হেলাল মিয়া
১৭৫০-১৮৫০ সালে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হওয়া ফলে সারা বিশ্বে পণ্য উৎপাদনের জন্য কলকারখানা গড়ে ওঠে। সেই কলকারখানার কাঁচামাল সংগ্রহের লক্ষ্যে চালু হয় ঔপনিবেশিক শাসন। তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে কলোনি প্রতিষ্ঠা করলে আগের তুলনায় কৃষকদের আরও বেশি দুর্দশা দেখা দেয়। ঠিক সেই সময় অন্য আরও দশটি সাধারণ শিশুর মতো করেই রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিল মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া।
তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছিল তখন নারীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চার কোন সুযোগ ছিল না। পুরুষরা শিক্ষার সুযোগ পেলেও নারীদের জন্য তা একেবারেই ছিল না। তখন নারীদের জীবনচক্র ছিল বাড়িতে রান্নাবান্না করা, স্বামীর সংসার করা। এর বাহিরে আর তেমন কিছুই ছিল না নারীদের জন্য। ধীরে ধীরে শিশু থেকে কিশোরী এভাবে বেড়ে উঠলেন মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া। তার পিতা আবু আলী হায়দার সাবের আরবি, ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হলেও মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে ছিলেন রক্ষণশীল।
বেগম রোকেয়া তার মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাসকালে একজন শিক্ষয়িত্রী ম্যামের কাছে কিছু পড়াশোনার সুযোগ পেলেও পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের চাপে সেটি বন্ধ করতে বাধ্য হন। তবুও অদম্য এই নারী থেমে থাকেননি। তিনি বড় ভাইবোনদের সহযোগিতায় উর্দু, আরবি, ফারসি, ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করেন। ১৯৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুরের বাসিন্দা উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। তার স্বামী ছিলে একাধারে ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সমাজ সংস্কারক, মুক্তচিন্তার অধিকারী, কুসংস্কারমুক্ত ও প্রগতিশীলভাবাপন্ন। স্বামীর সহযোগিতায় দেশ-বিদেশের অনেক নামিদামি লেখকদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
১৯০২ সালে ’পিপাসা’ নামক একটি বাংলা গল্প লেখার মাধ্যমে সাহিত্যক হিসেবে বেগম রোকেয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯০৫ সালে সুলতানাস ড্রিমস (সুলতানার স্বপ্ন) ভারতের মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হয়। সেই লেখাটি ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় তখন তিনি অনেক সুনাম অর্জন করেন।
স্বামীর অনুপ্রেরণায় লেখালেখি শুরু করলেও তার বিবাহিত জীবন খুব বেশি সময় সময় স্থায়ী হয়নি। তার স্বাধীন সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ১৯০৯ সালে অকালে মারা যান। তবুও তিনি থেমে না থেকে একের পর এক সাহিত্য রচনা করেছেন। তার স্বামীর রেখে যাওয়া অর্থ দিয়ে ১৯০৯ সালে মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি বাঙালি মুসলিম নারীদের জন্য ১৯১৬ সালে আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত নারীবিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। ১৯৩০ সালে বেগম রোকেয়া বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করেন, যা ছিল তার পক্ষে একটি দুঃসাহসিক কাজ।
তার রচিত সুলতানার স্বপ্ন নিয়ে তৎকালীন সময়ে স্প্যানিশ নির্মাতা ইসাবেলা হারগুয়েরা অ্যানিমেশন চলচিত্র নির্মাণ করেন। স্প্যানিশ ভাষায় এর নাম ‘এল সুয়েনো দে লা সুলতানা‘। বেগম রোকেয়ার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য ‘রোকেয়া হল’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ষাটের দশকে। এছাড়া তার অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য আবাসিক হল রয়েছে। এমনকি তার নামে স্কুল, কলেজসহ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবসে নারী উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য বিশিষ্ট নারীদের রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়। তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে সরকার তার পৈতৃক ভিটায় ৩.১৫ একর জমির ওপর ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’ নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে এটি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলা একাডেমি। তার উল্লেখযোগ্য লেখনিগুলো হলো সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, মতিচূর, অবরোধবাসিনী, যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।’ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার জরিপে ৬ষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বরে এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটলে তাকে সোদপুর, কলকাতায় সমাহিত করা হয়। আজকে বাংলাদেশি ও বাঙালি নারীদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারিগর নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া।
[লেখক : শিক্ষার্থী, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর]
হেলাল মিয়া
সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪
১৭৫০-১৮৫০ সালে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হওয়া ফলে সারা বিশ্বে পণ্য উৎপাদনের জন্য কলকারখানা গড়ে ওঠে। সেই কলকারখানার কাঁচামাল সংগ্রহের লক্ষ্যে চালু হয় ঔপনিবেশিক শাসন। তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে কলোনি প্রতিষ্ঠা করলে আগের তুলনায় কৃষকদের আরও বেশি দুর্দশা দেখা দেয়। ঠিক সেই সময় অন্য আরও দশটি সাধারণ শিশুর মতো করেই রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিল মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া।
তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছিল তখন নারীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চার কোন সুযোগ ছিল না। পুরুষরা শিক্ষার সুযোগ পেলেও নারীদের জন্য তা একেবারেই ছিল না। তখন নারীদের জীবনচক্র ছিল বাড়িতে রান্নাবান্না করা, স্বামীর সংসার করা। এর বাহিরে আর তেমন কিছুই ছিল না নারীদের জন্য। ধীরে ধীরে শিশু থেকে কিশোরী এভাবে বেড়ে উঠলেন মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া। তার পিতা আবু আলী হায়দার সাবের আরবি, ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হলেও মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে ছিলেন রক্ষণশীল।
বেগম রোকেয়া তার মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাসকালে একজন শিক্ষয়িত্রী ম্যামের কাছে কিছু পড়াশোনার সুযোগ পেলেও পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের চাপে সেটি বন্ধ করতে বাধ্য হন। তবুও অদম্য এই নারী থেমে থাকেননি। তিনি বড় ভাইবোনদের সহযোগিতায় উর্দু, আরবি, ফারসি, ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করেন। ১৯৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুরের বাসিন্দা উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। তার স্বামী ছিলে একাধারে ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সমাজ সংস্কারক, মুক্তচিন্তার অধিকারী, কুসংস্কারমুক্ত ও প্রগতিশীলভাবাপন্ন। স্বামীর সহযোগিতায় দেশ-বিদেশের অনেক নামিদামি লেখকদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
১৯০২ সালে ’পিপাসা’ নামক একটি বাংলা গল্প লেখার মাধ্যমে সাহিত্যক হিসেবে বেগম রোকেয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯০৫ সালে সুলতানাস ড্রিমস (সুলতানার স্বপ্ন) ভারতের মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হয়। সেই লেখাটি ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় তখন তিনি অনেক সুনাম অর্জন করেন।
স্বামীর অনুপ্রেরণায় লেখালেখি শুরু করলেও তার বিবাহিত জীবন খুব বেশি সময় সময় স্থায়ী হয়নি। তার স্বাধীন সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ১৯০৯ সালে অকালে মারা যান। তবুও তিনি থেমে না থেকে একের পর এক সাহিত্য রচনা করেছেন। তার স্বামীর রেখে যাওয়া অর্থ দিয়ে ১৯০৯ সালে মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি বাঙালি মুসলিম নারীদের জন্য ১৯১৬ সালে আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত নারীবিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। ১৯৩০ সালে বেগম রোকেয়া বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করেন, যা ছিল তার পক্ষে একটি দুঃসাহসিক কাজ।
তার রচিত সুলতানার স্বপ্ন নিয়ে তৎকালীন সময়ে স্প্যানিশ নির্মাতা ইসাবেলা হারগুয়েরা অ্যানিমেশন চলচিত্র নির্মাণ করেন। স্প্যানিশ ভাষায় এর নাম ‘এল সুয়েনো দে লা সুলতানা‘। বেগম রোকেয়ার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য ‘রোকেয়া হল’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ষাটের দশকে। এছাড়া তার অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য আবাসিক হল রয়েছে। এমনকি তার নামে স্কুল, কলেজসহ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবসে নারী উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য বিশিষ্ট নারীদের রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়। তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে সরকার তার পৈতৃক ভিটায় ৩.১৫ একর জমির ওপর ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’ নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে এটি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলা একাডেমি। তার উল্লেখযোগ্য লেখনিগুলো হলো সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, মতিচূর, অবরোধবাসিনী, যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।’ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার জরিপে ৬ষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বরে এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটলে তাকে সোদপুর, কলকাতায় সমাহিত করা হয়। আজকে বাংলাদেশি ও বাঙালি নারীদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারিগর নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া।
[লেখক : শিক্ষার্থী, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর]