alt

উপ-সম্পাদকীয়

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

আনোয়ারুল হক

: সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

আওয়ামী লীগের একটানা দেড় দশকের শাসনকালে সারা দেশে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ, অভিনেতা, অভিনেত্রী, গায়ক, গায়িকা, খেলোয়াড়, ক্রীড়াবিদÑকোনো পেশার লোক বাদ ছিলেন না, যারা আওয়ামী লীগ বিশেষত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর স্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন না। এদের মধ্যে অনেকেই জাতীয় পদক প্রাপ্তি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক, চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভিসি, প্রো-ভিসি পদ, দেশে বিদেশে চিকিৎসায় সরকারি বা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের আনুকূল্য, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্ব লাভ, নিদেন পক্ষে রাজউকের প্লটপ্রাপ্তি বা সরকারি খরচে বিদেশ সফর ইত্যাদি সুবিধা পেয়ে নিজেরা ধন্য হয়েছেন এবং স্তুতির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ এদের মধ্যে অনেকেই সরকারঘোষিত নিয়মানুযায়ী নিজ যোগ্যতায়ই এসব সুবিধা পেতে পারতেন। আর একটা অংশ আছেন যারা সরকারি আনুকূল্যের সদ্ব্যবহার করে নানা ধরনের দুর্নীতি, তদবির বাণিজ্য ইত্যাদিতে নিয়োজিত ছিলেন। এদের কথা বাদ দেয়াই ভালো। সব আমলেই এ ধরনের অর্থলিপ্সু মানুষ সব পেশায় কিছু থাকেন। এসবের বাইরে আরো কিছু মানুষ আছেন যারা প্রগতিমনা, বাম মনষ্ক, মুক্ত মানবিক সমাজের কথা ভাবেন তারা কোনো প্রাপ্তির দিকে না তাকিয়ে কেন জানি কথিত ‘উন্নয়ন আর চেতনা’-এর বিশেষ পাহারাদার হয়ে দাঁড়ালেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে ২০১৪ সালে যখন ইলেকশনের বদলে অনেকটা সিলেকশন হলো। তখন সরকারের তরফ থেকে কিন্তু বলা হয়েছিলো এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন এবং ৬ মাস পরেই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। এ বক্তব্য যতটা না দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ছিলো তার চেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশস্থ বিদেশি কূটনীতিক ও পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশে। সীমিত যে কয়টি আসনে এক তরফা নির্বাচন আয়োজন করতে হয়েছিলো বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল তা প্রতিরোধে এবং নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরে তা প্রত্যাখান করে আগে পরে মিলিয়ে প্রায় এক মাস যাবৎ হরতাল অবরোধ ব্যাপক অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে সর্বাত্মক আন্দোলন করে। এতো দীর্ঘ সময়ের আন্দোলনে সেভাবে গণ-সম্পৃক্ততা না থাকায় এবং মানুষের জীবন-জীবিকা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ব্যাপক সরকারী নিপীড়নের এক পর্যায়ে বিএনপি রাজপথের আন্দোলন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। দেশে কার্যত একদলীয় একটি পার্লামেন্ট কায়েম হওয়ায় চলমান সংসদীয় রাজনীতির দ্বিদলীয় ব্যবস্থাও অকার্যকর হয়ে পড়ে। একদলীয় পার্লামেন্টারি ব্যাবস্থায় সরকার স্বৈরাচারী শাসনের দিকে অগ্রসর হয়।

২০১৮-তে তো আরো বড় কেলেঙ্কারি হলো। ড. কামাল হোসেন পার্লামেন্টারি রাজনীতির ধারা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ নেন। তার উদ্যোগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলীয় জোটসহ শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর সব বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ভোট হয়ে যায় নিশি ভোট। রাতেই ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে ফেলা হয়। এভাবে ভোটের মাধ্যমে সরকার বদলের এমনকি প্রকৃত বিরোধী শক্তিকে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার রাস্তাও যখন বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন থেকেই ভিন্ন পন্থায় সরকার বদলের আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছিল। আওয়ামী লীগ নেতাদের যে জ্ঞান-বুদ্ধি নাই, তাও তো নয়। তাদেরও তো বুঝার কথা। আওয়ামী লীগ নেতা নূহ উল আলমই তো প্রবীণ বামপন্থি নেতা অসুস্থ হায়দা আকবর খান রণোকে দেখে এসে পত্রিকায় লিখলেন রণো ভাই তার কাছে হাসিনার খোঁজ খবর নিয়েছেন এবং তার জীবন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তাকে সাবধানে থাকতে বলেছেন। তারপরেও তারা একই পথে চলতে লাগলেন।

