alt

উপ-সম্পাদকীয়

শাসনব্যবস্থা : জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

গাজী তারেক আজিজ

: মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে চুয়ান্ন বছর পার করেছে। এই সময় নিতান্তই কম সময় নয়। এই সময়কালে গণতন্ত্র, সামরিক শাসন, একদলীয় শাসন ও নির্বাচিত সরকারÑ সব ধরনের শাসনব্যবস্থা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন সরকার মডেল আমাদের প্রয়োজন? কোন পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হবে? এমন বহু প্রশ্ন সাম্প্রতিক মানুষের মুখে মুখে।

কারণ আমরা আজও ঠিক করতে পারিনি, রাষ্ট্র হিসেবে নিজ দেশকে কোথায় দেখতে চাই? আজও আমরা ঠিক করতে পারিনি কেমন সরকার পদ্ধতি আমাদের শাসনব্যবস্থার জন্য যুৎসই? আমরা বারবার হোঁচট খাই, আর উঠে দাঁড়িয়ে সে কথা ঠিকই ভুলে যাই। আর তাই পথ বদলে নতুন করে শুরু করি! এভাবে শুরুতে শুরু করতে করতে অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটার শঙ্কা আশঙ্কাজনক। যদিও আমরা তেমনটি প্রত্যাশা করছি না। তাই বলে একই ঘূর্ণাবর্ত আমাদের এতটা তাড়া করবে? ভাবতে পারছি না!

একটি রাষ্ট্র কেবল ভূখ-, জনগণ ও সার্বভৌমত্ব দ্বারা গঠিত নয়Ñ তার পরিচালনা পদ্ধতিই ঠিক করে দেয় সেই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। শাসনব্যবস্থা যদি দক্ষ, ন্যায়নিষ্ঠ ও গণমুখী না হয়, তবে সম্পদের প্রাচুর্য কিংবা ঐতিহাসিক ঐতিহ্যও রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করতে পারে না। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আজ প্রশ্ন উঠেছে: কোন ধরনের সরকার মডেল সবচেয়ে কার্যকর, গ্রহণযোগ্য ও যুগোপযোগী?

একদিকে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে দেশীয় বাস্তবতাÑ এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

প্রচলিত সরকার পদ্ধতি :

বিশ্বজুড়ে সরকার পরিচালনায় তিনটি মূলধারার পদ্ধতি প্রচলিতÑ সংসদীয়, রাষ্ট্রপতি ও আধা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি।

সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী থাকেন। তিনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুক্তরাজ্য, ভারত, বাংলাদেশ এই মডেলের অনুসারী। এ ব্যবস্থায় সংসদের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা থাকে, তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেক সময় সংসদ কেবল আনুষ্ঠানিক রূপে পরিণত হয়। সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি থেকে সংস্কারের রূপরেখায় দাবি উত্থাপিত হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার পদ্ধতির। যদিও এই পদ্ধতিতে কে কাকে নেতা মানবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সব পদ্ধতিতেই একজন দলনেতা থাকতে হয়। তাদের দাবিতে সে বিষয়টি সুরাহা কীভাবে করা হয়ে তা জানা যায়নি।

রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপ্রধান সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। তিনি একইসঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান। যুক্তরাষ্ট্র এ মডেলের প্রধান উদাহরণ। এ পদ্ধতিতে নির্বাহী ও আইন প্রণয়নকারী পরিষদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন থাকে।

আধা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুজনেই প্রশাসনিক ক্ষমতা ভাগ করে নেন। ফ্রান্সের মডেলকে কেন্দ্র করে এই ব্যবস্থা অনেক দেশে কার্যকরভাবে চলছে। যদিও দ্বন্দ্ব নিরসনে সেসব দেশে উচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। স্বাধীন বিচারালয় থাকলে সরকার কিংবা পরিচালন পদ্ধতি নিয়ে খুব একটা বেগ পোহাতে হয় না। বিচারালয় তেমন সাক্ষর রেখেছেন, যা প্রমাণিত সত্য।

বাংলাদেশের বাস্তবতা :

বাংলাদেশ একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসরণ করছে। তবে দীর্ঘকাল ধরে দেখা যাচ্ছে, এই ব্যবস্থায় কার্যকর সংসদীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। সংসদ প্রায়শঃই দলীয় করায়ত্ত, বিরোধী দলের অংশগ্রহণ সীমিত, আর জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন অস্পষ্ট।

রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এলে প্রশাসনের দলীয়করণ করে ফেলে। নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা কার্যত একত্রে মিশে গিয়ে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা কমে যায়। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছেÑ এই মডেল কি আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে? নাকি পরিবর্তন প্রয়োজন?

