ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বর্তমানে পৃথিবী নানা পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন, যার ফলে একটি নিরাপদ এবং সুষম পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বেড়েছে। নিরাপদ পরিবেশ বলতে এমন একটি পরিবেশকে বুঝায় যেখানে মানুষের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা হয় এবং পরিবেশের প্রতি কোনো ক্ষতি না করে মানব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়।
সুষম পরিবেশ হলো এমন একটি পরিবেশ যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সামাজিক ন্যায়ের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। বর্তমান বিশ্ব পরিবেশগত দুর্দশার কারণে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, যা মানবজাতির জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্পায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার এবং বনভূমি নিধনের ফলে পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে, যার ফলে বন্যপ্রাণী, কৃষি এবং পানি সম্পদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জীববৈচিত্র্য দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, যা পরিবেশের স্থিতিশীলতা এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। তৃতীয়ত, দূষণ-বিশেষ করে বায়ু, পানি এবং মাটি দূষণ- মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চতুর্থত, প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার ও অপচয় পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে। আজকের দিনে, যখন জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস এবং দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন এই পরিবেশের সুরক্ষা এবং সুষমতার ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে আমাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও সুষম পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
একটি নিরাপদ এবং সুষম পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য কিছু মূল উপাদান প্রয়োজন। প্রথমত, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, যার মাধ্যমে বর্তমান চাহিদা পূরণ করা হবে, কিন্তু ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পরিবেশগত ক্ষতি না করা হবে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে পরিবেশের ক্ষতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, পরিবেশ রক্ষা করতে হবে, যাতে দূষণ কমানো যায়, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা যায় এবং প্রাকৃতিক বাসস্থান রক্ষা করা যায়। এক্ষেত্রে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বিকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, একটি সুষম পরিবেশ তৈরির জন্য সামাজিক ন্যায় নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে সব শ্রেণীর মানুষ পরিচ্ছন্ন পানি, বায়ু, খাদ্য এবং বাসস্থান পেতে পারে। এটি নিশ্চিত করবে যে পরিবেশের ক্ষতির কারণে কোন নির্দিষ্ট জনগণ বা গোষ্ঠী অতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। চতুর্থত, সার্কুলার অর্থনীতি গড়ে তোলার মাধ্যমে বর্জ্য কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ করা যায় এবং পুনঃব্যবহার ও পুনঃচক্রণের মাধ্যমে সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। পঞ্চমত, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করা যাবে। এর মধ্যে রয়েছে কার্বন নির্গমন কমানো, গাছপালা রোপণ করা এবং জলবায়ুবান্ধব অবকাঠামো তৈরি করা।
ঢাকা শহরের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। এটি বিভিন্ন সময়ে মুঘল, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শাসনের অধীনে ছিল। মুঘল আমলে ঢাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল, যেমন লালবাগ কেল্লা এবং পলাশী যুদ্ধের মাঠ। ব্রিটিশ শাসনামলে এটি একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং পাকিস্তানি সময়ে ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ঢাকার অবস্থান বাংলাদেশে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদী অববাহিকার মধ্যে, যা শহরের আর্কিটেকচার এবং কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর অবস্থান দেশের কেন্দ্রীভাগে হওয়ায় এটি বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ঢাকা শহরের দ্রুত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি শহরের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করেছে, যেমন যানজট, বায়ু দুষণ, পানি সংকট এবং অপর্যাপ্ত নগর পরিকল্পনা।