কৈশোর, তারুণ্য, মধ্য বয়স পার হয়ে এখন তো বার্ধক্যে উপনীত হয়েছি। পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি দেখে ২০২৩- এর ডিসেম্বরেই কালের কল্লোলে কান পেতে শুনছিলাম আসছে হাসিনার বিদায় বাহন। ২০২৪- এর নির্বাচন শেখ হাসিনা পার করতে পারবেন এটা আমার মনে হয়নি। কিন্তু তিনি পার করতে পেরেছেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বন্দুকের তাক থাকে বিরোধী আন্দোলনের দিকে। বন্দুকের তাক যখনই ঘুরে বিপরীত দিকে গেছে তখনই সব পরাক্রমশালী শাসকের পরিবর্তন হয়েছে। ২০২৩ বা ‘২৪-এর জানুয়ারিতে বন্দুকের তাক পরিবর্তিত হয়নি। হাসিনা সরকার টিকে গেছে। কিন্তু বিদায় বাহন প্রস্তুত ছিলো। মাত্র ছয় মাসের মাথায় সামান্য কোটা ইস্যুতে নাকাল হয়ে বর্বর হত্যাযজ্ঞসংঘটিত করে গোট দলসহ বিদায়যাত্রায় শরিক হলেন। এমন যাত্রা যেন অনেকটা শবযাত্রা! এ বিদায় চিরবিদায় নয়, দুঃশাসন থেকে বিদায়।

আজ যদি বলি শেখ হাসিনার এ করুণ পরিণতির জন্য শুধু তিনি বা তার দল নয়, স্তুতি বাগীশ পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীরাও এবং প্রগতিমনা, বামমনষ্ক কিছু জনবিচ্ছিন্ন মানুষও দায়ীÑ যারা মনে করতেন আওয়ামী উন্নয়ন আর চেতনার বিকল্প হচ্ছে একমাত্র ধর্মান্ধ শক্তি। তাই আরো ভালো বিকল্প গড়ে ওঠা না পর্যন্ত আওয়ামী কর্তৃত্ববাদ ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরোধীতা করা যাবে না। আবার ভালো বিকল্প গড়ার কাজেও তারা ছিলেন না। আওয়ামী লীগ পতনের পরে শবযাত্রায়ও তারা নেই। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় আছেন। নিজেরা কিছু লেখেন না। অন্যদের লেখা, ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পরে বিদেশে অবস্থানকারী ইউটিউবারদের কন্টেন্ট, ভারতীয় মিডিয়ার কিছু সংবাদ এবং পশ্চিমা দুনিয়ার মিডিয়ার কিছু খবর, প্রতিবেদন এগুলো শেয়ার করেন, ফরোয়ার্ড করেন। সে সব সংবাদ প্রতিবেদনের একমাত্র সুর সমগ্র ঘটনা ‘মেটিকিউলাস ডিজাইনের অংশ’। সেই ১৯৯১ সালের ‘সূক্ষ¥ কারচুপি’র জিগিরের মতো এবারে ‘রিজিম চেঞ্জের সূক্ষ¥ পরিকল্পনা’র জিগির!

