পাভেল পার্থ
রাজশাহী শহরের হাজারখানেক পুকুরের ভেতর মাত্র সাড়ে তিনশ পুকুর কোনোমতে টিকে আছে। পদ্মা-মহানন্দা অববাহিকার এই প্রাচীন শহরটি ক্রমশই রুক্ষ, পানিহীন ও প্রাণহীন হয়ে ওঠছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে অবস্থিত এই শহরের পাতালপানির আধার প্রতিদিন নিখোঁজ হচ্ছে। নিখোঁজ পানির খোঁজে পিপাসার্ত মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রতিদিন ৪৬ মিলিয়ন লিটার পানির ঘাটতি রয়েছে রাজশাহী শহরে। ২০৩০ সালের ভেতর জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা অঙ্গীকার করেছি। ঘোষণা করেছি, কাউকে পেছনে ফেলে উন্নয়ন নয়। কিন্তু পানির হাহাকার তো পেছন থেকে আরও পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে।
২০৩০ সালে রাজশাহীতে আমরা একবিন্দু পানি আর খুঁজে পাব তো? নাকি আমরা বোতলবন্দি পানি আমদানি ও ক্রয় করার মতো ‘আজগুবি সক্ষমতা’ অর্জন করব? তবে পাতাল বা ভূমিজ পানিকে আগলে রাখলেই কী আমরা সেই পানি পান করতে পারব? কে আমাদের আশ^াস দেবে সেই পানিতে বিষ ও ভারী ধাতু থাকবে না। গ্রাম-শহরের গরিব মানুষেরা পানিতে বিষ মেশাননি, পানির আধার দখল ও লুণ্ঠন করেননি। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে একতরফা দোষ দেই আমরা যে মেশিন দিয়ে পাতালপানি টেনে তুলে তারাই শূন্য করেছে। কিন্তু পাতালপানি শূন্যকরণের এই মর্মন্তুদ পরিকল্পনা কি শুধু এই প্রতিষ্ঠানের? কোনোভাবেই না। এটি বৈশি^ক ক্ষমতাকাঠামো এবং কলোনিয়াল উন্নয়ন বাহাদুরির সঙ্গে জড়িত। ষাটের দশকে ‘সবুজবিপ্লব’ প্রকল্পের মাধ্যমে মেশিন দিয়ে পাতাল পানি উত্তোলন এবং মাটিতে বিষ মিশিয়ে দেয়ার এই তা-ব শুরু হয়। কনসালটেটিভ গ্রুপ অন ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (সিজিআইএআর), বহুপাক্ষিক ব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানিরা জোটবদ্ধ হয়ে এই সর্বনাশ বিশ^ময় প্রতিষ্ঠা করেছে। আজ তৃষ্ণার্ত, বিষাক্ত, খানখান এক ভঙ্গুর পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে ওইসব মুনাফাখোরেরা বলছে, ‘সবুজবিপ্লব প্রকল্প’ আসলেই পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সংকটে ঠেলে দিয়েছে। এখন এই সংকটের দায়ভার কে নেবে? কিন্তু কিছু ক্ষমতাধরের মুনাফা বৃদ্ধিকরণ সিদ্ধান্তের কারণে আজ কেন পাতালপানি হারাবে বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল, উপকূল কিংবা হাওরাঞ্চল?