বর্তমানে ঢাকা একটি অত্যন্ত জনবহুল শহর। এটি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০২৪ সালের শুমারি অনুযায়ী, ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। শহরের প্রধান সড়কগুলোতে দুর্ভোগ এবং যানজট একটি বড় সমস্যা, যা শহরবাসীদের দৈনন্দিন জীবনকে কঠিন করে তোলে। এর পাশাপাশি, পানি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শক্তি খরচ এবং বায়ু দূষণও নগরবাসীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় একযোগে যে চ্যালেঞ্জটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো সুশৃঙ্খল নগর পরিকল্পনার অভাব। নগরের উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষা একসাথে করা সম্ভব নয় যদি না এটি একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে। নগর পরিকল্পনা না হলে, অপ্রয়োজনীয় বিল্ডিং নির্মাণ, আবাসন সংকট এবং ট্রাফিক জ্যামের মতো সমস্যাগুলো বেড়ে যাবে। ঢাকার নির্মাণ কাজের ফলে অধিকাংশ স্থানেই প্রাকৃতিক জলাশয়, উদ্ভিদরাজি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান হারিয়ে যাচ্ছে। আবার নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা পুরোনো এবং অপ্রতুল, ফলে বৃষ্টির সময় জলাশয়ে অতিরিক্ত পানি জমে যা প্লাবন সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঢাকা শহরে ৮০ শতাংশ শিল্পকারখানা অপরিকল্পিতভাবে স্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ যেখানে কারখানা করার কথা, সেখানে তা করা হয়নি। যে যার মতো সুবিধাজনক জায়গায় শিল্পায়ন করেছেন। অথচ সেটা করার কথা ছিল জোনকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে সরকারও চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। আবার অনেক ক্ষেত্রে শিল্প মালিকরাও সরকারকে মেনেজ করে ফেলেছেন। তাই এখন আমাদের মডেল হতে হবে ‘আগে পরিবেশ, তারপর উন্নয়ন’। এ মডেলটি যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে যে কোনো নগর বাসযোগ্য হবে। সেই মডেলে আমাদের যেতে হবে। সরকারকে সে উদ্যাগ নিতে হবে।
একটি আদর্শ নগরায়নের জন্য বেশকিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। একটা নগরের ২৫ ভাগ সবুজায়ন থাকাই লাগবে। ১০ থেকে ১৫ ভাগ জলাশয় বা জলাধার থাকতে হবে। আর বাকি ৪০ ভাগ হয়তো কংক্রিট থাকতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশের নগরায়ণ যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, দেখা যাবে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বহুতল ভবন। কিন্তু আগুন লাগলে তা নেভাতে পানি পাওয়া যায় না। অথচ আমাদের পরিকল্পনায় এ সবুজটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। গ্রাউন্ড ওয়াটার নিয়ে কোনো গবেষণাও নেই। পানির স্তর দিন দিন ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। সেটা পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ কারণ হচ্ছে। এভাবে আমরা যে উন্নয়নের কাথা বলছি, সেখানে উন্নয়নের পরিবেশের কোনো ব্যাকরণ নেই। দেশে ভোটের দাম কমে যাওয়ায় জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিও কমে গেছে। কেউ জবাবদিহি করে না। তারা জানে কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না। একজন শিল্পপতি জানে কোনো সমস্যা হলে রাজনীতিবিদকে মেনেজ করে ফেলবেন। জনগণের কাছে যাওয়া লাগবে না। আবার জনগণও জানে আন্দোলন করে লাভ হবে না। কারণ আন্দোলন করে কোনো স্বীকৃতি নেই। বরং অনেক সময় পরিবেশ নিয়ে যারা কথা বলেন, তাদের প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হয়েছে বিগত দিনে।
গত এপ্রিল মাসে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে তাপমাত্রা পার করে এসেছে বাংলাদেশ, যার প্রভাবে পশু-পাখিসহ মানব জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট চোখে দেখার মতো ছিল না। শুধু যে গরম তাই নয়, গত কয়েক বছরে প্রকৃতি অস্বাভাবিক আচরণ করছে। শীতকালে শীত নেই, বর্ষাকালে নেই বৃষ্টি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে তীব্র বায়ুদূষণ। বাংলাদেশের নাম এখন প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উল্লেখিত হয়, সেটি বায়ুদূষণে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে থাকার জন্য। বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে দৃশ্যমান হয়েছে দেশে মৃত্যুর প্রায় ৩২% নাকি দূষণ প্রক্রিয়ার পরিণতি। আজকের পরিবেশের এই অস্বাভাবিকতার জন্য মানুষের কৃতকর্মই দায়ী বলা চলে। নির্বিচারে আমরা সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত এক অমূল্য উপহার- প্রকৃতির বিনাশ করছি, এতে বিভিন্ন প্রাণিকুলসহ মানব সভ্যতা প্রকৃতির রোষানলে পড়ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য এখন আর ঠিক নেই। বাংলাদেশের ষড়ঋতু যেন হারিয়ে গিয়েছে বছরজুড়ে তীব্র তাপদাহের ডামাডোলে।
ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যদি অনুন্নয়নের চিত্র পরিলক্ষিত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে কী করণীয় তা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। কয়েক দিন আগেই বড় বড় বিশ্ব নেতাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জলবায়ুবিষয়ক (কপ-২৭) সম্মেলন। নানা ধরনের সমীক্ষা, গবেষণা প্রতিবেদন, সেমিনার, আলোচনা এবং বক্তৃতা সম্মেলনে আটকে থাকাই কি পরিবেশ রক্ষার একমাত্র উপায় নাকি সরকার এবং মন্ত্রনালয় গুলোর পাশাপাশি জনসাধারণের সচেতনতা এবং নানামুখী পদক্ষেপ বাড়ানোও জরুরি। বিশ্বের যেসব দেশ জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। প্রশ্ন হচ্ছে দেশের জনসাধারণ এই বিষয়ে কী ভাবছে। আদৌ তাদের ভাবনায় পরিবেশ এবং প্রকৃতি আছে কিনা! অথবা তারা কি জানে তাদের জীবনধারায় কী ধরনের পরিবর্তন আনলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমবে? এই গুরুত্বপূর্ণ দশকে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবর্তন মোকাবিলায় অনেক দ্রুত ও সময়পোযোগী কর্মপরিকল্পনা নেয়া এখনই সময়। অধিক হারে বৃক্ষরোপণ, শিল্পায়নের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রাণ-প্রকৃতির সঠিক সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ রোধে সচেতনতা বাড়ানো, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, শহরে সবুজ বনায়ন প্রকল্প, নদী এবং জলাভূমি দখলমুক্ত করে সংরক্ষণ করতে হবে। উন্নয়ন দৌড়ে পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত না করে পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং পরিবেশ রক্ষায় সমাজের সকল পর্যায়ের মানুষকে আরো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। প্রকৃতির ওপরেই মানব সভ্যতার অস্তিত্ব টিকে রয়েছে, আমরা যেন নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংস ডেকে না আনি। উন্নয়ন হোক, তবে তা যেন হয় পরিবেশবান্ধব।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘আগে উন্নয়ন, পরে পরিবেশ’ এমন কথা বলা হচ্ছে। এ ধরনের একটি সংলাপ আমরা বেশ কিছুদিন ধরে শুনছি। আসলে এটি ধ্বংসাত্মক একটি প্রতিপাদ্য। উন্নয়ন কখনই পরিবেশকে বাদ দিয়ে হবে না। যে উন্নয়নে পরিবেশ বিপর্যয় হয়, সে উন্নয়ন মডেলে আমরা যাবো না। ‘আগে পরিবেশ, তারপর উন্নয়ন’- এ মডেল বাস্তবায়ন করা গেলে যে কোনো নগর বাসযোগ্য হবে। ঢাকা শহরের উন্নয়ন এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরের বাসযোগ্যতা এবং পরিবেশের উন্নতির জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এবং জনগণের মধ্যে একত্রে কাজ করার মাধ্যমে, ঢাকাকে আরও বাসযোগ্য, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব শহরে পরিণত করা সম্ভব। পরিবেশের বিষয়ে যেন আমরা কোনো ছাড় না দেই। তাহলে একটা পর্যায়ে গিয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা কমিয়ে আনা যাবে। যে মানদ- আমাদের টেকসই উন্নয়নে সহায়ক হবে।
নিরাপদ এবং সুষম পরিবেশ তৈরিতে একটি সমন্বিত ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রয়োজন। সর্বপ্রথম, বৈশ্বিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা জরুরি। পরিবেশগত সমস্যাগুলি আন্তঃরাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, যা সমাধান করতে হলে সব দেশকে একত্রে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং সম্মেলন, যেমন প্যারিস চুক্তি, এরই মধ্যে এ ধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। নবায়নযোগ্য শক্তির উদ্ভাবন, শক্তি সঞ্চয় প্রযুক্তি এবং বর্জ্য পুনর্ব্যবহার প্রযুক্তি পরিবেশের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় উদ্যোগ এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং জনগণ মিলে কাজ করলে পরিবেশগত সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব হবে। এছাড়া পরিবেশ শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার, যাতে সাধারণ মানুষ পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী জীবনযাত্রা পরিবর্তন করতে পারে।
সঠিক পরিকল্পনা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি নিরাপদ, সুষম এবং টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারব, যা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেবে। এভাবে একটি নিরাপদ এবং সুষম পরিবেশের জন্য নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনার মাধ্যমে পৃথিবীকে একটি বাসযোগ্য ও স্থিতিশীল জায়গা করে তুলতে হবে।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪
বর্তমানে পৃথিবী নানা পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন, যার ফলে একটি নিরাপদ এবং সুষম পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বেড়েছে। নিরাপদ পরিবেশ বলতে এমন একটি পরিবেশকে বুঝায় যেখানে মানুষের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা হয় এবং পরিবেশের প্রতি কোনো ক্ষতি না করে মানব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়।
সুষম পরিবেশ হলো এমন একটি পরিবেশ যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সামাজিক ন্যায়ের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। বর্তমান বিশ্ব পরিবেশগত দুর্দশার কারণে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, যা মানবজাতির জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্পায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার এবং বনভূমি নিধনের ফলে পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে, যার ফলে বন্যপ্রাণী, কৃষি এবং পানি সম্পদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জীববৈচিত্র্য দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, যা পরিবেশের স্থিতিশীলতা এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। তৃতীয়ত, দূষণ-বিশেষ করে বায়ু, পানি এবং মাটি দূষণ- মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চতুর্থত, প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার ও অপচয় পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে। আজকের দিনে, যখন জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস এবং দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন এই পরিবেশের সুরক্ষা এবং সুষমতার ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে আমাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও সুষম পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
একটি নিরাপদ এবং সুষম পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য কিছু মূল উপাদান প্রয়োজন। প্রথমত, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, যার মাধ্যমে বর্তমান চাহিদা পূরণ করা হবে, কিন্তু ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পরিবেশগত ক্ষতি না করা হবে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে পরিবেশের ক্ষতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, পরিবেশ রক্ষা করতে হবে, যাতে দূষণ কমানো যায়, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা যায় এবং প্রাকৃতিক বাসস্থান রক্ষা করা যায়। এক্ষেত্রে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বিকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, একটি সুষম পরিবেশ তৈরির জন্য সামাজিক ন্যায় নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে সব শ্রেণীর মানুষ পরিচ্ছন্ন পানি, বায়ু, খাদ্য এবং বাসস্থান পেতে পারে। এটি নিশ্চিত করবে যে পরিবেশের ক্ষতির কারণে কোন নির্দিষ্ট জনগণ বা গোষ্ঠী অতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। চতুর্থত, সার্কুলার অর্থনীতি গড়ে তোলার মাধ্যমে বর্জ্য কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ করা যায় এবং পুনঃব্যবহার ও পুনঃচক্রণের মাধ্যমে সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। পঞ্চমত, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করা যাবে। এর মধ্যে রয়েছে কার্বন নির্গমন কমানো, গাছপালা রোপণ করা এবং জলবায়ুবান্ধব অবকাঠামো তৈরি করা।
ঢাকা শহরের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। এটি বিভিন্ন সময়ে মুঘল, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শাসনের অধীনে ছিল। মুঘল আমলে ঢাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল, যেমন লালবাগ কেল্লা এবং পলাশী যুদ্ধের মাঠ। ব্রিটিশ শাসনামলে এটি একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং পাকিস্তানি সময়ে ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ঢাকার অবস্থান বাংলাদেশে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদী অববাহিকার মধ্যে, যা শহরের আর্কিটেকচার এবং কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর অবস্থান দেশের কেন্দ্রীভাগে হওয়ায় এটি বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ঢাকা শহরের দ্রুত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি শহরের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করেছে, যেমন যানজট, বায়ু দুষণ, পানি সংকট এবং অপর্যাপ্ত নগর পরিকল্পনা।
বর্তমানে ঢাকা একটি অত্যন্ত জনবহুল শহর। এটি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০২৪ সালের শুমারি অনুযায়ী, ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। শহরের প্রধান সড়কগুলোতে দুর্ভোগ এবং যানজট একটি বড় সমস্যা, যা শহরবাসীদের দৈনন্দিন জীবনকে কঠিন করে তোলে। এর পাশাপাশি, পানি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শক্তি খরচ এবং বায়ু দূষণও নগরবাসীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় একযোগে যে চ্যালেঞ্জটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো সুশৃঙ্খল নগর পরিকল্পনার অভাব। নগরের উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষা একসাথে করা সম্ভব নয় যদি না এটি একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে। নগর পরিকল্পনা না হলে, অপ্রয়োজনীয় বিল্ডিং নির্মাণ, আবাসন সংকট এবং ট্রাফিক জ্যামের মতো সমস্যাগুলো বেড়ে যাবে। ঢাকার নির্মাণ কাজের ফলে অধিকাংশ স্থানেই প্রাকৃতিক জলাশয়, উদ্ভিদরাজি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান হারিয়ে যাচ্ছে। আবার নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা পুরোনো এবং অপ্রতুল, ফলে বৃষ্টির সময় জলাশয়ে অতিরিক্ত পানি জমে যা প্লাবন সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঢাকা শহরে ৮০ শতাংশ শিল্পকারখানা অপরিকল্পিতভাবে স্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ যেখানে কারখানা করার কথা, সেখানে তা করা হয়নি। যে যার মতো সুবিধাজনক জায়গায় শিল্পায়ন করেছেন। অথচ সেটা করার কথা ছিল জোনকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে সরকারও চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। আবার অনেক ক্ষেত্রে শিল্প মালিকরাও সরকারকে মেনেজ করে ফেলেছেন। তাই এখন আমাদের মডেল হতে হবে ‘আগে পরিবেশ, তারপর উন্নয়ন’। এ মডেলটি যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে যে কোনো নগর বাসযোগ্য হবে। সেই মডেলে আমাদের যেতে হবে। সরকারকে সে উদ্যাগ নিতে হবে।
একটি আদর্শ নগরায়নের জন্য বেশকিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। একটা নগরের ২৫ ভাগ সবুজায়ন থাকাই লাগবে। ১০ থেকে ১৫ ভাগ জলাশয় বা জলাধার থাকতে হবে। আর বাকি ৪০ ভাগ হয়তো কংক্রিট থাকতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশের নগরায়ণ যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, দেখা যাবে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বহুতল ভবন। কিন্তু আগুন লাগলে তা নেভাতে পানি পাওয়া যায় না। অথচ আমাদের পরিকল্পনায় এ সবুজটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। গ্রাউন্ড ওয়াটার নিয়ে কোনো গবেষণাও নেই। পানির স্তর দিন দিন ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। সেটা পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ কারণ হচ্ছে। এভাবে আমরা যে উন্নয়নের কাথা বলছি, সেখানে উন্নয়নের পরিবেশের কোনো ব্যাকরণ নেই। দেশে ভোটের দাম কমে যাওয়ায় জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিও কমে গেছে। কেউ জবাবদিহি করে না। তারা জানে কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না। একজন শিল্পপতি জানে কোনো সমস্যা হলে রাজনীতিবিদকে মেনেজ করে ফেলবেন। জনগণের কাছে যাওয়া লাগবে না। আবার জনগণও জানে আন্দোলন করে লাভ হবে না। কারণ আন্দোলন করে কোনো স্বীকৃতি নেই। বরং অনেক সময় পরিবেশ নিয়ে যারা কথা বলেন, তাদের প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হয়েছে বিগত দিনে।
গত এপ্রিল মাসে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে তাপমাত্রা পার করে এসেছে বাংলাদেশ, যার প্রভাবে পশু-পাখিসহ মানব জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট চোখে দেখার মতো ছিল না। শুধু যে গরম তাই নয়, গত কয়েক বছরে প্রকৃতি অস্বাভাবিক আচরণ করছে। শীতকালে শীত নেই, বর্ষাকালে নেই বৃষ্টি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে তীব্র বায়ুদূষণ। বাংলাদেশের নাম এখন প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উল্লেখিত হয়, সেটি বায়ুদূষণে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে থাকার জন্য। বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে দৃশ্যমান হয়েছে দেশে মৃত্যুর প্রায় ৩২% নাকি দূষণ প্রক্রিয়ার পরিণতি। আজকের পরিবেশের এই অস্বাভাবিকতার জন্য মানুষের কৃতকর্মই দায়ী বলা চলে। নির্বিচারে আমরা সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত এক অমূল্য উপহার- প্রকৃতির বিনাশ করছি, এতে বিভিন্ন প্রাণিকুলসহ মানব সভ্যতা প্রকৃতির রোষানলে পড়ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য এখন আর ঠিক নেই। বাংলাদেশের ষড়ঋতু যেন হারিয়ে গিয়েছে বছরজুড়ে তীব্র তাপদাহের ডামাডোলে।
ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যদি অনুন্নয়নের চিত্র পরিলক্ষিত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে কী করণীয় তা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। কয়েক দিন আগেই বড় বড় বিশ্ব নেতাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জলবায়ুবিষয়ক (কপ-২৭) সম্মেলন। নানা ধরনের সমীক্ষা, গবেষণা প্রতিবেদন, সেমিনার, আলোচনা এবং বক্তৃতা সম্মেলনে আটকে থাকাই কি পরিবেশ রক্ষার একমাত্র উপায় নাকি সরকার এবং মন্ত্রনালয় গুলোর পাশাপাশি জনসাধারণের সচেতনতা এবং নানামুখী পদক্ষেপ বাড়ানোও জরুরি। বিশ্বের যেসব দেশ জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। প্রশ্ন হচ্ছে দেশের জনসাধারণ এই বিষয়ে কী ভাবছে। আদৌ তাদের ভাবনায় পরিবেশ এবং প্রকৃতি আছে কিনা! অথবা তারা কি জানে তাদের জীবনধারায় কী ধরনের পরিবর্তন আনলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমবে? এই গুরুত্বপূর্ণ দশকে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবর্তন মোকাবিলায় অনেক দ্রুত ও সময়পোযোগী কর্মপরিকল্পনা নেয়া এখনই সময়। অধিক হারে বৃক্ষরোপণ, শিল্পায়নের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রাণ-প্রকৃতির সঠিক সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ রোধে সচেতনতা বাড়ানো, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, শহরে সবুজ বনায়ন প্রকল্প, নদী এবং জলাভূমি দখলমুক্ত করে সংরক্ষণ করতে হবে। উন্নয়ন দৌড়ে পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত না করে পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং পরিবেশ রক্ষায় সমাজের সকল পর্যায়ের মানুষকে আরো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। প্রকৃতির ওপরেই মানব সভ্যতার অস্তিত্ব টিকে রয়েছে, আমরা যেন নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংস ডেকে না আনি। উন্নয়ন হোক, তবে তা যেন হয় পরিবেশবান্ধব।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘আগে উন্নয়ন, পরে পরিবেশ’ এমন কথা বলা হচ্ছে। এ ধরনের একটি সংলাপ আমরা বেশ কিছুদিন ধরে শুনছি। আসলে এটি ধ্বংসাত্মক একটি প্রতিপাদ্য। উন্নয়ন কখনই পরিবেশকে বাদ দিয়ে হবে না। যে উন্নয়নে পরিবেশ বিপর্যয় হয়, সে উন্নয়ন মডেলে আমরা যাবো না। ‘আগে পরিবেশ, তারপর উন্নয়ন’- এ মডেল বাস্তবায়ন করা গেলে যে কোনো নগর বাসযোগ্য হবে। ঢাকা শহরের উন্নয়ন এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরের বাসযোগ্যতা এবং পরিবেশের উন্নতির জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এবং জনগণের মধ্যে একত্রে কাজ করার মাধ্যমে, ঢাকাকে আরও বাসযোগ্য, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব শহরে পরিণত করা সম্ভব। পরিবেশের বিষয়ে যেন আমরা কোনো ছাড় না দেই। তাহলে একটা পর্যায়ে গিয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা কমিয়ে আনা যাবে। যে মানদ- আমাদের টেকসই উন্নয়নে সহায়ক হবে।
নিরাপদ এবং সুষম পরিবেশ তৈরিতে একটি সমন্বিত ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রয়োজন। সর্বপ্রথম, বৈশ্বিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা জরুরি। পরিবেশগত সমস্যাগুলি আন্তঃরাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, যা সমাধান করতে হলে সব দেশকে একত্রে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং সম্মেলন, যেমন প্যারিস চুক্তি, এরই মধ্যে এ ধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। নবায়নযোগ্য শক্তির উদ্ভাবন, শক্তি সঞ্চয় প্রযুক্তি এবং বর্জ্য পুনর্ব্যবহার প্রযুক্তি পরিবেশের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় উদ্যোগ এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং জনগণ মিলে কাজ করলে পরিবেশগত সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব হবে। এছাড়া পরিবেশ শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার, যাতে সাধারণ মানুষ পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী জীবনযাত্রা পরিবর্তন করতে পারে।
সঠিক পরিকল্পনা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি নিরাপদ, সুষম এবং টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারব, যা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেবে। এভাবে একটি নিরাপদ এবং সুষম পরিবেশের জন্য নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনার মাধ্যমে পৃথিবীকে একটি বাসযোগ্য ও স্থিতিশীল জায়গা করে তুলতে হবে।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]