মিহির কুমার রায়
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি এ সময়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে এটি ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির তীব্রতা শহরের তুলনায় বেশি, যেখানে অক্টোবর মাসে গ্রামীণ মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং শহুরে মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান নতুনভাবে মূল্যস্ফীতি হিসাব করার প্রয়োজনীয়তাকে সামনে এনেছে। বিবিএস বর্তমানে কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স (সিপিআই) পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। জাতিসংঘের নির্দেশিকা অনুযায়ী চালিত এই পদ্ধতিতে ৭৪৯টি পণ্য ও সেবার দাম বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে ২৪২টি খাদ্যপণ্য এবং ৫০৭টি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা অন্তর্ভুক্ত। তবে এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা হলো, কিছু পণ্য বাংলাদেশের বাজারে তেমন ব্যবহৃত হয় না, যা প্রকৃত মূল্যস্ফীতির চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ।
নতুন পদ্ধতি : কোর ইনফ্লেশন
বিশ্বের অনেক দেশ সিপিআইয়ের পাশাপাশি কোর ইনফ্লেশন পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। এই পদ্ধতিতে এমন পণ্যগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেগুলোর দাম স্থায়ী এবং নিয়মিত ওঠানামা করে না। বাংলাদেশে কোর ইনফ্লেশন চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে বিবিএস। এ পদ্ধতিতে দেশের মানুষ বেশি ভোগ করে এমন ৫০টি পণ্য অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে।
কোর ইনফ্লেশনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অস্থিতিশীল পণ্য, যেমন জ্বালানি তেল, পেঁয়াজ, মৌসুমি সবজি ইত্যাদি এই পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। বিবিএস জানিয়েছে, এই নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির আরও সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে। প্রথম ফলাফল পেতে কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগবে।
বিদ্যমান পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
বর্তমান সিপিআই পদ্ধতিতে এমন অনেক পণ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেগুলো সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়। এছাড়া খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে চাল ও মাছের মতো কিছু পণ্যের দাম সামান্য বাড়লেও পুরো সিপিআই সূচক ব্যাপক প্রভাবিত হয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরীর মতে, সিপিআই মানুষের আয়ের কতভাগ কোথায় ব্যয় হচ্ছে, জীবনমান কেমন, তা বুঝতে সাহায্য করে। তবে কোর ইনফ্লেশন মুদ্রানীতি নির্ধারণে কার্যকর হতে পারে।
কোর ইনফ্লেশন বনাম স্পেশাল সিপিআই
কোর ইনফ্লেশনের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা স্পেশাল সিপিআই পদ্ধতি চালুর ওপরও জোর দিচ্ছেন। এ পদ্ধতিতে নিম্নআয়ের মানুষ বেশি ব্যবহার করে এমন পণ্যের দামের ওঠানামা বিশ্লেষণ করা হয়। এটি সরকারের নীতি-নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে। বিবিএসের কর্মকর্তারা মনে করেন, স্পেশাল সিপিআই নিম্নআয়ের মানুষের জন্য আরও কার্যকর হবে।
মূল্যস্ফীতির মূল কারণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির মূল কারণ চাহিদা নয়, বরং সরবরাহজনিত সমস্যাগুলো। উৎপাদক থেকে ভোক্তাপর্যায়ে পণ্য সরবরাহে চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট এবং বাজার ব্যবস্থার ত্রুটিই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজনীয়তা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নীতিগত পদক্ষেপের পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছাও এ সংকট মোকাবিলায় জরুরি। অতীতে বিভিন্ন সরকার মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য প্রকাশ না করে নিজেদের সুবিধামতো উপস্থাপন করেছে। সঠিক তথ্যপ্রকাশ এবং বাস্তবভিত্তিক অর্থনৈতিক সূচক নির্ধারণ এখন সময়ের দাবি।
মূল্যস্ফীতি নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি যেমন কোর ইনফ্লেশন চালু করা প্রয়োজন, তেমনি বিদ্যমান সিপিআই পদ্ধতির আধুনিকায়নও অপরিহার্য। সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন পদ্ধতি দেশের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণ এবং সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
[লেখক : সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]
