শেখর ভট্টাচার্য
যে বাংলাদেশকে আমরা গত কয়েক দশক ধরে দেখছি, এই বাংলাদেশ কি লালনের, হাছনের, রাধারমন, আরকুম শাহের বাংলাদেশ? মরমী কবি, মরমী সাধকদের চেতনায় ঋদ্ধ বাংলাদেশকে খুঁজে পাচ্ছি না কয়েক দশক ধরে। বিষয় বাসনা, ইহজগতের মোহ ত্যাগ করে মানবিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করার যে সংকল্প ছিল বাংলার আদি দার্শনিকদের, সেই মানবিক বাংলাদেশকে আমরা হারিয়ে ফেলছি ক্রমাগত।
আউল-বাউলের দেশ বাংলাদেশ। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাউল দর্শন। সে দর্শনের মূল সুর অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবতাবাদ। বাউল দর্শনের প্রধান পুরুষ মহাত্মা লালন সাঁইজি তার গানে গানে বারবার উচ্চারণ করেছেন মানুষের কথা, অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবতার কথা। এ দর্শন বাংলার গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বন্দরের মানুষ হাজার বছর ধরে মনে পুষে রাখলেও ইদানীং নানাভাবে তা থেকে বের হয়ে এসে অসহনশীল এবং সহিংস হয়ে উঠছে তারা। যেন ভুলতে বসেছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ কিংবা ‘মানুষের জন্য মানুষ’-এর মত মর্মবাণী। বাউল দর্শনের প্রকাশ ঘটে মূলত সঙ্গীতের মাধ্যমে। এ বাউল দর্শন আমাদের সমাজে বেশি প্রসার ঘটতো এবং বাউল দর্শনের পথে মানুষ পরিচালিত হতো, তাহলে অসাম্প্রদায়িকতার এদেশে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠত না।
প্রতিটি আন্দোলনের শেষে প্রত্যয় জেগে ওঠে মানবিক বাংলাদেশ গড়ার। যে মানুষেরা বিপ্লব, আন্দোলন, অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে তারা আসে দেশটিকে মানবিক ভাবে গড়ে তুলতে। হিংসা, প্রতিহিংসা, দলাদলি এসব তো থাকে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে। আন্দোলনকে যেহেতু তারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাই তারা প্রান্তিক মানুষদের স্বপ্ন দেখান, এবার হবে সবাইর বাংলাদেশ, সমতার বাংলাদেশ, সমদৃষ্টির বাংলাদেশ। আন্দোলন শেষে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন ক্ষমতাকে সুসংহত করতে। ক্ষমতার মোহে নিজেদের মধ্যে নিজেরা বিভেদ সৃষ্টি করেন। বিভেদ, অনৈক্য দলাদলির পাঁকে পড়ে এক সময় আন্দোলনের মূল চেতনা জীবন্মৃত হয়ে পড়ে। স্বপ্ন ভঙ্গ হয় নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক মানুষদের।
মানবিক, অসাম্প্রদায়িক সমদৃষ্টির, সমতার বাংলাদেশের খোঁজ করছি আমরা মুক্তিযুদ্ধ উত্তর সময় থেকে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল আমাদের একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। ছেষট্টির ছয় দফার জন্মই তো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের বৈষম্য ঘোচানোর উদ্দেশ্য। ছয় দফা আন্দোলনে সারা বাংলাদেশ জেগে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধে মানুষের এই প্রাণবন্ত, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মূল কারণ হলো এই বৈষম্য নিরসন। এই উপমহাদেশে বিভাজিত অঞ্চল পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিমাংশের ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই নয়; শোষণ-শাসন, নিপীড়ন-বঞ্চনা ইত্যাদির বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি, মনমানসিকতা ও চিন্তাচেতনার পার্থক্যই ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে অধিকতর ক্ষোভ-প্রক্ষিপ্ত করেছিল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তি স্থাপিত হলেও অর্থনীতির ওপর রাজনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। আমরা জানি, এ উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণতা দানের উদ্দেশ্যেই সুনিপুণ নষ্ট পরিকল্পনায় তারা ধর্মকে শোষণের ঢাল হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
কোটা আন্দোলন থেকে সৃষ্ট আন্দোলনের নামকরণ করা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্য নিরসনের কথা শুনলেই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। বৈষম্য নিরসন মানুষের অবচেতনের সব চেয়ে তীব্র আকাক্সক্ষা। সে আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়িত হতে না দেখে মানুষ হতাশ হয়, মানুষের ভেতর ক্ষোভ জন্ম নেয়। বৈষম্য নিরসনের নামে আন্দোলন হয়েছিল বলে চব্বিশের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে প্রান্তিক মানুষেরাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মানুষের মনের ভেতরে যে স্বপ্ন রয়েছে, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে একথাটি তারা বিশ্বাস করেন। এবারও যদি তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয় তাহলে নীরবতার এক ভয়াবহ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে আমাদের বাংলাদেশে। “নীরবতা” বীভৎস! নীরবতা অনেকটা বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্ন চাপের মতো। এই নীরবতাই এক সময় হয়তো বৈষম্য পরায়ন আমাদের এই সমাজে যে কোন সময় বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসতে পারে।
