জিয়াউদ্দীন আহমেদ
রাজধানীর ঢাকা কলেজ ও সেন্ট্রাল আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছুদিন আগে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা আইডিয়াল কলেজের সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যায়। ঘটনা গুরুতর হলেও ঘটনার কারণ কিন্তু গুরুতর নয়। ঢাকা কলেজে একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা আইডিয়াল কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কথা কাটাকাটির জেরে মারধর করা হয়। এরপর থেকেই পাল্টাপাল্টি আক্রমণ। এই পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৮ জন ছাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।
২০১৭ সালে ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়; তার আগে কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। সাত কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সমস্যা নিরসন কল্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল করে স্বতন্ত্র নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার অধিভুক্ত করার দাবিতে বহুদিন আন্দোলন করেছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা। এই সাত কলেজের মধ্যে তিতুমীর কলেজও রয়েছে; কিন্তু তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি পক্ষ সাত কলেজের সমন্বয়ে প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে থাকতে চায় না; তারা চায়, তিতুমীর কলেজ আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় হোক। ১৯৯৭ সাল থেকে তারা এই দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের অন্যতম প্রধান যুক্তি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মাঝে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। শিক্ষার্থীরা কলেজের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন করেছে এবং তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে ট্রেন চালানোর কারণে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা চলন্ত ট্রেনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে বহু যাত্রীকে আহতও করেছে।
‘দিল্লির দাসত্বকারী’, ‘বাংলাদেশ ও ইসলামের শত্রু’, ‘পতিত সরকারের দোসর’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে ‘আলেম ওলামা ও তাওহিদী জনতাকে। বিক্ষোভকারীরা ‘ভারতীয় আগ্রাসন’ প্রতিরোধে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার পত্রিকার সামনে শুধু জুমার নামাজ আদায় করেননি, ‘জিয়াফত’ ও ‘জোড়া গরু জবেহ’ কর্মসূচি পালনের চেষ্টাও করেছেন। একটি গরুর ওপর লেখা ছিল ‘মতি গরু’। রাজশাহীতে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ছাড়াও প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সাইনবোর্ড ভাঙচুর করে তাতে আগুন দিয়েছে তাওহিদী জনতা। এই দুটি পত্রিকাকে পতিত সরকারের দোসর বলা হচ্ছে, অথচ এই দুইটি পত্রিকা সম্পর্কে শেখ হাসিনার অভিযোগ ছিল, ‘গোটা ২০টা বছর আমার রাজনীতির জীবনে এই পত্রিকাগুলো শুধু আমার বিরুদ্ধে কুৎসাই রটনা করে গেছে, আমার বিরুদ্ধে লিখে গেছে। আওয়ামী লীগ যেন তাদের শত্রু।’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সময় টেলিভিশন, ডিবিসি, একাত্তর টিভি, এটিএন বাংলা, এটিএন নিউজসহ কয়েকটি বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। এসব বিক্ষোভ নিয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গণমাধ্যমে ফ্যাসিবাদের এক শ্রেণীর দোসর সৃষ্টি হয়েছে। ফলে গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। তা ফিরিয়ে আনতে সাংবাদিকদেরই ভূমিকা পালন করতে হবে।’ কিন্তু আইনজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তার এবং শিক্ষকদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করার অভ্যাস তো নতুন নয়, এই অভ্যাসবশে ইতোমধ্যে অনেক সাংবাদিক অন্তর্বর্তী সরকারেরও দোসর হয়ে গেছেন; তথ্য উপদেষ্টা নিশ্চয়ই তা ইত্যবসরে বুঝতে পেরেছেন। দোসর সাংবাদিকদের তাবেদারি প্রশ্নের কারণেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজারে মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। কোন কোন মাজারে ঘোষণা দিয়ে একাধিকবার আক্রমণ হয়েছে, বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে মাজারের স্থাপনা। শাহপরান (রহ.)