আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
যেসব কীটপতঙ্গ মানুষের জন্য ক্ষতিকারক তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত একটি পতঙ্গ হলো মশা। আর এই মশার অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমরা কতকিছুই না করি। তবুও মশার হাত থেকে রেহাই মেলেনি এখনও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্টে মশাকে ‘আতঙ্ক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মশাবাহিত রোগে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার মানুষ মারা যায় এবং প্রতি বছর এই মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখে গিয়ে পৌঁছায়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বহু জটিল রোগ নিরাময়ে সক্ষম হলেও প্রাণঘাতী ডেঙ্গু নিরাময়ে অনেকটাই পিছিয়ে। সাধারণত সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বর্ষার আগে শুরু হয় এবং মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কে ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের দেখা দিচ্ছে, ফলশ্রুতিতে প্রায় সারা বছরই ডেঙ্গুরোগী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ সময় জনস্বাস্থ্য বিভাগ ও সিটি করপোরেশন মশা দমন ও নিধনে সক্রিয় ভূমিকা রাখলেও এ প্রচেষ্টা কতটা কার্যকর সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাধ্য হয়ে নাগরিকদের নিজ উদ্যোগে মশার কামড় থেকে বাঁচার ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে যার সুযোগ নিচ্ছে মশার কয়েল প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো। মুনাফা অর্জনের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে এই কোম্পানিগুলো। মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য দ্রুত সমাধানের উপায় হিসেবে অনেকেই মশার কয়েল, স্প্রে বা ত্বকে ব্যবহার্য লোশন বা রিপেলেন্ট ব্যবহার করেন। এগুলোর মধ্যে সাধারণভাবে বহুল প্রচলিত মশার কয়েল যা সুলভে সর্বস্তরের জনসাধারণই ব্যবহার করতে পারে। নি¤œমানের কয়েল মানুষ দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে দূষিত ধোঁয়ায় মানবদেহের শ্বাসকষ্ট, কিডনি, লিভারের ক্ষতি, ক্যানসার, এমনকি গর্ভের শিশুর বিকলাঙ্গতা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
বালাইনাশক অধ্যাদেশ ১৯৭১ এবং ১৯৮৫-এর নিয়ম অনুযায়ী, মশার কয়েল উৎপাদন, বাজারজাত ও সংরক্ষণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, অধিদপ্তরের অনুমোদন পাওয়ার পর পাবলিক হেলথ প্রোডাক্ট (পিএইচপি) নম্বর ও বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নিয়েই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বালাইনাশক পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হবে। অধিকাংশ কয়েল কোম্পানি অনুমোদনহীনভাবে ভুয়া পিএইচপি নম্বর ও বিএসটিআই লোগো ব্যবহার করে আকর্ষণীয় মোড়কে বিপজ্জনক পণ্য বাজারজাত করছে। বাজারগুলোতে নি¤œমানের কয়েলের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়লেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির দেখা মেলা দায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মশার কয়েলে সর্বাধিক ০.৩ মাত্রার ‘অ্যাকটিভ ইনটিগ্রেডিয়েন্ট’ ব্যবহারের সুপারিশ করেছে, যা মশা তাড়াতে কার্যকর হলেও এটি মশা মারতে পারে না। বাস্তবে, অনুমোদনহীন কয়েলে অতি মাত্রার বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় যা শুধু মশাই নয়, অন্যান্য পোকামাকড় যেমনÑ পিঁপড়া, তেলাপোকা এমনকি টিকটিকিও মেরে ফেলে।
