জিল্লুর রহমান
প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস পালিত হয়। বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর জাতিসংঘের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কনভেনশন পাস হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর এ দিবস পালন করা হয়। দুর্নীতি বলতে আমরা সাধারণ অর্থে বুঝি, স্বাভাবিক নিয়ম-নীতির গতিধারাকে লঙ্ঘন করে কোন কাজ করা যা কোনো ব্যক্তিস্বার্থ বা দলীয়স্বার্থ চরিতার্থ করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি এক ভয়াবহ অভিশাপ। এটি হলো একধরনের অপরাধমূলক ঘৃণিত কাজ, যা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও আদর্শের পরিপন্থি। দুর্নীতি জাতির সব অর্জনকে এবং জাতীয় উন্নয়নের সব সম্ভাবনাকে ম্লান করে দেয়। কারণ, দুর্নীতিবাজ স্বার্থান্ধ, বিবেকবর্জিত। তিনি সব সময় নিজের স্বার্থসিদ্ধির মতলবে থাকেন। স্বার্থান্ধ ব্যক্তি নিজের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার কাজেই ব্যস্ত থাকেন। সমাজের কল্যাণ, দেশের মঙ্গলের কথা তিনি চিন্তা করেন না। জাতীয় জীবনের উন্নতি, সমৃদ্ধির কথা ভাবতে তার বিবেক সায় দেয় না।
ঘুষ ও দুর্নীতি যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির সবচেয়ে বড় শত্রু। বাংলাদেশের দুর্নীতির আওতা ও পরিধি এতটাই ব্যাপক যে, একে কয়েক লাইনের একটি প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব ও দুরূহ কাজ। ঘুষ ও দুর্নীতি হলো নীতিবিরুদ্ধ একটি ঘৃণিত অপরাধমূলক কাজ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘুষ ও দুর্নীতি একটি ভয়াবহ অভিশাপ। যদিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ সর্বোপরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে কঠিনতম অন্তরায় দুর্নীতি, তথাপি দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়; তারা দুর্নীতির নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি ও তা প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে দেশ বা দেশের সমগ্র জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যায় না।
সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫১ হাজার কোটি টাকা। টিআইবি বলছে, ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে এই দুর্নীতি হয়েছে। পক্ষগুলো হলোÑ মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী রাজনীতিক, আমলা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং ঠিকাদার।
তাছাড়া, অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটির তথ্যমতে, বিগত সরকারের সময় যে উন্নয়নের ধারণা দেয়া হয়েছিল, তা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একটি ‘চোরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে শেখ হাসিনার সরকার হরেক রকম পদ্ধতিতে দুর্নীতি করে দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছে। উন্নয়নের ওই বয়ানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অন্তত ২৮ রকম উপায়ে দুর্নীতি সংঘটনের তথ্য খুঁজে পেয়েছে সংশ্লিষ্ট কমিটি। শ্বেতপত্র কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবারিত দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে একটি ‘চোরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রতি বছর পাচার করা অর্থের পরিমাণ ছিল গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দুর্নীতির জাতীয় খানা জরিপ ২০২১ এর একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া শীর্ষ তিনে থাকা অপর দুটি সংস্থা হলো পাসপোর্ট ও বিআরটিএ। এই ৩টি খাতে সবচেয়ে বেশি ঘুষও নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। টিআইবি সেবা খাতে দুর্নীতির ধরন ও মাত্রা নির্ণয়ে ১৯৯৭ সাল থেকে দুর্নীতিবিষয়ক জাতীয় খানা জরিপ পরিচালনা করে আসছে। এ পর্যন্ত ২ থেকে ৩ বছর অন্তর ৯টি খানা জরিপ পরিচালনা করেছে এবং এ খানা জরিপটি এ ধরনের নবম জরিপ। টিআইবি বলছে, ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ৮ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত সময়ে ৬৪টি জেলায় জরিপটি পরিচালিত হয়। নির্বাচিত খানাগুলো ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন সেবা খাতে সেবাগ্রহণের সময় যেসব দুর্নীতি ও হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে তার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। টিআইবি ‘খানা’ হিসেবে একই বাসস্থানে বসবাস করে, একই রান্নায় খাওয়া-দাওয়া করে এবং তাদের মধ্যে একজন খানাপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতÑ এমন পরিবারকে বিবেচনা করেছে।
দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারীরা মনে করেন ‘দুর্নীতির জন্য ৯০ ভাগ দায়ী রাজনৈতিক নেতারা তাদের নোংরা রাজনীতি, ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ, রাতারাতি ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষাই দুর্নীতির অন্যতম কারণ। তারা বলেন, দুর্নীতি থেকে উত্তরণের একটি সুচিন্তিত পথ হলো দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠেকিয়ে আয়বৈষম্য কমিয়ে আনা। বাংলাদেশকে ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে হলে রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের সদিচ্ছা শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হবে না, বাস্তবে থাকতে হবে। কারণ, সব সচেতন দায়িত্বশীল নাগরিকদের সদিচ্ছা ছাড়া কখনো দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে না, কোনো দেশেই হয়নি, আমাদের দেশেও হবে না।
বিশ্বে কোনো দেশই দুর্নীতিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারেনি। উন্নত দেশগুলোতে দুর্নীতি আছে, তবে তা সীমিত বা সহনীয় পর্যায়ে। তাই দুর্নীতি সেসব দেশের প্রধান সমস্যা নয়। তবে একটি সমাজে কোনোভাবেই ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির বিস্তার সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। দ্রুত উন্নয়ন এবং ব্যাপক দুর্নীতিও কাম্য হতে পারে না। অতি দরিদ্র কোনো দেশ যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবিত হয় তখন সেখানে অবধারিতভাবে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে।
উন্নয়নকাজকে ত্বরান্বিত করতে যেটি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে একটি বড় ব্যাধি। এটি দেশের সার্বিক অগ্রগতি এবং উন্নয়ন ব্যাহত করে চলছে যুগের পর যুগ। দুর্নীতি দমন কোনো সরকারের পক্ষে এককভাবে দমন করা সম্ভব নয়, সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরে মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে আমাদের। শুধু সরকার বা রাজনৈতিক দলের নয়, সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকদেরও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। রোগের চিকিৎসার চেয়ে যদি রোগ প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে বেশি কাজে দেয়। আমরা যদি আমাদের শুভবুদ্ধি, মূল্যবোধ, দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার ও থাবা প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলেই দুর্নীতি নামক জাতীয় ব্যাধির বিস্তার বাড়তেই থাকবে!
[লেখক : ব্যাংকার]
জিল্লুর রহমান
সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস পালিত হয়। বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর জাতিসংঘের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কনভেনশন পাস হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর এ দিবস পালন করা হয়। দুর্নীতি বলতে আমরা সাধারণ অর্থে বুঝি, স্বাভাবিক নিয়ম-নীতির গতিধারাকে লঙ্ঘন করে কোন কাজ করা যা কোনো ব্যক্তিস্বার্থ বা দলীয়স্বার্থ চরিতার্থ করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি এক ভয়াবহ অভিশাপ। এটি হলো একধরনের অপরাধমূলক ঘৃণিত কাজ, যা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও আদর্শের পরিপন্থি। দুর্নীতি জাতির সব অর্জনকে এবং জাতীয় উন্নয়নের সব সম্ভাবনাকে ম্লান করে দেয়। কারণ, দুর্নীতিবাজ স্বার্থান্ধ, বিবেকবর্জিত। তিনি সব সময় নিজের স্বার্থসিদ্ধির মতলবে থাকেন। স্বার্থান্ধ ব্যক্তি নিজের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার কাজেই ব্যস্ত থাকেন। সমাজের কল্যাণ, দেশের মঙ্গলের কথা তিনি চিন্তা করেন না। জাতীয় জীবনের উন্নতি, সমৃদ্ধির কথা ভাবতে তার বিবেক সায় দেয় না।
ঘুষ ও দুর্নীতি যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির সবচেয়ে বড় শত্রু। বাংলাদেশের দুর্নীতির আওতা ও পরিধি এতটাই ব্যাপক যে, একে কয়েক লাইনের একটি প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব ও দুরূহ কাজ। ঘুষ ও দুর্নীতি হলো নীতিবিরুদ্ধ একটি ঘৃণিত অপরাধমূলক কাজ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘুষ ও দুর্নীতি একটি ভয়াবহ অভিশাপ। যদিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ সর্বোপরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে কঠিনতম অন্তরায় দুর্নীতি, তথাপি দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়; তারা দুর্নীতির নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি ও তা প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে দেশ বা দেশের সমগ্র জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যায় না।
সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫১ হাজার কোটি টাকা। টিআইবি বলছে, ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে এই দুর্নীতি হয়েছে। পক্ষগুলো হলোÑ মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী রাজনীতিক, আমলা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং ঠিকাদার।