-এর মাজারে হামলায় একটি ছেলে মারাও গেছে। আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ সুফিবাদে বিশ্বাসী। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয়েছে সুফি দরবেশের মাধ্যমে। এখনো আমাদের দেশের বঙ বঙ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা সিলেটের হযরত শাহ জালাল দরগাহে গিয়ে কবর জিয়ারত করে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করার রেওয়াজ অক্ষুণœ রেখেছেন। বিখ্যাত দুইজন সুফি দরবেশের নামে দেশের প্রধান দুটি বিমানবন্দরের নামকরণ করা হয়েছে। আজকাল রাজনীতিবিদদের কবরকেও ‘মাজার’ বলা হয়। সৌদি আরবেও সাহাবাদের যেসব মাজার ছিল তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। আব্দুল ওয়াহাব নজদির দর্শনে অনুপ্রাণিত সৌদ বংশের শাসকরা এই মাজার ভাঙার সঙ্গে জড়িত ছিল। আব্দুল ওয়াহাব নজদি সুফিজম, ওলি-আউলিয়া, মুর্শিদ, মাজার জিয়ারত ইত্যাদিকে বিদআত, এমনকি শিরক হিসেবেও আখ্যা দেন।
সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও মোল্লা কলেজের ছাত্রদের মধ্যে মারামারি ও লুটতরাজের কাহিনী সাম্প্রতিককালের। এক ছাত্রের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর কারণে ন্যাশনাল মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী আর কবি নজরুল কলেজে মোল্লা কলেজের ছাত্ররা হামলা ও লুটপাট করেছে। পরবর্তী পালায় এসেছে সোহরাওয়ার্দী আর কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের শক্তি প্রদর্শন; মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে পাল্টা হামলা চালিয়ে কলেজটির বিভিন্ন সামগ্রী ও সরঞ্জাম লুট করা হয়েছে। দিনভর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষে আহত হয়েছে অনেকে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে কোথাও অকস্মাৎ আক্রমণ হচ্ছে না, ঘোষণা দিয়ে হামলা করা হচ্ছে, ঘোষণা দিয়ে আক্রমণ করার মধ্যে বীরত্বের মহিমা রয়েছে। মোল্লা কলেজ অভিমুখে লাঠি হাতে ছাত্রদের বীরদর্পে হেঁটে যাওয়ার অভিযান প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী দেখতে দেখতে আমাদের মতো প্রবীণদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, কিন্তু এত দীর্ঘ সময়েও ছাত্রদের রোধ করতে কাউকে দেখা গেল না, ১০-২০ হাজার ছাত্রের ভুয়া ভুয়া চিৎকারে পুলিশ ছিল অসহায়।
বাংলাদেশে এগুলো এখন নিত্যদিনের ঘটনা। কিছুদিন ধরে একনাগাড়ে চলেছে শিক্ষক নির্যাতন ও বিতাড়ন। কিছুদিন পরপর ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, তিতুমীর কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই আর লুটপাট করে তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজছে। মুসল্লিদের দুইপক্ষের সংঘর্ষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এক জুমার নামাজের দিনে ছিল রণক্ষেত্র। গ্রেফতারকৃত আসামিদের ওপর আইনজীবীদের আক্রমণ চলেছে কিছুদিন।
অন্যদিকে কয়েক দিন আগে একজন আইনজীবীকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। এজলাসে ডিম মারা হয়েছে, ডিম মারা হয়েছে শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায়। প্রায় সবার মোবাইলের ইনবক্সে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনার ভিডিও আসে, সত্য-অসত্যের সংমিশ্রণ। গুজব আর মিথ্যার ছড়াছড়ি থাকলেও বাংলাদেশ যে ভয়াবহ নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কখনো শিক্ষক, কখনো আনসার, কখনো সনাতনী, কখনো ছাত্র, কখনো তাওহিদী জনতা তাদের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামছে। আইনানুগ প্রতিকার না থাকায় পরিবেশ-পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
