alt

উপ-সম্পাদকীয়

স্নায়ুরোগ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

: মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো চিকিৎসা। কিন্তু এই মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে রয়েছে হরেক রকম প্রতিবন্ধকতা। ভুল চিকিৎসা, রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসকদের ব্যর্থতা, চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনে রোগীদের সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি বিষয়গুলো নিয়ে বিরাজ করছে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। পত্র-পত্রিকায় এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি হয়। চিকিৎসাসেবার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করা হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিকার হয় না। আমরা প্রতি নিয়ত চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে নানাভাবে আক্রান্ত এবং অবধারিত ক্ষতিগ্রস্ত! যেসব রোগ নির্ণয়ে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের ভুল হয়, সেগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে স্নায়বিক রোগ। স্নায়বিক রোগগুলো একটি জটিল চিকিৎসা অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে, যা স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতাকে মৌলিকভাবে ব্যাহত করে। এই রোগগুলো মানুষের মস্তিষ্ক, মেরুদ- এবং স্নায়ু নেটওয়ার্কগুলোকে প্রভাবিত করে। অনন্য নির্ণয়, চিকিৎসা এবং রোগীর যতেœর চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর নির্ভর করে রোগীর সুস্থতা। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি বছর ১৩ এপ্রিল আন্তর্জাতিক এফএনডি (কার্যকরী নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার) সচেতনতা দিবস পালিত হয়। এই দিবসটির লক্ষ্য হচ্ছে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তা করা, এফএনডি প্রতিরোধ, চিকিৎসা এবং পুনরুদ্ধারের জন্য গবেষণার অগ্রগতি করা।

দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে স্নায়বিক রোগ সম্পর্কে কোন পরিসংখ্যান নেই। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের খবরের আলোকে জানা যায়, দেশে বয়স্ক মানুষের স্নায়বিক রোগ, পারকিনসন্সের মতো মস্তিষ্ক ক্ষয়জনিত রোগ বা বিভিন্ন ধরনের ডিমেনসিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। স্নায়বিক রোগেই এখন দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে। এসব রোগের চিকিৎসায় দেশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, জনবল ও যন্ত্রপাতির মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।

বিভিন্ন স্নায়বিক রোগের মধ্যে রয়েছেÑ আলঝেইমার, মাইগ্রেন, এপিলেপসি, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, পারকিনসন, অ্যাপ্রাক্সিয়া, অ্যাগনোসিয়া, অ্যাফেসিয়া, ডিসারথ্রিয়া। এসব মস্তিষ্কের স্নায়বিক রোগ। এছাড়া মেরুদ-ের কিছু স্নায়বিক রোগ রয়েছে, পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি, ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া, ডাইসঅটোনোমিয়া, মাল্টিপল সিস্টেম অ্যাট্রোফি, অ্যামিওট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস প্রভৃতি।

ওয়ার্ল্ড হেলথ জার্নালে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা গেছে, বিশ্বের প্রধান স্নায়বিক রোগের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে পারকিনসন্স। বিশ্বব্যাপী ১০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। রোগটির ভয়াবহতার কথা আলোচনায় আনার জন্য ১১ এপ্রিল বিশ্ব পারকিনসন্স দিবস পালন করা হয়। যদিও আমাদের দেশে এই দিবসটির আনুষ্ঠানিক কোন স্বীকৃতি নেই! চিকিৎসকদের অনেকেই এই রোগটি সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা রাখেন না। এমনকি অনেক নিউরো বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রেও ধারণা না রাখার বিষয়টি প্রযোজ্য।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মস্তিষ্কের রোগসম্পর্কিত বিভিন্ন অধ্যায় ঘেটে জানা গেছে, পারকিনসন্স মূলত একটি মস্তিষ্কের রোগ। কোনো কারণে মস্তিষ্কের সাবস্ট্যান্টিয়া নিগ্রা নামক অংশের স্নায়ু কোষের ক্ষতির কারণে ডোপামিনের উৎপাদন কমে গেলে বা সমস্যা হলে এই রোগ হয়। আসলে, মস্তিষ্কের এই অংশে ডোপামিন তৈরি হয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি তার স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে ধীরগতি অনুভব করতে শুরু করে এবং তার কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার অভাব এবং ভারসাম্যসম্পর্কিত সমস্যা অনুভব করে। সেই সঙ্গে মাংসপেশিতে শক্ত হওয়া বা এর পাশাপাশি শরীর কাঁপানো, হাঁটা, কথা বলা, ঘ্রাণ ও ঘুমের সমস্যা এবং পায়ে কোষ্ঠকাঠিন্য ও অস্থিরতার মতো সমস্যা দেখা দেয়। পারকিনসন্স রোগের লক্ষণগুলো প্রায়শই শরীরের একপাশে বা একটি অঙ্গ থেকে শুরু হয়। কিন্তু এই রোগের প্রভাব যত বাড়তে থাকে, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও এর প্রভাব পড়তে থাকে। পারকিনসন্সের উন্নত পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনযাত্রার মান ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।

