী প্রথম দিকে হাতের সংবেদন হারানোর সমস্যায় পড়েন, পরে সঠিক চিকিৎসার অভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েন। যখন একজন কুষ্ঠ রোগী ওষুধ খান, তখন এর জন্য জটিলতা হতে পারে। যদি এটি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয় তবে এটি রোগীর জন্য প্রতিবন্ধিতার কারণ হতে পারে। ভুক্তভোগীরা প্রাথমিক পর্যায়ে পুনর্গঠনমূলক অস্ত্রোপচারের সুবিধা পেলে কুষ্ঠরোগের কারণে সৃষ্ট প্রতিবন্ধিতা রোধ করা যেতে পারে। তাই আমাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহে পুনর্গঠনমূলক অস্ত্রোপচারের যথাযথ ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কুষ্ঠরোগে স্নায়ুর ক্ষতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো সংবেদন হারানো, বা অ্যানাস্থেসিয়া, যা ব্যক্তিকে স্বাভাবিক দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের সময় নিজেকে আহত করার সুযোগ করে দেয়। কুষ্ঠরোগ পেশি নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে দুর্বলতা, নখর, জয়েন্টের শক্ততা এবং বিকৃতি ঘটে। সংক্রামক রোগের মধ্যে কুষ্ঠ রোগ স্থায়ী শারীরিক অক্ষমতার একটি প্রধান কারণ। কুষ্ঠরোগের কারণে প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো স্নায়ুর ক্ষতি শুরু হওয়ার আগেই প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত ও সময়মতো চিকিৎসা করা। প্রতিক্রিয়া এবং নিউরাইটিসসহ কুষ্ঠরোগের জটিলতাগুলোর কার্যকরী ব্যবস্থাপনা আরও প্রতিবন্ধিতার বিকাশকে প্রতিরোধ বা হ্রাস করতে পারে। কুষ্ঠ দ্বারা সৃষ্ট প্রতিবন্ধিতা বড় একটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এটি আরও কুসংস্কার ছড়ায়, অন্যদিকে অন্যান্য কারণে সৃষ্ট প্রতিবন্ধিতার কারণে এতটা কুসংস্কার ছড়ায় না। কুষ্ঠ দ্বারা সৃষ্ট প্রতিবন্ধিতার কারণে সমস্ত কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তি কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার হয় এবং তারপরে তারা সমাজের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়, যা তাদের দৈনন্দিন জীবন, জীবিকা এবং চিকিৎসাকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। অনেকাংশে, প্রতিবন্ধিতা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে সামাজিক কুসংস্কার এবং বৈষম্যকে শক্তিশালী করে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষার জন্য ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’ নামে একটি আইন রয়েছে, কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এতে কুষ্ঠ-সংক্রান্ত প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। তাই কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে যারা পঙ্গু হয়েছেন তারা সরকারের দেয়া সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই সেক্টরে কর্মরত অধিকারকর্মীরা আইনটি সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যাতে কুষ্ঠ রোগের কারণে যারা প্রতিবন্ধী তারা যাতে প্রতিবন্ধিতার মানদ-ে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সরকারি সেবা পাওয়ার অধিকারী হয়।

কুষ্ঠ-সম্পর্কিত প্রতিবন্ধিতার ফলে প্রধানত দুটি সমস্যা দেখা দেয়। একটি হলো কুসংস্কারর কারণে ভুক্তভোগীদের দৈনন্দিন সামগ্রিক জীবনকে ব্যাহত করে এবং অন্যটি হলো ভুক্তভোগীরা পরিবার ও সমাজে বোঝা হয়ে দাঁড়ায় এর ফলে তারা সমাজে ও পারিবারে কোনো অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়। অন্য কোনো বিকল্প উপায় না পেয়ে প্রতিবন্ধীরা জীবিকার তাগিদে ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়ে। তাই আমাদের জাতীয় স্বার্থে কুষ্ঠ সমস্যা মোকাবিলা করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা আমাদের দেশের জন্য মানবিক, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠ রোগ নির্মূল করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকারের এই অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দিতে জাতীয় বাজেটে এই খাতে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ থাকা অপরিহার্য। ‘বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশি^ক কুষ্ঠ কৌশল ২০২১-২০৩০’ এর দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে শূন্য কুষ্ঠ সংক্রমণ এবং শূন্য কুষ্ঠ প্রতিবন্ধিতার দিকে ত্বরান্বিত করার জন্য আমাদের এখন কাজ করতে হবে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা তার বৈশি^ক কুষ্ঠ কৌশল ২০২১-২০৩০-এর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশ্বের দেশগুলোকে কুষ্ঠ রোগের শূন্য স্তর এবং সংক্রমণ, প্রতিবন্ধিতা, কুসংস্কার এবং বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট বৈষম্য দূর করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা দূর করতে হলে বাংলাদেশকে কুষ্ঠরোগ মুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে হবে। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন জাতীয় বাজেটে কুষ্ঠ খাতে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দের মাধ্যমে কুষ্ঠ ইস্যুকে জাতীয়ভাবে গুরুত্ব প্রদান করা। কুষ্ঠ নির্মূলে অপারেশন প্ল্যান তৈরি করা, কুষ্ঠরোগ সম্পর্কে দেশব্যাপী ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সম্ভাব্য কুষ্ঠ রোগীদের সক্রিয়ভাবে শনাক্ত করা এবং রোগ নির্ণয়সহ তাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা, এবং কুষ্ঠ-সম্পর্কিত কুসংস্কার ও বৈষম্য অবসানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

জীবন ফিরে আসুক বাংলার নদীগুলোতে

কান্দন সরেন হত্যা ও ভূমি বিরোধ কি এড়ানো যেত না

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র: রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমস্যা কোথায়?

মানবাধিকার দিবস : মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা?

আমলাতান্ত্রিক স্বচ্ছতা : সংস্কারের পথে নাকি পুনরাবৃত্তি?

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কথা

ছবি

বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের অগ্রদূত

দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার বন্ধ করতে হবে

মা তোর বদনখানি মলিন হলে

ব্যবসায়ী নেতৃত্বশূন্য ই-ক্যাব

মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়ে নতুন পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা

মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা চায়

সবার উপরে মানুষ সত্য

এইচএসসিতে ইংরেজিতে ফল বিপর্যয় কেন, করণীয় কী

ছবি

নিরাপদ এবং সুষম পরিবেশের পরিকল্পনা

ফার্মেসি শিক্ষা ও পেশার সংস্কার প্রয়োজন

মশার কয়েলের প্রভাব : জনস্বাস্থ্যের অদৃশ্য হুমকি

“আইনুন কাইনুন সর্বনেশে...”

এই সর্বনাশের দায় কার?

জ্ঞানই শক্তি

বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস : জোর দিতে হবে প্রতিরোধে

ঋণ ব্যবস্থা : তেলা মাথায় ঢালো তেল, ন্যাড়া মাথায় ভাঙো বেল

বিচারকের ওপর হামলা কেন

বৈশ্বিক নিষ্ক্রিয়তার কবলে রোহিঙ্গা ইস্যু

আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবস

বৈষম্য ঘোচাতে চাই একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়

রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ

সমস্যার সূতিকাগার

ছবি

বাংলাদেশে আলু চাষে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতি

দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের পথ কী?

ব্যাংক সংস্কার : কাটবে কি অন্ধকার?

