কামরুজ্জামান
সমাজে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার চোখের বড় অভাব। চারদিকে শুধু দেয়াল। ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, লম্বা বেটে, সুন্দর অসুন্দর, যোগ্য অযোগ্য, ধার্মিক অধার্মিক, রাজা-প্রজা, শাসক শোষক , শিক্ষিত অশিক্ষিত, স্বাধীন পরাধীন ইত্যাদি শ্রেণী ও বৈষম্য নিয়ে সমাজ তৈরি হয়েছে। মানুষে মানুষে তৈরি হয়েছে ভেদাভেদ ও বৈষম্য, আবার জাতধর্ম, কৃষ্টি ও প্রথারও রয়েছে ভিন্নতা। শুধু জাতধর্ম, ভাষা, রং ভৌগোলিক ভিন্নতায় নয় একই ভূখন্ডের মানুষের রয়েছে আদর্শিক ও মতেরও ভিন্নতা। মানুষের আদর্শ এবং মতের ভিন্নতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার ভিন্নতা থাকা কি উচিত?
একই বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম নিয়েও এক সন্তান আরেক সন্তানকে হেয় চোখে দেখে, দিনের পর দিন করে যায় অবহেলা ও নির্যাতন। বঞ্চিত করে অধিকার ও সম্পত্তি থেকে। এটা পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ রাষ্ট্রের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এই শোষণ এবং বঞ্চনা লক্ষ করা যায়। মানুষ সুযোগ পেলেই একজন আরেকজনকে নিয়ন্ত্রণ করে, একজন আরেকজনকে ঠকায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা বলেছেন, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।’
একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে প্রচন্ড রকমের হেয় করে, ছোট করে দেখে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। শোষণ করে, নির্যাতন করে। একজন মানুষ আরেকজন মানুষ সম্পর্কে মূল্যায়নটা যখন এই রকম হয় তখন তার উল্টো পিঠে জন্ম নেয় ঘৃণা।
শোষণ আর নির্যাতনের বিপরীতে সবসময়ই জন্ম নেয় ঘৃণা। আর এই ঘৃণা মানুষ থেকে মানুষকে আলাদা করে ফেলে। তৈরি হয় বিভেদ। এই বিভেদ শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহে। পরিণতি হয় পতনের। এই পতন শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এর সাথে পতন হয় সমাজ সভ্যতা কৃষ্টি-সংস্কৃতি রাষ্ট্রের এমনকি অর্থনীতির। কখনও কখনও ভূখন্ডেরও।
মানুষ বাঁচে কত বছর? ষাট, সত্তর, আশি কিংবা নব্বই বছর। কালের মহাযাত্রায় এই বেঁচে থাকা খুব সময় নয়। এই অল্প সময়ের জীবনে মানুষের চাওয়া পাওয়ার শেষ থাকে না। এই চাওয়া-পাওয়াই মানুষের জীবনে যত বিপত্তি ঘটায়। মানুষ লোভী হয়ে উঠে। মানুষ বেশি পেতে চায়। বেশি পাইতে গিয়ে মানুষ হয়ে উঠে অসৎ এবং নিয়ন্ত্রককারী। মানুষের যখন অর্থ হয়, মানুষ যখন ক্ষমতা হাতে পায় তখন অন্য মানুষকে ছোট করে দেখে। নিজের মধ্যে পরিবর্তন নিয়ে আসে। অন্য আর দশজন মানুষ থেকে নিজেকে আলাদা করে ভাবতে থাকে। তৈরি করে আলাদা সমাজ। মানুষ সম্পর্কে ধারণা করতে থাকে নেতিবাচক। কথায় এবং কাজে বুঝাতে থাকে সেই একমাত্র মানুষ অন্যেরা মানুষ নয়।
মানুষ পৃথিবীতে অনেক মহৎ কাজও করে থাকে। কেউ সেবামূলক কাজ করে, কেউ শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে, কেউ রাজনীতি করে, কেউ স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করে, কেউ আবার এসব কিছুই করে না। প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করে। কেউ আবার গবেষণা করে, গবেষণা করে নতুন নতুন আবিস্কার করে। অনেকেই অনেক কিছু করে। কিন্তু মানুষ মানুষের জন্য হিংসা বিদ্বেষের উর্ধ্বে গিয়ে কাজ করবে এবং মানুষ মানুষের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এই বিষয়টি নিশ্চিত করার জায়গাটা পৃথিবীতে এখনো তৈরি হয় নি। কেউ করতে পারেনি।
সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষে মানুষে সংঘাত এবং বিভেদ ছিল। এখনো আছে। গোত্র ধর্ম সম্প্রদায় জাতি দেশ নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত হয়েছে বিস্তর, এখনও হচ্ছে। একে অন্যকে দোষারোপ করছে। সবাই ভালো যার যার পক্ষে যুক্তি দাড় করাচ্ছে। যে যে কাজটি করছে তার কাজটি সঠিক পক্ষে যুক্তি দাড় করাচ্ছে। তারপরও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, একজন আরেকজনের ক্ষতি করছে। মানুষ মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের চোখে দেখছে।
সমাজে বহু শ্রেণী-পেশার মানুষ রয়েছে। কামার কুমার জেলে তাঁতি, নরসুন্দর, মুচি ক্লিনার, ড্রাইভার, রিকশাওয়ালা, দর্জি, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, উকিল মুক্তার, রাজনীতিক, প্রফেসর, ব্যারিস্টার ইত্যাদি। প্রত্যেক শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতা হিংসা। একজন আরেকজনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। নিজ পেশার বাইরে অন্য পেশার হলে তো কথাই নেই। মানুষ বাইরে একরকম আচরণ করে ভিতরে করে আরেকরকম।