বহু প্রমাণ আছে বৈশি^ক ক্ষমতাকাঠামো এবং তার লেজুড় বহুজাতিক কোম্পানিরা জাতিরাষ্ট্রের আইন, নীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে। কৃষি, পানি, ভূমি, খনিজ, জ¦ালানি, বাণিজ্য কিংবা খাদ্যব্যবস্থা সবকিছুই। আর এই সামগ্রিক দুরাবস্থা বৈধভাবে জারি থাকছে অন্যায্য পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও নিওলিবারেল রাজনৈতিক বাহাদুরির কারণেই। এই দোর্দন্ড প্রতাপ চুরমার না হলে আরো পানিশূণ্য হবে এই দেশ। নদী, নালা, খাল, খাড়ি, ছড়া, ঝিরি, হাওর, বাঁওড়, বিল, দীঘি, পুকুর, ডোবাকে খুন ও লুট করে এই যে পাতালপানির পেছনে আমাদের অবিরাম ছুটে চলা একে থামানো জরুরি। সব পানি হারিয়ে গেলে এরপর আমরা কার পেছনে ছুটবো? এই গ্রহ ছাড়িয়ে আরেক কোনো গ্রহ কিংবা গ্যালাক্সিতে কী আমরা পানির জন্য ছুটব? এটা কী সায়েন্স ফিকশন? এইটা আমাদের জীবন। আমাদের জীবন এতটাই মমতাময়, যা, মাটি ও পানির ব্যাকরণ পাঠ করে গড়ে ওঠেছিল। বৈশি^ক ক্ষমতা, মুনাফা ও কর্তৃত্বের ভেতর দিয়ে একে চুরমার করার দরকার ছিল না। আজ জলবায়ু সম্মেলনের বিশ^মঞ্চে এই রুগ্ণ দুনিয়াকে বাঁচাতে আমরা অস্থির, দিশেহারা, ক্ষুব্ধ ও হতাশ। বিশ^নেতৃত্ব কোনো আওয়াজ কিংবা প্রমাণ তোয়াক্কা করছে না।
কেবল রাজশাহী বা ঢাকা নয়; আজ বিশে^র বহু নগর নানাভাবে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। কমছে পানি ও সবুজ বলয়, বাড়ছে ধুলি ও আলোকদূষণ, বায়ু ও শব্দদূষণ। সবকিছু কমলেও শহরে প্রতিদিন বাড়ছে রোগশোক, ভোগান্তি ও তীব্র অনিশ্চয়তা। দেশের প্রতিটি শহরের ঘরে ঘরে শিশু, প্রবীণ ও প্রসূতি মায়েদের বিচিত্রসব সর্দি-কাশি, জ¦র, এলার্জি, শ^াসকষ্ট বাড়ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ ও ভয়াবহতা একরত্তিও কমেনি। ডেঙ্গুতে প্রশ্নহীন মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারছে না কেউ। নগরে প্রতিটি ঘরে ঘরে জ¦র হলেই আশংকা ও আর্তি। নাগরিক জীবনের এই যন্ত্রণা আর ভোগান্তির দায় ও দায়িত্ব নিতে রাষ্ট্র এখনো সক্রিয় নয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে। বিগত কর্তৃত্ববাদী রেজিমের পতন হলেও এখনো ডেঙ্গু কিংবা বায়ুদূষণের তীব্রতা বিন্দুমাত্র থামেনি। কেন থামছে না সেসব প্রশ্নও জোরালোভাবে ওঠছে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক কমিটি, রাজনৈতিক দল কিংবা নাগরিক আন্দোলনকে এসব সংকট ও বৈষম্য নিয়ে সোচ্চার হওয়া জরুরি। ডেঙ্গু ও বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যু ও ভোগান্তি কাঠামোগত বৈষম্য এবং জলবায়ুগত সংকটের ফলাফল। নাগরিক জীবনে এমন যন্ত্রণা ও মৃত্যু-আশংকা জিইয়ে রেখে তাহলে কীভাবে আমরা রাষ্ট্র সংস্কার করব? নাকি ডেঙ্গু মশা সবাইকে কামড়াবে না এমন শর্ত আছে। শুধু ফুটপাত, বস্তি, দালান, শ্রেণীকক্ষ, বাজার, শপিংমল, পরিবহন কিংবা পার্ক নয়; সচিবালয় থেকে মন্ত্রণালয় সব স্থানই কিন্তু ডেঙ্গু ও বায়ুদূষণের বিপদের মুখোমুখি।