সরকার মাঝে মাঝে কঠোর হওয়ার হুমকি দেয়, কিন্তু সেইম সাইড হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় হুমকির বাস্তবায়ন হয় না, বা হতে পারে না। কঠোর হওয়া মানে পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড আর টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ বা চরম পর্যায়ে গুলি করা। এগুলো স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বৈশিষ্ট্য, অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশকে এসব আচরণ করতে দিতে পারে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে বুঝতে হবে, যতই দিন যাচ্ছে সরকার ও দেশের কর্মকা-ের ওপর আন্তর্জাতিক নজরদারি ততই বাড়ছে। ইন্টারনেটের যুগে পৃথিবী হয়েছে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’, অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বহির্বিশ্বের সব প্রেসার নিস্তেজ করে দেয়া আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষেও সম্ভব হবে না।
স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের উচ্ছেদ হওয়ার পরও এসব অরাজকতা থামানো যাচ্ছে না; সর্বত্র সংঘাত, সংঘর্ষ আর লুটপাট। এসব ঘটনার পেছনে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের ইন্ধন ও ষড়যন্ত্র খোঁজা হচ্ছে। পাকিস্তান আমল থেকেই সব সরকার নিজের ব্যর্থতার হদিস খুঁজেছে বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রের মধ্যে। এখনো যদি একই প্রক্রিয়া-পদ্ধতিতে ষড়যন্ত্রের কথা বলে প্রকৃত অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়া হয়, তাহলে দেশের জনগণ আর কখনো ‘আদর্শ সরকার’-এর হদিস পাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা আছে, বিশ্বাস আছে, আগ্রহ আছে, দরদ আছে। তাই জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, শেয়ারের বাজারে ধস, আমানতের টাকা ফেরত দিতে ব্যাংকের অপারগতাও জনগণ নীরবে হজম করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের এই মমত্ববোধ ও সমমর্মিতাকে সরকারের সমীহ করা উচিত। রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের চেতনা যাতে কোনভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেদিকে সরকারকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। নতুবা ইতিহাসের কথিত পুনরাবৃত্তি পরবর্তীকালের দলীয় সরকারের হাতে বারবার হতেই থাকবে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
রোববার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪
রাজধানীর ঢাকা কলেজ ও সেন্ট্রাল আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছুদিন আগে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা আইডিয়াল কলেজের সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যায়। ঘটনা গুরুতর হলেও ঘটনার কারণ কিন্তু গুরুতর নয়। ঢাকা কলেজে একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা আইডিয়াল কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কথা কাটাকাটির জেরে মারধর করা হয়। এরপর থেকেই পাল্টাপাল্টি আক্রমণ। এই পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৮ জন ছাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।
২০১৭ সালে ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়; তার আগে কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। সাত কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সমস্যা নিরসন কল্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল করে স্বতন্ত্র নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার অধিভুক্ত করার দাবিতে বহুদিন আন্দোলন করেছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা। এই সাত কলেজের মধ্যে তিতুমীর কলেজও রয়েছে; কিন্তু তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি পক্ষ সাত কলেজের সমন্বয়ে প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে থাকতে চায় না; তারা চায়, তিতুমীর কলেজ আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় হোক। ১৯৯৭ সাল থেকে তারা এই দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের অন্যতম প্রধান যুক্তি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মাঝে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। শিক্ষার্থীরা কলেজের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন করেছে এবং তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে ট্রেন চালানোর কারণে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা চলন্ত ট্রেনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে বহু যাত্রীকে আহতও করেছে।
