মিহির কুমার রায়
দেশের অর্থনীতিতে কৃষি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। সেবা ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও খাদ্য উৎপাদনে ধারাবাহিক অগ্রগতি এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ৬২ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত, মানে কৃষি এখনো নিয়োগের বড় ক্ষেত্র। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংন্থা, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি), বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেশের চরম দারিদ্র (২০১৯-২০ সালে ১০ শতাংশ) নিরসনে কৃষি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইফপ্রির বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বার্ষিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী, স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫২ বছরে দেশের প্রধান প্রধান শস্য উৎপাদন তিন থেকে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ। এ পর্যন্ত লবণাক্ততা, খরা, প্লাবনসহিষ্ণু এবং জিঙ্কসমৃদ্ধ ১৩৪টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
এত ধরনের ধান চাষের আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিবিড় সবজি চাষাবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫ হাজার টন সবজি উৎপাদন করেছে এবং তৃতীয় অবস্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশ পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজিতে প্রতি হেক্টরে ফলন বৃদ্ধিতে প্রথম, শস্য জাতের উন্নয়নে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চা উৎপাদনে তৃতীয়, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২০’ অনুসারে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে তৃতীয় এবং মাছ চাষে পঞ্চম। গত ১০ বছরে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে প্রথম অবস্থানে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক পটভূমি নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। সামনে আসছে নতুন অনেক ইশতেহার ও সংস্কার প্রস্তাব। নতুন পরিস্থিতিতে দেখা দিয়েছে খাদ্যনিরাপত্তার চিরকালীন প্রসঙ্গ। একটা জনপদের অগ্রগতি ও প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্ত খাদ্যনিরাপত্তার প্রশ্ন সমাধান। ধানের দেশ বাংলার সমৃদ্ধি ও সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধান চাষের সাফল্য ও ব্যর্থতা। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) প্রকাশিত প্রতিবেদন তার বড় প্রমাণ। জরিপ বলছে, বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২০ শতাংশ মানুষ। সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে এ হার সবচেয়ে বেশি, ২৪ শতাংশ। এমনকি দেশের রাজধানী ঢাকায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ১৭ শতাংশ। প্রতিবেদনের দাবি, দেশের সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষি ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এর প্রভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্যসংস্থান করতে পারছে না প্রতি ১০ জনের তিনজন বা ৩০ শতাংশ। নিম্নআয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৩৬ শতাংশ।
খাদ্যব্যয় সংকোচনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ২৯ শতাংশ মানুষ। আর সার্বিক জীবন-জীবিকায় ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে ৭১ শতাংশ মানুষ। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করছে দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ। খাদ্যের এ নিরাপত্তার প্রশ্নটি দিন শেষে ভাতের নিরাপত্তার প্রশ্ন। কারণ দেশের যে অংশটি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তাদের প্রধান খাদ্যই ভাত। দেশের আট বিভাগের ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ডব্লিউএফপি। তাতে যেন বঙ্গীয় জনপদের ইতিহাসে চিরকাল ধরে থাকা সংকটটিই আরেকবার চিহ্নিত হয়েছে। কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাত ও প্রবাসী আয়ের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। পরিণতিতে দেশে খাদ্যদ্রব্য আমদানির প্রবণতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুসারে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ বছরে গড়ে ১৪৯.৮ কেজি খাদ্যশস্য গ্রহণ করে থাকে এবং বাংলাদেশে যদি তার পরিমাণ ১৮২.৫ কেজি ধরা হয় এবং শতকরা ২৫ ভাগ বীজ, পশুখাদ্য ও অপচয় ধরা হয়, তাহলে মোট খাদ্য চাহিদা দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। এর চেয়ে অনেক বেশি চাল ও মোট খাদ্যশস্য প্রতি বছর আমরা উৎপাদন করছি, তারপরও কমবেশি প্রায় ১ কোটি টন চাল, গম ও ভুট্টা প্রতি বছর আমদানি করতে হচ্ছে যা ক্রমাগতই বেড়ে যাচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চাল ও গম আমদানি হয়েছে ৬৭.০২ লাখ মেট্টিক টন আর ভুট্টা ২৪ লাখ মেট্টিক টন। এখানে উল্লেখ্য যে, গত ১৩ বছরে কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে গড়ে প্রায় ৪ শতাংশ হারে তা সত্ত্বেও কৃষিপণ্যের আমদানি হ্রাস হয়নি। চাল আমদানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়, আমদানিতে ৫০ শতাংশ, তেলের প্রায় ৯০ শতাংশ, চিনির ক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। আমাদের কৃষিজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নির্ভরতা যখন এত বেশি, তখন বৈশ্বিক মূল্য অস্থিরতা ও ঘাটতি অভ্যন্তরীণ বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পর্যাপ্ত উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা ছাড়া এ সংকট কাটানো যাবে না। এ নির্ভরতা কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে কার্যকরী খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল। আর এক্ষেত্রে সময়োপযোগী কৌশল গ্রহণ করে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে প্রয়োজন শক্তিশালী যোগাযোগ চ্যানেল স্থাপন করা। সঠিক যোগাযোগ চ্যানেলের অভাবে খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল কী ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে পারে? খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল একটি বিস্তৃত ও জটিল নেটওয়ার্ক, যেখানে গ্রামীণ কৃষক, জেলে, খামারি ও মধ্যস্বত্বভোগী এবং শহুরে খুচরা বিক্রেতারা পরস্পর নির্ভরশীল উপায়ে কাজ করার মাধ্যমে গ্রাম থেকে তাজা শস্য ও মাছ-মাংস শহরের বাজারে নিয়ে আসে।
এক্ষেত্রে সবগুলো পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থাকা সত্ত্বেও, যোগাযোগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট দূরত্ব রয়েছে, যা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে দক্ষ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এবং অদক্ষ সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রান্তিক কৃষকরা কম মুনাফা পাচ্ছেন এবং খাদ্যপণ্যের অপচয়ও ঘটছে। এক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যের আদান-প্রদান নিশ্চিত করার মাধ্যমে শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা ইতিবাচকভাবে পুরো সরবরাহ শৃঙ্খলের গতিপ্রকৃতি বদলে দিতে পারে, যা একই সঙ্গে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনার সব অংশীজনদের মুনাফা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। কার্যকরী যোগাযোগ ব্যবস্থা অংশীদারদের মধ্যে কার্যক্রম পরিচালনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগে কার্যকরী চ্যানেলের মাধ্যমে কৃষক, জেলে, মধ্যস্বত্বভোগী এবং খুচরা বিক্রেতারা বাজারের চাহিদা, লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ এবং আবহাওয়ার সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে সক্ষম হবেন। এখানে জনপ্রিয় ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ইমোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেখানে রয়েছে হাই-কোয়ালিটি ভিডিও কলের সুবিধা। বর্তমানের ইন্টারনেটের যুগে এ ধরনের ডিজিটাল চ্যানেলে সহজেই যোগাযোগ করা যায়।
পচনশীল পণ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবহন, রিয়েল-টাইমে বাজারমূল্য এবং চাহিদা সম্পর্কে সঠিক ও সময়োপযোগী তথ্যের আদান-প্রদান অত্যন্ত জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো কৃষক সময়মতো জানতে পারেন যে নির্দিষ্ট একটি খাদ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ছে, তবে তিনি তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণে এবং সেই পণ্য সরবরাহে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারবেন। ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের সাহায্যে কৃষক, জেলে, ও খামারিরা সহজেই মধ্যস্বত্বভোগী বা খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, যা পুরো সরবরাহ শৃঙ্খলের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করবে। ইতোমধ্যেই কিছু প্রতিষ্ঠান আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকদের বাজারমূল্য, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং ফসল ব্যবস্থাপনার বিষয়ে রিয়েল- টাইম তথ্য দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ফসলের উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। একইভাবে, ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কৃষক, জেলে, খামারি, মধ্যস্বত্বভোগী ও খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে সময়মতো যোগাযোগ নিশ্চিত করে খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।
হাই-কোয়ালিটি ভিডিও কল ও ছবি আদান-প্রদানের মাধ্যমে স্বচ্ছতা যেমন নিশ্চিত করা যাবে, তেমনি ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে পারস্পরিক আস্থাও বৃদ্ধি পাবে; পাশাপাশি, গ্রামীণ কৃষক, জেলে ও খামারিদের যোগাযোগ খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। দেশের কার্যকরী খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল সার্বিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষক, খামারি ও জেলেরা এবং শহরের খুচরা বিক্রেতারা দেশের খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের মধ্যে রিয়েল-টাইম এবং স্বচ্ছ যোগাযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে খাদ্য অপচয় যেমন হ্রাস করা যাবে, তেমনি তাদের মুনাফা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখা সম্ভব। ডিজিটাল যোগাযোগ এক্ষেত্রে অংশীদারদের মধ্যে কার্যকরী যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা বাড়াতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
[লেখক : সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]
মিহির কুমার রায়
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪
দেশের অর্থনীতিতে কৃষি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। সেবা ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও খাদ্য উৎপাদনে ধারাবাহিক অগ্রগতি এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ৬২ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত, মানে কৃষি এখনো নিয়োগের বড় ক্ষেত্র। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংন্থা, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি), বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেশের চরম দারিদ্র (২০১৯-২০ সালে ১০ শতাংশ) নিরসনে কৃষি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইফপ্রির বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বার্ষিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী, স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫২ বছরে দেশের প্রধান প্রধান শস্য উৎপাদন তিন থেকে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ। এ পর্যন্ত লবণাক্ততা, খরা, প্লাবনসহিষ্ণু এবং জিঙ্কসমৃদ্ধ ১৩৪টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
এত ধরনের ধান চাষের আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিবিড় সবজি চাষাবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫ হাজার টন সবজি উৎপাদন করেছে এবং তৃতীয় অবস্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশ পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজিতে প্রতি হেক্টরে ফলন বৃদ্ধিতে প্রথম, শস্য জাতের উন্নয়নে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চা উৎপাদনে তৃতীয়, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২০’ অনুসারে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে তৃতীয় এবং মাছ চাষে পঞ্চম। গত ১০ বছরে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে প্রথম অবস্থানে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক পটভূমি নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। সামনে আসছে নতুন অনেক ইশতেহার ও সংস্কার প্রস্তাব। নতুন পরিস্থিতিতে দেখা দিয়েছে খাদ্যনিরাপত্তার চিরকালীন প্রসঙ্গ। একটা জনপদের অগ্রগতি ও প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্ত খাদ্যনিরাপত্তার প্রশ্ন সমাধান। ধানের দেশ বাংলার সমৃদ্ধি ও সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধান চাষের সাফল্য ও ব্যর্থতা। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) প্রকাশিত প্রতিবেদন তার বড় প্রমাণ। জরিপ বলছে, বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২০ শতাংশ মানুষ। সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে এ হার সবচেয়ে বেশি, ২৪ শতাংশ। এমনকি দেশের রাজধানী ঢাকায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ১৭ শতাংশ। প্রতিবেদনের দাবি, দেশের সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষি ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এর প্রভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্যসংস্থান করতে পারছে না প্রতি ১০ জনের তিনজন বা ৩০ শতাংশ। নিম্নআয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৩৬ শতাংশ।
খাদ্যব্যয় সংকোচনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ২৯ শতাংশ মানুষ। আর সার্বিক জীবন-জীবিকায় ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে ৭১ শতাংশ মানুষ। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করছে দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ। খাদ্যের এ নিরাপত্তার প্রশ্নটি দিন শেষে ভাতের নিরাপত্তার প্রশ্ন। কারণ দেশের যে অংশটি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তাদের প্রধান খাদ্যই ভাত। দেশের আট বিভাগের ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ডব্লিউএফপি। তাতে যেন বঙ্গীয় জনপদের ইতিহাসে চিরকাল ধরে থাকা সংকটটিই আরেকবার চিহ্নিত হয়েছে। কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাত ও প্রবাসী আয়ের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। পরিণতিতে দেশে খাদ্যদ্রব্য আমদানির প্রবণতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুসারে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ বছরে গড়ে ১৪৯.৮ কেজি খাদ্যশস্য গ্রহণ করে থাকে এবং বাংলাদেশে যদি তার পরিমাণ ১৮২.৫ কেজি ধরা হয় এবং শতকরা ২৫ ভাগ বীজ, পশুখাদ্য ও অপচয় ধরা হয়, তাহলে মোট খাদ্য চাহিদা দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। এর চেয়ে অনেক বেশি চাল ও মোট খাদ্যশস্য প্রতি বছর আমরা উৎপাদন করছি, তারপরও কমবেশি প্রায় ১ কোটি টন চাল, গম ও ভুট্টা প্রতি বছর আমদানি করতে হচ্ছে যা ক্রমাগতই বেড়ে যাচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চাল ও গম আমদানি হয়েছে ৬৭.