তাহলে বাঁচামরার সঙ্গে সম্পর্কিত এই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমরা সুরাহা করতে পারছি না কেন? প্রতিদিনের নাগরিক যন্ত্রণাগুলো জিইয়ে রেখে আমাদের তর্ক শুধু টিপ, জিয়াফত, ইসকন, মাজার কিংবা মব-ভায়োলেন্সে সীমাবদ্ধ হয়ে ওঠছে। বরং ডেঙ্গু, বায়ুদূষণ, বাজারমূল্য কিংবা উৎপাদন ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের বেশি কাজ করা জরুরি। প্রথমত শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার প্রবণতাগুলো আমাদের অর্জন করতে হবে। মৌলিক মানবাধিকারগুলো শর্তহীনভাবে সবার জন্য সমতারভিত্তিতে নিশ্চিত হতে হবে। এজন্য আমাদের চারধার, শহর থেকে গ্রাম, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বাস্তুতন্ত্রে শংকামুক্ত সৃজনশীল কর্মমুখর তৎপরতাকে চাঙ্গা রাখতে হবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের দায়িত্বশীল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রাণময় সম্পর্ক মজবুত করতে হবে। হতে পারে সেই প্রতিবেশী শিশু, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী মানুষ, দলিত, আদিবাসী, নারী, পুরুষ কিংবা জেন্ডারবৈচিত্র্যের। ধর্ম, পেশা, ভাষা, ভূগোল ভিন্নতায় নানা শ্রেণী ও বর্গের। প্রতিবেশী হতে পারে গাছ, পাখি, অরণ্য, পাহাড়, কৃষিজমি, নদী, উদ্যান, খেলার মাঠ, মঞ্চ, ময়দান, জলাভূমি, ধান, কুকুর, বিড়াল কিংবা মৌমাছি। নিজেদের ইতিহাস, বাস্তুতন্ত্র, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের তুমুল আওয়াজ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন ও উদাসীন হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই আমাদের বিকাশকে গতিশীল করবে না। নাগরিক দুর্ভোগ এবং উৎপাদন সম্পর্ককে তাই রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান বিবেচ্য হিসেবে চিন্তা করতে হবে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণের আওয়াজ তুলেছে, সব কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা-বাহাদুরির বিরুদ্ধে গ্রাফিতি এঁকেছে। আমরা রক্তমাখা এইসব আওয়াজ ও গ্রাফিতিকে ভুলে যেতে পারি না। তাহলে নাগরিক দুর্ভোগ এবং উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত বহুমুখী কর্তৃত্ববাদকে আমাদের পরতে পরতে চিহ্নিত করতে হবে। প্রাকৃতিক ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে জানা বোঝার ন্যায্য পরিসর তৈরি করতে হবে। নাগরিক জীবনের দুর্ভোগ ও নিয়ন্ত্রিত উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রশ্নহীন দখল ও দূষণ। প্রমাণিত হয়েছে দখল ও দূষণ মূলত লাগামহীন দুর্নীতির ফলাফল। কর্তৃত্ববাদী রেজিম থেকে শুরু করে বৈশি^ক নিওলিবারেল ক্ষমতা কাঠামোর জবরদস্ত অন্যায় দুর্নীতি এই দুঃসহ নির্দয় ভোগান্তি প্রবল করেছে। এই ভোগান্তিকে জবরদস্তি করে ঢাকবার জন্য আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে খুল্লামখুল্লা ভোগবাদ।
ডেঙ্গুতে কিছু মানুষ মরবেই, বড় শহরে বাতাস দূষিতই থাকে, শিশু আর প্রবীণের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাই অসুখ-বিসুখ লেগে থাকবেই, যুদ্ধের কারণে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই, সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে মাস্তি করতে হবে। দূষিত নগরে ডেঙ্গু কি বায়ু-দূষণে মৃতদের লাশ মাড়িয়ে আমরা তাই মাস্তি করতে নামি কোনো বহুজাতিক ফুড চেইনশপে। যাদের কেউ কেউ ভরা পেটে প্যালেস্টাইনে গণহত্যা করার জন্য ইসরায়েলে খাবারের দোকান খুলেছে। প্রতিবেশ ও প্রতিবেশীর সব যন্ত্রণা আড়াল করে হয়তো আমরা টগবগিয়ে গিলতে থাকি কর্পোরেট