মিহির কুমার রায়
রোববার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি এ সময়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে এটি ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির তীব্রতা শহরের তুলনায় বেশি, যেখানে অক্টোবর মাসে গ্রামীণ মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং শহুরে মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান নতুনভাবে মূল্যস্ফীতি হিসাব করার প্রয়োজনীয়তাকে সামনে এনেছে। বিবিএস বর্তমানে কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স (সিপিআই) পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। জাতিসংঘের নির্দেশিকা অনুযায়ী চালিত এই পদ্ধতিতে ৭৪৯টি পণ্য ও সেবার দাম বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে ২৪২টি খাদ্যপণ্য এবং ৫০৭টি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা অন্তর্ভুক্ত। তবে এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা হলো, কিছু পণ্য বাংলাদেশের বাজারে তেমন ব্যবহৃত হয় না, যা প্রকৃত মূল্যস্ফীতির চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ।
নতুন পদ্ধতি : কোর ইনফ্লেশন
বিশ্বের অনেক দেশ সিপিআইয়ের পাশাপাশি কোর ইনফ্লেশন পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। এই পদ্ধতিতে এমন পণ্যগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেগুলোর দাম স্থায়ী এবং নিয়মিত ওঠানামা করে না। বাংলাদেশে কোর ইনফ্লেশন চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে বিবিএস। এ পদ্ধতিতে দেশের মানুষ বেশি ভোগ করে এমন ৫০টি পণ্য অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে।
কোর ইনফ্লেশনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অস্থিতিশীল পণ্য, যেমন জ্বালানি তেল, পেঁয়াজ, মৌসুমি সবজি ইত্যাদি এই পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। বিবিএস জানিয়েছে, এই নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির আরও সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে। প্রথম ফলাফল পেতে কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগবে।
বিদ্যমান পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
বর্তমান সিপিআই পদ্ধতিতে এমন অনেক পণ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেগুলো সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়। এছাড়া খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে চাল ও মাছের মতো কিছু পণ্যের দাম সামান্য বাড়লেও পুরো সিপিআই সূচক ব্যাপক প্রভাবিত হয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরীর মতে, সিপিআই মানুষের আয়ের কতভাগ কোথায় ব্যয় হচ্ছে, জীবনমান কেমন, তা বুঝতে সাহায্য করে। তবে কোর ইনফ্লেশন মুদ্রানীতি নির্ধারণে কার্যকর হতে পারে।
কোর ইনফ্লেশন বনাম স্পেশাল সিপিআই
কোর ইনফ্লেশনের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা স্পেশাল সিপিআই পদ্ধতি চালুর ওপরও জোর দিচ্ছেন। এ পদ্ধতিতে নিম্নআয়ের মানুষ বেশি ব্যবহার করে এমন পণ্যের দামের ওঠানামা বিশ্লেষণ করা হয়। এটি সরকারের নীতি-নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে। বিবিএসের কর্মকর্তারা মনে করেন, স্পেশাল সিপিআই নিম্নআয়ের মানুষের জন্য আরও কার্যকর হবে।
মূল্যস্ফীতির মূল কারণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির মূল কারণ চাহিদা নয়, বরং সরবরাহজনিত সমস্যাগুলো। উৎপাদক থেকে ভোক্তাপর্যায়ে পণ্য সরবরাহে চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট এবং বাজার ব্যবস্থার ত্রুটিই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজনীয়তা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নীতিগত পদক্ষেপের পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছাও এ সংকট মোকাবিলায় জরুরি। অতীতে বিভিন্ন সরকার মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য প্রকাশ না করে নিজেদের সুবিধামতো উপস্থাপন করেছে। সঠিক তথ্যপ্রকাশ এবং বাস্তবভিত্তিক অর্থনৈতিক সূচক নির্ধারণ এখন সময়ের দাবি।
মূল্যস্ফীতি নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি যেমন কোর ইনফ্লেশন চালু করা প্রয়োজন, তেমনি বিদ্যমান সিপিআই পদ্ধতির আধুনিকায়নও অপরিহার্য। সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন পদ্ধতি দেশের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণ এবং সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
[লেখক : সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]