২০২২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে যেহেতু এসব রোগ সম্পর্কে কোন গবেষণা নেই, সে কারণে পারকিনসন্স রোগীর কোন পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট কেউ বলতে পারে না। তবে চিকিৎসকদের মতে, এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

ল্যানসেট নিউরোলজি জার্নালে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের একটি পরিসংখ্যান পেশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে ৩.৪ বিলিয়ন মানুষ নিউরোলজিকাল ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ স্নায়ুজনিত রোগে ভুগছিলেন তারা। সেই রোগেই মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল বেশি। নিউরোলজিকাল ডিসঅর্ডারগুলোর মধ্যে উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো। এসব দেশে জনসংখ্যার পাশাপাশি বেড়েছে পরিবেশের দূষণ, জীবনযাপনের নানা সমস্যা। গবেষকরা জানাচ্ছেন, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট ৩০ বছরের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই ৩১ বছরের সময়কালে ১৮ শতাংশ বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের স্নায়ুজনিত রোগের হার। পাশাপাশি কমেছে মানুষের আয়ুও। আগে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ৩৭৫ মিলিয়ন বছর আয়ু কমত। বর্তমানে তা ৪৪৩ মিলিয়ন বছরে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আগের তুলনায় আরও কমছে মানুষের আয়ু।

গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ, ইনজুরিস অ্যান্ড রিস্ক ফ্যাক্টর স্টাডিজ ২০২১ খ্রিস্টাব্দের পরিসংখ্যান অনুসারে জনসংখ্যার মধ্যে বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, যার ফলে মোট আয়ুও কমতির পথে।

স্নায়বিক স্বাস্থ্যহানির পেছনে বেশ কিছু রোগের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে জানান গবেষকরা। চিকিৎসা সেবাদান অত্যন্ত মানবিক পেশা। কিন্তু অবকাঠামোর অভাব, সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা, দায়িত্ববোধের ঘাটতির পাশাপাশি অব্যবস্থার দায় সরকার এড়াতে পারে না। চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিপর্যয় রোধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই। কী করে চিকিৎসাকেন্দ্রের নামে এতো

‘বাণিজ্যকেন্দ্র’ গড়ে উঠছে, যা চরম জীবনঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেÑ এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার দায়ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এড়াতে পারে না। চিকিৎসাকেন্দ্রে অনুশাসন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়ের দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে। দেশের চিকিৎসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যদি যথাযথ সংস্কার অবিলম্বে না করা হয় তাহলে দেশের সামগ্রিক উন্নতি অধরাই রয়ে যাবে। নিত্য নতুন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সংখ্যা না বাড়িয়ে আধুনিক কারিকুলামের সঙ্গে যুক্ত, আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক ও দক্ষ ল্যাব পরিচালনাকারী বাড়াতে হবে। যেহেতু এটা টেকনিক্যাল শিক্ষানির্ভর ব্যবস্থা তাই মেডিকেল কলেজগুলোয় বাড়াতে হবে ল্যাবরেটরির সংখ্যা। এছাড়া আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কেউ শুধু বই মুখস্থ করে, যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই নামমাত্র চিকিৎসক না হন।

চিকিৎসা বিষয়ে গবেষণায় আরো জোর দিতে হবে, বাড়াতে হবে প্রণোদনা। এই কাজগুলো যদি দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে হয়তো আমরা আমাদের প্রিয়জনদের আরও কিছুদিন ধরে রাখতে পারব। যাপিত জীবনে অসুস্থতা না থাকলে সেটির প্রভাব পরিবার থেকে শুরু করে দেশের জন্যও মঙ্গলকর হবে। সুতরাং সকলের সুস্থ জীবন কাম্য।

[লেখক : সংবাদকর্মী]

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব ও করণীয়

শাসনব্যবস্থা : জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

বয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

বর্ষার আগেই নদীভাঙনের আতঙ্কে উপকূলবাসী

ছবি

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ : মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন

‘রিসেটের’ পরাকৌশল কী হওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গ : জাতীয় বাজেট

ব্রুনোর শ্মশান মঞ্চ

দুর্নীতির অবিশ্বাস্য খতিয়ান

সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন, বহুত্ববাদ : সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ!

পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ সংকটে ধর্মনিরপেক্ষতা

পেশাগত দায় ও নৈতিকতা

বিনোদনের রূপান্তর : সংস্কৃতির সংকোচন ও নতুন পথ

রম্যগদ্য : ‘চোর চাই, চোর...’

শুভ-অশুভ বলে কিছু কি আছে

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মিশে আছে কৃষি ও কৃষক

বাংলাদেশে ঘটনা অঘটন: প্রায় সবক্ষেত্রেই ইস্যু নির্বাচন

ছবি

নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ

বৈসাবি : সম্মিলনের জাতীয় উৎসব

সংকট ও সংক্রান্তির শক্তি

ছবি

গাজার অশ্রু : ইসরায়েলের বর্বরতা ও বিশ্বের নীরবতা

দেশের কৃষি অর্থনীতির নীরব নায়িকারা

বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের ফেরে বিএনপি ও এনসিপি

ফৌজদারি মামলায় অপরাধের আলামত উদ্ধারে আইন মানতে বাধা কোথায়?

জলবায়ুর নতুন ছকে বদলে যাচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ভারতে ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে বিতর্ক

কীটনাশকের বিষচক্র : উন্নয়নের নামে শোষণ ও বিপর্যয়

বোরো ধান উৎপাদনে প্রধান অন্তরায় বিদ্যুৎ-বিভ্রাট

ঢাকার বাসিন্দাদের নিঃশ্বাসে এক বিপন্নতা

‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ হলে ‘ওয়াশিং মেশিন পার্টি’ বেকার হয়ে পড়বে না তো!

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?

বাসন্তী পূজা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস : বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র

মার্কিন নীতির পরিবর্তনে ইউক্রেনের পরিণতি

গাজা : ক্রমবর্ধমান মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

স্নায়ুরোগ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো চিকিৎসা। কিন্তু এই মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে রয়েছে হরেক রকম প্রতিবন্ধকতা। ভুল চিকিৎসা, রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসকদের ব্যর্থতা, চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনে রোগীদের সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি বিষয়গুলো নিয়ে বিরাজ করছে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। পত্র-পত্রিকায় এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি হয়। চিকিৎসাসেবার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করা হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিকার হয় না। আমরা প্রতি নিয়ত চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে নানাভাবে আক্রান্ত এবং অবধারিত ক্ষতিগ্রস্ত! যেসব রোগ নির্ণয়ে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের ভুল হয়, সেগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে স্নায়বিক রোগ। স্নায়বিক রোগগুলো একটি জটিল চিকিৎসা অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে, যা স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতাকে মৌলিকভাবে ব্যাহত করে। এই রোগগুলো মানুষের মস্তিষ্ক, মেরুদ- এবং স্নায়ু নেটওয়ার্কগুলোকে প্রভাবিত করে। অনন্য নির্ণয়, চিকিৎসা এবং রোগীর যতেœর চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর নির্ভর করে রোগীর সুস্থতা। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি বছর ১৩ এপ্রিল আন্তর্জাতিক এফএনডি (কার্যকরী নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার) সচেতনতা দিবস পালিত হয়। এই দিবসটির লক্ষ্য হচ্ছে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তা করা, এফএনডি প্রতিরোধ, চিকিৎসা এবং পুনরুদ্ধারের জন্য গবেষণার অগ্রগতি করা।

দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে স্নায়বিক রোগ সম্পর্কে কোন পরিসংখ্যান নেই। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের খবরের আলোকে জানা যায়, দেশে বয়স্ক মানুষের স্নায়বিক রোগ, পারকিনসন্সের মতো মস্তিষ্ক ক্ষয়জনিত রোগ বা বিভিন্ন ধরনের ডিমেনসিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। স্নায়বিক রোগেই এখন দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে। এসব রোগের চিকিৎসায় দেশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, জনবল ও যন্ত্রপাতির মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।

বিভিন্ন স্নায়বিক রোগের মধ্যে রয়েছেÑ আলঝেইমার, মাইগ্রেন, এপিলেপসি, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, পারকিনসন, অ্যাপ্রাক্সিয়া, অ্যাগনোসিয়া, অ্যাফেসিয়া, ডিসারথ্রিয়া। এসব মস্তিষ্কের স্নায়বিক রোগ। এছাড়া মেরুদ-ের কিছু স্নায়বিক রোগ রয়েছে, পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি, ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া, ডাইসঅটোনোমিয়া, মাল্টিপল সিস্টেম অ্যাট্রোফি, অ্যামিওট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস প্রভৃতি।

ওয়ার্ল্ড হেলথ জার্নালে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা গেছে, বিশ্বের প্রধান স্নায়বিক রোগের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে পারকিনসন্স। বিশ্বব্যাপী ১০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। রোগটির ভয়াবহতার কথা আলোচনায় আনার জন্য ১১ এপ্রিল বিশ্ব পারকিনসন্স দিবস পালন করা হয়। যদিও আমাদের দেশে এই দিবসটির আনুষ্ঠানিক কোন স্বীকৃতি নেই! চিকিৎসকদের অনেকেই এই রোগটি সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা রাখেন না। এমনকি অনেক নিউরো বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রেও ধারণা না রাখার বিষয়টি প্রযোজ্য।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মস্তিষ্কের রোগসম্পর্কিত বিভিন্ন অধ্যায় ঘেটে জানা গেছে, পারকিনসন্স মূলত একটি মস্তিষ্কের রোগ। কোনো কারণে মস্তিষ্কের সাবস্ট্যান্টিয়া নিগ্রা নামক অংশের স্নায়ু কোষের ক্ষতির কারণে ডোপামিনের উৎপাদন কমে গেলে বা সমস্যা হলে এই রোগ হয়। আসলে, মস্তিষ্কের এই অংশে ডোপামিন তৈরি হয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি তার স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে ধীরগতি অনুভব করতে শুরু করে এবং তার কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার অভাব এবং ভারসাম্যসম্পর্কিত সমস্যা অনুভব করে। সেই সঙ্গে মাংসপেশিতে শক্ত হওয়া বা এর পাশাপাশি শরীর কাঁপানো, হাঁটা, কথা বলা, ঘ্রাণ ও ঘুমের সমস্যা এবং পায়ে কোষ্ঠকাঠিন্য ও অস্থিরতার মতো সমস্যা দেখা দেয়। পারকিনসন্স রোগের লক্ষণগুলো প্রায়শই শরীরের একপাশে বা একটি অঙ্গ থেকে শুরু হয়। কিন্তু এই রোগের প্রভাব যত বাড়তে থাকে, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও এর প্রভাব পড়তে থাকে। পারকিনসন্সের উন্নত পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনযাত্রার মান ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।

২০২২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে যেহেতু এসব রোগ সম্পর্কে কোন গবেষণা নেই, সে কারণে পারকিনসন্স রোগীর কোন পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট কেউ বলতে পারে না। তবে চিকিৎসকদের মতে, এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

ল্যানসেট নিউরোলজি জার্নালে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের একটি পরিসংখ্যান পেশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে ৩.৪ বিলিয়ন মানুষ নিউরোলজিকাল ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ স্নায়ুজনিত রোগে ভুগছিলেন তারা। সেই রোগেই মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল বেশি। নিউরোলজিকাল ডিসঅর্ডারগুলোর মধ্যে উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো। এসব দেশে জনসংখ্যার পাশাপাশি বেড়েছে পরিবেশের দূষণ, জীবনযাপনের নানা সমস্যা। গবেষকরা জানাচ্ছেন, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট ৩০ বছরের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই ৩১ বছরের সময়কালে ১৮ শতাংশ বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের স্নায়ুজনিত রোগের হার। পাশাপাশি কমেছে মানুষের আয়ুও। আগে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ৩৭৫ মিলিয়ন বছর আয়ু কমত। বর্তমানে তা ৪৪৩ মিলিয়ন বছরে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আগের তুলনায় আরও কমছে মানুষের আয়ু।

গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ, ইনজুরিস অ্যান্ড রিস্ক ফ্যাক্টর স্টাডিজ ২০২১ খ্রিস্টাব্দের পরিসংখ্যান অনুসারে জনসংখ্যার মধ্যে বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, যার ফলে মোট আয়ুও কমতির পথে।

স্নায়বিক স্বাস্থ্যহানির পেছনে বেশ কিছু রোগের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে জানান গবেষকরা। চিকিৎসা সেবাদান অত্যন্ত মানবিক পেশা। কিন্তু অবকাঠামোর অভাব, সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা, দায়িত্ববোধের ঘাটতির পাশাপাশি অব্যবস্থার দায় সরকার এড়াতে পারে না। চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিপর্যয় রোধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই। কী করে চিকিৎসাকেন্দ্রের নামে এতো

‘বাণিজ্যকেন্দ্র’ গড়ে উঠছে, যা চরম জীবনঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেÑ এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার দায়ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এড়াতে পারে না। চিকিৎসাকেন্দ্রে অনুশাসন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়ের দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে। দেশের চিকিৎসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যদি যথাযথ সংস্কার অবিলম্বে না করা হয় তাহলে দেশের সামগ্রিক উন্নতি অধরাই রয়ে যাবে। নিত্য নতুন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সংখ্যা না বাড়িয়ে আধুনিক কারিকুলামের সঙ্গে যুক্ত, আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক ও দক্ষ ল্যাব পরিচালনাকারী বাড়াতে হবে। যেহেতু এটা টেকনিক্যাল শিক্ষানির্ভর ব্যবস্থা তাই মেডিকেল কলেজগুলোয় বাড়াতে হবে ল্যাবরেটরির সংখ্যা। এছাড়া আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কেউ শুধু বই মুখস্থ করে, যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই নামমাত্র চিকিৎসক না হন।

চিকিৎসা বিষয়ে গবেষণায় আরো জোর দিতে হবে, বাড়াতে হবে প্রণোদনা। এই কাজগুলো যদি দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে হয়তো আমরা আমাদের প্রিয়জনদের আরও কিছুদিন ধরে রাখতে পারব। যাপিত জীবনে অসুস্থতা না থাকলে সেটির প্রভাব পরিবার থেকে শুরু করে দেশের জন্যও মঙ্গলকর হবে। সুতরাং সকলের সুস্থ জীবন কাম্য।

[লেখক : সংবাদকর্মী]

back to top