খাদ্য ও পানীয়। যারা হয়তো বিশ^ব্যাপী প্লাস্টিক দূষণের জন্য দায়ী, বনবিনাশ কিংবা পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। বৈশি^ক ক্ষমতা কাঠামোর রাজনীতি ও মুনাফানির্ভর অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত চলমান নিওলিবারেল ব্যবস্থায় বেড়ে ওঠেছে বাংলাদেশের জেন-জি তরুণ প্রজন্ম জুলাই গণঅভ্যুত্থান জন্ম দিয়েছে। বিশ^ব্যাপী তরুণ প্রজন্ম জাগছে। বিষমুক্ত নিরাপদ পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন ও জলবায়ু ন্যায্যতার লড়াই দীর্ঘতর হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তরুণ প্রজন্মের এই সাহসী জিজ্ঞাসাগুলোকে পাঠ ও বিবেচনায় আনতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার কর্মকৌশলে নাগরিক দুর্ভোগ এবং দেশের জন-উৎপাদনব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে গুরুত্ব দিতে হবে।
কেবল বাংলাদেশ নয়; সমগ্র বিশ^ আমরা এক অস্থির আর জটিল সন্ধিক্ষণের ভেতর আছি। যুদ্ধ ও গণহত্যা জারি রেখে এই দুনিয়াতে আমরা ঠিকই ফুর্তি করতে পারছি। পিপাসার্ত ও ক্ষুধার্ত মানুষের দীর্ঘতর সারির সামনেই আমরা কী কেমন ভরপেট ঘুম দেই। পিটিয়ে হাতি, বিষ দিয়ে কুকুর কিংবা একের পর এক গাছ হত্যা করলেও আমাদের কলিজায় কোনো ছলকানি নাই। বন্যা, লবণ পানি, খরা, পাহাড়ি ঢল বা অনাবৃষ্টিতে ক্লান্ত কাহিল গ্রামের পর গ্রাম দুর্গত জীবনের দিকে তাকানোর আমাদের সময় কই? সবকিছু অগ্রাহ্য আর আড়াল করে আমরা কী পারছি আমাদের সুস্থ, নিরাপদ ও ভালো রাখতে? আমরা কী ডেঙ্গু, বায়ু দূষণ বা তীব্র তাপদাহের শংকা ও সংঘাত থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারছি? অগ্রাহ্য, অস্বীকার, আড়াল বা দেখে না দেখার ভান করা এই নিওলিবারেল বাস্তবতায় কোনো সমাধান নয়। প্রশ্ন করা, জিজ্ঞাসা তৈরি করা, বাহাস জিইয়ে রাখা, অনুশীলন গুলো জারি রাখা এবং আওয়াজ ওঠানোই এই বৈষম্যমূলক কর্তৃত্ববাদী বৈশি^ক ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে সমাধানের পথ। হুল-তেভাগা থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান আওয়াজ তোলার দৃষ্টান্তই রেখে গেছে। নাগরিক হিসেবে তাই আমাদের দায় ও দায়িত্ব আছে। নিজের প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের সম্পর্ককে জোরালো ও মজবুত করতে হবে। প্রাকৃতিক ও সামাজিক বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষায় প্রতিজনের ভূমিকাকে স্পষ্ট করতে হবে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে জনজিজ্ঞাসাগুলিকে মর্যাদার ভিত্তিতে প্রকাশ ও প্রচার করতে সচেষ্ট হতে হবে। মিডিয়া-মুনাফাকেই একমাত্র বিবেচনায় না এনে, নাগরিক জীবনের চলমান দুর্ভোগ এবং জন-উৎপাদন ব্যবস্থার প্রশ্নগুলিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
