ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ পার করছে। মূলত সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট স্ফুলিঙ্গ দ্রুত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা এবং কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এই অভ্যুত্থানে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে জনগণের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। পুলিশ প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে জনগণের সঙ্গে সৌহার্দ প্রদর্শনের চাইতে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকেই জরুরি মনে করত, যে কারণে বাহিনীটি ক্রমেই অকার্যকর হতে থাকে এবং সমাজে বিভাজনের পরিবেশ তরান্বিত হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম ও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের অভিযোগে ক্রমেই পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা নিম্নমুখী। সেবা ও সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশকে হরহামেশাই মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিকে উহ্য রেখে একটি সংকীর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকতে দেখা যায়। এই সত্যটি বাংলাদেশের পক্ষে আর অমীমাংসিত রাখা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সংস্কার করতে হলে অবশ্যই ১৮৬১ সালের সেই ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশ অ্যাক্ট থেকে সরে আসতে হবেÑ যে আইনে সেবার চেয়ে নিয়ন্ত্রণেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ২০০৭ সালে এবং আবার ২০১৩ সালে, একটি পুলিশ সংস্কার প্রকল্পের অধীনে নতুন একটি পুলিশ অধ্যাদেশের খসড়া তৈরিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা প্রদান করা হয়েছিল। এর কাজ চলমান ছিল ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল অবধি। এই খসড়া অধ্যাদেশটিতে গণতান্ত্রিক, জনবান্ধব পুলিশিং এর লক্ষ্যে, একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি প্রাতিষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণ ব্যবস্থাসহ জনসাধারণের পক্ষ থেকে তদারকি এবং জবাবদিহিতা আদায়ের বিধান রাখা হয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও খসড়া অধ্যাদেশ এবং ২০১৩ সালের পর্যালোচনা রাজনৈতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্তের অভাবে থমকে যায়।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে একটি পেশাদার, জবাবদিহিমূলক এবং দক্ষ পরিষেবা দান-এর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরকে শক্তিশালী ভিত্তি এনে দিতে পুলিশিং সম্পর্কিত একটি নতুন আইনি কাঠামো প্রয়োজন। এই আইন বলবত হলে টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বাস্তবায়িত হবে, যা ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করবে, নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের সুরক্ষা দেবে এবং পুলিশ ও জনগণের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলবে। বাংলাদেশে পুলিশ সংস্কারের লক্ষ্য হতে হবে এমন একটি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা যা হবে গণতান্ত্রিক, জনমুখী এবং সমাজে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত নানাবিধ চাহিদা পূরণে করিতকর্মা। এর জন্য আইনি কাঠামো থেকে শুরু করে পুলিশ কল্যাণ, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণ, প্রশিক্ষণ এবং জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির অনুশীলন পর্যন্ত বিদ্যমান ব্যবস্থার সবকিছুরই সংস্কার প্রয়োজন। পুলিশকে জননিরাপত্তা ও মানবাধিকারের রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে।
এই সংস্কারের জন্য একটি কাঠামোগত পদ্ধতির প্রয়োজন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনকেও পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ও আনসার ভিডিপি বাহিনীর জন্য নতুন পোশাকের অনুমোদন হয়। কোন বাহিনীকে শুধু পোশাক দিয়ে বাহিনীর সার্বিক সংস্কার হবে না। সংস্কারের জন্য দৃষ্টিভঙ্গিগত, কিছু অন্তর্নিহিত বিষয়ের দিকে নজর দিতে হয়। সেগুলো যেমন মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। পুলিশ সংস্কার কমিটি প্রশ্নোউত্তর জরিপের ভিত্তিতে সরকারের কাছে রিপোর্ট দাখিল করেছে বটে। কমিটি এক্ষেত্রে কোন মৌলিকতার স্বাক্ষর বা ছাপ রাখতে সক্ষম হয়নি বলে মনে হয়েছে বরং কমিটি তার সদস্যদের নিজস্ব মেধা, বুদ্ধি, বিবেচনা ও অভিজ্ঞতাকে এ রিপোর্টে স্থান দিলে তা ভালো হতো। এ ক্ষেত্রে অতীত কার্যকালাপ, আন্তঃবাহিনী সম্পর্ক এবং পুলিশের সক্ষমতা, দুর্বলতা, ক্ষমতা, চুরি, দুর্নীতি ইত্যাদি অপকর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতা ও কতৃত্ববাদিতা, অবকাঠমোগত চিত্র কর্মপদ্ধতি, সম্পাদিত কাজের মান, মনিটরিং ব্যবস্থা, মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ ও সর্বোপরি তদারকিমূলক কাজের নিয়ন্ত্রণসহ স্থানীয় ন্যায়পাল কমিশন গঠনের কথা ভাবতে হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে যে কোন সংস্কারের বিষয়কে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনায় আনতে হবে। এছাড়া বাহিনীর ইমেজ বৃদ্ধির জন্য জনগণের সঙ্গে পুলিশের/আনসারের আন্তসম্পর্কীয় সভা-সেমিনার এবং যোগাযোগ স্থাপনের কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। অধিকন্ত পুলিশের/আনসারের প্রশিক্ষণের মান বৃদ্ধি হলে সার্বিকভাবে ভালো পুলিশিং নিশ্চিত করা যাবে। এছাড়া সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধে আগ্রহী অনুপ্রাণিত পুলিশ/আনসার সদস্যই বাহিনীর ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। সর্বোপরি পুলিশ/আনসার বাহিনীকে স্থানীয় সরকারের নিরাপত্তা ও পুলিশিং দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। আসামি দিনে বাংলাদেশের সুশাসন কতটা সুদৃঢ় হবে তা নির্ভর করবে একটি জনবান্ধবমুখী পুলিশ প্রশাসনের ওপর। আজকে একটি বিতর্কিত প্রশ্ন পুলিশকে জনবান্ধব নীতি থেকে দূরে রেখে সরকারের সুবিধাভোগী শ্রেণীতে পরিণত করা হয়েছে তথা দলীয়করণ বিতর্কে বিতর্কিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের এ যাবতকালের কোন সরকারকেই এ বিতর্কের ঊর্ধ্বে বলা যায় না। তবে মোটা দাগে পুলিশের সঠিক নেতৃত্ব ও চেইন অফ কমান্ড এর মাধ্যমে একটি নির্ভরযোগ্য পুলিশ প্রশাসন গঠিত হতে পারে। একটি রাষ্ট্রের যাবতীয় সব দায়িত্ব এককভাবে পুলিশের ওপর ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। এতে পুলিশ বাহিনীর ক্ষমতায়নের মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
তারা তাদেরকে চরম ও পরম ক্ষমতার অধিকারী মনে করে এবং প্রকারান্তরে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব কাজে তাদের প্রভুত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করে থাকে। এমতাবস্থায় পুলিশিং কে পুলিশিং করার কোনো বিকল্প নেই। অতএব নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সেবামুখী পুলিশ প্রশাসনে জাতির ভবিষ্যৎ কা-ারি। অধিকন্তু কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের প্রধান চাবিকাঠি। সর্বোপরি সৎ, দক্ষ ও দায়িত্বশীল পুলিশিং ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পুলিশিং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রকৃত কল্যাণ সম্ভব হবে। পুলিশ-সম্পর্কিত যে কোনো ঘটনা বা বিষয়ের সঠিক ও সুষ্ঠু ব্যাখা দেয়া প্রয়োজন। পুলিশ কর্তৃক সংঘটিত যে কোনো অপরাধ বা পুলিশের প্রতি যে কোনো অসম্মান এবং আঘাতের সঠিক ও সুচারু তদন্ত করতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়ন ও সেই সঙ্গে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সর্বশেষে বলা আবশ্যক যে পুলিশকে সমালোচনার পাশাপাশি ভালো কাজে উৎসাহ ও প্রশংসা করতে হবে। তাহলে একটা টেকসই সংস্কার সাধিত হবে এবং আপামর জনসাধারণ, পুলিশ এবং দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ও আনসার ভিডিপি বাহিনীর প্রতিষ্ঠা দিবস ও পুলিশ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিক উদযাপন হওয়ার কথা ছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ দুটি অনুষ্ঠানকে প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতা সীমাবদ্ধ না রেখে সীমিত পরিসরে দিবস সপ্তাহ পালনের কর্মসূচি নেয়া হয়। এটা বাহিনীর সদস্যদের ওপর কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা তা আলোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। গণঅভ্যুত্থানকালে পুলিশ ও আনসার বাহিনী এক কঠিন ট্রমার সম্মুখীন হয়। উভয় বাহিনীকে ঢেলে সাজিয়ে কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত করে সদস্যদের ট্রমামুক্ত করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের নতুন শক্তিতে বলিয়ান ও শক্তিমান করতে হবে।
[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
 
                                         
