alt

উপ-সম্পাদকীয়

এক যে ছিল স্বৈরাচারের আশির দশক!

আনোয়ারুল হক

: রোববার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

সাধারণভাবে নতুন স্মৃতি পুরোনোকে মনে রাখা কঠিন করে তোলে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভুলে যাওয়া খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়টি মস্তিষ্ক দ্বারা পরিচালিত হয়। আবার ইতিহাসের এমন এমন কিছু অধ্যায় মস্তিষ্কের কুঠরিতে এমনভাবে জায়গা করে নেয় যা আর মানুষ ভুলতে পারে না। যেমন আমাদের জেনারেশন সেই কৈশোরে যারা ’৬৯ দেখেছে, অল্পস্বল্প মিছিলে হেঁটেছে তাদের স্মৃতিতে ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান উজ্জ্বল। শুধু অভ্যুত্থানই নয় বিজয়ী অভ্যুত্থানের যে রাজনৈতিক ফলাফল তা কিভাবে দ্রুত একটা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচনের রায়কে পাকিস্তানি শাসকেরা অস্বীকার করার ফলে কীভাবে এক নদী রক্ত পেরিয়ে একটা স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হলো-সবই আমাদের সামনে আমাদের কম বেশি অংশগ্রহণে ঘটে গেল।

আবার এই যে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এর ভ্রƒণ সৃষ্টি হয়েছিল ’৫২-র ভাষা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে-যা আমাদের জেনারেশন দেখেনি। কিন্তু একটা জাতির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আমাদের ইতিহাসকে এমনভাবে স্পর্শ করে আছে মনে হয় আমরাও সালাম বরকতের সঙ্গে পথ হেঁটেছি। একটা জাতি বা জনগোষ্ঠীর বিকাশের ইতিহাস এমনই-চাইলেই মুছে ফেলা যায় না, মুছেও না।

১৯৮২ থেকে ’৯০ অর্থাৎ প্রায় গোটা ’৮০-র দশক জুড়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘস্থায়ী গণসংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৮২-৮৩সনে এ সংগ্রামের সূচনা করেছিল বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ এবং যার এক ধরনের পরিসমাপ্তি হয়েছিল ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দমন পীড়নের প্রথম লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বেছে নেন। সামরিক ফরমান জারি করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এমনকি হলসমূহের অভ্যন্তরেও কোনো সভা সমাবেশ মিছিল করা যাবে না। পাঁচজনের বেশি একত্রিত হওয়া যাবে না। মিলাদ বা দোয়া মাহফিল করতে হলেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামরিক ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিতে হবে। একের পর এক এ ধরনের অপমানজনক ফরমান ছাত্রদের আত্মসম্মানে আঘাত হানে। এবং একতরফা ভাবে শিক্ষা বিশেষত উচ্চ শিক্ষাকে সাধারণের জন্য সংকোচন এবং প্রাথমিক স্তর থেকেই শিশু মনে সাম্প্রদায়িক ভেদ বিভেদ সৃষ্টির শিক্ষা নীতি ঘোষণা করার ফলে ছাত্র আন্দোলনে ভাটার টান থাকলেও গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধের ডাক দিলে ছাত্র সমাজ দ্রুতই সাড়া দেয়। প্রতিরোধের আকাক্সক্ষায় ছাত্র আন্দোলনে এক নব উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। তবে অগ্রসর হওয়ার পথ মসৃণ ছিল না। সামরিক শাসনের মধ্যে আঁকাবাঁকা নানা পথে নানা কৌশলে সেদিনের ছাত্র আন্দোলনকে অগ্রসর করতে হয়েছিল। এবং অবশেষে ১৪ ফেব্রুয়ারি ’৮৩ তারিখে সামরিক আইন ভেঙে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক বিশাল ছাত্র মিছিল স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশে রওনা হয় সচিবালয়ের পথে।