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি :

কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা। নইলে কাঠামো বদলালেও ফল মিলবে না।

অন্যদিকে কোনো কোনো সংবিধান বিশেষজ্ঞের অভিমত, আমাদের রাষ্ট্রপতি মডেল নয়, প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ সরকারব্যবস্থা, যেখানে নির্বাহী ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও কার্যকর সংসদ থাকবে।

বাস্তবতার মুখোমুখি সংসদ :

গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, সংসদ যেন আর নীতিনির্ধারণের কেন্দ্র নয়, বরং দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল সংসদে গেলে তা প্রায়ই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। জাতীয় বাজেট থেকে শুরু করে নীতিগত প্রশ্নেও সংসদে কার্যকর বিতর্ক হয় না।

একদিকে সংসদীয় মডেল, কিন্তু অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত প্রায় সব নির্বাহী ক্ষমতাÑ এটা একধরনের বৈপরীত্য সৃষ্টি করছে। এতে করে সাংসদদের নিজ নিজ এলাকার জনগণের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে কাজ করতে পারে না। এতে স্থানীয় অসন্তোষ তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে সামাল দেয়া যায় না।

রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি, সম্ভাবনা ও সংশয় :

অনেকেই মনে করেন, একটি রাষ্ট্রপতি শাসিতপদ্ধতি গ্রহণ করলে নির্বাহী বিভাগ আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী, সেখানে এ পদ্ধতি কার্যকর। তবে বাংলাদেশে এমন কাঠামো কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। এমন সংশয় আমাদের জুজুর মতো তাড়া করে ফেরে, যা থেকে উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি তো বটেই অত্যাবশ্যকও।

রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির ঝুঁকি হলো স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা, বিশেষ করে যদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা না থাকে। আমাদের দেশে জন বিমুখ শাসকদের সে ভয় এতটাই প্রকট যে, অতীতের পথ ধরে অতীতেই হেঁটেছেন তারা। আর তাতেই ইতিহাস সুখকর ছিল না কোন কালেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ রাতারাতি সম্ভব না হলেও, পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে। কেউ কথা রাখেনি!

আধা রাষ্ট্রপতি মডেল : ভারসাম্যের সম্ভাবনা?

এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি থাকে। এতে কিছুটা ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, তবে বাস্তবে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না থাকে, তাহলে দ্বৈত নেতৃত্ব নিয়ে সংঘাত দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় একজন অন্যজনের ব্যক্তিগত পর্যায়ের শত্রুতে পরিণত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়, বরং দেশীয় রাজনৈতিক কালচার হিসেবে প্রত্যাশিত! আমরা জনগণ কেবলই খেলার পুতুল!

জনমানুষের চাওয়া কী?

জনগণ চায় নিরাপত্তা, ন্যায্যতা, কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন। জনগণ চায় তাদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের হয়ে কথা বলুক, তাদের স্বার্থ রক্ষা করুক। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকারব্যবস্থা কেবল ক্ষমতার কেন্দ্রায়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে গেছে। আদতে জনগণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা কোন কালে রাখতে পেরেছে, সে প্রশ্ন থেকে যায়।

প্রযুক্তি ও আধুনিকীকরণ :

আজকের দিনে রাষ্ট্র পরিচালনায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ই-গভর্ন্যান্স, ওপেন ডেটা, ডিজিটাল ফিডব্যাকের মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। সরকার ব্যবস্থা যাই হোক, প্রযুক্তিকে একীভূত করতে না পারলে সেটি আধুনিক হতে পারে না। আর জনগণ যদি প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে থাকে তখন রাষ্ট্র পরিচালনা বলি আর সরকার পরিচালনা বলি কিছুতেই কিছু হবে না। চিন্তায় কাজে দক্ষতায় পিছিয়ে থাকা জাতি নিজস্বতা প্রয়োগে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

সম্ভাব্য সমাধান :

১. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।

২. নির্বাচন কমিশন, তথ্য কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করা।

৩. সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা নিশ্চিত করা।

৪. প্রশাসনের দলীয়করণ বন্ধ করে পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা।

৫. স্থানীয় সরকারকে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতাবান ও জবাবদিহিমূলক করা।

৬. স্বাধীন বিচার বিভাগ।

৭. পুলিশের দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করে, জনগণের সেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

৮. নাগরিকদের সুনাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নতি করা।

সরকার পদ্ধতির প্রশ্নটি কেবল কাঠামোর নয়, এটি সংস্কৃতির বিষয়। যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক না হয়, তাহলে যে কোনো সরকারব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আমাদের প্রয়োজন, এমন একটি মডেলÑ যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে, প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে এবং জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণ থাকবে রাষ্ট্র পরিচালনায়। হয়তো সে ব্যবস্থাটি একটি সংস্কারকৃত সংসদীয় পদ্ধতিই হতে পারে, কিংবা যুগোপযোগী আধা রাষ্ট্রপতি মডেলওÑ কিন্তু যেটিই হোক, সেটি হতে হবে জনগণের অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিফলন। শেষ কথা হলো সরকারি ব্যবস্থার কাঠামো নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে থাকা গণতন্ত্রের চর্চা, স্বচ্ছতা ও মানবিক মূল্যবোধই একটি রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

স্নায়ুরোগ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব ও করণীয়

বয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

বর্ষার আগেই নদীভাঙনের আতঙ্কে উপকূলবাসী

ছবি

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ : মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন

‘রিসেটের’ পরাকৌশল কী হওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গ : জাতীয় বাজেট

ব্রুনোর শ্মশান মঞ্চ

দুর্নীতির অবিশ্বাস্য খতিয়ান

সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন, বহুত্ববাদ : সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ!

পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ সংকটে ধর্মনিরপেক্ষতা

পেশাগত দায় ও নৈতিকতা

বিনোদনের রূপান্তর : সংস্কৃতির সংকোচন ও নতুন পথ

রম্যগদ্য : ‘চোর চাই, চোর...’

শুভ-অশুভ বলে কিছু কি আছে

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মিশে আছে কৃষি ও কৃষক

বাংলাদেশে ঘটনা অঘটন: প্রায় সবক্ষেত্রেই ইস্যু নির্বাচন

ছবি

নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ

বৈসাবি : সম্মিলনের জাতীয় উৎসব

সংকট ও সংক্রান্তির শক্তি

ছবি

গাজার অশ্রু : ইসরায়েলের বর্বরতা ও বিশ্বের নীরবতা

দেশের কৃষি অর্থনীতির নীরব নায়িকারা

বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের ফেরে বিএনপি ও এনসিপি

ফৌজদারি মামলায় অপরাধের আলামত উদ্ধারে আইন মানতে বাধা কোথায়?

জলবায়ুর নতুন ছকে বদলে যাচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ভারতে ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে বিতর্ক

কীটনাশকের বিষচক্র : উন্নয়নের নামে শোষণ ও বিপর্যয়

বোরো ধান উৎপাদনে প্রধান অন্তরায় বিদ্যুৎ-বিভ্রাট

ঢাকার বাসিন্দাদের নিঃশ্বাসে এক বিপন্নতা

‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ হলে ‘ওয়াশিং মেশিন পার্টি’ বেকার হয়ে পড়বে না তো!

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?

বাসন্তী পূজা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস : বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র

মার্কিন নীতির পরিবর্তনে ইউক্রেনের পরিণতি

গাজা : ক্রমবর্ধমান মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শাসনব্যবস্থা : জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

গাজী তারেক আজিজ

মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে চুয়ান্ন বছর পার করেছে। এই সময় নিতান্তই কম সময় নয়। এই সময়কালে গণতন্ত্র, সামরিক শাসন, একদলীয় শাসন ও নির্বাচিত সরকারÑ সব ধরনের শাসনব্যবস্থা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন সরকার মডেল আমাদের প্রয়োজন? কোন পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হবে? এমন বহু প্রশ্ন সাম্প্রতিক মানুষের মুখে মুখে।

কারণ আমরা আজও ঠিক করতে পারিনি, রাষ্ট্র হিসেবে নিজ দেশকে কোথায় দেখতে চাই? আজও আমরা ঠিক করতে পারিনি কেমন সরকার পদ্ধতি আমাদের শাসনব্যবস্থার জন্য যুৎসই? আমরা বারবার হোঁচট খাই, আর উঠে দাঁড়িয়ে সে কথা ঠিকই ভুলে যাই। আর তাই পথ বদলে নতুন করে শুরু করি! এভাবে শুরুতে শুরু করতে করতে অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটার শঙ্কা আশঙ্কাজনক। যদিও আমরা তেমনটি প্রত্যাশা করছি না। তাই বলে একই ঘূর্ণাবর্ত আমাদের এতটা তাড়া করবে? ভাবতে পারছি না!

একটি রাষ্ট্র কেবল ভূখ-, জনগণ ও সার্বভৌমত্ব দ্বারা গঠিত নয়Ñ তার পরিচালনা পদ্ধতিই ঠিক করে দেয় সেই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। শাসনব্যবস্থা যদি দক্ষ, ন্যায়নিষ্ঠ ও গণমুখী না হয়, তবে সম্পদের প্রাচুর্য কিংবা ঐতিহাসিক ঐতিহ্যও রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করতে পারে না। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আজ প্রশ্ন উঠেছে: কোন ধরনের সরকার মডেল সবচেয়ে কার্যকর, গ্রহণযোগ্য ও যুগোপযোগী?

একদিকে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে দেশীয় বাস্তবতাÑ এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

প্রচলিত সরকার পদ্ধতি :

বিশ্বজুড়ে সরকার পরিচালনায় তিনটি মূলধারার পদ্ধতি প্রচলিতÑ সংসদীয়, রাষ্ট্রপতি ও আধা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি।

সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী থাকেন। তিনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুক্তরাজ্য, ভারত, বাংলাদেশ এই মডেলের অনুসারী। এ ব্যবস্থায় সংসদের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা থাকে, তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেক সময় সংসদ কেবল আনুষ্ঠানিক রূপে পরিণত হয়। সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি থেকে সংস্কারের রূপরেখায় দাবি উত্থাপিত হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার পদ্ধতির। যদিও এই পদ্ধতিতে কে কাকে নেতা মানবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সব পদ্ধতিতেই একজন দলনেতা থাকতে হয়। তাদের দাবিতে সে বিষয়টি সুরাহা কীভাবে করা হয়ে তা জানা যায়নি।

রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপ্রধান সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। তিনি একইসঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান। যুক্তরাষ্ট্র এ মডেলের প্রধান উদাহরণ। এ পদ্ধতিতে নির্বাহী ও আইন প্রণয়নকারী পরিষদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন থাকে।

আধা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুজনেই প্রশাসনিক ক্ষমতা ভাগ করে নেন। ফ্রান্সের মডেলকে কেন্দ্র করে এই ব্যবস্থা অনেক দেশে কার্যকরভাবে চলছে। যদিও দ্বন্দ্ব নিরসনে সেসব দেশে উচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। স্বাধীন বিচারালয় থাকলে সরকার কিংবা পরিচালন পদ্ধতি নিয়ে খুব একটা বেগ পোহাতে হয় না। বিচারালয় তেমন সাক্ষর রেখেছেন, যা প্রমাণিত সত্য।

বাংলাদেশের বাস্তবতা :

বাংলাদেশ একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসরণ করছে। তবে দীর্ঘকাল ধরে দেখা যাচ্ছে, এই ব্যবস্থায় কার্যকর সংসদীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। সংসদ প্রায়শঃই দলীয় করায়ত্ত, বিরোধী দলের অংশগ্রহণ সীমিত, আর জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন অস্পষ্ট।

রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এলে প্রশাসনের দলীয়করণ করে ফেলে। নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা কার্যত একত্রে মিশে গিয়ে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা কমে যায়। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছেÑ এই মডেল কি আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে? নাকি পরিবর্তন প্রয়োজন?

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি :

কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা। নইলে কাঠামো বদলালেও ফল মিলবে না।

অন্যদিকে কোনো কোনো সংবিধান বিশেষজ্ঞের অভিমত, আমাদের রাষ্ট্রপতি মডেল নয়, প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ সরকারব্যবস্থা, যেখানে নির্বাহী ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও কার্যকর সংসদ থাকবে।

বাস্তবতার মুখোমুখি সংসদ :

গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, সংসদ যেন আর নীতিনির্ধারণের কেন্দ্র নয়, বরং দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল সংসদে গেলে তা প্রায়ই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। জাতীয় বাজেট থেকে শুরু করে নীতিগত প্রশ্নেও সংসদে কার্যকর বিতর্ক হয় না।