ছবি

নিত্যপণ্যের দামে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস

রম্যগদ্য: ম্যাড় ম্যাড়ে সোনা-কাহিনী

রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগার

কেন এত ধ্বংস, কেন এত মৃত্যু

জলবায়ু সম্মেলন থেকে আমরা কী পেলাম

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি ও করণীয়

সাজেদুল ইসলাম

শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, প্রায় ৪৭.৪২ লাখ মানুষ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২.৪%, শারীরিক বা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী, অন্য কথায় প্রতিবন্ধী মানুষ। বিবিএস সমীক্ষা (২০২২) এর ফলাফল অনুসারে, দেশে ৩.২৯% পুরুষ এবং ২.৩৪% মহিলার কোনো না কোনো ধরনের অক্ষমতা রয়েছে এবং তাদের মধ্যে বেশির ভাগই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, কুষ্ঠ রোগ মানুষের মধ্যে প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টির জন্য দায়ী অন্যতম একটি প্রধান কারণ। তবে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্তকরণ এবং সময়মতো চিকিৎসা করা গেলে এই ধরনের প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, কুষ্ঠ-সম্পর্কিত প্রতিবন্ধিতার ঘটনা হ্রাস করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, তা হল কুষ্ঠ রোগের প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং আক্রান্তদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা। সেজন্য জনসাধারণকে অবহিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা উচিত যে, কুষ্ঠ রোগের প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী জটিলতাগুলোকে প্রতিরোধ করে। কুষ্ঠ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, জন্মগত, বংশগত বা অভিশাপের ফল নয়। চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠরোগ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগের কারণে পঙ্গু হলে হাত ও পায়ের কার্যক্রম অচল হয়ে যায়, যন্ত্রণাপূর্ণ ঘা ও ইনফেকশন দেখা দেয়, এমনকি অন্ধত্বও দেখা দেয়। কুষ্ঠ সাধারণত আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক ¯œায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙুল বাঁকা হওয়া, মুখের প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘাঁ ইত্যাদি বিকলাঙ্গতা দেখা দেয় এবং রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা ও বৈষম্য প্রকটরূপে দেখা দেয়। ন্যাশনাল লেপ্রসি প্রোগ্রাম (এনএলপি) এর তথ্য অনুসারে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বার্ষিক প্রায় ৩০০০ থেকে ৩৫০০ নতুন কুষ্ঠ রোগ শনাক্ত করা হলেও প্রকৃত সংখ্যাটি এই সংখ্যার দ্বিগুণ।

দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ এর মতে, প্রায় ৬% থেকে ৮% কুষ্ঠ রোগী পরে সময়মতো এবং মানসম্পন্ন চিকিৎসার অভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। এছাড়া ৫% রোগী প্রথম দিকে হাতের সংবেদন হারানোর সমস্যায় পড়েন, পরে সঠিক চিকিৎসার অভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েন। যখন একজন কুষ্ঠ রোগী ওষুধ খান, তখন এর জন্য জটিলতা হতে পারে। যদি এটি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয় তবে এটি রোগীর জন্য প্রতিবন্ধিতার কারণ হতে পারে। ভুক্তভোগীরা প্রাথমিক পর্যায়ে পুনর্গঠনমূলক অস্ত্রোপচারের সুবিধা পেলে কুষ্ঠরোগের কারণে সৃষ্ট প্রতিবন্ধিতা রোধ করা যেতে পারে। তাই আমাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহে পুনর্গঠনমূলক অস্ত্রোপচারের যথাযথ ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কুষ্ঠরোগে স্নায়ুর ক্ষতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো সংবেদন হারানো, বা অ্যানাস্থেসিয়া, যা ব্যক্তিকে স্বাভাবিক দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের সময় নিজেকে আহত করার সুযোগ করে দেয়। কুষ্ঠরোগ পেশি নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে দুর্বলতা, নখর, জয়েন্টের শক্ততা এবং বিকৃতি ঘটে। সংক্রামক রোগের মধ্যে কুষ্ঠ রোগ স্থায়ী শারীরিক অক্ষমতার একটি প্রধান কারণ। কুষ্ঠরোগের কারণে প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো স্নায়ুর ক্ষতি শুরু হওয়ার আগেই প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত ও সময়মতো চিকিৎসা করা। প্রতিক্রিয়া এবং নিউরাইটিসসহ কুষ্ঠরোগের জটিলতাগুলোর কার্যকরী ব্যবস্থাপনা আরও প্রতিবন্ধিতার বিকাশকে প্রতিরোধ বা হ্রাস করতে পারে। কুষ্ঠ দ্বারা সৃষ্ট প্রতিবন্ধিতা বড় একটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এটি আরও কুসংস্কার ছড়ায়, অন্যদিকে অন্যান্য কারণে সৃষ্ট প্রতিবন্ধিতার কারণে এতটা কুসংস্কার ছড়ায় না। কুষ্ঠ দ্বারা সৃষ্ট প্রতিবন্ধিতার কারণে সমস্ত কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তি কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার হয় এবং তারপরে তারা সমাজের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়, যা তাদের দৈনন্দিন জীবন, জীবিকা এবং চিকিৎসাকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। অনেকাংশে, প্রতিবন্ধিতা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে সামাজিক কুসংস্কার এবং বৈষম্যকে শক্তিশালী করে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষার জন্য ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’ নামে একটি আইন রয়েছে, কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এতে কুষ্ঠ-সংক্রান্ত প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। তাই কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে যারা পঙ্গু হয়েছেন তারা সরকারের দেয়া সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই সেক্টরে কর্মরত অধিকারকর্মীরা আইনটি সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যাতে কুষ্ঠ রোগের কারণে যারা প্রতিবন্ধী তারা যাতে প্রতিবন্ধিতার মানদ-ে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সরকারি সেবা পাওয়ার অধিকারী হয়।

কুষ্ঠ-সম্পর্কিত প্রতিবন্ধিতার ফলে প্রধানত দুটি সমস্যা দেখা দেয়। একটি হলো কুসংস্কারর কারণে ভুক্তভোগীদের দৈনন্দিন সামগ্রিক জীবনকে ব্যাহত করে এবং অন্যটি হলো ভুক্তভোগীরা পরিবার ও সমাজে বোঝা হয়ে দাঁড়ায় এর ফলে তারা সমাজে ও পারিবারে কোনো অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়। অন্য কোনো বিকল্প উপায় না পেয়ে প্রতিবন্ধীরা জীবিকার তাগিদে ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়ে। তাই আমাদের জাতীয় স্বার্থে কুষ্ঠ সমস্যা মোকাবিলা করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা আমাদের দেশের জন্য মানবিক, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠ রোগ নির্মূল করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকারের এই অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দিতে জাতীয় বাজেটে এই খাতে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ থাকা অপরিহার্য। ‘বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশি^ক কুষ্ঠ কৌশল ২০২১-২০৩০’ এর দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে শূন্য কুষ্ঠ সংক্রমণ এবং শূন্য কুষ্ঠ প্রতিবন্ধিতার দিকে ত্বরান্বিত করার জন্য আমাদের এখন কাজ করতে হবে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা তার বৈশি^ক কুষ্ঠ কৌশল ২০২১-২০৩০-এর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশ্বের দেশগুলোকে কুষ্ঠ রোগের শূন্য স্তর এবং সংক্রমণ, প্রতিবন্ধিতা, কুসংস্কার এবং বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট বৈষম্য দূর করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা দূর করতে হলে বাংলাদেশকে কুষ্ঠরোগ মুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে হবে। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন জাতীয় বাজেটে কুষ্ঠ খাতে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দের মাধ্যমে কুষ্ঠ ইস্যুকে জাতীয়ভাবে গুরুত্ব প্রদান করা। কুষ্ঠ নির্মূলে অপারেশন প্ল্যান তৈরি করা, কুষ্ঠরোগ সম্পর্কে দেশব্যাপী ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সম্ভাব্য কুষ্ঠ রোগীদের সক্রিয়ভাবে শনাক্ত করা এবং রোগ নির্ণয়সহ তাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা, এবং কুষ্ঠ-সম্পর্কিত কুসংস্কার ও বৈষম্য অবসানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

back to top