                                         ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                        ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                           	                                            ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ পার করছে। মূলত সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট স্ফুলিঙ্গ দ্রুত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা এবং কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এই অভ্যুত্থানে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে জনগণের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। পুলিশ প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে জনগণের সঙ্গে সৌহার্দ প্রদর্শনের চাইতে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকেই জরুরি মনে করত, যে কারণে বাহিনীটি ক্রমেই অকার্যকর হতে থাকে এবং সমাজে বিভাজনের পরিবেশ তরান্বিত হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম ও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের অভিযোগে ক্রমেই পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা নিম্নমুখী। সেবা ও সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশকে হরহামেশাই মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিকে উহ্য রেখে একটি সংকীর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকতে দেখা যায়। এই সত্যটি বাংলাদেশের পক্ষে আর অমীমাংসিত রাখা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সংস্কার করতে হলে অবশ্যই ১৮৬১ সালের সেই ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশ অ্যাক্ট থেকে সরে আসতে হবেÑ যে আইনে সেবার চেয়ে নিয়ন্ত্রণেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ২০০৭ সালে এবং আবার ২০১৩ সালে, একটি পুলিশ সংস্কার প্রকল্পের অধীনে নতুন একটি পুলিশ অধ্যাদেশের খসড়া তৈরিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা প্রদান করা হয়েছিল। এর কাজ চলমান ছিল ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল অবধি। এই খসড়া অধ্যাদেশটিতে গণতান্ত্রিক, জনবান্ধব পুলিশিং এর লক্ষ্যে, একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি প্রাতিষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণ ব্যবস্থাসহ জনসাধারণের পক্ষ থেকে তদারকি এবং জবাবদিহিতা আদায়ের বিধান রাখা হয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও খসড়া অধ্যাদেশ এবং ২০১৩ সালের পর্যালোচনা রাজনৈতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্তের অভাবে থমকে যায়।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে একটি পেশাদার, জবাবদিহিমূলক এবং দক্ষ পরিষেবা দান-এর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরকে শক্তিশালী ভিত্তি এনে দিতে পুলিশিং সম্পর্কিত একটি নতুন আইনি কাঠামো প্রয়োজন। এই আইন বলবত হলে টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বাস্তবায়িত হবে, যা ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করবে, নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের সুরক্ষা দেবে এবং পুলিশ ও জনগণের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলবে। বাংলাদেশে পুলিশ সংস্কারের লক্ষ্য হতে হবে এমন একটি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা যা হবে গণতান্ত্রিক, জনমুখী এবং সমাজে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত নানাবিধ চাহিদা পূরণে করিতকর্মা। এর জন্য আইনি কাঠামো থেকে শুরু করে পুলিশ কল্যাণ, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণ, প্রশিক্ষণ এবং জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির অনুশীলন পর্যন্ত বিদ্যমান ব্যবস্থার সবকিছুরই সংস্কার প্রয়োজন। পুলিশকে জননিরাপত্তা ও মানবাধিকারের রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে।