০২ লাখ মেট্টিক টন আর ভুট্টা ২৪ লাখ মেট্টিক টন। এখানে উল্লেখ্য যে, গত ১৩ বছরে কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে গড়ে প্রায় ৪ শতাংশ হারে তা সত্ত্বেও কৃষিপণ্যের আমদানি হ্রাস হয়নি। চাল আমদানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়, আমদানিতে ৫০ শতাংশ, তেলের প্রায় ৯০ শতাংশ, চিনির ক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। আমাদের কৃষিজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নির্ভরতা যখন এত বেশি, তখন বৈশ্বিক মূল্য অস্থিরতা ও ঘাটতি অভ্যন্তরীণ বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পর্যাপ্ত উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা ছাড়া এ সংকট কাটানো যাবে না। এ নির্ভরতা কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে কার্যকরী খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল। আর এক্ষেত্রে সময়োপযোগী কৌশল গ্রহণ করে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে প্রয়োজন শক্তিশালী যোগাযোগ চ্যানেল স্থাপন করা। সঠিক যোগাযোগ চ্যানেলের অভাবে খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল কী ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে পারে? খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল একটি বিস্তৃত ও জটিল নেটওয়ার্ক, যেখানে গ্রামীণ কৃষক, জেলে, খামারি ও মধ্যস্বত্বভোগী এবং শহুরে খুচরা বিক্রেতারা পরস্পর নির্ভরশীল উপায়ে কাজ করার মাধ্যমে গ্রাম থেকে তাজা শস্য ও মাছ-মাংস শহরের বাজারে নিয়ে আসে।
এক্ষেত্রে সবগুলো পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থাকা সত্ত্বেও, যোগাযোগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট দূরত্ব রয়েছে, যা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে দক্ষ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এবং অদক্ষ সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রান্তিক কৃষকরা কম মুনাফা পাচ্ছেন এবং খাদ্যপণ্যের অপচয়ও ঘটছে। এক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যের আদান-প্রদান নিশ্চিত করার মাধ্যমে শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা ইতিবাচকভাবে পুরো সরবরাহ শৃঙ্খলের গতিপ্রকৃতি বদলে দিতে পারে, যা একই সঙ্গে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনার সব অংশীজনদের মুনাফা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। কার্যকরী যোগাযোগ ব্যবস্থা অংশীদারদের মধ্যে কার্যক্রম পরিচালনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগে কার্যকরী চ্যানেলের মাধ্যমে কৃষক, জেলে, মধ্যস্বত্বভোগী এবং খুচরা বিক্রেতারা বাজারের চাহিদা, লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ এবং আবহাওয়ার সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে সক্ষম হবেন। এখানে জনপ্রিয় ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ইমোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেখানে রয়েছে হাই-কোয়ালিটি ভিডিও কলের সুবিধা। বর্তমানের ইন্টারনেটের যুগে এ ধরনের ডিজিটাল চ্যানেলে সহজেই যোগাযোগ করা যায়।
পচনশীল পণ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবহন, রিয়েল-টাইমে বাজারমূল্য এবং চাহিদা সম্পর্কে সঠিক ও সময়োপযোগী তথ্যের আদান-প্রদান অত্যন্ত জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো কৃষক সময়মতো জানতে পারেন যে নির্দিষ্ট একটি খাদ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ছে, তবে তিনি তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণে এবং সেই পণ্য সরবরাহে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারবেন। ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের সাহায্যে কৃষক, জেলে, ও খামারিরা সহজেই মধ্যস্বত্বভোগী বা খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, যা পুরো সরবরাহ শৃঙ্খলের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করবে। ইতোমধ্যেই কিছু প্রতিষ্ঠান আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকদের বাজারমূল্য, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং ফসল ব্যবস্থাপনার বিষয়ে রিয়েল- টাইম তথ্য দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ফসলের উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। একইভাবে, ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কৃষক, জেলে, খামারি, মধ্যস্বত্বভোগী ও খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে সময়মতো যোগাযোগ নিশ্চিত করে খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।
হাই-কোয়ালিটি ভিডিও কল ও ছবি আদান-প্রদানের মাধ্যমে স্বচ্ছতা যেমন নিশ্চিত করা যাবে, তেমনি ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে পারস্পরিক আস্থাও বৃদ্ধি পাবে; পাশাপাশি, গ্রামীণ কৃষক, জেলে ও খামারিদের যোগাযোগ খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। দেশের কার্যকরী খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল সার্বিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষক, খামারি ও জেলেরা এবং শহরের খুচরা বিক্রেতারা দেশের খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের মধ্যে রিয়েল-টাইম এবং স্বচ্ছ যোগাযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে খাদ্য অপচয় যেমন হ্রাস করা যাবে, তেমনি তাদের মুনাফা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখা সম্ভব। ডিজিটাল যোগাযোগ এক্ষেত্রে অংশীদারদের মধ্যে কার্যকরী যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা বাড়াতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
[লেখক : সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]