জন্মভূমি, জন্মমাটি ও দেশ নিয়ে বহু সামাজিক রূপকল্প এবং পাবলিক ডিসকোর্স আছে। সচরাচর যেমন বলা হয়, ‘আমার দেশ, আমার মা’। দেশকে ‘মা’ হিসেবে রূপকাছু নিয়েও বহু তর্ক আছে। প্রতিবেশ-নারীবাদীদের সেই প্রশ্ন এখানে টানছি। ‘দেশ’র সীমানা ও জমানা নিয়ে ভাবনাগুলো নানা শ্রেণী, বর্গ ও জাতিতে ভিন্ন ভিন্ন। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া গ্রাম থেকে শহরে আসা রিকশাচালক-কৃষক গ্রামে যাওয়ার সময় বলেন ‘দেশে যাই’। কারও কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক। ডেঙ্গু, বায়ুদূষণ, বাজারমূল্য, যানজটের মতো অসহনীয় অমীমাংসিত নাগরিক যন্ত্রণার ভেতর আমার সামনে বারবার জাতীয় সংগীত ভেসে আসে। ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়ন জলে ভাসি’। নাগরিক, সরকার ও রাষ্ট্র আমাদের সবার দায় ও দায়িত্ব দেশের চোখের পানি মুছে দেয়া। নাগরিক দুর্ভোগ ও উৎপাদনব্যবস্থার জিজ্ঞাসাগুলোকে আমরা যত বেশি গুরুত্ব দেব, ততই মায়ের চেহারা থেকে মলিনতা দূর হতে থাকবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেশের মলিনতাকে ‘বৈষম্য’ হিসেবে পাঠ করেছে। দায় ও দরদের রাজনীতিকে এই পাঠ অব্যাহত রাখতে হবে।
[লেখক : গবেষক, পরিবেশ-প্রতিবেশ ]
পাভেল পার্থ
সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪
রাজশাহী শহরের হাজারখানেক পুকুরের ভেতর মাত্র সাড়ে তিনশ পুকুর কোনোমতে টিকে আছে। পদ্মা-মহানন্দা অববাহিকার এই প্রাচীন শহরটি ক্রমশই রুক্ষ, পানিহীন ও প্রাণহীন হয়ে ওঠছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে অবস্থিত এই শহরের পাতালপানির আধার প্রতিদিন নিখোঁজ হচ্ছে। নিখোঁজ পানির খোঁজে পিপাসার্ত মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রতিদিন ৪৬ মিলিয়ন লিটার পানির ঘাটতি রয়েছে রাজশাহী শহরে। ২০৩০ সালের ভেতর জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা অঙ্গীকার করেছি। ঘোষণা করেছি, কাউকে পেছনে ফেলে উন্নয়ন নয়। কিন্তু পানির হাহাকার তো পেছন থেকে আরও পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে।
২০৩০ সালে রাজশাহীতে আমরা একবিন্দু পানি আর খুঁজে পাব তো? নাকি আমরা বোতলবন্দি পানি আমদানি ও ক্রয় করার মতো ‘আজগুবি সক্ষমতা’ অর্জন করব? তবে পাতাল বা ভূমিজ পানিকে আগলে রাখলেই কী আমরা সেই পানি পান করতে পারব? কে আমাদের আশ^াস দেবে সেই পানিতে বিষ ও ভারী ধাতু থাকবে না। গ্রাম-শহরের গরিব মানুষেরা পানিতে বিষ মেশাননি, পানির আধার দখল ও লুণ্ঠন করেননি। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে একতরফা দোষ দেই আমরা যে মেশিন দিয়ে পাতালপানি টেনে তুলে তারাই শূন্য করেছে। কিন্তু পাতালপানি শূন্যকরণের এই মর্মন্তুদ পরিকল্পনা কি শুধু এই প্রতিষ্ঠানের? কোনোভাবেই না। এটি বৈশি^ক ক্ষমতাকাঠামো এবং কলোনিয়াল উন্নয়ন বাহাদুরির সঙ্গে জড়িত। ষাটের দশকে ‘সবুজবিপ্লব’ প্রকল্পের মাধ্যমে মেশিন দিয়ে পাতাল পানি উত্তোলন এবং মাটিতে বিষ মিশিয়ে দেয়ার এই তা-ব শুরু হয়। কনসালটেটিভ গ্রুপ অন ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (সিজিআইএআর), বহুপাক্ষিক ব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানিরা জোটবদ্ধ হয়ে এই সর্বনাশ বিশ^ময় প্রতিষ্ঠা করেছে। আজ তৃষ্ণার্ত, বিষাক্ত, খানখান এক ভঙ্গুর পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে ওইসব মুনাফাখোরেরা বলছে, ‘সবুজবিপ্লব প্রকল্প’ আসলেই পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সংকটে ঠেলে দিয়েছে। এখন এই সংকটের দায়ভার কে নেবে? কিন্তু কিছু ক্ষমতাধরের মুনাফা বৃদ্ধিকরণ সিদ্ধান্তের কারণে আজ কেন পাতালপানি হারাবে বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল, উপকূল কিংবা হাওরাঞ্চল?
বহু প্রমাণ আছে বৈশি^ক ক্ষমতাকাঠামো এবং তার লেজুড় বহুজাতিক কোম্পানিরা জাতিরাষ্ট্রের আইন, নীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে। কৃষি, পানি, ভূমি, খনিজ, জ¦ালানি, বাণিজ্য কিংবা খাদ্যব্যবস্থা সবকিছুই। আর এই সামগ্রিক দুরাবস্থা বৈধভাবে জারি থাকছে অন্যায্য পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও নিওলিবারেল রাজনৈতিক বাহাদুরির কারণেই। এই দোর্দন্ড প্রতাপ চুরমার না হলে আরো পানিশূণ্য হবে এই দেশ। নদী, নালা, খাল, খাড়ি, ছড়া, ঝিরি, হাওর, বাঁওড়, বিল, দীঘি, পুকুর, ডোবাকে খুন ও লুট করে এই যে পাতালপানির পেছনে আমাদের অবিরাম ছুটে চলা একে থামানো জরুরি। সব পানি হারিয়ে গেলে এরপর আমরা কার পেছনে ছুটবো? এই গ্রহ ছাড়িয়ে আরেক কোনো গ্রহ কিংবা গ্যালাক্সিতে কী আমরা পানির জন্য ছুটব? এটা কী সায়েন্স ফিকশন? এইটা আমাদের জীবন। আমাদের জীবন এতটাই মমতাময়, যা, মাটি ও পানির ব্যাকরণ পাঠ করে গড়ে ওঠেছিল। বৈশি^ক ক্ষমতা, মুনাফা ও কর্তৃত্বের ভেতর দিয়ে একে চুরমার করার দরকার ছিল না। আজ জলবায়ু সম্মেলনের বিশ^মঞ্চে এই রুগ্ণ দুনিয়াকে বাঁচাতে আমরা অস্থির, দিশেহারা, ক্ষুব্ধ ও হতাশ। বিশ^নেতৃত্ব কোনো আওয়াজ কিংবা প্রমাণ তোয়াক্কা করছে না।
কেবল রাজশাহী বা ঢাকা নয়; আজ বিশে^র বহু নগর নানাভাবে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। কমছে পানি ও সবুজ বলয়, বাড়ছে ধুলি ও আলোকদূষণ, বায়ু ও শব্দদূষণ। সবকিছু কমলেও শহরে প্রতিদিন বাড়ছে রোগশোক, ভোগান্তি ও তীব্র অনিশ্চয়তা। দেশের প্রতিটি শহরের ঘরে ঘরে শিশু, প্রবীণ ও প্রসূতি মায়েদের বিচিত্রসব সর্দি-কাশি, জ¦র, এলার্জি, শ^াসকষ্ট বাড়ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ ও ভয়াবহতা একরত্তিও কমেনি। ডেঙ্গুতে প্রশ্নহীন মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারছে না কেউ। নগরে প্রতিটি ঘরে ঘরে জ¦র হলেই আশংকা ও আর্তি। নাগরিক জীবনের এই যন্ত্রণা আর ভোগান্তির দায় ও দায়িত্ব নিতে রাষ্ট্র এখনো সক্রিয় নয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে। বিগত কর্তৃত্ববাদী রেজিমের পতন হলেও এখনো ডেঙ্গু কিংবা বায়ুদূষণের তীব্রতা বিন্দুমাত্র থামেনি। কেন থামছে না সেসব প্রশ্নও জোরালোভাবে ওঠছে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক কমিটি, রাজনৈতিক দল কিংবা নাগরিক আন্দোলনকে এসব সংকট ও বৈষম্য নিয়ে সোচ্চার হওয়া জরুরি। ডেঙ্গু ও বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যু ও ভোগান্তি কাঠামোগত বৈষম্য এবং জলবায়ুগত সংকটের ফলাফল। নাগরিক জীবনে এমন যন্ত্রণা ও মৃত্যু-আশংকা জিইয়ে রেখে তাহলে কীভাবে আমরা রাষ্ট্র সংস্কার করব? নাকি ডেঙ্গু মশা সবাইকে কামড়াবে না এমন শর্ত আছে। শুধু ফুটপাত, বস্তি, দালান, শ্রেণীকক্ষ, বাজার, শপিংমল, পরিবহন কিংবা পার্ক নয়; সচিবালয় থেকে মন্ত্রণালয় সব স্থানই কিন্তু ডেঙ্গু ও বায়ুদূষণের বিপদের মুখোমুখি।
তাহলে বাঁচামরার সঙ্গে সম্পর্কিত এই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমরা সুরাহা করতে পারছি না কেন? প্রতিদিনের নাগরিক যন্ত্রণাগুলো জিইয়ে রেখে আমাদের তর্ক শুধু টিপ, জিয়াফত, ইসকন, মাজার কিংবা মব-ভায়োলেন্সে সীমাবদ্ধ হয়ে ওঠছে। বরং ডেঙ্গু, বায়ুদূষণ, বাজারমূল্য কিংবা উৎপাদন ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের বেশি কাজ করা জরুরি। প্রথমত শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার প্রবণতাগুলো আমাদের অর্জন করতে হবে। মৌলিক মানবাধিকারগুলো শর্তহীনভাবে