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিছিল এগিয়ে চলেছে সচিবালয় অভিমুখে ভীত শাসকেরা সেই মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। শহীদের মৃত্যু বরণ করেন জয়নাল এবং পরবর্তীতে মোজাম্মেল ও কাঞ্চন। গুম করে ফেলা হয় অনেক লাশ। রাতের আঁধারে নেমে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন যা থেকে ছাত্রী হলও বাদ যায়নি। দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র আন্দোলনের যে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল দমন-পীড়নের মাধ্যমে তাকে নিভিয়ে দেয়া যায়নি। বরং তা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। গড়ে ওঠে সামরিক শাসন বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের জোট, শ্রমিক-কর্মচারীদের জোট, পেশাজীবী আন্দোলন, কৃষক-খেতমজুর আন্দোলন, সাংস্কৃতিক জোট, এমনকি কবিতা পরিষদের মতো সংগঠনের আন্দোলন। সামরিক শাসনের অবসান এবং নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে গনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের নানা পর্বে ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ছাত্র আন্দোলনের কর্মী সেলিম-দেলোয়ারকে পুলিশের ট্রাকের চাকায় পিষ্ট করে হত্যা করা হয়। ছাত্র কর্মী রাউফুন বসুনিয়া, শাহজাহান সিরাজ এবং এক জটিল পর্বে আসলাম প্রমুখের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলন অগ্রসর হয়। এ লড়াইয়ে শ্রমিক নেতা তাজুল ও খেতমজুর আন্দোলনের কর্মী টিটোর আত্মদান আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। আর অতি সাধারণ মানুষের হাতে লেখা ও বুকে পিঠে আঁকা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ হয়ে যায় সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। শহীদ নূর হোসেন যেন গণতন্ত্রের সংগ্রামের প্রতীক। এমনিভাবে সংগ্রামের নানা পর্বে অসংখ্য শহীদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি রক্তপতাকা হাতে ছাত্র সমাজ অগ্রসর হয়েছে ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পথে এবং অভ্যুত্থানের বিজয় মশাল জ্বালাতে শেষ মুহূর্তে জীবন উৎসর্গ করেন সেই ১৪ ফেব্রুয়ারির মিছিলের মুখ আর ৯০-এ পেশাজীবী আন্দোলনের নেতা ডা. মিলন।

সামরিক শাসন আর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আশির দশকজুড়ে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার লড়াই এবং নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসের অংশ। তেমনি ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে ২০২৪-এর বীরত্বপূর্ন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান। কোন আন্দোলন বা গণসংগ্রামই চেনা ছক বা ছন্দে সীমাবদ্ধ থাকে না। তাই তো সৃষ্টি হয় নতুন নতুন ইতিহাস। এবারের জুলাই ছাত্র গণঅভ্যুত্থান বিশেষ করে তারুণ্যের জাগরণ যে বৈশিষ্ট্য নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল তা অন্য সময়ের থেকে ভিন্নতর এবং অতিসাম্প্রতিক। তাই আবু সাইদের বীরত্ব বা মুগ্ধর মুগ্ধতা, রিকশার পাদানিতে গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজ আমাদের গভীরভাবে আলোড়িত করে। তেমনি সেলিম-দেলোয়ারের পুলিশের ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে আত্মদানের কাহিনী কিংবা ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক তাজুল ইসলামের আদমজীতে কারখানা শ্রমিক হিসাবে চাকরি নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে জীবন বলিদান, নূর হোসেনের বীরত্বগাথা কিংবা ডা. মিলনের আত্মোৎসর্গ সবই ইতিহাসের অংশ।

ইতিহাসের একটা অংশ দিয়ে আরেকটা অংশ ঢেকে ফেলার প্রচেষ্টা হবে আত্মঘাতী। এবং শেষ বিচারে তা সফল হয় না। কিন্তু তার পরেও বর্ণচোরা এক গোষ্ঠী জাতির সব বীরত্বগাথা ও গৌরবের ইতিহাসকে ডিলিট করে শুধু ’২৪-কে প্রতিস্থাপন করতে চাইছে। প্রায় এক দশকের সামরিক শাসনের ঘন আঁধারে ১৪ ফেব্রুয়ারি ৮৩ ছিল ধ্রুবতারার মতো। এবং ১৪ ফেব্রুয়ারিই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে দ্রোহের আগুন জে¦লেছিল এবং তা অবসান না হওয়া পর্যন্ত ওই সময়ের সংগ্রামে দ্যুতি হিসেবে থেকেছে। আর ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়ে আসছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসাবে।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন ]

অস্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক বায়ুদূষণ

আদিবাসীদের কাঁটাতারে বন্দি জীবন

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন : বাংলাদেশের কৌশল

শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গে

আর জি কর ঘিরে শাসক কৌশল প্রসঙ্গে

নিজের পথে ইউরোপ

ছবি

এই দাহ্য আগুন কি বিপ্লবী হতাশার বাহ্য রূপ

ভূমিজ বাঁওড় মৎস্যজীবীদের সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানা

মব থামাবে কে?

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

ফিরে দেখা বসন্ত উৎসব

রম্যগদ্য : কানামাছির রাজনীতি

চেকের মামলায় জেল খাটলেও টাকা আদায়ের আইনি প্রক্রিয়া

প্রতিক্রিয়াশীলতার ছায়াতলে কেবলই অন্ধকার

স্মরণ : গুরু রবিদাস জী

মাঘী পূর্ণিমা : সম্প্রীতির মধুময় স্মৃতি

ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনার বিপজ্জনক বাস্তবতা

পুলিশে কেমন সংস্কার চাই?

সত্যিই কি ইউএসএআইডি বন্ধ হয়ে যাবে

রম্যগদ্য: “গো টু দ্য ডেভিল”

এত ক্রোধ, প্রতিহিংসা আর অস্থিরতাÑ সবই কি স্বৈরাচারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া!

কীভাবে আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়?

কেন এই ধ্বংস?

প্রসঙ্গ: সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

পশ্চিমবঙ্গ : রাজনৈতিক হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : উত্তরণের উপায়

কুষ্ঠ : স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে ইস্যুটি কেন গুরুত্বপূর্ণ

ঔপনিবেশিকতা নাকি মানবতার অবমূল্যায়ন?

রম্যগদ্য : ‘নারী মানেই ব্যভিচারী...’

প্রসঙ্গ: সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫

ছবি

নীরদ সি চৌধুরী : পেন্ডুলামের মতো দোলায়মান এক বাঙালি চরিত্র

ভোজবাজি ও ভানুমতির খেলা

সড়কে কিশোর মোটরবাইকার : নিয়ন্ত্রণ জরুরি

মব জাস্টিস আইনের শাসনের পরিপন্থি

ছবি

গভীর সংকট আর বড় সম্ভাবনা পাশাপাশি হাঁটছে

জ্ঞানদায়িনী মা সরস্বতী দেবী

tab

উপ-সম্পাদকীয়

এক যে ছিল স্বৈরাচারের আশির দশক!

আনোয়ারুল হক

রোববার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

সাধারণভাবে নতুন স্মৃতি পুরোনোকে মনে রাখা কঠিন করে তোলে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভুলে যাওয়া খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়টি মস্তিষ্ক দ্বারা পরিচালিত হয়। আবার ইতিহাসের এমন এমন কিছু অধ্যায় মস্তিষ্কের কুঠরিতে এমনভাবে জায়গা করে নেয় যা আর মানুষ ভুলতে পারে না। যেমন আমাদের জেনারেশন সেই কৈশোরে যারা ’৬৯ দেখেছে, অল্পস্বল্প মিছিলে হেঁটেছে তাদের স্মৃতিতে ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান উজ্জ্বল। শুধু অভ্যুত্থানই নয় বিজয়ী অভ্যুত্থানের যে রাজনৈতিক ফলাফল তা কিভাবে দ্রুত একটা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচনের রায়কে পাকিস্তানি শাসকেরা অস্বীকার করার ফলে কীভাবে এক নদী রক্ত পেরিয়ে একটা স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হলো-সবই আমাদের সামনে আমাদের কম বেশি অংশগ্রহণে ঘটে গেল।

আবার এই যে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এর ভ্রƒণ সৃষ্টি হয়েছিল ’৫২-র ভাষা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে-যা আমাদের জেনারেশন দেখেনি। কিন্তু একটা জাতির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আমাদের ইতিহাসকে এমনভাবে স্পর্শ করে আছে মনে হয় আমরাও সালাম বরকতের সঙ্গে পথ হেঁটেছি। একটা জাতি বা জনগোষ্ঠীর বিকাশের ইতিহাস এমনই-চাইলেই মুছে ফেলা যায় না, মুছেও না।

১৯৮২ থেকে ’৯০ অর্থাৎ প্রায় গোটা ’৮০-র দশক জুড়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘস্থায়ী গণসংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৮২-৮৩সনে এ সংগ্রামের সূচনা করেছিল বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ এবং যার এক ধরনের পরিসমাপ্তি হয়েছিল ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দমন পীড়নের প্রথম লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বেছে নেন। সামরিক ফরমান জারি করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এমনকি হলসমূহের অভ্যন্তরেও কোনো সভা সমাবেশ মিছিল করা যাবে না। পাঁচজনের বেশি একত্রিত হওয়া যাবে না। মিলাদ বা দোয়া মাহফিল করতে হলেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামরিক ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিতে হবে। একের পর এক এ ধরনের অপমানজনক ফরমান ছাত্রদের আত্মসম্মানে আঘাত হানে। এবং একতরফা ভাবে শিক্ষা বিশেষত উচ্চ শিক্ষাকে সাধারণের জন্য সংকোচন এবং প্রাথমিক স্তর থেকেই শিশু মনে সাম্প্রদায়িক ভেদ বিভেদ সৃষ্টির শিক্ষা নীতি ঘোষণা করার ফলে ছাত্র আন্দোলনে ভাটার টান থাকলেও গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধের ডাক দিলে ছাত্র সমাজ দ্রুতই সাড়া দেয়। প্রতিরোধের আকাক্সক্ষায় ছাত্র আন্দোলনে এক নব উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। তবে অগ্রসর হওয়ার পথ মসৃণ ছিল না। সামরিক শাসনের মধ্যে আঁকাবাঁকা নানা পথে নানা কৌশলে সেদিনের ছাত্র আন্দোলনকে অগ্রসর করতে হয়েছিল। এবং অবশেষে ১৪ ফেব্রুয়ারি ’৮৩ তারিখে সামরিক আইন ভেঙে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক বিশাল ছাত্র মিছিল স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশে রওনা হয় সচিবালয়ের পথে।

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিছিল এগিয়ে চলেছে সচিবালয় অভিমুখে ভীত শাসকেরা সেই মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। শহীদের মৃত্যু বরণ করেন জয়নাল এবং পরবর্তীতে মোজাম্মেল ও কাঞ্চন। গুম করে ফেলা হয় অনেক লাশ। রাতের আঁধারে নেমে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন যা থেকে ছাত্রী হলও বাদ যায়নি। দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র আন্দোলনের যে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল দমন-পীড়নের মাধ্যমে তাকে নিভিয়ে দেয়া যায়নি। বরং তা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। গড়ে ওঠে সামরিক শাসন বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের জোট, শ্রমিক-কর্মচারীদের জোট, পেশাজীবী আন্দোলন, কৃষক-খেতমজুর আন্দোলন, সাংস্কৃতিক জোট, এমনকি কবিতা পরিষদের মতো সংগঠনের আন্দোলন। সামরিক শাসনের অবসান এবং নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে গনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের নানা পর্বে ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ছাত্র আন্দোলনের কর্মী সেলিম-দেলোয়ারকে পুলিশের ট্রাকের চাকায় পিষ্ট করে হত্যা করা হয়। ছাত্র কর্মী রাউফুন বসুনিয়া, শাহজাহান সিরাজ এবং এক জটিল পর্বে আসলাম প্রমুখের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলন অগ্রসর হয়। এ লড়াইয়ে শ্রমিক নেতা তাজুল ও খেতমজুর আন্দোলনের কর্মী টিটোর আত্মদান আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। আর অতি সাধারণ মানুষের হাতে লেখা ও বুকে পিঠে আঁকা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ হয়ে যায় সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। শহীদ নূর হোসেন যেন গণতন্ত্রের সংগ্রামের প্রতীক। এমনিভাবে সংগ্রামের নানা পর্বে অসংখ্য শহীদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি রক্তপতাকা হাতে ছাত্র সমাজ অগ্রসর হয়েছে ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পথে এবং অভ্যুত্থানের বিজয় মশাল জ্বালাতে শেষ মুহূর্তে জীবন উৎসর্গ করেন সেই ১৪ ফেব্রুয়ারির মিছিলের মুখ আর ৯০-এ পেশাজীবী আন্দোলনের নেতা ডা. মিলন।

সামরিক শাসন আর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আশির দশকজুড়ে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার লড়াই এবং নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসের অংশ। তেমনি ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে ২০২৪-এর বীরত্বপূর্ন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান। কোন আন্দোলন বা গণসংগ্রামই চেনা ছক বা ছন্দে সীমাবদ্ধ থাকে না। তাই তো সৃষ্টি হয় নতুন নতুন ইতিহাস। এবারের জুলাই ছাত্র গণঅভ্যুত্থান বিশেষ করে তারুণ্যের জাগরণ যে বৈশিষ্ট্য নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল তা অন্য সময়ের থেকে ভিন্নতর এবং অতিসাম্প্রতিক। তাই আবু সাইদের বীরত্ব বা মুগ্ধর মুগ্ধতা, রিকশার পাদানিতে গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজ আমাদের গভীরভাবে আলোড়িত করে। তেমনি সেলিম-দেলোয়ারের পুলিশের ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে আত্মদানের কাহিনী কিংবা ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক তাজুল ইসলামের আদমজীতে কারখানা শ্রমিক হিসাবে চাকরি নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে জীবন বলিদান, নূর হোসেনের বীরত্বগাথা কিংবা ডা. মিলনের আত্মোৎসর্গ সবই ইতিহাসের অংশ।

ইতিহাসের একটা অংশ দিয়ে আরেকটা অংশ ঢেকে ফেলার প্রচেষ্টা হবে আত্মঘাতী। এবং শেষ বিচারে তা সফল হয় না। কিন্তু তার পরেও বর্ণচোরা এক গোষ্ঠী জাতির সব বীরত্বগাথা ও গৌরবের ইতিহাসকে ডিলিট করে শুধু ’২৪-কে প্রতিস্থাপন করতে চাইছে। প্রায় এক দশকের সামরিক শাসনের ঘন আঁধারে ১৪ ফেব্রুয়ারি ৮৩ ছিল ধ্রুবতারার মতো। এবং ১৪ ফেব্রুয়ারিই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে দ্রোহের আগুন জে¦লেছিল এবং তা অবসান না হওয়া পর্যন্ত ওই সময়ের সংগ্রামে দ্যুতি হিসেবে থেকেছে। আর ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়ে আসছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসাবে।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন ]

back to top