‘দিল্লির দাসত্বকারী’, ‘বাংলাদেশ ও ইসলামের শত্রু’, ‘পতিত সরকারের দোসর’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে ‘আলেম ওলামা ও তাওহিদী জনতাকে। বিক্ষোভকারীরা ‘ভারতীয় আগ্রাসন’ প্রতিরোধে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার পত্রিকার সামনে শুধু জুমার নামাজ আদায় করেননি, ‘জিয়াফত’ ও ‘জোড়া গরু জবেহ’ কর্মসূচি পালনের চেষ্টাও করেছেন। একটি গরুর ওপর লেখা ছিল ‘মতি গরু’। রাজশাহীতে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ছাড়াও প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সাইনবোর্ড ভাঙচুর করে তাতে আগুন দিয়েছে তাওহিদী জনতা। এই দুটি পত্রিকাকে পতিত সরকারের দোসর বলা হচ্ছে, অথচ এই দুইটি পত্রিকা সম্পর্কে শেখ হাসিনার অভিযোগ ছিল, ‘গোটা ২০টা বছর আমার রাজনীতির জীবনে এই পত্রিকাগুলো শুধু আমার বিরুদ্ধে কুৎসাই রটনা করে গেছে, আমার বিরুদ্ধে লিখে গেছে। আওয়ামী লীগ যেন তাদের শত্রু।’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সময় টেলিভিশন, ডিবিসি, একাত্তর টিভি, এটিএন বাংলা, এটিএন নিউজসহ কয়েকটি বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। এসব বিক্ষোভ নিয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গণমাধ্যমে ফ্যাসিবাদের এক শ্রেণীর দোসর সৃষ্টি হয়েছে। ফলে গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। তা ফিরিয়ে আনতে সাংবাদিকদেরই ভূমিকা পালন করতে হবে।’ কিন্তু আইনজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তার এবং শিক্ষকদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করার অভ্যাস তো নতুন নয়, এই অভ্যাসবশে ইতোমধ্যে অনেক সাংবাদিক অন্তর্বর্তী সরকারেরও দোসর হয়ে গেছেন; তথ্য উপদেষ্টা নিশ্চয়ই তা ইত্যবসরে বুঝতে পেরেছেন। দোসর সাংবাদিকদের তাবেদারি প্রশ্নের কারণেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজারে মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। কোন কোন মাজারে ঘোষণা দিয়ে একাধিকবার আক্রমণ হয়েছে, বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে মাজারের স্থাপনা। শাহপরান (রহ.)-এর মাজারে হামলায় একটি ছেলে মারাও গেছে। আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ সুফিবাদে বিশ্বাসী। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয়েছে সুফি দরবেশের মাধ্যমে। এখনো আমাদের দেশের বঙ বঙ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা সিলেটের হযরত শাহ জালাল দরগাহে গিয়ে কবর জিয়ারত করে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করার রেওয়াজ অক্ষুণœ রেখেছেন। বিখ্যাত দুইজন সুফি দরবেশের নামে দেশের প্রধান দুটি বিমানবন্দরের নামকরণ করা হয়েছে। আজকাল রাজনীতিবিদদের কবরকেও ‘মাজার’ বলা হয়। সৌদি আরবেও সাহাবাদের যেসব মাজার ছিল তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। আব্দুল ওয়াহাব নজদির দর্শনে অনুপ্রাণিত সৌদ বংশের শাসকরা এই মাজার ভাঙার সঙ্গে জড়িত ছিল। আব্দুল ওয়াহাব নজদি সুফিজম, ওলি-আউলিয়া, মুর্শিদ, মাজার জিয়ারত ইত্যাদিকে বিদআত, এমনকি শিরক হিসেবেও আখ্যা দেন।
সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও মোল্লা কলেজের ছাত্রদের মধ্যে মারামারি ও লুটতরাজের কাহিনী সাম্প্রতিককালের। এক ছাত্রের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর কারণে ন্যাশনাল মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী আর কবি নজরুল কলেজে মোল্লা কলেজের ছাত্ররা হামলা ও লুটপাট করেছে। পরবর্তী পালায় এসেছে সোহরাওয়ার্দী আর কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের শক্তি প্রদর্শন; মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে পাল্টা হামলা চালিয়ে কলেজটির বিভিন্ন সামগ্রী ও সরঞ্জাম লুট করা হয়েছে। দিনভর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষে আহত হয়েছে অনেকে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে কোথাও অকস্মাৎ আক্রমণ হচ্ছে না, ঘোষণা দিয়ে হামলা করা হচ্ছে, ঘোষণা দিয়ে আক্রমণ করার মধ্যে বীরত্বের মহিমা রয়েছে। মোল্লা কলেজ অভিমুখে লাঠি হাতে ছাত্রদের বীরদর্পে হেঁটে যাওয়ার অভিযান প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী দেখতে দেখতে আমাদের মতো প্রবীণদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, কিন্তু এত দীর্ঘ সময়েও ছাত্রদের রোধ করতে কাউকে দেখা গেল না, ১০-২০ হাজার ছাত্রের ভুয়া ভুয়া চিৎকারে পুলিশ ছিল অসহায়।
বাংলাদেশে এগুলো এখন নিত্যদিনের ঘটনা। কিছুদিন ধরে একনাগাড়ে চলেছে শিক্ষক নির্যাতন ও বিতাড়ন। কিছুদিন পরপর ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, তিতুমীর কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই আর লুটপাট করে তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজছে। মুসল্লিদের দুইপক্ষের সংঘর্ষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এক জুমার নামাজের দিনে ছিল রণক্ষেত্র। গ্রেফতারকৃত আসামিদের ওপর আইনজীবীদের আক্রমণ চলেছে কিছুদিন।
অন্যদিকে কয়েক দিন আগে একজন আইনজীবীকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। এজলাসে ডিম মারা হয়েছে, ডিম মারা হয়েছে শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায়। প্রায় সবার মোবাইলের ইনবক্সে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনার ভিডিও আসে, সত্য-অসত্যের সংমিশ্রণ। গুজব আর মিথ্যার ছড়াছড়ি থাকলেও বাংলাদেশ যে ভয়াবহ নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কখনো শিক্ষক, কখনো আনসার, কখনো সনাতনী, কখনো ছাত্র, কখনো তাওহিদী জনতা তাদের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামছে। আইনানুগ প্রতিকার না থাকায় পরিবেশ-পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
সরকার মাঝে মাঝে কঠোর হওয়ার হুমকি দেয়, কিন্তু সেইম সাইড হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় হুমকির বাস্তবায়ন হয় না, বা হতে পারে না। কঠোর হওয়া মানে পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড আর টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ বা চরম পর্যায়ে গুলি করা। এগুলো স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বৈশিষ্ট্য, অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশকে এসব আচরণ করতে দিতে পারে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে বুঝতে হবে, যতই দিন যাচ্ছে সরকার ও দেশের কর্মকা-ের ওপর আন্তর্জাতিক নজরদারি ততই বাড়ছে। ইন্টারনেটের যুগে পৃথিবী হয়েছে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’, অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বহির্বিশ্বের সব প্রেসার নিস্তেজ করে দেয়া আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষেও সম্ভব হবে না।
স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের উচ্ছেদ হওয়ার পরও এসব অরাজকতা থামানো যাচ্ছে না; সর্বত্র সংঘাত, সংঘর্ষ আর লুটপাট। এসব ঘটনার পেছনে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের ইন্ধন ও ষড়যন্ত্র খোঁজা হচ্ছে। পাকিস্তান আমল থেকেই সব সরকার নিজের ব্যর্থতার হদিস খুঁজেছে বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রের মধ্যে। এখনো যদি একই প্রক্রিয়া-পদ্ধতিতে ষড়যন্ত্রের কথা বলে প্রকৃত অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়া হয়, তাহলে দেশের জনগণ আর কখনো ‘আদর্শ সরকার’-এর হদিস পাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা আছে, বিশ্বাস আছে, আগ্রহ আছে, দরদ আছে। তাই জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, শেয়ারের বাজারে ধস, আমানতের টাকা ফেরত দিতে ব্যাংকের অপারগতাও জনগণ নীরবে হজম করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের এই মমত্ববোধ ও সমমর্মিতাকে সরকারের সমীহ করা উচিত। রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের চেতনা যাতে কোনভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেদিকে সরকারকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। নতুবা ইতিহাসের কথিত পুনরাবৃত্তি পরবর্তীকালের দলীয় সরকারের হাতে বারবার হতেই থাকবে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক]