এম এ হোসাইন
রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে এমনও মুহূর্ত আসে যখন জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছায় একটি পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করে। দেশের সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে এমন একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে যেখানে সমাজ-রাজনীতির প্রেক্ষাপট পুনর্গঠন এবং একটি অধিকতর ন্যায়সঙ্গত শাসনব্যবস্থা তৈরির সম্ভাবনা উজ্জ্বল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যা এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তারা বিভিন্ন খাতে সংস্কারের পদক্ষেপ নির্ধারণের মাধ্যমে জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু একটি প্রশ্ন রয়েই যায়Ñ এই সংস্কারগুলো কি সেই গণঅসন্তোষের মূল কারণগুলো লক্ষ্য করছে, যা মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছিল, নাকি এগুলো কেবলমাত্র লোকদেখানো বানবাক্য মাত্র?
এই প্রশ্নের গভীরে একটি কঠিন বাস্তবতা লুকিয়ে আছে যা হলো শাসনব্যবস্থায় ও সমাজে একটি বিষাক্ত ‘পুরনো সংস্কৃতি’-র স্থায়িত্ব। এই সংস্কৃতি, কিছু রাজনৈতিক দল, তাদের নেতা এবং এমনকি আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর দ্বারা লালিত, অন্যায়, জবরদস্তি, আর্থিক শোষণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বীজ বপন করেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচ্চপর্যায় থেকে সতর্কতা এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও, এই অসদাচরণগুলো যেন টিকে থাকে এবং অর্থবহ পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলে।
যদিও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকেই এই নেতিবাচক সংস্কৃতি লালন করার জন্য দায়ী করা হয়, তবে সমস্যাটি আসলে অনেক জটিল। আমলাতন্ত্র, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন, এই সমস্যার অংশীদার। সরকারি কর্মকর্তাদের মৌন বা প্রকাশ্য অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতা ও দুর্নীতি বিকশিত হতে পারে না। লোভনীয় ঠিকাদারি মুনাফা থেকে শুরু করে বেআইনি কার্যকলাপ উপেক্ষা করা পর্যন্ত এই ধরনের সহযোগিতা ন্যায়বিচারকে দুর্বল করে এবং জনগণের দুর্ভোগকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।
পুলিশ কর্তৃক রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্যায় সহায়তায় জড়িত থাকাটা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এমন চক্রের পরিণাম বেশ ভয়াবহ হয়েছে, যেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জনকল্যাণের চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। এটি শাসনব্যবস্থার বিশুদ্ধতাকে দুর্বল করে এবং এমন এক দুষ্ট চক্র তৈরি করে যেখানে জনগণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসন উভয়ের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে শতাব্দীর অন্যতম সুযোগ। প্রশাসনিক পরিবর্তনের প্রস্তাব, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে, পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া অতিব জরুরি। তবে, ইতিহাস আমাদের অযথা আশাবাদের বিরুদ্ধে সতর্ক করে। অতীতের এমন প্রচেষ্টা প্রায়শই স্থায়ী ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয়েছে। আমলাতন্ত্রে পরিবর্তন আইনগতভাবে বাস্তবায়ন করা গেলেও, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংস্কার করা আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ।
রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নিজেদের পরিবর্তনের দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের শোষণের গভীর মূলভিত্তি ভেঙে ফেলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা গ্রহণ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সংস্কার ছাড়া, সবচেয়ে সদিচ্ছাপূর্ণ প্রশাসনিক পরিবর্তনগুলোও প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হতে পারে। মূল প্রশ্ন হলোÑ রাজনৈতিক দলগুলো কি নিজেদের স্বার্থ ছাড়িয়ে জনকল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতে সক্ষম হবে? নাকি তারা পুরনো শাসন ও শোষণের পরিচিত পদ্ধতিগুলোতে ফিরে যাবে?