মানুষ একজন আরেকজনের সাফল্যে উপরে উপরে যতটা খুশি হয় ভেতরে ঠিক ততটাই হিংসা করে। এটা করে মানুষের হীনমন্যতার কারণে। প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে। দুই শ্রেণীর মানুষ কখনও হিংসা করে না। একজন হলো প্রত্যেক সন্তানের বাবা-মা। প্রতিটি বাবা-মা তার সন্তানের সাফল্যে খুশি হয়। আরেকজন হলো- আদর্শ শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষক সবসময়ই তার ছাত্রের সাফল্যে সুখ অনুভব করে খুশি হয়। এছাড়া কমবেশি সবাই সবাইকে প্রতিযোগী মনে করে। হিংসা বিদ্বেষ করে। প্রকাশ্যে হয়তো করতে পারে না কিন্তু মনে মনে হলেও করে।
আমাদের সমাজে যারা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ রয়েছে তাদের অর্থ ও সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী আলাদা আলাদা মূল্যায়ন করা হয়। সবাই তো মানুষ। শুধু মূল্যায়নের জায়গাটা হয় ভিন্ন। অথচ সমাজে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের দরকার রয়েছে। এক শ্রেণী ছাড়া আরেক শ্রেণীর মানুষের চলা সম্ভব নয়। কিন্তু ছোট পেশার মানুষ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দেখা হয় ছোট করে। তুই তুকারী করে ডাকা হয়। তাদের সাথে দমকের সুরে কথা বলা হয় । অনেক সময় চড়থাপ্পড়ও মারা হয়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘মানুষ’ কবিতায় বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান-মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’
পৃথিবীতে মানুষই বড়। ধর্ম বর্ণ শ্রেণী-পেশা ধনী গরিব নাই ভেদাভেদ। কবি ভন্ডদের সম্পর্কে এও বলেছেন, ‘হায় রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!’ ভেদাভেদ আসলে মানুষেরই সৃষ্টি। নিজেরা সুবিধা লুটে নেওয়ার জন্য জাতপাত কিংবা শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করে রেখেছে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অনাচার হয় ধর্মের নামে। ধর্মকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে মানুষকে অত্যাচার করা হয়। মারা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনে যুদ্ধের কারণে চরম মানবিক বিপর্যয় চলছে। সারা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে। কারো হৃদয়ে মানবিকতা জাগ্রত হচ্ছে না। অথচ মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো নৈতিক দায়িত্ব। কবি নজরুল এখানেও সতর্ক করে বলেছেনÑ
‘মানুষেরে ঘৃণা করি/ ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল/ চুম্বিছে মরি মরি/ ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ/ নাও জোর করে কেড়ে, / যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব/ সেই মানুষেরে মেরে, / পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল!/ -মূর্খরা সব শোনো, / মানুষ এনেছে গ্রন্থ;/ -গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। ভুপেন হাজারিকা’র সেই বিখ্যাত গান, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু, মানুষ মানুষের জন্য। তাই সকল গোত্র সম্প্রদায়, শ্রেণী-পেশা, ধর্ম, জাত উপজাত সর্বস্তরের মানুষকে মানুষ হিসাবেই চিন্তা করতে হবে।
প্রতিটি মানুষের ভিতরে ভালো একটা সত্তা আছে; কিন্তু লোভ ক্ষমতা হিংসা বিদ্বেষ পরশ্রীকাতরতা তাকে বের হতে দেয় না। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার জায়গাটা আসলে বিবেক এবং মনুষ্যত্ববোধের বিষয়। ভেতরের মনুষ্যত্বটাকে আগে জাগ্রত করতে হবে। বিবেকবোধ বাড়াতে হবে। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তবেই মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার জায়গা তৈরি হবে। কমে আসবে বৈষম্য।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]
কামরুজ্জামান
শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪
সমাজে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার চোখের বড় অভাব। চারদিকে শুধু দেয়াল। ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, লম্বা বেটে, সুন্দর অসুন্দর, যোগ্য অযোগ্য, ধার্মিক অধার্মিক, রাজা-প্রজা, শাসক শোষক , শিক্ষিত অশিক্ষিত, স্বাধীন পরাধীন ইত্যাদি শ্রেণী ও বৈষম্য নিয়ে সমাজ তৈরি হয়েছে। মানুষে মানুষে তৈরি হয়েছে ভেদাভেদ ও বৈষম্য, আবার জাতধর্ম, কৃষ্টি ও প্রথারও রয়েছে ভিন্নতা। শুধু জাতধর্ম, ভাষা, রং ভৌগোলিক ভিন্নতায় নয় একই ভূখন্ডের মানুষের রয়েছে আদর্শিক ও মতেরও ভিন্নতা। মানুষের আদর্শ এবং মতের ভিন্নতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার ভিন্নতা থাকা কি উচিত?