বিনা ভোটে, নৈশভোটে ও ড্যামি ভোটে নির্বাচিত হয়ে যে আওয়ামী লীগ নিজেদের পায়ের তলার মাটি নিজেরাই অনেক আগেই সরিয়ে ফেলেছিলো, তা কখনোই তাদের চোখে পড়তো না; বা পড়লেও ‘৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী সভায় স্থান করে দেওয়া বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে অন্যায় করাটাকেও ফরজ কাজ মনে করতেন। আর এ কথা তো নতুন নয় পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের দূরত্ব দিন দিন বেড়েই চলছিলো। কিন্তু অতিরিক্ত ভারত-নির্ভরতার জোরে তিনি বিষয়টিকে পাত্তা দিতেন না। একদিকে সরকারের অগণতান্ত্রিক চেহারা অন্যদিকে অতিরিক্ত ভারত-নির্ভরতায় তিনি শুধু দেশের জনগণই নন দুনিয়া থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। সব দেশেই কিছু অভিভাবকসম ব্যক্তিত্ব থাকে। সরকার পরিচালনা করতে যেয়ে এ ধরনের ব্যক্তিদের সব পরামর্শ রাখা যায় না, কিন্তু তারপরও তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়। তাদের সম্মান জানাতে হয়। এরা অনেক বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করলেও কেউই শেখ হাসিনার প্রতি শত্রু মনোভাবাপন্ন ছিলেন না। কিন্তু তিনি সবাইকে তার প্রতিপক্ষ এবং কাউকে কাউকে শত্রু শিবিরের লোক মনে করতেন। এভাবে দেশের অভিভাবকসম ব্যক্তিত্বদের থেকে তিনি নিজেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন। তার পতন দুদিন পরে হলেও অনিবার্য ছিলো। এসব পরিবর্তনের ঘটনার সাথে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দুনিয়ার মোড়লদেরও ভূমিকা থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেন শাসকরা নিজেই। তাই শুধুমাত্রমেটিকিউলাস ডিজাইন তত্ত্ব হাজির করে আত্মসন্তুষ্টি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতের পথ রচনায় তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে না।

পাথরের মতো স্থির হলে সে রাজনীতি টিকে থাকতে পারে না। রাজনীতিকে সচল থাকতে হবে মানুষের জন্য। মানুষের সমর্থনেই রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পায়। আর জুলাই জাগরণের মধ্য দিয়ে তারুণ্যের যে আকাক্সক্ষা প্রকাশ পেয়েছে তা এখনো সারা দেশেরদেয়ালে দেয়ালে আঁকা আছে। ওই স্বপ্নকে পড়তে পারলেই বোঝা যায় সংগ্রামটা রেজিম পরিবর্তনের চেয়ে বেশি আকাংখার ছিলো। তারুণ্যের সেই স্বপ্নকে বিবেচনায় রেখেই সামনের দিনগুলোতে অগ্রসর হতে হবে। ভুল করতে করতেই তো জীবনের পথে হাঁটে মানুষ। রাজনৈতিক বিবেচনায়ও ভুল হয়। ভুল হয়ে থাকলে তা স্বীকারে তাই কোনও গ্লানি নেই। হয়তো গৌরবও নেই। কিন্তু ভুল শুধরে নিয়ে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, ক্রীড়াবিদ আর প্রগতিমনা মানুষ, যারা ‘৭১ এর পরাজিত শক্তির উত্থান দেখে ঝুঁকে পড়েছিলেন আওয়ামী বলয়ের দিকে তারা যদি আজ দেশের বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির পাশে দাঁড়ান তবে দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের এই সময়টাতে দক্ষিণ পন্থার উগ্র মূর্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কিছুটা ইতিবাচক রাজনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি হতে পারে। জীবন কিন্তু পশ্চাৎমুখী চলে না। ফেলে আসা দিনের জন্য অপেক্ষাও করে না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই সময়।

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

লই গো বুক পেতে অনল-বাণ!

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ

আমেরিকার অলিগার্কি পতনের আখ্যান

রম্যগদ্য : ‘উহু উহু, তোরে মাফ করা যায় না...’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট : সংকোচন, সংকট ও সম্ভাবনার প্রতিফলন

আম রপ্তানি : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

সামাজিকমাধ্যম গুরুত্বহীন নয়

জমির শ্রেণী চেনার উপায় ও পরিবর্তনের নিয়ম-কানুন

বাংলাদেশ : “রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ”

নতুন নোট, নতুন বিতর্ক

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশা ও উপজেলা পর্যায়ের অদক্ষতা : কে নেবে দায়িত্ব?

তরল সম্পর্কের গোলকধাঁধা

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

বাজেটে বৈষম্য কমানোর কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন আছে কি

চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে

রম্যগদ্য : ‘নির্বাচন, না নীর-বচন...’

প্লাস্টিক দূষণ নয়, প্রকৃতির পাশে দাঁড়ান

কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ত্যাগের মহিমায় ঈদুল আজহা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

আনোয়ারুল হক

সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

আওয়ামী লীগের একটানা দেড় দশকের শাসনকালে সারা দেশে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ, অভিনেতা, অভিনেত্রী, গায়ক, গায়িকা, খেলোয়াড়, ক্রীড়াবিদÑকোনো পেশার লোক বাদ ছিলেন না, যারা আওয়ামী লীগ বিশেষত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর স্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন না। এদের মধ্যে অনেকেই জাতীয় পদক প্রাপ্তি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক, চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভিসি, প্রো-ভিসি পদ, দেশে বিদেশে চিকিৎসায় সরকারি বা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের আনুকূল্য, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্ব লাভ, নিদেন পক্ষে রাজউকের প্লটপ্রাপ্তি বা সরকারি খরচে বিদেশ সফর ইত্যাদি সুবিধা পেয়ে নিজেরা ধন্য হয়েছেন এবং স্তুতির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ এদের মধ্যে অনেকেই সরকারঘোষিত নিয়মানুযায়ী নিজ যোগ্যতায়ই এসব সুবিধা পেতে পারতেন। আর একটা অংশ আছেন যারা সরকারি আনুকূল্যের সদ্ব্যবহার করে নানা ধরনের দুর্নীতি, তদবির বাণিজ্য ইত্যাদিতে নিয়োজিত ছিলেন। এদের কথা বাদ দেয়াই ভালো। সব আমলেই এ ধরনের অর্থলিপ্সু মানুষ সব পেশায় কিছু থাকেন। এসবের বাইরে আরো কিছু মানুষ আছেন যারা প্রগতিমনা, বাম মনষ্ক, মুক্ত মানবিক সমাজের কথা ভাবেন তারা কোনো প্রাপ্তির দিকে না তাকিয়ে কেন জানি কথিত ‘উন্নয়ন আর চেতনা’-এর বিশেষ পাহারাদার হয়ে দাঁড়ালেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে ২০১৪ সালে যখন ইলেকশনের বদলে অনেকটা সিলেকশন হলো। তখন সরকারের তরফ থেকে কিন্তু বলা হয়েছিলো এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন এবং ৬ মাস পরেই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। এ বক্তব্য যতটা না দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ছিলো তার চেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশস্থ বিদেশি কূটনীতিক ও পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশে। সীমিত যে কয়টি আসনে এক তরফা নির্বাচন আয়োজন করতে হয়েছিলো বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল তা প্রতিরোধে এবং নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরে তা প্রত্যাখান করে আগে পরে মিলিয়ে প্রায় এক মাস যাবৎ হরতাল অবরোধ ব্যাপক অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে সর্বাত্মক আন্দোলন করে। এতো দীর্ঘ সময়ের আন্দোলনে সেভাবে গণ-সম্পৃক্ততা না থাকায় এবং মানুষের জীবন-জীবিকা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ব্যাপক সরকারী নিপীড়নের এক পর্যায়ে বিএনপি রাজপথের আন্দোলন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। দেশে কার্যত একদলীয় একটি পার্লামেন্ট কায়েম হওয়ায় চলমান সংসদীয় রাজনীতির দ্বিদলীয় ব্যবস্থাও অকার্যকর হয়ে পড়ে। একদলীয় পার্লামেন্টারি ব্যাবস্থায় সরকার স্বৈরাচারী শাসনের দিকে অগ্রসর হয়।