যে কোন বিজয়কে নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ এবং বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন দেশ প্রেমিক শুভ শক্তি সম্পন্ন মানুষের বজ্রকঠিন শপথ। আমরা প্রতিটি বিপ্লবের শেষে দেখেছি ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে ধর্মকে নোংরা ভাবে ব্যবহার করা হয়। শেখ হাসিনা ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্মকে কুৎসিত ভাবে ব্যবহার করেছেন। যে কারণে তিনি বাংলাদেশের কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে পারেননি। সাতচল্লিশের পর থেকে মানুষ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি দেখে হতাশ হয়েছে।
বাঙালি আদিকাল থেকেই ঐতিহ্যিক চেতনায় ধর্মান্ধতা বর্জন করে ধার্মিকতাকে গ্রহণ করার মাধ্যমেই তাদের মানবিক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার শাশ্বত বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে জাতীয়তাবাদের আলোয় প্রজ্বলিত হয়েছিল, যা একুশের চেতনায় পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার- এই মৌলিক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত ঐক্যবদ্ধ বাঙালি বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষার মর্যাদায় সমাসীন করতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে বদ্ধপরিকর ছিল। স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে দীর্ঘ সংগ্রামের বিবক্ষিত পরিক্রমা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় এই অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনাই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয় গভীরে মনোব্যূহ নির্মাণে অপরিসীম ব্রতধারীর ভূমিকা পালন করেছে। সমাজ-সংস্কৃতির বিকাশ আবরণে ধর্ম আপেক্ষিক কোনো বস্তু হিসেবে নয়; সনাতনিক নিয়ম বা স্বাভাবিক সহজ-সরল-মানবিক বৃত্তিকে গঠন করার প্রক্রিয়ায় এর ভূমিকা সাবলীল, অবারিত ও চিরঞ্জীব। আমাদের এই বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য সংখ্যাগুরু বা লঘুর ভিত্তিতে নয়; বরং ধ্যান-ধারণা, ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতি এবং সৃজনশীল মনন-মানসে চিরায়ত মৃন্ময়ী আদান-প্রদান ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।
বস্তুত বাঙালি সংস্কৃতি হলো বহু জাতির সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ফল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ সালে আর্যদের আগমনের আগে ‘ভেড্ডি’ নামে যে মানব বসতির সন্ধান মেলে, সেই থেকে বর্তমান সময় অবধি পর্যন্ত বাঙালি নামক জাতি উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্য সংস্কৃতিকেই তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে রূপ-রূপান্তরের মাধ্যমে আজকের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির রূপ দান করেছে। মূলত বাংলাভাষার সুমধুরতা, আত্মীকরণের অসীম ক্ষমতা, বাঙালি নারীর কমনীয়তা এবং পুরুষের উগ্রবাদের বিপরীতে নমনীয় মধ্যপন্থা এবং সমন্বয়ধর্মিতার সংশ্লেষের মধ্যে যে সৌম্যসৌন্দর্য তাই আজকের রূপ-রূপান্তরের বাঙালি সংস্কৃতির সৌধ নির্মিতিতে মৌল ভূমিকা পালন করেছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, দেশপ্রেম সর্বোপরি নুন্যতম বিশ্বাসকে ভিত্তি করে জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করতে না পারলে আমরা যতো ভাবেই চেষ্টা করিনা কেনো বৈষ্যম্যহীন সমতার বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে বলে মনে করি না। একাত্তরকে পুঁজি করে যারা রাজনীতি করেছেন তারা দলগত ভাবে অন্যায় করেছেন, একাত্তরের ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবন দান এর সাথে সম্পর্কিত নয়। আর মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু শুধু একাত্তর নয়। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। বায়ান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, উনসত্তর, সত্তরের মহান আন্দোলনগুলোতে এদেশের সব শ্রেণীর মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। সম্প্রতি আমরা দেখি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসকে একাত্তর বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের ভেতর বৃত্তাবদ্ধ করা হয়েছে। একাত্তরের যে ভিত্তি রয়েছে, একাত্তরে পৌঁছোনার জন্য লক্ষ কোটি মানুষের ত্যাগ রয়েছে সে ইতিহাস ব্যাপক ভাবে আলোচনা করা হচ্ছে না। কেন আলোচনা করা হচ্ছে না আমরা জানি না। মনে রাখতে হবে শেখ হাসিনার শাসনে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতিফলন ছিল না। শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে সরে এসেছেন এর অর্থ এই নয় যে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, সংবিধান সব কিছু ঘৃণ্য হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনার প্রতি ক্ষোভকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি ক্ষোভ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রকাশ করছেন তারা আবার ভুল পথে হাঁটছেন। এ ভাবে বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ করলে আবারও স্বপ্ন ভঙ্গের দ্বারে উপস্থিত হব।
আমাদের সামনে এক মানবিক বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান। যে কাঠামোয় বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতাকে ভোগ করবে সবাই মিলে। মানবিক মর্যাদায় সবাই শ্রেণীর মানুষ একই কাতারে দাঁড়াবে। চব্বিশের আন্দোলনের পর এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে দাঁড়াবে। মুক্তিযুদ্ধের পরে ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশ বারে বারে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে। আর বারবার হোঁচট খেয়েছে। বৈষম্যহীন, সমদৃষ্টির বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রতিহিংসা ভুলে গিয়ে একাত্তরের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্যের প্রয়োজন। উদার, গণতান্ত্রিক, মুক্ত চিন্তার বাংলাদেশ মানুষকে সমমর্যাদা দিতে সক্ষম হবে। আমরা কী পারব সে পথে এগোতে। নতুন বছরের প্রারম্ভে এটি আমাদের আন্তরিক কামনা।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক ]
শেখর ভট্টাচার্য
বুধবার, ০১ জানুয়ারী ২০২৫
যে বাংলাদেশকে আমরা গত কয়েক দশক ধরে দেখছি, এই বাংলাদেশ কি লালনের, হাছনের, রাধারমন, আরকুম শাহের বাংলাদেশ? মরমী কবি, মরমী সাধকদের চেতনায় ঋদ্ধ বাংলাদেশকে খুঁজে পাচ্ছি না কয়েক দশক ধরে। বিষয় বাসনা, ইহজগতের মোহ ত্যাগ করে মানবিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করার যে সংকল্প ছিল বাংলার আদি দার্শনিকদের, সেই মানবিক বাংলাদেশকে আমরা হারিয়ে ফেলছি ক্রমাগত।
আউল-বাউলের দেশ বাংলাদেশ। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাউল দর্শন। সে দর্শনের মূল সুর অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবতাবাদ। বাউল দর্শনের প্রধান পুরুষ মহাত্মা লালন সাঁইজি তার গানে গানে বারবার উচ্চারণ করেছেন মানুষের কথা, অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবতার কথা। এ দর্শন বাংলার গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বন্দরের মানুষ হাজার বছর ধরে মনে পুষে রাখলেও ইদানীং নানাভাবে তা থেকে বের হয়ে এসে অসহনশীল এবং সহিংস হয়ে উঠছে তারা। যেন ভুলতে বসেছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ কিংবা ‘মানুষের জন্য মানুষ’-এর মত মর্মবাণী। বাউল দর্শনের প্রকাশ ঘটে মূলত সঙ্গীতের মাধ্যমে। এ বাউল দর্শন আমাদের সমাজে বেশি প্রসার ঘটতো এবং বাউল দর্শনের পথে মানুষ পরিচালিত হতো, তাহলে অসাম্প্রদায়িকতার এদেশে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠত না।
প্রতিটি আন্দোলনের শেষে প্রত্যয় জেগে ওঠে মানবিক বাংলাদেশ গড়ার। যে মানুষেরা বিপ্লব, আন্দোলন, অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে তারা আসে দেশটিকে মানবিক ভাবে গড়ে তুলতে। হিংসা, প্রতিহিংসা, দলাদলি এসব তো থাকে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে। আন্দোলনকে যেহেতু তারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাই তারা প্রান্তিক মানুষদের স্বপ্ন দেখান, এবার হবে সবাইর বাংলাদেশ, সমতার বাংলাদেশ, সমদৃষ্টির বাংলাদেশ। আন্দোলন শেষে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন ক্ষমতাকে সুসংহত করতে। ক্ষমতার মোহে নিজেদের মধ্যে নিজেরা বিভেদ সৃষ্টি করেন। বিভেদ, অনৈক্য দলাদলির পাঁকে পড়ে এক সময় আন্দোলনের মূল চেতনা জীবন্মৃত হয়ে পড়ে। স্বপ্ন ভঙ্গ হয় নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক মানুষদের।