একদিকে সংসদীয় মডেল, কিন্তু অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত প্রায় সব নির্বাহী ক্ষমতাÑ এটা একধরনের বৈপরীত্য সৃষ্টি করছে। এতে করে সাংসদদের নিজ নিজ এলাকার জনগণের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে কাজ করতে পারে না। এতে স্থানীয় অসন্তোষ তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে সামাল দেয়া যায় না।

রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি, সম্ভাবনা ও সংশয় :

অনেকেই মনে করেন, একটি রাষ্ট্রপতি শাসিতপদ্ধতি গ্রহণ করলে নির্বাহী বিভাগ আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী, সেখানে এ পদ্ধতি কার্যকর। তবে বাংলাদেশে এমন কাঠামো কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। এমন সংশয় আমাদের জুজুর মতো তাড়া করে ফেরে, যা থেকে উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি তো বটেই অত্যাবশ্যকও।

রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির ঝুঁকি হলো স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা, বিশেষ করে যদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা না থাকে। আমাদের দেশে জন বিমুখ শাসকদের সে ভয় এতটাই প্রকট যে, অতীতের পথ ধরে অতীতেই হেঁটেছেন তারা। আর তাতেই ইতিহাস সুখকর ছিল না কোন কালেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ রাতারাতি সম্ভব না হলেও, পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে। কেউ কথা রাখেনি!

আধা রাষ্ট্রপতি মডেল : ভারসাম্যের সম্ভাবনা?

এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি থাকে। এতে কিছুটা ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, তবে বাস্তবে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না থাকে, তাহলে দ্বৈত নেতৃত্ব নিয়ে সংঘাত দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় একজন অন্যজনের ব্যক্তিগত পর্যায়ের শত্রুতে পরিণত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়, বরং দেশীয় রাজনৈতিক কালচার হিসেবে প্রত্যাশিত! আমরা জনগণ কেবলই খেলার পুতুল!

জনমানুষের চাওয়া কী?

জনগণ চায় নিরাপত্তা, ন্যায্যতা, কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন। জনগণ চায় তাদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের হয়ে কথা বলুক, তাদের স্বার্থ রক্ষা করুক। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকারব্যবস্থা কেবল ক্ষমতার কেন্দ্রায়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে গেছে। আদতে জনগণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা কোন কালে রাখতে পেরেছে, সে প্রশ্ন থেকে যায়।

প্রযুক্তি ও আধুনিকীকরণ :

আজকের দিনে রাষ্ট্র পরিচালনায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ই-গভর্ন্যান্স, ওপেন ডেটা, ডিজিটাল ফিডব্যাকের মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। সরকার ব্যবস্থা যাই হোক, প্রযুক্তিকে একীভূত করতে না পারলে সেটি আধুনিক হতে পারে না। আর জনগণ যদি প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে থাকে তখন রাষ্ট্র পরিচালনা বলি আর সরকার পরিচালনা বলি কিছুতেই কিছু হবে না। চিন্তায় কাজে দক্ষতায় পিছিয়ে থাকা জাতি নিজস্বতা প্রয়োগে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

সম্ভাব্য সমাধান :

১. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।

২. নির্বাচন কমিশন, তথ্য কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করা।

৩. সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা নিশ্চিত করা।

৪. প্রশাসনের দলীয়করণ বন্ধ করে পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা।

৫. স্থানীয় সরকারকে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতাবান ও জবাবদিহিমূলক করা।

৬. স্বাধীন বিচার বিভাগ।

৭. পুলিশের দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করে, জনগণের সেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

৮. নাগরিকদের সুনাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নতি করা।

সরকার পদ্ধতির প্রশ্নটি কেবল কাঠামোর নয়, এটি সংস্কৃতির বিষয়। যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক না হয়, তাহলে যে কোনো সরকারব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আমাদের প্রয়োজন, এমন একটি মডেলÑ যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে, প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে এবং জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণ থাকবে রাষ্ট্র পরিচালনায়। হয়তো সে ব্যবস্থাটি একটি সংস্কারকৃত সংসদীয় পদ্ধতিই হতে পারে, কিংবা যুগোপযোগী আধা রাষ্ট্রপতি মডেলওÑ কিন্তু যেটিই হোক, সেটি হতে হবে জনগণের অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিফলন। শেষ কথা হলো সরকারি ব্যবস্থার কাঠামো নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে থাকা গণতন্ত্রের চর্চা, স্বচ্ছতা ও মানবিক মূল্যবোধই একটি রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top