২০১৮-তে তো আরো বড় কেলেঙ্কারি হলো। ড. কামাল হোসেন পার্লামেন্টারি রাজনীতির ধারা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ নেন। তার উদ্যোগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলীয় জোটসহ শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর সব বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ভোট হয়ে যায় নিশি ভোট। রাতেই ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে ফেলা হয়। এভাবে ভোটের মাধ্যমে সরকার বদলের এমনকি প্রকৃত বিরোধী শক্তিকে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার রাস্তাও যখন বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন থেকেই ভিন্ন পন্থায় সরকার বদলের আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছিল। আওয়ামী লীগ নেতাদের যে জ্ঞান-বুদ্ধি নাই, তাও তো নয়। তাদেরও তো বুঝার কথা। আওয়ামী লীগ নেতা নূহ উল আলমই তো প্রবীণ বামপন্থি নেতা অসুস্থ হায়দা আকবর খান রণোকে দেখে এসে পত্রিকায় লিখলেন রণো ভাই তার কাছে হাসিনার খোঁজ খবর নিয়েছেন এবং তার জীবন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তাকে সাবধানে থাকতে বলেছেন। তারপরেও তারা একই পথে চলতে লাগলেন।

কৈশোর, তারুণ্য, মধ্য বয়স পার হয়ে এখন তো বার্ধক্যে উপনীত হয়েছি। পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি দেখে ২০২৩- এর ডিসেম্বরেই কালের কল্লোলে কান পেতে শুনছিলাম আসছে হাসিনার বিদায় বাহন। ২০২৪- এর নির্বাচন শেখ হাসিনা পার করতে পারবেন এটা আমার মনে হয়নি। কিন্তু তিনি পার করতে পেরেছেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বন্দুকের তাক থাকে বিরোধী আন্দোলনের দিকে। বন্দুকের তাক যখনই ঘুরে বিপরীত দিকে গেছে তখনই সব পরাক্রমশালী শাসকের পরিবর্তন হয়েছে। ২০২৩ বা ‘২৪-এর জানুয়ারিতে বন্দুকের তাক পরিবর্তিত হয়নি। হাসিনা সরকার টিকে গেছে। কিন্তু বিদায় বাহন প্রস্তুত ছিলো। মাত্র ছয় মাসের মাথায় সামান্য কোটা ইস্যুতে নাকাল হয়ে বর্বর হত্যাযজ্ঞসংঘটিত করে গোট দলসহ বিদায়যাত্রায় শরিক হলেন। এমন যাত্রা যেন অনেকটা শবযাত্রা! এ বিদায় চিরবিদায় নয়, দুঃশাসন থেকে বিদায়।

আজ যদি বলি শেখ হাসিনার এ করুণ পরিণতির জন্য শুধু তিনি বা তার দল নয়, স্তুতি বাগীশ পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীরাও এবং প্রগতিমনা, বামমনষ্ক কিছু জনবিচ্ছিন্ন মানুষও দায়ীÑ যারা মনে করতেন আওয়ামী উন্নয়ন আর চেতনার বিকল্প হচ্ছে একমাত্র ধর্মান্ধ শক্তি। তাই আরো ভালো বিকল্প গড়ে ওঠা না পর্যন্ত আওয়ামী কর্তৃত্ববাদ ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরোধীতা করা যাবে না। আবার ভালো বিকল্প গড়ার কাজেও তারা ছিলেন না। আওয়ামী লীগ পতনের পরে শবযাত্রায়ও তারা নেই। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় আছেন। নিজেরা কিছু লেখেন না। অন্যদের লেখা, ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পরে বিদেশে অবস্থানকারী ইউটিউবারদের কন্টেন্ট, ভারতীয় মিডিয়ার কিছু সংবাদ এবং পশ্চিমা দুনিয়ার মিডিয়ার কিছু খবর, প্রতিবেদন এগুলো শেয়ার করেন, ফরোয়ার্ড করেন। সে সব সংবাদ প্রতিবেদনের একমাত্র সুর সমগ্র ঘটনা ‘মেটিকিউলাস ডিজাইনের অংশ’। সেই ১৯৯১ সালের ‘সূক্ষ¥ কারচুপি’র জিগিরের মতো এবারে ‘রিজিম চেঞ্জের সূক্ষ¥ পরিকল্পনা’র জিগির!

বিনা ভোটে, নৈশভোটে ও ড্যামি ভোটে নির্বাচিত হয়ে যে আওয়ামী লীগ নিজেদের পায়ের তলার মাটি নিজেরাই অনেক আগেই সরিয়ে ফেলেছিলো, তা কখনোই তাদের চোখে পড়তো না; বা পড়লেও ‘৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী সভায় স্থান করে দেওয়া বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে অন্যায় করাটাকেও ফরজ কাজ মনে করতেন। আর এ কথা তো নতুন নয় পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের দূরত্ব দিন দিন বেড়েই চলছিলো। কিন্তু অতিরিক্ত ভারত-নির্ভরতার জোরে তিনি বিষয়টিকে পাত্তা দিতেন না। একদিকে সরকারের অগণতান্ত্রিক চেহারা অন্যদিকে অতিরিক্ত ভারত-নির্ভরতায় তিনি শুধু দেশের জনগণই নন দুনিয়া থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। সব দেশেই কিছু অভিভাবকসম ব্যক্তিত্ব থাকে। সরকার পরিচালনা করতে যেয়ে এ ধরনের ব্যক্তিদের সব পরামর্শ রাখা যায় না, কিন্তু তারপরও তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়। তাদের সম্মান জানাতে হয়। এরা অনেক বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করলেও কেউই শেখ হাসিনার প্রতি শত্রু মনোভাবাপন্ন ছিলেন না। কিন্তু তিনি সবাইকে তার প্রতিপক্ষ এবং কাউকে কাউকে শত্রু শিবিরের লোক মনে করতেন। এভাবে দেশের অভিভাবকসম ব্যক্তিত্বদের থেকে তিনি নিজেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন। তার পতন দুদিন পরে হলেও অনিবার্য ছিলো। এসব পরিবর্তনের ঘটনার সাথে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দুনিয়ার মোড়লদেরও ভূমিকা থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেন শাসকরা নিজেই। তাই শুধুমাত্রমেটিকিউলাস ডিজাইন তত্ত্ব হাজির করে আত্মসন্তুষ্টি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতের পথ রচনায় তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে না।

পাথরের মতো স্থির হলে সে রাজনীতি টিকে থাকতে পারে না। রাজনীতিকে সচল থাকতে হবে মানুষের জন্য। মানুষের সমর্থনেই রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পায়। আর জুলাই জাগরণের মধ্য দিয়ে তারুণ্যের যে আকাক্সক্ষা প্রকাশ পেয়েছে তা এখনো সারা দেশেরদেয়ালে দেয়ালে আঁকা আছে। ওই স্বপ্নকে পড়তে পারলেই বোঝা যায় সংগ্রামটা রেজিম পরিবর্তনের চেয়ে বেশি আকাংখার ছিলো। তারুণ্যের সেই স্বপ্নকে বিবেচনায় রেখেই সামনের দিনগুলোতে অগ্রসর হতে হবে। ভুল করতে করতেই তো জীবনের পথে হাঁটে মানুষ। রাজনৈতিক বিবেচনায়ও ভুল হয়। ভুল হয়ে থাকলে তা স্বীকারে তাই কোনও গ্লানি নেই। হয়তো গৌরবও নেই। কিন্তু ভুল শুধরে নিয়ে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, ক্রীড়াবিদ আর প্রগতিমনা মানুষ, যারা ‘৭১ এর পরাজিত শক্তির উত্থান দেখে ঝুঁকে পড়েছিলেন আওয়ামী বলয়ের দিকে তারা যদি আজ দেশের বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির পাশে দাঁড়ান তবে দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের এই সময়টাতে দক্ষিণ পন্থার উগ্র মূর্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কিছুটা ইতিবাচক রাজনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি হতে পারে। জীবন কিন্তু পশ্চাৎমুখী চলে না। ফেলে আসা দিনের জন্য অপেক্ষাও করে না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই সময়।

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

back to top