মানবিক, অসাম্প্রদায়িক সমদৃষ্টির, সমতার বাংলাদেশের খোঁজ করছি আমরা মুক্তিযুদ্ধ উত্তর সময় থেকে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল আমাদের একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। ছেষট্টির ছয় দফার জন্মই তো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের বৈষম্য ঘোচানোর উদ্দেশ্য। ছয় দফা আন্দোলনে সারা বাংলাদেশ জেগে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধে মানুষের এই প্রাণবন্ত, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মূল কারণ হলো এই বৈষম্য নিরসন। এই উপমহাদেশে বিভাজিত অঞ্চল পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিমাংশের ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই নয়; শোষণ-শাসন, নিপীড়ন-বঞ্চনা ইত্যাদির বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি, মনমানসিকতা ও চিন্তাচেতনার পার্থক্যই ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে অধিকতর ক্ষোভ-প্রক্ষিপ্ত করেছিল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তি স্থাপিত হলেও অর্থনীতির ওপর রাজনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। আমরা জানি, এ উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণতা দানের উদ্দেশ্যেই সুনিপুণ নষ্ট পরিকল্পনায় তারা ধর্মকে শোষণের ঢাল হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
কোটা আন্দোলন থেকে সৃষ্ট আন্দোলনের নামকরণ করা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্য নিরসনের কথা শুনলেই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। বৈষম্য নিরসন মানুষের অবচেতনের সব চেয়ে তীব্র আকাক্সক্ষা। সে আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়িত হতে না দেখে মানুষ হতাশ হয়, মানুষের ভেতর ক্ষোভ জন্ম নেয়। বৈষম্য নিরসনের নামে আন্দোলন হয়েছিল বলে চব্বিশের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে প্রান্তিক মানুষেরাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মানুষের মনের ভেতরে যে স্বপ্ন রয়েছে, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে একথাটি তারা বিশ্বাস করেন। এবারও যদি তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয় তাহলে নীরবতার এক ভয়াবহ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে আমাদের বাংলাদেশে। “নীরবতা” বীভৎস! নীরবতা অনেকটা বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্ন চাপের মতো। এই নীরবতাই এক সময় হয়তো বৈষম্য পরায়ন আমাদের এই সমাজে যে কোন সময় বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসতে পারে।
যে কোন বিজয়কে নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ এবং বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন দেশ প্রেমিক শুভ শক্তি সম্পন্ন মানুষের বজ্রকঠিন শপথ। আমরা প্রতিটি বিপ্লবের শেষে দেখেছি ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে ধর্মকে নোংরা ভাবে ব্যবহার করা হয়। শেখ হাসিনা ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্মকে কুৎসিত ভাবে ব্যবহার করেছেন। যে কারণে তিনি বাংলাদেশের কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে পারেননি। সাতচল্লিশের পর থেকে মানুষ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি দেখে হতাশ হয়েছে।
বাঙালি আদিকাল থেকেই ঐতিহ্যিক চেতনায় ধর্মান্ধতা বর্জন করে ধার্মিকতাকে গ্রহণ করার মাধ্যমেই তাদের মানবিক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার শাশ্বত বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে জাতীয়তাবাদের আলোয় প্রজ্বলিত হয়েছিল, যা একুশের চেতনায় পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার- এই মৌলিক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত ঐক্যবদ্ধ বাঙালি বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষার মর্যাদায় সমাসীন করতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে বদ্ধপরিকর ছিল। স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে দীর্ঘ সংগ্রামের বিবক্ষিত পরিক্রমা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় এই অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনাই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয় গভীরে মনোব্যূহ নির্মাণে অপরিসীম ব্রতধারীর ভূমিকা পালন করেছে। সমাজ-সংস্কৃতির বিকাশ আবরণে ধর্ম আপেক্ষিক কোনো বস্তু হিসেবে নয়; সনাতনিক নিয়ম বা স্বাভাবিক সহজ-সরল-মানবিক বৃত্তিকে গঠন করার প্রক্রিয়ায় এর ভূমিকা সাবলীল, অবারিত ও চিরঞ্জীব। আমাদের এই বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য সংখ্যাগুরু বা লঘুর ভিত্তিতে নয়; বরং ধ্যান-ধারণা, ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতি এবং সৃজনশীল মনন-মানসে চিরায়ত মৃন্ময়ী আদান-প্রদান ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।
বস্তুত বাঙালি সংস্কৃতি হলো বহু জাতির সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ফল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ সালে আর্যদের আগমনের আগে ‘ভেড্ডি’ নামে যে মানব বসতির সন্ধান মেলে, সেই থেকে বর্তমান সময় অবধি পর্যন্ত বাঙালি নামক জাতি উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্য সংস্কৃতিকেই তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে রূপ-রূপান্তরের মাধ্যমে আজকের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির রূপ দান করেছে। মূলত বাংলাভাষার সুমধুরতা, আত্মীকরণের অসীম ক্ষমতা, বাঙালি নারীর কমনীয়তা এবং পুরুষের উগ্রবাদের বিপরীতে নমনীয় মধ্যপন্থা এবং সমন্বয়ধর্মিতার সংশ্লেষের মধ্যে যে সৌম্যসৌন্দর্য তাই আজকের রূপ-রূপান্তরের বাঙালি সংস্কৃতির সৌধ নির্মিতিতে মৌল ভূমিকা পালন করেছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, দেশপ্রেম সর্বোপরি নুন্যতম বিশ্বাসকে ভিত্তি করে জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করতে না পারলে আমরা যতো ভাবেই চেষ্টা করিনা কেনো বৈষ্যম্যহীন সমতার বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে বলে মনে করি না। একাত্তরকে পুঁজি করে যারা রাজনীতি করেছেন তারা দলগত ভাবে অন্যায় করেছেন, একাত্তরের ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবন দান এর সাথে সম্পর্কিত নয়। আর মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু শুধু একাত্তর নয়। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। বায়ান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, উনসত্তর, সত্তরের মহান আন্দোলনগুলোতে এদেশের সব শ্রেণীর মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। সম্প্রতি আমরা দেখি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসকে একাত্তর বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের ভেতর বৃত্তাবদ্ধ করা হয়েছে। একাত্তরের যে ভিত্তি রয়েছে, একাত্তরে পৌঁছোনার জন্য লক্ষ কোটি মানুষের ত্যাগ রয়েছে সে ইতিহাস ব্যাপক ভাবে আলোচনা করা হচ্ছে না। কেন আলোচনা করা হচ্ছে না আমরা জানি না। মনে রাখতে হবে শেখ হাসিনার শাসনে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতিফলন ছিল না। শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে সরে এসেছেন এর অর্থ এই নয় যে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, সংবিধান সব কিছু ঘৃণ্য হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনার প্রতি ক্ষোভকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি ক্ষোভ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রকাশ করছেন তারা আবার ভুল পথে হাঁটছেন। এ ভাবে বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ করলে আবারও স্বপ্ন ভঙ্গের দ্বারে উপস্থিত হব।
আমাদের সামনে এক মানবিক বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান। যে কাঠামোয় বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতাকে ভোগ করবে সবাই মিলে। মানবিক মর্যাদায় সবাই শ্রেণীর মানুষ একই কাতারে দাঁড়াবে। চব্বিশের আন্দোলনের পর এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে দাঁড়াবে। মুক্তিযুদ্ধের পরে ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশ বারে বারে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে। আর বারবার হোঁচট খেয়েছে। বৈষম্যহীন, সমদৃষ্টির বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রতিহিংসা ভুলে গিয়ে একাত্তরের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্যের প্রয়োজন। উদার, গণতান্ত্রিক, মুক্ত চিন্তার বাংলাদেশ মানুষকে সমমর্যাদা দিতে সক্ষম হবে। আমরা কী পারব সে পথে এগোতে। নতুন বছরের প্রারম্ভে এটি আমাদের আন্তরিক কামনা।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক ]