সুজন বিপ্লব
বংশ পরম্পরায় নিরঙ্কুশ প্রথাগত মালিকানার ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে বাঁওড় জলাভূমিকেন্দ্রীক বসবাসরত মৎস্যজীবী জেলে জনগোষ্ঠী জীবন-জীবিকা নির্বাহে আদিকাল থেকে আধুনিক কাল পরিক্রমা করছে। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পরে বাঁওড়গুলো সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত হয়। ফলে তৎকালীন সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাঁওড়গুলো খাস খতিয়ানভুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে নীতিমালা অনুসারে পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাঁওড়গুলো গ্রহণ করলেও জেলে জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের বিবেচনাবর্হিভূত উদ্ভট প্রকল্প ও ইজারা নীতির মাধ্যমে অন্যায়ভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বাঁওড় জনপদের বয়ানে ভূমিহীন জেলেদের ভিটামাটি, জীবিকা হারানো ও বঞ্চনার সংবাদ নিদারুণ প্রান্তিকতায় উন্নয়ন নীতির ডামাডোলে চাপা পড়ে আছে। দেশের বৃহত্তম বাঁওড়গুলোর মধ্যে ঝিনাইদহের বলুহর, জয়দিয়া, কাঠগড়া, ফতেপুর, মর্জাত ও যশোরের বেড়গোবিন্দপুরসহ ৬টি বাঁওড়ে বঞ্চনার শিকার হাজার হাজার জেলে পরিবারের মতো ইজারা পদ্ধতিতে দেশের সব বাঁওড়ের ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী দেউলিয়া হয়ে গেছে। ইজারা প্রথার কুফলে মানবেতর জীবনযাপন করছে, যারা সম্পূর্ণ বাঁওড়ের ওপর নির্ভরশীল। বাঁওড় মৎস্যজীবী জেলেরা এখন কর্মহীন ও বেকার। নিরুপায় বাঁওড় জেলে নর-নারীরা প্রান্তিক শ্রমিকে পরিণত হয়েছে।
সরকারের ভূমি ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ শেষে মৎস্য মন্ত্রণালয় মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন জানালেও ভূমি মন্ত্রণালয় সাড়া দেয়নি। আলোচিত ৬টি বাঁওড় বেসরকারি পর্যায়ে ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। গণমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে, প্রকল্পটি ঘিরে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি-লুটপাটের ফলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কিন্তু বাঁওড় ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্তে জেলে পরিবারগুলো পথে বসেছে। ছয়টি বাঁওড়পাড়ে প্রায় ১ হাজার জেলে পরিবারের সদস্যসমেত ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। ইজারা পদ্ধতির অভিঘাতে সারাদেশে সব বাঁওড় থেকে হাজার হাজার মৎস্যজীবী জেলেরা বিতাড়িত হয়েছেন। বাঁওড়ে মাছ ধরতে পারছে না তারা। জীবন-জীবিকার একমাত্র পথ বন্ধ হয়েছে। অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটছে তাদের। সরকারি হিসাবে দেখা যায়, জলমহাল থেকে পাওয়া এই ১০০ কোটি টাকা রাজস্বের জন্য ৭ লাখ কোটি টাকার জাতীয় বাজেটে দেশের ২ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা জিম্মি করার ফলে দুর্নীতিবাজ আমলা, টাউট রাজনীতিক, বাটপার সমাজপতিদের রমরমা অবস্থা নিশ্চিত হয়েছে। খাস খতিয়ানভুক্ত ভূমি আর জলমহালের সঙ্গে বালুমহাল, বনাঞ্চল, চরাঞ্চল ও পাহাড়-সমতলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় জমিদারি কায়দায় ইজারার বন্দোবস্তে সাধারণ জনগণ কোন সুফল পাচ্ছে না। ইজারা পদ্ধতির কারণে উচ্ছেদ হয়ে গেছে ভূমিজ জনগোষ্ঠীর প্রথাগত মালিকানা। প্রয়োজন ভূমিজ জনগোষ্ঠীর প্রথাগত মালিকানার গ্যারান্টি। রাষ্ট্রীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতে গঠনমূলক পরিকল্পনামাফিক ভূমিহীন ও কর্মহীন জনসাধারণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সংকটের আশু সমাধান জরুরি। যেখানে জলমহাল ও খাসখতিয়ানভুক্তি ভূমি ব্যবস্থাপনাকে সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানায় রূপান্তর করে জীবন-জীবিকার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব, সেখানে ইজারা দিয়ে অর্থনৈতিক দূর্বৃত্তায়নকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে লাভের অংকে হিসাব-নিকাশটা গণমুখী রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী, বেহিসাবি ও গোলমেলে বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি, ২০০৯ মোতাবেক ‘জাল যার জলা তার’ এই নীতির আলোকে গৃহীত বলা হলেও ইজারা পদ্ধতির ফলে ‘টাকা যার ইজারা তার, ইজারা যার জলা তার’ বলাটাও নির্ভুল বাস্তবতা। প্রকৃত মৎস্যজীবীদের সুরক্ষায় জলমহালে ইজারা প্রথা বাতিল করা উচিত। প্রচলিত জলমহাল নীতিমালা বিদ্যমান থাকায় জেলেদের স্বার্থ সংরক্ষণ হওয়ারও সুযোগ নেই। জলমহাল নীতিমালার সূত্রে বাঁওড়গুলো ইজারাদারদের কুক্ষিগত হয়ে গেছে।
বাঁওড়-সম্পর্কিত বিষয়ে আন্দোলনে সক্রিয় জেলে জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত না করে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনরূপ গণতান্ত্রিক এখতিয়ার নেই। তাই ভুক্তভোগী বাঁওড় জেলেদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ বাঁওড় মৎস্যজীবী আন্দোলনের সাক্ষাৎ, মতামত ও প্রস্তাবনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়া উচিত। বাঁওড় মৎস্যজীবীদের ব্যতিরেকে বাঁওড় জলমহালে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় আস্থার সংকট ও গ্রহণযোগ্যতায় প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কের উদ্রেক করছে। বিগত আমলে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর মতো জেলেরাও রাজনৈতিক অধিকারহীনতার মধ্যে আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে হতাশ ও হতদ্যোম হয়ে পড়ে। বিভিন্ন সময় জেলেদের ওপর অবৈধ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে জমি দখল, বাঁওড়ে অবৈধভাবে মালিকানা আরোপ করা হতো। বিভিন্ন ইস্যুতে জেলেদের হুমকি ও বসতভিটা উচ্ছেদ, জীবিকায় বাধা প্রদানের স্থায়ী সমাধান করতে হবে। রাষ্ট্রীয় তদারকিতে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলেদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে। বাঁওড়কে দখলদারিত্ব ও প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রভাবমুক্ত করতে হবে। বাঁওড়কেন্দ্রিক জেলেদের জীবিকা, আবাসস্থলসহ যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা ও সম্মতিসাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দেশের সমগ্র বাঁওড়পাড়ের হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করতে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ ও উদ্ভূত সংকট সমাধানে আমাদের সুনির্দিষ্ট ৪ দফা দাবিনামার বাস্তবায়ন চাই। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ বাঁওড় মৎস্যজীবী আন্দোলনের উদ্যোগে বাঁওড় জলমহালে ইজারাপ্রথা বিলোপ ও সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানা প্রতিষ্ঠায় ৪ দফা দাবিকে যৌক্তিক বিবেচনা করে স্থায়ী সমাধানে দেশব্যাপী বাঁওড় জরিপ ও শুমারি, সব বাঁওড় জলমহালে ভুক্তভোগী ভূমিজ জেলে জনগোষ্ঠীর প্রথাগত ও ন্যায়সঙ্গত মালিকানার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানার ৪ দফা দাবিনামা :
১. বাঁওড় জলমহালসমূহের ইজারা পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল করে জেলেদের ন্যায়সঙ্গত মালিকানার স্বীকৃতি দিয়ে সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে। মৎস্যজীবীদের অনুকূলে ও জাতীয় স্বার্থে জলমহাল ব্যবস্থাপনা আইন সংশোধন করতে হবে। জাতীয় বাঁওড় উন্নয়ন বোর্ড, স্বতন্ত্র বাঁওড় জলমহাল নীতিমালা ও বাঁওড় জেলেদের প্রান্তিক শ্রমিক হিসেবে নিজস্ব সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দিতে হবে।
২. জলমহালে মাছ চাষে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের অর্থায়নে ও জেলেদের সঙ্গে ন্যায্য উৎপাদনের অংশীদারিত্ব চুক্তি করতে হবে।
৩. সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় প্রকৃত মৎস্যজীবীদের শুমারি করে তালিকাবদ্ধ করে মৎস্যজীবী কার্ড প্রদান করতে হবে। জেলেদের রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি না করে বাঁওড় জলাশয়ে মাছের প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মহীন জেলেদের কর্মসংস্থানের জন্য মৎস্য অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে হবে।
নতুন দিনের বৈষম্যহীন ও অংশগ্রহণমূলক বাংলাদেশ নির্মাণের যে অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছে, সে অগ্রযাত্রায় অতি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাঁওড় মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তায় সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানার প্রতিষ্ঠায় উত্থাপিত দাবিনামা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে তা বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
[লেখক : সদস্য সচিব, বাংলাদেশ বাঁওড় মৎস্যজীবী আন্দোলন, কেন্দ্রীয় কমিটি]
সুজন বিপ্লব