তাছাড়া, অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটির তথ্যমতে, বিগত সরকারের সময় যে উন্নয়নের ধারণা দেয়া হয়েছিল, তা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একটি ‘চোরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে শেখ হাসিনার সরকার হরেক রকম পদ্ধতিতে দুর্নীতি করে দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছে। উন্নয়নের ওই বয়ানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অন্তত ২৮ রকম উপায়ে দুর্নীতি সংঘটনের তথ্য খুঁজে পেয়েছে সংশ্লিষ্ট কমিটি। শ্বেতপত্র কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবারিত দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে একটি ‘চোরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রতি বছর পাচার করা অর্থের পরিমাণ ছিল গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দুর্নীতির জাতীয় খানা জরিপ ২০২১ এর একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া শীর্ষ তিনে থাকা অপর দুটি সংস্থা হলো পাসপোর্ট ও বিআরটিএ। এই ৩টি খাতে সবচেয়ে বেশি ঘুষও নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। টিআইবি সেবা খাতে দুর্নীতির ধরন ও মাত্রা নির্ণয়ে ১৯৯৭ সাল থেকে দুর্নীতিবিষয়ক জাতীয় খানা জরিপ পরিচালনা করে আসছে। এ পর্যন্ত ২ থেকে ৩ বছর অন্তর ৯টি খানা জরিপ পরিচালনা করেছে এবং এ খানা জরিপটি এ ধরনের নবম জরিপ। টিআইবি বলছে, ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ৮ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত সময়ে ৬৪টি জেলায় জরিপটি পরিচালিত হয়। নির্বাচিত খানাগুলো ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন সেবা খাতে সেবাগ্রহণের সময় যেসব দুর্নীতি ও হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে তার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। টিআইবি ‘খানা’ হিসেবে একই বাসস্থানে বসবাস করে, একই রান্নায় খাওয়া-দাওয়া করে এবং তাদের মধ্যে একজন খানাপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতÑ এমন পরিবারকে বিবেচনা করেছে।
দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারীরা মনে করেন ‘দুর্নীতির জন্য ৯০ ভাগ দায়ী রাজনৈতিক নেতারা তাদের নোংরা রাজনীতি, ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ, রাতারাতি ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষাই দুর্নীতির অন্যতম কারণ। তারা বলেন, দুর্নীতি থেকে উত্তরণের একটি সুচিন্তিত পথ হলো দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠেকিয়ে আয়বৈষম্য কমিয়ে আনা। বাংলাদেশকে ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে হলে রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের সদিচ্ছা শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হবে না, বাস্তবে থাকতে হবে। কারণ, সব সচেতন দায়িত্বশীল নাগরিকদের সদিচ্ছা ছাড়া কখনো দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে না, কোনো দেশেই হয়নি, আমাদের দেশেও হবে না।
বিশ্বে কোনো দেশই দুর্নীতিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারেনি। উন্নত দেশগুলোতে দুর্নীতি আছে, তবে তা সীমিত বা সহনীয় পর্যায়ে। তাই দুর্নীতি সেসব দেশের প্রধান সমস্যা নয়। তবে একটি সমাজে কোনোভাবেই ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির বিস্তার সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। দ্রুত উন্নয়ন এবং ব্যাপক দুর্নীতিও কাম্য হতে পারে না। অতি দরিদ্র কোনো দেশ যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবিত হয় তখন সেখানে অবধারিতভাবে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে।
উন্নয়নকাজকে ত্বরান্বিত করতে যেটি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে একটি বড় ব্যাধি। এটি দেশের সার্বিক অগ্রগতি এবং উন্নয়ন ব্যাহত করে চলছে যুগের পর যুগ। দুর্নীতি দমন কোনো সরকারের পক্ষে এককভাবে দমন করা সম্ভব নয়, সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরে মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে আমাদের। শুধু সরকার বা রাজনৈতিক দলের নয়, সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকদেরও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। রোগের চিকিৎসার চেয়ে যদি রোগ প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে বেশি কাজে দেয়। আমরা যদি আমাদের শুভবুদ্ধি, মূল্যবোধ, দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার ও থাবা প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলেই দুর্নীতি নামক জাতীয় ব্যাধির বিস্তার বাড়তেই থাকবে!
[লেখক : ব্যাংকার]