এই সংস্কারের জন্য একটি কাঠামোগত পদ্ধতির প্রয়োজন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনকেও পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ও আনসার ভিডিপি বাহিনীর জন্য নতুন পোশাকের অনুমোদন হয়। কোন বাহিনীকে শুধু পোশাক দিয়ে বাহিনীর সার্বিক সংস্কার হবে না। সংস্কারের জন্য দৃষ্টিভঙ্গিগত, কিছু অন্তর্নিহিত বিষয়ের দিকে নজর দিতে হয়। সেগুলো যেমন মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। পুলিশ সংস্কার কমিটি প্রশ্নোউত্তর জরিপের ভিত্তিতে সরকারের কাছে রিপোর্ট দাখিল করেছে বটে। কমিটি এক্ষেত্রে কোন মৌলিকতার স্বাক্ষর বা ছাপ রাখতে সক্ষম হয়নি বলে মনে হয়েছে বরং কমিটি তার সদস্যদের নিজস্ব মেধা, বুদ্ধি, বিবেচনা ও অভিজ্ঞতাকে এ রিপোর্টে স্থান দিলে তা ভালো হতো। এ ক্ষেত্রে অতীত কার্যকালাপ, আন্তঃবাহিনী সম্পর্ক এবং পুলিশের সক্ষমতা, দুর্বলতা, ক্ষমতা, চুরি, দুর্নীতি ইত্যাদি অপকর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতা ও কতৃত্ববাদিতা, অবকাঠমোগত চিত্র কর্মপদ্ধতি, সম্পাদিত কাজের মান, মনিটরিং ব্যবস্থা, মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ ও সর্বোপরি তদারকিমূলক কাজের নিয়ন্ত্রণসহ স্থানীয় ন্যায়পাল কমিশন গঠনের কথা ভাবতে হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে যে কোন সংস্কারের বিষয়কে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনায় আনতে হবে। এছাড়া বাহিনীর ইমেজ বৃদ্ধির জন্য জনগণের সঙ্গে পুলিশের/আনসারের আন্তসম্পর্কীয় সভা-সেমিনার এবং যোগাযোগ স্থাপনের কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। অধিকন্ত পুলিশের/আনসারের প্রশিক্ষণের মান বৃদ্ধি হলে সার্বিকভাবে ভালো পুলিশিং নিশ্চিত করা যাবে। এছাড়া সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধে আগ্রহী অনুপ্রাণিত পুলিশ/আনসার সদস্যই বাহিনীর ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। সর্বোপরি পুলিশ/আনসার বাহিনীকে স্থানীয় সরকারের নিরাপত্তা ও পুলিশিং দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। আসামি দিনে বাংলাদেশের সুশাসন কতটা সুদৃঢ় হবে তা নির্ভর করবে একটি জনবান্ধবমুখী পুলিশ প্রশাসনের ওপর। আজকে একটি বিতর্কিত প্রশ্ন পুলিশকে জনবান্ধব নীতি থেকে দূরে রেখে সরকারের সুবিধাভোগী শ্রেণীতে পরিণত করা হয়েছে তথা দলীয়করণ বিতর্কে বিতর্কিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের এ যাবতকালের কোন সরকারকেই এ বিতর্কের ঊর্ধ্বে বলা যায় না। তবে মোটা দাগে পুলিশের সঠিক নেতৃত্ব ও চেইন অফ কমান্ড এর মাধ্যমে একটি নির্ভরযোগ্য পুলিশ প্রশাসন গঠিত হতে পারে। একটি রাষ্ট্রের যাবতীয় সব দায়িত্ব এককভাবে পুলিশের ওপর ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। এতে পুলিশ বাহিনীর ক্ষমতায়নের মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
তারা তাদেরকে চরম ও পরম ক্ষমতার অধিকারী মনে করে এবং প্রকারান্তরে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব কাজে তাদের প্রভুত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করে থাকে। এমতাবস্থায় পুলিশিং কে পুলিশিং করার কোনো বিকল্প নেই। অতএব নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সেবামুখী পুলিশ প্রশাসনে জাতির ভবিষ্যৎ কা-ারি। অধিকন্তু কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের প্রধান চাবিকাঠি। সর্বোপরি সৎ, দক্ষ ও দায়িত্বশীল পুলিশিং ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পুলিশিং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রকৃত কল্যাণ সম্ভব হবে। পুলিশ-সম্পর্কিত যে কোনো ঘটনা বা বিষয়ের সঠিক ও সুষ্ঠু ব্যাখা দেয়া প্রয়োজন। পুলিশ কর্তৃক সংঘটিত যে কোনো অপরাধ বা পুলিশের প্রতি যে কোনো অসম্মান এবং আঘাতের সঠিক ও সুচারু তদন্ত করতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়ন ও সেই সঙ্গে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সর্বশেষে বলা আবশ্যক যে পুলিশকে সমালোচনার পাশাপাশি ভালো কাজে উৎসাহ ও প্রশংসা করতে হবে। তাহলে একটা টেকসই সংস্কার সাধিত হবে এবং আপামর জনসাধারণ, পুলিশ এবং দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ও আনসার ভিডিপি বাহিনীর প্রতিষ্ঠা দিবস ও পুলিশ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিক উদযাপন হওয়ার কথা ছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ দুটি অনুষ্ঠানকে প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতা সীমাবদ্ধ না রেখে সীমিত পরিসরে দিবস সপ্তাহ পালনের কর্মসূচি নেয়া হয়। এটা বাহিনীর সদস্যদের ওপর কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা তা আলোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। গণঅভ্যুত্থানকালে পুলিশ ও আনসার বাহিনী এক কঠিন ট্রমার সম্মুখীন হয়। উভয় বাহিনীকে ঢেলে সাজিয়ে কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত করে সদস্যদের ট্রমামুক্ত করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের নতুন শক্তিতে বলিয়ান ও শক্তিমান করতে হবে।
[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