রোববার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
বংশ পরম্পরায় নিরঙ্কুশ প্রথাগত মালিকানার ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে বাঁওড় জলাভূমিকেন্দ্রীক বসবাসরত মৎস্যজীবী জেলে জনগোষ্ঠী জীবন-জীবিকা নির্বাহে আদিকাল থেকে আধুনিক কাল পরিক্রমা করছে। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পরে বাঁওড়গুলো সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত হয়। ফলে তৎকালীন সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাঁওড়গুলো খাস খতিয়ানভুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে নীতিমালা অনুসারে পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাঁওড়গুলো গ্রহণ করলেও জেলে জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের বিবেচনাবর্হিভূত উদ্ভট প্রকল্প ও ইজারা নীতির মাধ্যমে অন্যায়ভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বাঁওড় জনপদের বয়ানে ভূমিহীন জেলেদের ভিটামাটি, জীবিকা হারানো ও বঞ্চনার সংবাদ নিদারুণ প্রান্তিকতায় উন্নয়ন নীতির ডামাডোলে চাপা পড়ে আছে। দেশের বৃহত্তম বাঁওড়গুলোর মধ্যে ঝিনাইদহের বলুহর, জয়দিয়া, কাঠগড়া, ফতেপুর, মর্জাত ও যশোরের বেড়গোবিন্দপুরসহ ৬টি বাঁওড়ে বঞ্চনার শিকার হাজার হাজার জেলে পরিবারের মতো ইজারা পদ্ধতিতে দেশের সব বাঁওড়ের ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী দেউলিয়া হয়ে গেছে। ইজারা প্রথার কুফলে মানবেতর জীবনযাপন করছে, যারা সম্পূর্ণ বাঁওড়ের ওপর নির্ভরশীল। বাঁওড় মৎস্যজীবী জেলেরা এখন কর্মহীন ও বেকার। নিরুপায় বাঁওড় জেলে নর-নারীরা প্রান্তিক শ্রমিকে পরিণত হয়েছে।
সরকারের ভূমি ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ শেষে মৎস্য মন্ত্রণালয় মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন জানালেও ভূমি মন্ত্রণালয় সাড়া দেয়নি। আলোচিত ৬টি বাঁওড় বেসরকারি পর্যায়ে ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। গণমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে, প্রকল্পটি ঘিরে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি-লুটপাটের ফলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কিন্তু বাঁওড় ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্তে জেলে পরিবারগুলো পথে বসেছে। ছয়টি বাঁওড়পাড়ে প্রায় ১ হাজার জেলে পরিবারের সদস্যসমেত ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। ইজারা পদ্ধতির অভিঘাতে সারাদেশে সব বাঁওড় থেকে হাজার হাজার মৎস্যজীবী জেলেরা বিতাড়িত হয়েছেন। বাঁওড়ে মাছ ধরতে পারছে না তারা। জীবন-জীবিকার একমাত্র পথ বন্ধ হয়েছে। অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটছে তাদের। সরকারি হিসাবে দেখা যায়, জলমহাল থেকে পাওয়া এই ১০০ কোটি টাকা রাজস্বের জন্য ৭ লাখ কোটি টাকার জাতীয় বাজেটে দেশের ২ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা জিম্মি করার ফলে দুর্নীতিবাজ আমলা, টাউট রাজনীতিক, বাটপার সমাজপতিদের রমরমা অবস্থা নিশ্চিত হয়েছে। খাস খতিয়ানভুক্ত ভূমি আর জলমহালের সঙ্গে বালুমহাল, বনাঞ্চল, চরাঞ্চল ও পাহাড়-সমতলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় জমিদারি কায়দায় ইজারার বন্দোবস্তে সাধারণ জনগণ কোন সুফল পাচ্ছে না। ইজারা পদ্ধতির কারণে উচ্ছেদ হয়ে গেছে ভূমিজ জনগোষ্ঠীর প্রথাগত মালিকানা। প্রয়োজন ভূমিজ জনগোষ্ঠীর প্রথাগত মালিকানার গ্যারান্টি। রাষ্ট্রীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতে গঠনমূলক পরিকল্পনামাফিক ভূমিহীন ও কর্মহীন জনসাধারণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সংকটের আশু সমাধান জরুরি। যেখানে জলমহাল ও খাসখতিয়ানভুক্তি ভূমি ব্যবস্থাপনাকে সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানায় রূপান্তর করে জীবন-জীবিকার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব, সেখানে ইজারা দিয়ে অর্থনৈতিক দূর্বৃত্তায়নকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে লাভের অংকে হিসাব-নিকাশটা গণমুখী রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী, বেহিসাবি ও গোলমেলে বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি, ২০০৯ মোতাবেক ‘জাল যার জলা তার’ এই নীতির আলোকে গৃহীত বলা হলেও ইজারা পদ্ধতির ফলে ‘টাকা যার ইজারা তার, ইজারা যার জলা তার’ বলাটাও নির্ভুল বাস্তবতা। প্রকৃত মৎস্যজীবীদের সুরক্ষায় জলমহালে ইজারা প্রথা বাতিল করা উচিত। প্রচলিত জলমহাল নীতিমালা বিদ্যমান থাকায় জেলেদের স্বার্থ সংরক্ষণ হওয়ারও সুযোগ নেই। জলমহাল নীতিমালার সূত্রে বাঁওড়গুলো ইজারাদারদের কুক্ষিগত হয়ে গেছে।
বাঁওড়-সম্পর্কিত বিষয়ে আন্দোলনে সক্রিয় জেলে জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত না করে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনরূপ গণতান্ত্রিক এখতিয়ার নেই। তাই ভুক্তভোগী বাঁওড় জেলেদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ বাঁওড় মৎস্যজীবী আন্দোলনের সাক্ষাৎ, মতামত ও প্রস্তাবনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়া উচিত। বাঁওড় মৎস্যজীবীদের ব্যতিরেকে বাঁওড় জলমহালে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় আস্থার সংকট ও গ্রহণযোগ্যতায় প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কের উদ্রেক করছে। বিগত আমলে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর মতো জেলেরাও রাজনৈতিক অধিকারহীনতার মধ্যে আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে হতাশ ও হতদ্যোম হয়ে পড়ে। বিভিন্ন সময় জেলেদের ওপর অবৈধ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে জমি দখল, বাঁওড়ে অবৈধভাবে মালিকানা আরোপ করা হতো। বিভিন্ন ইস্যুতে জেলেদের হুমকি ও বসতভিটা উচ্ছেদ, জীবিকায় বাধা প্রদানের স্থায়ী সমাধান করতে হবে। রাষ্ট্রীয় তদারকিতে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলেদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে। বাঁওড়কে দখলদারিত্ব ও প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রভাবমুক্ত করতে হবে। বাঁওড়কেন্দ্রিক জেলেদের জীবিকা, আবাসস্থলসহ যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা ও সম্মতিসাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দেশের সমগ্র বাঁওড়পাড়ের হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করতে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ ও উদ্ভূত সংকট সমাধানে আমাদের সুনির্দিষ্ট ৪ দফা দাবিনামার বাস্তবায়ন চাই। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ বাঁওড় মৎস্যজীবী আন্দোলনের উদ্যোগে বাঁওড় জলমহালে ইজারাপ্রথা বিলোপ ও সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানা প্রতিষ্ঠায় ৪ দফা দাবিকে যৌক্তিক বিবেচনা করে স্থায়ী সমাধানে দেশব্যাপী বাঁওড় জরিপ ও শুমারি, সব বাঁওড় জলমহালে ভুক্তভোগী ভূমিজ জেলে জনগোষ্ঠীর প্রথাগত ও ন্যায়সঙ্গত মালিকানার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানার ৪ দফা দাবিনামা :
১. বাঁওড় জলমহালসমূহের ইজারা পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল করে জেলেদের ন্যায়সঙ্গত মালিকানার স্বীকৃতি দিয়ে সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে। মৎস্যজীবীদের অনুকূলে ও জাতীয় স্বার্থে জলমহাল ব্যবস্থাপনা আইন সংশোধন করতে হবে। জাতীয় বাঁওড় উন্নয়ন বোর্ড, স্বতন্ত্র বাঁওড় জলমহাল নীতিমালা ও বাঁওড় জেলেদের প্রান্তিক শ্রমিক হিসেবে নিজস্ব সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দিতে হবে।
২. জলমহালে মাছ চাষে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের অর্থায়নে ও জেলেদের সঙ্গে ন্যায্য উৎপাদনের অংশীদারিত্ব চুক্তি করতে হবে।
৩. সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় প্রকৃত মৎস্যজীবীদের শুমারি করে তালিকাবদ্ধ করে মৎস্যজীবী কার্ড প্রদান করতে হবে। জেলেদের রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি না করে বাঁওড় জলাশয়ে মাছের প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মহীন জেলেদের কর্মসংস্থানের জন্য মৎস্য অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে হবে।
নতুন দিনের বৈষম্যহীন ও অংশগ্রহণমূলক বাংলাদেশ নির্মাণের যে অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছে, সে অগ্রযাত্রায় অতি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাঁওড় মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তায় সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানার প্রতিষ্ঠায় উত্থাপিত দাবিনামা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে তা বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
[লেখক : সদস্য সচিব, বাংলাদেশ বাঁওড় মৎস্যজীবী আন্দোলন, কেন্দ্রীয় কমিটি]