সবার জন্য সমতারভিত্তিতে নিশ্চিত হতে হবে। এজন্য আমাদের চারধার, শহর থেকে গ্রাম, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বাস্তুতন্ত্রে শংকামুক্ত সৃজনশীল কর্মমুখর তৎপরতাকে চাঙ্গা রাখতে হবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের দায়িত্বশীল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রাণময় সম্পর্ক মজবুত করতে হবে। হতে পারে সেই প্রতিবেশী শিশু, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী মানুষ, দলিত, আদিবাসী, নারী, পুরুষ কিংবা জেন্ডারবৈচিত্র্যের। ধর্ম, পেশা, ভাষা, ভূগোল ভিন্নতায় নানা শ্রেণী ও বর্গের। প্রতিবেশী হতে পারে গাছ, পাখি, অরণ্য, পাহাড়, কৃষিজমি, নদী, উদ্যান, খেলার মাঠ, মঞ্চ, ময়দান, জলাভূমি, ধান, কুকুর, বিড়াল কিংবা মৌমাছি। নিজেদের ইতিহাস, বাস্তুতন্ত্র, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের তুমুল আওয়াজ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন ও উদাসীন হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই আমাদের বিকাশকে গতিশীল করবে না। নাগরিক দুর্ভোগ এবং উৎপাদন সম্পর্ককে তাই রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান বিবেচ্য হিসেবে চিন্তা করতে হবে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণের আওয়াজ তুলেছে, সব কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা-বাহাদুরির বিরুদ্ধে গ্রাফিতি এঁকেছে। আমরা রক্তমাখা এইসব আওয়াজ ও গ্রাফিতিকে ভুলে যেতে পারি না। তাহলে নাগরিক দুর্ভোগ এবং উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত বহুমুখী কর্তৃত্ববাদকে আমাদের পরতে পরতে চিহ্নিত করতে হবে। প্রাকৃতিক ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে জানা বোঝার ন্যায্য পরিসর তৈরি করতে হবে। নাগরিক জীবনের দুর্ভোগ ও নিয়ন্ত্রিত উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রশ্নহীন দখল ও দূষণ। প্রমাণিত হয়েছে দখল ও দূষণ মূলত লাগামহীন দুর্নীতির ফলাফল। কর্তৃত্ববাদী রেজিম থেকে শুরু করে বৈশি^ক নিওলিবারেল ক্ষমতা কাঠামোর জবরদস্ত অন্যায় দুর্নীতি এই দুঃসহ নির্দয় ভোগান্তি প্রবল করেছে। এই ভোগান্তিকে জবরদস্তি করে ঢাকবার জন্য আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে খুল্লামখুল্লা ভোগবাদ।
ডেঙ্গুতে কিছু মানুষ মরবেই, বড় শহরে বাতাস দূষিতই থাকে, শিশু আর প্রবীণের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাই অসুখ-বিসুখ লেগে থাকবেই, যুদ্ধের কারণে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই, সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে মাস্তি করতে হবে। দূষিত নগরে ডেঙ্গু কি বায়ু-দূষণে মৃতদের লাশ মাড়িয়ে আমরা তাই মাস্তি করতে নামি কোনো বহুজাতিক ফুড চেইনশপে। যাদের কেউ কেউ ভরা পেটে প্যালেস্টাইনে গণহত্যা করার জন্য ইসরায়েলে খাবারের দোকান খুলেছে। প্রতিবেশ ও প্রতিবেশীর সব যন্ত্রণা আড়াল করে হয়তো আমরা টগবগিয়ে গিলতে থাকি কর্পোরেট খাদ্য ও পানীয়। যারা হয়তো বিশ^ব্যাপী প্লাস্টিক দূষণের জন্য দায়ী, বনবিনাশ কিংবা পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। বৈশি^ক ক্ষমতা কাঠামোর রাজনীতি ও মুনাফানির্ভর অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত চলমান নিওলিবারেল ব্যবস্থায় বেড়ে ওঠেছে বাংলাদেশের জেন-জি তরুণ প্রজন্ম জুলাই গণঅভ্যুত্থান জন্ম দিয়েছে। বিশ^ব্যাপী তরুণ প্রজন্ম জাগছে। বিষমুক্ত নিরাপদ পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন ও জলবায়ু ন্যায্যতার লড়াই দীর্ঘতর হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তরুণ প্রজন্মের এই সাহসী জিজ্ঞাসাগুলোকে পাঠ ও বিবেচনায় আনতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার কর্মকৌশলে নাগরিক দুর্ভোগ এবং দেশের জন-উৎপাদনব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে গুরুত্ব দিতে হবে।
কেবল বাংলাদেশ নয়; সমগ্র বিশ^ আমরা এক অস্থির আর জটিল সন্ধিক্ষণের ভেতর আছি। যুদ্ধ ও গণহত্যা জারি রেখে এই দুনিয়াতে আমরা ঠিকই ফুর্তি করতে পারছি। পিপাসার্ত ও ক্ষুধার্ত মানুষের দীর্ঘতর সারির সামনেই আমরা কী কেমন ভরপেট ঘুম দেই। পিটিয়ে হাতি, বিষ দিয়ে কুকুর কিংবা একের পর এক গাছ হত্যা করলেও আমাদের কলিজায় কোনো ছলকানি নাই। বন্যা, লবণ পানি, খরা, পাহাড়ি ঢল বা অনাবৃষ্টিতে ক্লান্ত কাহিল গ্রামের পর গ্রাম দুর্গত জীবনের দিকে তাকানোর আমাদের সময় কই? সবকিছু অগ্রাহ্য আর আড়াল করে আমরা কী পারছি আমাদের সুস্থ, নিরাপদ ও ভালো রাখতে? আমরা কী ডেঙ্গু, বায়ু দূষণ বা তীব্র তাপদাহের শংকা ও সংঘাত থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারছি? অগ্রাহ্য, অস্বীকার, আড়াল বা দেখে না দেখার ভান করা এই নিওলিবারেল বাস্তবতায় কোনো সমাধান নয়। প্রশ্ন করা, জিজ্ঞাসা তৈরি করা, বাহাস জিইয়ে রাখা, অনুশীলন গুলো জারি রাখা এবং আওয়াজ ওঠানোই এই বৈষম্যমূলক কর্তৃত্ববাদী বৈশি^ক ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে সমাধানের পথ। হুল-তেভাগা থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান আওয়াজ তোলার দৃষ্টান্তই রেখে গেছে। নাগরিক হিসেবে তাই আমাদের দায় ও দায়িত্ব আছে। নিজের প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের সম্পর্ককে জোরালো ও মজবুত করতে হবে। প্রাকৃতিক ও সামাজিক বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষায় প্রতিজনের ভূমিকাকে স্পষ্ট করতে হবে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে জনজিজ্ঞাসাগুলিকে মর্যাদার ভিত্তিতে প্রকাশ ও প্রচার করতে সচেষ্ট হতে হবে। মিডিয়া-মুনাফাকেই একমাত্র বিবেচনায় না এনে, নাগরিক জীবনের চলমান দুর্ভোগ এবং জন-উৎপাদন ব্যবস্থার প্রশ্নগুলিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
জন্মভূমি, জন্মমাটি ও দেশ নিয়ে বহু সামাজিক রূপকল্প এবং পাবলিক ডিসকোর্স আছে। সচরাচর যেমন বলা হয়, ‘আমার দেশ, আমার মা’। দেশকে ‘মা’ হিসেবে রূপকাছু নিয়েও বহু তর্ক আছে। প্রতিবেশ-নারীবাদীদের সেই প্রশ্ন এখানে টানছি। ‘দেশ’র সীমানা ও জমানা নিয়ে ভাবনাগুলো নানা শ্রেণী, বর্গ ও জাতিতে ভিন্ন ভিন্ন। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া গ্রাম থেকে শহরে আসা রিকশাচালক-কৃষক গ্রামে যাওয়ার সময় বলেন ‘দেশে যাই’। কারও কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক। ডেঙ্গু, বায়ুদূষণ, বাজারমূল্য, যানজটের মতো অসহনীয় অমীমাংসিত নাগরিক যন্ত্রণার ভেতর আমার সামনে বারবার জাতীয় সংগীত ভেসে আসে। ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়ন জলে ভাসি’। নাগরিক, সরকার ও রাষ্ট্র আমাদের সবার দায় ও দায়িত্ব দেশের চোখের পানি মুছে দেয়া। নাগরিক দুর্ভোগ ও উৎপাদনব্যবস্থার জিজ্ঞাসাগুলোকে আমরা যত বেশি গুরুত্ব দেব, ততই মায়ের চেহারা থেকে মলিনতা দূর হতে থাকবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেশের মলিনতাকে ‘বৈষম্য’ হিসেবে পাঠ করেছে। দায় ও দরদের রাজনীতিকে এই পাঠ অব্যাহত রাখতে হবে।
[লেখক : গবেষক, পরিবেশ-প্রতিবেশ ]