একই বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম নিয়েও এক সন্তান আরেক সন্তানকে হেয় চোখে দেখে, দিনের পর দিন করে যায় অবহেলা ও নির্যাতন। বঞ্চিত করে অধিকার ও সম্পত্তি থেকে। এটা পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ রাষ্ট্রের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এই শোষণ এবং বঞ্চনা লক্ষ করা যায়। মানুষ সুযোগ পেলেই একজন আরেকজনকে নিয়ন্ত্রণ করে, একজন আরেকজনকে ঠকায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা বলেছেন, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।’
একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে প্রচন্ড রকমের হেয় করে, ছোট করে দেখে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। শোষণ করে, নির্যাতন করে। একজন মানুষ আরেকজন মানুষ সম্পর্কে মূল্যায়নটা যখন এই রকম হয় তখন তার উল্টো পিঠে জন্ম নেয় ঘৃণা।
শোষণ আর নির্যাতনের বিপরীতে সবসময়ই জন্ম নেয় ঘৃণা। আর এই ঘৃণা মানুষ থেকে মানুষকে আলাদা করে ফেলে। তৈরি হয় বিভেদ। এই বিভেদ শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহে। পরিণতি হয় পতনের। এই পতন শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এর সাথে পতন হয় সমাজ সভ্যতা কৃষ্টি-সংস্কৃতি রাষ্ট্রের এমনকি অর্থনীতির। কখনও কখনও ভূখন্ডেরও।
মানুষ বাঁচে কত বছর? ষাট, সত্তর, আশি কিংবা নব্বই বছর। কালের মহাযাত্রায় এই বেঁচে থাকা খুব সময় নয়। এই অল্প সময়ের জীবনে মানুষের চাওয়া পাওয়ার শেষ থাকে না। এই চাওয়া-পাওয়াই মানুষের জীবনে যত বিপত্তি ঘটায়। মানুষ লোভী হয়ে উঠে। মানুষ বেশি পেতে চায়। বেশি পাইতে গিয়ে মানুষ হয়ে উঠে অসৎ এবং নিয়ন্ত্রককারী। মানুষের যখন অর্থ হয়, মানুষ যখন ক্ষমতা হাতে পায় তখন অন্য মানুষকে ছোট করে দেখে। নিজের মধ্যে পরিবর্তন নিয়ে আসে। অন্য আর দশজন মানুষ থেকে নিজেকে আলাদা করে ভাবতে থাকে। তৈরি করে আলাদা সমাজ। মানুষ সম্পর্কে ধারণা করতে থাকে নেতিবাচক। কথায় এবং কাজে বুঝাতে থাকে সেই একমাত্র মানুষ অন্যেরা মানুষ নয়।
মানুষ পৃথিবীতে অনেক মহৎ কাজও করে থাকে। কেউ সেবামূলক কাজ করে, কেউ শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে, কেউ রাজনীতি করে, কেউ স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করে, কেউ আবার এসব কিছুই করে না। প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করে। কেউ আবার গবেষণা করে, গবেষণা করে নতুন নতুন আবিস্কার করে। অনেকেই অনেক কিছু করে। কিন্তু মানুষ মানুষের জন্য হিংসা বিদ্বেষের উর্ধ্বে গিয়ে কাজ করবে এবং মানুষ মানুষের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এই বিষয়টি নিশ্চিত করার জায়গাটা পৃথিবীতে এখনো তৈরি হয় নি। কেউ করতে পারেনি।
সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষে মানুষে সংঘাত এবং বিভেদ ছিল। এখনো আছে। গোত্র ধর্ম সম্প্রদায় জাতি দেশ নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত হয়েছে বিস্তর, এখনও হচ্ছে। একে অন্যকে দোষারোপ করছে। সবাই ভালো যার যার পক্ষে যুক্তি দাড় করাচ্ছে। যে যে কাজটি করছে তার কাজটি সঠিক পক্ষে যুক্তি দাড় করাচ্ছে। তারপরও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, একজন আরেকজনের ক্ষতি করছে। মানুষ মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের চোখে দেখছে।
সমাজে বহু শ্রেণী-পেশার মানুষ রয়েছে। কামার কুমার জেলে তাঁতি, নরসুন্দর, মুচি ক্লিনার, ড্রাইভার, রিকশাওয়ালা, দর্জি, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, উকিল মুক্তার, রাজনীতিক, প্রফেসর, ব্যারিস্টার ইত্যাদি। প্রত্যেক শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতা হিংসা। একজন আরেকজনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। নিজ পেশার বাইরে অন্য পেশার হলে তো কথাই নেই। মানুষ বাইরে একরকম আচরণ করে ভিতরে করে আরেকরকম।
মানুষ একজন আরেকজনের সাফল্যে উপরে উপরে যতটা খুশি হয় ভেতরে ঠিক ততটাই হিংসা করে। এটা করে মানুষের হীনমন্যতার কারণে। প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে। দুই শ্রেণীর মানুষ কখনও হিংসা করে না। একজন হলো প্রত্যেক সন্তানের বাবা-মা। প্রতিটি বাবা-মা তার সন্তানের সাফল্যে খুশি হয়। আরেকজন হলো- আদর্শ শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষক সবসময়ই তার ছাত্রের সাফল্যে সুখ অনুভব করে খুশি হয়। এছাড়া কমবেশি সবাই সবাইকে প্রতিযোগী মনে করে। হিংসা বিদ্বেষ করে। প্রকাশ্যে হয়তো করতে পারে না কিন্তু মনে মনে হলেও করে।
আমাদের সমাজে যারা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ রয়েছে তাদের অর্থ ও সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী আলাদা আলাদা মূল্যায়ন করা হয়। সবাই তো মানুষ। শুধু মূল্যায়নের জায়গাটা হয় ভিন্ন। অথচ সমাজে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের দরকার রয়েছে। এক শ্রেণী ছাড়া আরেক শ্রেণীর মানুষের চলা সম্ভব নয়। কিন্তু ছোট পেশার মানুষ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দেখা হয় ছোট করে। তুই তুকারী করে ডাকা হয়। তাদের সাথে দমকের সুরে কথা বলা হয় । অনেক সময় চড়থাপ্পড়ও মারা হয়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘মানুষ’ কবিতায় বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান-মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’
পৃথিবীতে মানুষই বড়। ধর্ম বর্ণ শ্রেণী-পেশা ধনী গরিব নাই ভেদাভেদ। কবি ভন্ডদের সম্পর্কে এও বলেছেন, ‘হায় রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!’ ভেদাভেদ আসলে মানুষেরই সৃষ্টি। নিজেরা সুবিধা লুটে নেওয়ার জন্য জাতপাত কিংবা শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করে রেখেছে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অনাচার হয় ধর্মের নামে। ধর্মকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে মানুষকে অত্যাচার করা হয়। মারা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনে যুদ্ধের কারণে চরম মানবিক বিপর্যয় চলছে। সারা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে। কারো হৃদয়ে মানবিকতা জাগ্রত হচ্ছে না। অথচ মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো নৈতিক দায়িত্ব। কবি নজরুল এখানেও সতর্ক করে বলেছেনÑ
‘মানুষেরে ঘৃণা করি/ ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল/ চুম্বিছে মরি মরি/ ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ/ নাও জোর করে কেড়ে, / যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব/ সেই মানুষেরে মেরে, / পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল!/ -মূর্খরা সব শোনো, / মানুষ এনেছে গ্রন্থ;/ -গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। ভুপেন হাজারিকা’র সেই বিখ্যাত গান, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু, মানুষ মানুষের জন্য। তাই সকল গোত্র সম্প্রদায়, শ্রেণী-পেশা, ধর্ম, জাত উপজাত সর্বস্তরের মানুষকে মানুষ হিসাবেই চিন্তা করতে হবে।
প্রতিটি মানুষের ভিতরে ভালো একটা সত্তা আছে; কিন্তু লোভ ক্ষমতা হিংসা বিদ্বেষ পরশ্রীকাতরতা তাকে বের হতে দেয় না। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার জায়গাটা আসলে বিবেক এবং মনুষ্যত্ববোধের বিষয়। ভেতরের মনুষ্যত্বটাকে আগে জাগ্রত করতে হবে। বিবেকবোধ বাড়াতে হবে। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তবেই মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার জায়গা তৈরি হবে। কমে আসবে বৈষম্য।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]