শাসনের সাফল্য বা ব্যর্থতার একটি বড় উপাদান হলো মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নেতৃত্ব। এই নেতাদের কার্যক্রম গোটা প্রশাসনিক কাঠামোর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তবে, ইতিহাস দেখিয়েছে যে আমলাতান্ত্রিক সংস্কার প্রায়ই তাদের দ্বারাই বাধাগ্রস্ত হয়, যারা এই সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকে। আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে সুবিধা নেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয় এমন একটি দায়মুক্তির সংস্কৃতি এই চক্রকে স্থায়ী করে।
‘কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না’Ñ এই উপমাটি এই সমস্যাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করে। বারবার ব্যবস্থাকে শুদ্ধ করার চেষ্টা সত্ত্বেও দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের দাগ যেন থেকে যায়। এই চক্র ভাঙতে হলে এমন ব্যবস্থা প্রয়োজন যা সব পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা এবং আমলাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে তাদের অবস্থান অপব্যবহার প্রতিরোধে কার্যকর প্রক্রিয়া তৈরি।
ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। শাসক, রাজনৈতিক নেতা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যদি রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনগণকে দমন ও শোষণ করার জন্য ব্যবহার করেন, এর ফলাফল প্রায়শই বিপর্যয়কর হয়। যদি জনঅসন্তোষকে কোন শাসক উপেক্ষা করে তবে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের মতো বড় ধরনের অস্থিরতার রূপ তাদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষনীয় বিষয় হতে পারে। এই আন্দোলনগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে গণতান্ত্রিক সরকারের পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলো অগ্রাহ্য করার ঝুঁকি কত বড়।
তবে, এমন আন্দোলনের পর প্রায়ই দেখা যায় দেশ আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে গেছে। আশার মুহূর্তগুলো হতাশায় রূপান্তরিত হয় যখন পুরনো শাসনব্যবস্থার পরিচিত ধাঁচগুলো আবার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চক্রটি স্পষ্ট করে দেয় যে জনগণের অসন্তোষের মূল কারণগুলো নিরসনে প্রকৃত, গভীরমুখী সংস্কার এখন কতটা জরুরি।
প্রশাসনে স্বচ্ছতা কেবল একটি মুখের বুলি নয়; এটি কার্যকর শাসনের ভিত্তি। সংস্কার কার্যকর করতে হলে এর সঙ্গে উন্মুক্ততা এবং জবাবদিহিতার প্রতি প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। এটি রাজনৈতিক দল এবং আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। নেতাদের জনগণের উদ্বেগ শোনার এবং দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ইচ্ছা প্রদর্শন করতে হবে।
জনগণের অংশগ্রহণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিকদের তাদের নেতাদের জবাবদিহি করার ক্ষমতা দিতে হবে, যা স্বাধীন তদারকি সংস্থা এবং তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করার মতো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্ভব। স্বচ্ছতার একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমেই সরকার জনগণের আস্থা পুনর্গঠন করতে পারে এবং এমন একটি শাসন ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে যা সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবায় নিবেদিত।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে, তাদের জনগণের তাৎক্ষণিক দাবি মেটাতে এবং যে গণক্ষোভ তাদের ক্ষমতায় এনেছে তা নিরসন করতে হবে। অন্যদিকে, দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধ করবে। এর জন্য প্রয়োজন বর্তমানের জনচাহিদার সঙ্গে একটি দীর্ঘস্থায়ী, টেকসই সমাধানের ভারসাম্য রক্ষা করা।
পুলিশ প্রশাসন এবং অন্যান্য আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে সংস্কার একটি সঠিক এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে, এই প্রচেষ্টাগুলোর পাশাপাশি সুশাসন এবং রাজনৈতিক জবাবদিহিতা বাড়ানোর জন্য ব্যাপক কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ সংস্কারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে এবং দেশ ও দশের সেবার সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিতে হবে, শোষণ ও শাসনের সংস্কৃতিকে নয়।
এই প্রচেষ্টাগুলোর সফলতা নির্ভর করবে রাজনৈতিক নেতা, আমলা এবং নাগরিকদের পরিবর্তনকে গ্রহণ করার এবং মেনে চলার ইচ্ছার ওপর। সামনে পথচলা হয়তোবা চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে এতে সম্ভাবনাও রয়েছে। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সংকটের মুহূর্তটিকে জাতির জন্য একটি মোড় পরিবর্তনের সুযোগে রূপান্তরিত করতে পারে।
ছাত্রদের আন্দোলন দেশের জন্য একটি অনন্য সুযোগ তৈরি করেছে, যেখানে বিষাক্ত রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে, যদি এই সমস্যা সমাধানের মূল কারণগুলোকে উপেক্ষা করা হয়, তাহলে এই সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারের প্রচেষ্টা অবশ্যই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, কিন্তু এর সাথে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্ন হলো, এই আশার মুহূর্তটি কি স্থায়ী পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে, নাকি এটি পুনরাবৃত্তির আরেকটি অধ্যায় হয়ে থাকবে? এর উত্তর সরকারের, রাজনৈতিক নেতাদের এবং জনগণের সম্মিলিত পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করে। তাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, যা জনগণের সেবা করবে, কিন্তু জনগণকে ব্যবস্থার সেবক করবে না। কেবল তখনই ‘নতুন বাংলাদেশের’ স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হতে পারে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]
এম এ হোসাইন
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪
রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে এমনও মুহূর্ত আসে যখন জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছায় একটি পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করে। দেশের সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে এমন একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে যেখানে সমাজ-রাজনীতির প্রেক্ষাপট পুনর্গঠন এবং একটি অধিকতর ন্যায়সঙ্গত শাসনব্যবস্থা তৈরির সম্ভাবনা উজ্জ্বল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যা এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তারা বিভিন্ন খাতে সংস্কারের পদক্ষেপ নির্ধারণের মাধ্যমে জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু একটি প্রশ্ন রয়েই যায়Ñ এই সংস্কারগুলো কি সেই গণঅসন্তোষের মূল কারণগুলো লক্ষ্য করছে, যা মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছিল, নাকি এগুলো কেবলমাত্র লোকদেখানো বানবাক্য মাত্র?
এই প্রশ্নের গভীরে একটি কঠিন বাস্তবতা লুকিয়ে আছে যা হলো শাসনব্যবস্থায় ও সমাজে একটি বিষাক্ত ‘পুরনো সংস্কৃতি’-র স্থায়িত্ব। এই সংস্কৃতি, কিছু রাজনৈতিক দল, তাদের নেতা এবং এমনকি আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর দ্বারা লালিত, অন্যায়, জবরদস্তি, আর্থিক শোষণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বীজ বপন করেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচ্চপর্যায় থেকে সতর্কতা এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও, এই অসদাচরণগুলো যেন টিকে থাকে এবং অর্থবহ পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলে।
যদিও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকেই এই নেতিবাচক সংস্কৃতি লালন করার জন্য দায়ী করা হয়, তবে সমস্যাটি আসলে অনেক জটিল। আমলাতন্ত্র, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন, এই সমস্যার অংশীদার। সরকারি কর্মকর্তাদের মৌন বা প্রকাশ্য অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতা ও দুর্নীতি বিকশিত হতে পারে না। লোভনীয় ঠিকাদারি মুনাফা থেকে শুরু করে বেআইনি কার্যকলাপ উপেক্ষা করা পর্যন্ত এই ধরনের সহযোগিতা ন্যায়বিচারকে দুর্বল করে এবং জনগণের দুর্ভোগকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।
পুলিশ কর্তৃক রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্যায় সহায়তায় জড়িত থাকাটা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এমন চক্রের পরিণাম বেশ ভয়াবহ হয়েছে, যেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জনকল্যাণের চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। এটি শাসনব্যবস্থার বিশুদ্ধতাকে দুর্বল করে এবং এমন এক দুষ্ট চক্র তৈরি করে যেখানে জনগণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসন উভয়ের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে শতাব্দীর অন্যতম সুযোগ। প্রশাসনিক পরিবর্তনের প্রস্তাব, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে, পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া অতিব জরুরি। তবে, ইতিহাস আমাদের অযথা আশাবাদের বিরুদ্ধে সতর্ক করে। অতীতের এমন প্রচেষ্টা প্রায়শই স্থায়ী ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয়েছে। আমলাতন্ত্রে পরিবর্তন আইনগতভাবে বাস্তবায়ন করা গেলেও, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংস্কার করা আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ।
রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নিজেদের পরিবর্তনের দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের শোষণের গভীর মূলভিত্তি ভেঙে ফেলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা গ্রহণ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সংস্কার ছাড়া, সবচেয়ে সদিচ্ছাপূর্ণ প্রশাসনিক পরিবর্তনগুলোও প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হতে পারে। মূল প্রশ্ন হলোÑ রাজনৈতিক দলগুলো কি নিজেদের স্বার্থ ছাড়িয়ে জনকল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতে সক্ষম হবে? নাকি তারা পুরনো শাসন ও শোষণের পরিচিত পদ্ধতিগুলোতে ফিরে যাবে?
শাসনের সাফল্য বা ব্যর্থতার একটি বড় উপাদান হলো মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নেতৃত্ব। এই নেতাদের কার্যক্রম গোটা প্রশাসনিক কাঠামোর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তবে, ইতিহাস দেখিয়েছে যে আমলাতান্ত্রিক সংস্কার প্রায়ই তাদের দ্বারাই বাধাগ্রস্ত হয়, যারা এই সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকে। আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে সুবিধা নেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয় এমন একটি দায়মুক্তির সংস্কৃতি এই চক্রকে স্থায়ী করে।
‘কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না’Ñ এই উপমাটি এই সমস্যাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করে। বারবার ব্যবস্থাকে শুদ্ধ করার চেষ্টা সত্ত্বেও দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের দাগ যেন থেকে যায়। এই চক্র ভাঙতে হলে এমন ব্যবস্থা প্রয়োজন যা সব পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা এবং আমলাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে তাদের অবস্থান অপব্যবহার প্রতিরোধে কার্যকর প্রক্রিয়া তৈরি।
ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। শাসক, রাজনৈতিক নেতা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যদি রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনগণকে দমন ও শোষণ করার জন্য ব্যবহার করেন, এর ফলাফল প্রায়শই বিপর্যয়কর হয়। যদি জনঅসন্তোষকে কোন শাসক উপেক্ষা করে তবে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের মতো বড় ধরনের অস্থিরতার রূপ তাদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষনীয় বিষয় হতে পারে। এই আন্দোলনগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে গণতান্ত্রিক সরকারের পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলো অগ্রাহ্য করার ঝুঁকি কত বড়।
তবে, এমন আন্দোলনের পর প্রায়ই দেখা যায় দেশ আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে গেছে। আশার মুহূর্তগুলো হতাশায় রূপান্তরিত হয় যখন পুরনো শাসনব্যবস্থার পরিচিত ধাঁচগুলো আবার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চক্রটি স্পষ্ট করে দেয় যে জনগণের অসন্তোষের মূল কারণগুলো নিরসনে প্রকৃত, গভীরমুখী সংস্কার এখন কতটা জরুরি।
প্রশাসনে স্বচ্ছতা কেবল একটি মুখের বুলি নয়; এটি কার্যকর শাসনের ভিত্তি। সংস্কার কার্যকর করতে হলে এর সঙ্গে উন্মুক্ততা এবং জবাবদিহিতার প্রতি প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। এটি রাজনৈতিক দল এবং আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। নেতাদের জনগণের উদ্বেগ শোনার এবং দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ইচ্ছা প্রদর্শন করতে হবে।
জনগণের অংশগ্রহণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিকদের তাদের নেতাদের জবাবদিহি করার ক্ষমতা দিতে হবে, যা স্বাধীন তদারকি সংস্থা এবং তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করার মতো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্ভব। স্বচ্ছতার একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমেই সরকার জনগণের আস্থা পুনর্গঠন করতে পারে এবং এমন একটি শাসন ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে যা সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবায় নিবেদিত।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে, তাদের জনগণের তাৎক্ষণিক দাবি মেটাতে এবং যে গণক্ষোভ তাদের ক্ষমতায় এনেছে তা নিরসন করতে হবে। অন্যদিকে, দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধ করবে। এর জন্য প্রয়োজন বর্তমানের জনচাহিদার সঙ্গে একটি দীর্ঘস্থায়ী, টেকসই সমাধানের ভারসাম্য রক্ষা করা।
পুলিশ প্রশাসন এবং অন্যান্য আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে সংস্কার একটি সঠিক এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে, এই প্রচেষ্টাগুলোর পাশাপাশি সুশাসন এবং রাজনৈতিক জবাবদিহিতা বাড়ানোর জন্য ব্যাপক কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ সংস্কারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে এবং দেশ ও দশের সেবার সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিতে হবে, শোষণ ও শাসনের সংস্কৃতিকে নয়।
এই প্রচেষ্টাগুলোর সফলতা নির্ভর করবে রাজনৈতিক নেতা, আমলা এবং নাগরিকদের পরিবর্তনকে গ্রহণ করার এবং মেনে চলার ইচ্ছার ওপর। সামনে পথচলা হয়তোবা চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে এতে সম্ভাবনাও রয়েছে। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সংকটের মুহূর্তটিকে জাতির জন্য একটি মোড় পরিবর্তনের সুযোগে রূপান্তরিত করতে পারে।
ছাত্রদের আন্দোলন দেশের জন্য একটি অনন্য সুযোগ তৈরি করেছে, যেখানে বিষাক্ত রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে, যদি এই সমস্যা সমাধানের মূল কারণগুলোকে উপেক্ষা করা হয়, তাহলে এই সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারের প্রচেষ্টা অবশ্যই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, কিন্তু এর সাথে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্ন হলো, এই আশার মুহূর্তটি কি স্থায়ী পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে, নাকি এটি পুনরাবৃত্তির আরেকটি অধ্যায় হয়ে থাকবে? এর উত্তর সরকারের, রাজনৈতিক নেতাদের এবং জনগণের সম্মিলিত পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করে। তাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, যা জনগণের সেবা করবে, কিন্তু জনগণকে ব্যবস্থার সেবক করবে না। কেবল তখনই ‘নতুন বাংলাদেশের’ স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হতে পারে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]