মশার কয়েলের উদ্ভাবক দেশ হলো চীন। প্রাচীন চীনে চন্দ্রমল্লিকা ফুল থেকে যে গুঁড়ো পাইরোগ্রাম পাওয়া যেত তার সঙ্গে গাছের বাকল থেকে পাওয়া আঠা জাতীয় পদার্থ মিশিয়ে মশা বিতাড়ক ধূপ তৈরি করা হতো। বর্তমানে কাঠের গুড়া, নারিকেলের মালা বা আইচার গুড়া সঙ্গে অ্যারারুটের মাড় মেশানো হয়। এক্ষেত্রে কাঠের গুড়া ও নারকেলের মালার গুড়া জ্বালানি হিসেবে এবং মিশ্রণকে জমাট করতে অ্যারারুটের মাড় ব্যবহার করা হয়। সবুজ রঙ হয় ম্যালাকাইট গ্রিন বা ক্রিস্টাল গ্রিন মেশানোর জন্য। মশার কয়েলের প্রধান উপাদান হলো পাইরোফ্রয়েড। এটা প্রাকৃতিক যৌগিক পদার্থ পাইরোগ্রাম থেকে পাওয়া যায়। অ্যালেথ্রিন-এর মতো সমধর্মী যৌগ থেকেও পাওয়া যায়। প্রায় সমস্ত মশার কয়েলের মোড়কে অ্যালেথ্রিন ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে। এর সঙ্গে ফেনল ও ক্রেসলÑ দুটি জৈবযৌগ ব্যবহার করা হয়। এসব কয়েলে ডাইমেফ্লুথ্রিন, ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন, প্যারাফিন ও কার্বন, সুগন্ধিসহ ইত্যাদি উপাদান ব্যবহার করা হয়।
দেশীয় বাজারে বিএসটিআই অনুমোদিত সর্বমোট ১২৫টি দেশীয় ব্র্যান্ডের মশার কয়েল রয়েছে; এর মধ্যে কয়েকটি ব্রান্ড দেশীয় সনামধ্যন্য কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত। এসব কোম্পানির মধ্যে ঢাকায় ৩৩টি, গাজীপুরে ১০টি, নারায়ণগঞ্জে ৩৭টি, কিশোরগঞ্জে ২১টি, চট্টগ্রামে ২টি, মুন্সিগঞ্জে ২টি, কুমিল্লায় ৪টি, খুলনায় ২টি, নাটোরে ২টি, হবিগঞ্জে ৩টি, ময়মনসিংহে ২টি, কুষ্টিয়া, যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, দিনাজপুর, পঞ্চগড় এবং রংপুরে ১টি করে কোম্পানি রয়েছে। কিছু মশার কয়েল আবার বিদেশ যেমনÑ চীন, ভারত, কোরিয়া ইত্যাদি থেকে আমদানিকৃত। দেশীয় মশা কয়েলের মোড়কের গায়ে বিএসটিআই অনুমোদনদের লোগো থাকলেও বিদেশিগুলো বিএসটিআই কর্তৃক পরীক্ষিত কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে বলার কোন উপায় নেই। সাধারণত প্রতি প্যাকেটে ১০টি করে কয়েল থাকে এবং বেশির ভাগ ব্র্যান্ডের প্রতিটি কয়েল ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত জ্বলে এবং ধোঁয়া ছড়ায়।
কিছু মানুষ মশার কয়েল ব্যবহারের সময় দরজা-জানালা বন্ধ রাখেন যাতে ধোঁয়া ঘর থেকে বেরিয়ে না যায়। কয়েলের ধোঁয়া আবদ্ধ স্থানে মশা তাড়াতে ভালো কাজ করলেও ধোঁয়ায় বিদ্যমান বিবিধ বিষাক্ত জৈব ও অজৈব বাষ্প, প্রচুর পরিমাণে সূক্ষ্ম ও অতিসূক্ষ্ম ভাসমান কণা (পার্টিকুলেট ম্যাটারস ২.৫) এবং কয়েলের দহনে উৎপন্ন ফরম্যালডিহাইড, বেনজিন, বেনজোপাইরিন, বেনজোফ্লিউরোঅ্যানথিন ইত্যাদি বিষাক্ত ও উদ্বায়ী যৌগ মশা তাড়ানোর পাশাপাশি মানুষের, বিশেষত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মারাত্মক ক্ষতি করে। এসব যৌগের অনেকগুলোই মানুষের সম্ভাব্য ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ হিসেবে পরিচিত।
মশার কয়েল জ্বেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে থাকলে শ্বাসকষ্টজনিত শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগসহ ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়। তাইওয়ানভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা যায় যে, একটি মশার কয়েল জ্বালালে যে পরিমাণ ফরম্যালডিহাইড জাতীয় বিষাক্ত জৈব বাষ্প তৈরি হয়, তা প্রায় ৫১টি সিগারেট জ্বালানোর সমান এবং যে পরিমাণ সূক্ষ্ম কণা উৎপন্ন হয় তা প্রায় ৭৫ থেকে ১৩৭টি সিগারেট জ্বালানোর সমতুল্য। পাশাপাশি এতে উৎপন্ন সূক্ষ্ম ও অতিসূক্ষ্ম ভাসমান কণা (পার্টিকুলেট ম্যাটারস ২.৫) ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করে রক্ত প্রবাহেও মিশে যেতে পারে। ফলে শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদরোগ এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। এগুলো শুধু যে ফুসফুস, হার্ট, মস্তিষ্ক ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের ক্ষতি করে তাই নয়; দীর্ঘমেয়াদি ফল হিসেবে ক্যানসারের সম্ভাবনাকেও ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তোলে। এ ছাড়াও মশার কয়েলে থাকা রাসায়নিক উপাদানগুলোর বিষক্রিয়ার কারণে কখনও কখনও তাৎক্ষণিকভাবে মাথা ঘোরা, বমি, এবং শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে, শুধু শারীরিক ক্ষতিই নয়, মশার কয়েলের ধোঁয়া আমাদের পরিবেশেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। কয়েলের ধোঁয়া বায়ুদূষণের একটি বড় উৎস। একেকটি কয়েল থেকে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, তা কয়েকটি সিগারেটের সমান ক্ষতিকর। এর ফলে ঘরের ভেতরে এবং আশপাশে বায়ুর মান দ্রুত খারাপ হয়ে যায়।
মশার কয়েল যে শুধু মশা দূর করে তা নয়, এটি একটি অদৃশ্য শত্রুর মতো আমাদের জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে মশারি ব্যবহার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং মশার আবাসস্থল এবং প্রজননস্থল ধ্বংস করা সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। এছাড়া মশা থেকে বাঁচতে কয়েলের পরিবর্তে দরজা-জানালা সন্ধ্যার আগে বন্ধ রাখা এবং মশারি টানিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা। মশার কয়েলের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে এবং কয়েলের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ পদ্ধতি ব্যবহারের প্রচার-প্রচারণা প্রয়োজন। নি¤œমানের কয়েলের বিপরীতে বিকল্প হিসেবে ইলেকট্রনিক মশা তাড়ানোর যন্ত্র, প্রাকৃতিক তেল (যেমন: লেবু ঘাস বা নিম তেল) এবং লিকুইড রিফিল ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হলেও সেগুলোরও ক্ষতিকর দিক নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। মশাবাহিত রোগের প্রকোপ কমাতে ব্যক্তি উদ্যোগ এবং সরকারি কার্যক্রমের সমন্বয় প্রয়োজন। আমাদেরকে অবশ্যই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে এবং এই সমস্যার টেকসই সমাধান খুঁজতে হবে। জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় এসব কয়েলের মান নিয়ন্ত্রণ, সরকারি তদারকির পাশাপাশি মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। সচেতনতা, সঠিক জ্ঞান এবং নিরাপদ অভ্যাসই হতে পারে আমাদের সুরক্ষার মূল চাবিকাঠি।
[লেখক : ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ]
আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪
যেসব কীটপতঙ্গ মানুষের জন্য ক্ষতিকারক তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত একটি পতঙ্গ হলো মশা। আর এই মশার অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমরা কতকিছুই না করি। তবুও মশার হাত থেকে রেহাই মেলেনি এখনও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্টে মশাকে ‘আতঙ্ক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মশাবাহিত রোগে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার মানুষ মারা যায় এবং প্রতি বছর এই মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখে গিয়ে পৌঁছায়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বহু জটিল রোগ নিরাময়ে সক্ষম হলেও প্রাণঘাতী ডেঙ্গু নিরাময়ে অনেকটাই পিছিয়ে। সাধারণত সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বর্ষার আগে শুরু হয় এবং মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কে ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের দেখা দিচ্ছে, ফলশ্রুতিতে প্রায় সারা বছরই ডেঙ্গুরোগী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ সময় জনস্বাস্থ্য বিভাগ ও সিটি করপোরেশন মশা দমন ও নিধনে সক্রিয় ভূমিকা রাখলেও এ প্রচেষ্টা কতটা কার্যকর সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাধ্য হয়ে নাগরিকদের নিজ উদ্যোগে মশার কামড় থেকে বাঁচার ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে যার সুযোগ নিচ্ছে মশার কয়েল প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো। মুনাফা অর্জনের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে এই কোম্পানিগুলো। মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য দ্রুত সমাধানের উপায় হিসেবে অনেকেই মশার কয়েল, স্প্রে বা ত্বকে ব্যবহার্য লোশন বা রিপেলেন্ট ব্যবহার করেন। এগুলোর মধ্যে সাধারণভাবে বহুল প্রচলিত মশার কয়েল যা সুলভে সর্বস্তরের জনসাধারণই ব্যবহার করতে পারে। নি¤œমানের কয়েল মানুষ দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে দূষিত ধোঁয়ায় মানবদেহের শ্বাসকষ্ট, কিডনি, লিভারের ক্ষতি, ক্যানসার, এমনকি গর্ভের শিশুর বিকলাঙ্গতা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
বালাইনাশক অধ্যাদেশ ১৯৭১ এবং ১৯৮৫-এর নিয়ম অনুযায়ী, মশার কয়েল উৎপাদন, বাজারজাত ও সংরক্ষণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, অধিদপ্তরের অনুমোদন পাওয়ার পর পাবলিক হেলথ প্রোডাক্ট (পিএইচপি) নম্বর ও বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নিয়েই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বালাইনাশক পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হবে। অধিকাংশ কয়েল কোম্পানি অনুমোদনহীনভাবে ভুয়া পিএইচপি নম্বর ও বিএসটিআই লোগো ব্যবহার করে আকর্ষণীয় মোড়কে বিপজ্জনক পণ্য বাজারজাত করছে। বাজারগুলোতে নি¤œমানের কয়েলের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়লেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির দেখা মেলা দায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মশার কয়েলে সর্বাধিক ০.৩ মাত্রার ‘অ্যাকটিভ ইনটিগ্রেডিয়েন্ট’ ব্যবহারের সুপারিশ করেছে, যা মশা তাড়াতে কার্যকর হলেও এটি মশা মারতে পারে না। বাস্তবে, অনুমোদনহীন কয়েলে অতি মাত্রার বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় যা শুধু মশাই নয়, অন্যান্য পোকামাকড় যেমনÑ পিঁপড়া, তেলাপোকা এমনকি টিকটিকিও মেরে ফেলে।
মশার কয়েলের উদ্ভাবক দেশ হলো চীন। প্রাচীন চীনে চন্দ্রমল্লিকা ফুল থেকে যে গুঁড়ো পাইরোগ্রাম পাওয়া যেত তার সঙ্গে গাছের বাকল থেকে পাওয়া আঠা জাতীয় পদার্থ মিশিয়ে মশা বিতাড়ক ধূপ তৈরি করা হতো। বর্তমানে কাঠের গুড়া, নারিকেলের মালা বা আইচার গুড়া সঙ্গে অ্যারারুটের মাড় মেশানো হয়। এক্ষেত্রে কাঠের গুড়া ও নারকেলের মালার গুড়া জ্বালানি হিসেবে এবং মিশ্রণকে জমাট করতে অ্যারারুটের মাড় ব্যবহার করা হয়। সবুজ রঙ হয় ম্যালাকাইট গ্রিন বা ক্রিস্টাল গ্রিন মেশানোর জন্য। মশার কয়েলের প্রধান উপাদান হলো পাইরোফ্রয়েড। এটা প্রাকৃতিক যৌগিক পদার্থ পাইরোগ্রাম থেকে পাওয়া যায়। অ্যালেথ্রিন-এর মতো সমধর্মী যৌগ থেকেও পাওয়া যায়। প্রায় সমস্ত মশার কয়েলের মোড়কে অ্যালেথ্রিন ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে। এর সঙ্গে ফেনল ও ক্রেসলÑ দুটি জৈবযৌগ ব্যবহার করা হয়। এসব কয়েলে ডাইমেফ্লুথ্রিন, ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন, প্যারাফিন ও কার্বন, সুগন্ধিসহ ইত্যাদি উপাদান ব্যবহার করা হয়।
দেশীয় বাজারে বিএসটিআই অনুমোদিত সর্বমোট ১২৫টি দেশীয় ব্র্যান্ডের মশার কয়েল রয়েছে; এর মধ্যে কয়েকটি ব্রান্ড দেশীয় সনামধ্যন্য কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত। এসব কোম্পানির মধ্যে ঢাকায় ৩৩টি, গাজীপুরে ১০টি, নারায়ণগঞ্জে ৩৭টি, কিশোরগঞ্জে ২১টি, চট্টগ্রামে ২টি, মুন্সিগঞ্জে ২টি, কুমিল্লায় ৪টি, খুলনায় ২টি, নাটোরে ২টি, হবিগঞ্জে ৩টি, ময়মনসিংহে ২টি, কুষ্টিয়া, যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, দিনাজপুর, পঞ্চগড় এবং রংপুরে ১টি করে কোম্পানি রয়েছে। কিছু মশার কয়েল আবার বিদেশ যেমনÑ চীন, ভারত, কোরিয়া ইত্যাদি থেকে আমদানিকৃত। দেশীয় মশা কয়েলের মোড়কের গায়ে বিএসটিআই অনুমোদনদের লোগো থাকলেও বিদেশিগুলো বিএসটিআই কর্তৃক পরীক্ষিত কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে বলার কোন উপায় নেই। সাধারণত প্রতি প্যাকেটে ১০টি করে কয়েল থাকে এবং বেশির ভাগ ব্র্যান্ডের প্রতিটি কয়েল ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত জ্বলে এবং ধোঁয়া ছড়ায়।
কিছু মানুষ মশার কয়েল ব্যবহারের সময় দরজা-জানালা বন্ধ রাখেন যাতে ধোঁয়া ঘর থেকে বেরিয়ে না যায়। কয়েলের ধোঁয়া আবদ্ধ স্থানে মশা তাড়াতে ভালো কাজ করলেও ধোঁয়ায় বিদ্যমান বিবিধ বিষাক্ত জৈব ও অজৈব বাষ্প, প্রচুর পরিমাণে সূক্ষ্ম ও অতিসূক্ষ্ম ভাসমান কণা (পার্টিকুলেট ম্যাটারস ২.৫) এবং কয়েলের দহনে উৎপন্ন ফরম্যালডিহাইড, বেনজিন, বেনজোপাইরিন, বেনজোফ্লিউরোঅ্যানথিন ইত্যাদি বিষাক্ত ও উদ্বায়ী যৌগ মশা তাড়ানোর পাশাপাশি মানুষের, বিশেষত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মারাত্মক ক্ষতি করে। এসব যৌগের অনেকগুলোই মানুষের সম্ভাব্য ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ হিসেবে পরিচিত।
মশার কয়েল জ্বেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে থাকলে শ্বাসকষ্টজনিত শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগসহ ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়। তাইওয়ানভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা যায় যে, একটি মশার কয়েল জ্বালালে যে পরিমাণ ফরম্যালডিহাইড জাতীয় বিষাক্ত জৈব বাষ্প তৈরি হয়, তা প্রায় ৫১টি সিগারেট জ্বালানোর সমান এবং যে পরিমাণ সূক্ষ্ম কণা উৎপন্ন হয় তা প্রায় ৭৫ থেকে ১৩৭টি সিগারেট জ্বালানোর সমতুল্য। পাশাপাশি এতে উৎপন্ন সূক্ষ্ম ও অতিসূক্ষ্ম ভাসমান কণা (পার্টিকুলেট ম্যাটারস ২.৫) ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করে রক্ত প্রবাহেও মিশে যেতে পারে। ফলে শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদরোগ এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। এগুলো শুধু যে ফুসফুস, হার্ট, মস্তিষ্ক ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের ক্ষতি করে তাই নয়; দীর্ঘমেয়াদি ফল হিসেবে ক্যানসারের সম্ভাবনাকেও ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তোলে। এ ছাড়াও মশার কয়েলে থাকা রাসায়নিক উপাদানগুলোর বিষক্রিয়ার কারণে কখনও কখনও তাৎক্ষণিকভাবে মাথা ঘোরা, বমি, এবং শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে, শুধু শারীরিক ক্ষতিই নয়, মশার কয়েলের ধোঁয়া আমাদের পরিবেশেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। কয়েলের ধোঁয়া বায়ুদূষণের একটি বড় উৎস। একেকটি কয়েল থেকে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, তা কয়েকটি সিগারেটের সমান ক্ষতিকর। এর ফলে ঘরের ভেতরে এবং আশপাশে বায়ুর মান দ্রুত খারাপ হয়ে যায়।
মশার কয়েল যে শুধু মশা দূর করে তা নয়, এটি একটি অদৃশ্য শত্রুর মতো আমাদের জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে মশারি ব্যবহার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং মশার আবাসস্থল এবং প্রজননস্থল ধ্বংস করা সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। এছাড়া মশা থেকে বাঁচতে কয়েলের পরিবর্তে দরজা-জানালা সন্ধ্যার আগে বন্ধ রাখা এবং মশারি টানিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা। মশার কয়েলের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে এবং কয়েলের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ পদ্ধতি ব্যবহারের প্রচার-প্রচারণা প্রয়োজন। নি¤œমানের কয়েলের বিপরীতে বিকল্প হিসেবে ইলেকট্রনিক মশা তাড়ানোর যন্ত্র, প্রাকৃতিক তেল (যেমন: লেবু ঘাস বা নিম তেল) এবং লিকুইড রিফিল ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হলেও সেগুলোরও ক্ষতিকর দিক নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। মশাবাহিত রোগের প্রকোপ কমাতে ব্যক্তি উদ্যোগ এবং সরকারি কার্যক্রমের সমন্বয় প্রয়োজন। আমাদেরকে অবশ্যই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে এবং এই সমস্যার টেকসই সমাধান খুঁজতে হবে। জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় এসব কয়েলের মান নিয়ন্ত্রণ, সরকারি তদারকির পাশাপাশি মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। সচেতনতা, সঠিক জ্ঞান এবং নিরাপদ অভ্যাসই হতে পারে আমাদের সুরক্ষার মূল চাবিকাঠি।
[লেখক : ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ]