সনজিৎ নন্দী
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সব মহলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তির হার প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু ভর্তির পর শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা চক্র সম্পন্ন করা নিশ্চিত করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।
প্রাথমিক শিক্ষা চক্র বলতে বোঝায়, একটি শিশু প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করা। নানা কারণে অনেক শিশু এই চক্র সম্পন্ন না করে বিদ্যালয় ত্যাগ করে। যদিও বর্তমানে ঝরে পড়ার হার অনেক কমেছে, তবুও এটি একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনা জরুরি।
ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হতে পারে শিক্ষার্থীর পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা। অনেক সময় পরিবার মনে করে, শিশুটি পড়ালেখার পরিবর্তে কাজ করলে আয়ের মাধ্যমে পরিবারে অবদান রাখতে পারবে। কিন্তু বিষয়টি শুধু অর্থনৈতিক নয়Ñএতে অভিভাবকের শিক্ষার অভাব, সচেতনতার ঘাটতি এবং মানসিকতার সমস্যাও জড়িত।
এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যালয়ে মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ ও উঠান বৈঠকসহ সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। শিক্ষকদের দায়িত্ব হবে অভিভাবকদের বোঝানোÑশিক্ষা হলো শিশুর ভবিষ্যতের ভিত্তি, শ্রম নয়।
আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি লক্ষ্য পূরণের জন্য ১৩টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং প্রাথমিক শিক্ষা শেষে অর্জনযোগ্য ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারিত আছে। এসব যোগ্যতা শ্রেণিভিত্তিক ও বিষয়ভিত্তিকভাবে বিভাজিত। যখন কোনো শিক্ষার্থী তার শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়, তখন সে পাঠের প্রতি আগ্রহ হারায়, বিদ্যালয়ে অনিয়মিত হতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্যালয় ত্যাগ করে।
এ কারণে একজন শিক্ষকের ভূমিকা হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষককে নিশ্চিত করতে হবে, প্রতিটি শিশু নির্ধারিত শ্রেণিতে প্রাপ্তিযোগ্য যোগ্যতা অর্জন করছে। এজন্য পাঠদান হতে হবে পরিকল্পিত ও আনন্দময়। শ্রেণিকক্ষে থাকতে হবে নিরাপদ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ।
শিক্ষককে হতে হবে শিশুদের জন্য সহজগম্য ও প্রেরণাদানকারী। শিশুর সঙ্গে আচরণ হবে উৎসাহব্যঞ্জক, কৌতূহল উদ্দীপক এবং শ্রদ্ধাস্নেহময়। যারা অন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তায় সমৃদ্ধ, কিন্তু সামাজিক খেলাধুলায় কম অংশগ্রহণ করেÑতাদের জন্য বই পড়া, চিত্রাঙ্কন বা সৃজনশীল কর্মকা-ের সুযোগ দিতে হবে।
পাঠপরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়াদের জন্য বিশেষ কৌশল গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষক যেন শিশুদের মনে ভয় নয়, বরং ভরসার স্থান হিসেবে স্থান করে নেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। মা-বাবার পর শিশু যাকে সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গায় রাখে, সে হচ্ছে শিক্ষক।
একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা যায়Ñএক শিক্ষার্থী, যে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, বিদ্যালয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে আসা বন্ধ করে দেয়। অনেক চেষ্টা করেও অভিভাবক তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেন না। একসময় শিক্ষক কৌশলে তাকে বিদ্যালয়ে এনে পিটি করানোর দায়িত্ব দেন। শিশু সেই দায়িত্ব এত আন্তরিকভাবে পালন করে যে, সে আর কখনও অনিয়মিত হয়নি। এই দায়িত্ব তার কাছে হয়ে ওঠে এক ধরনের আত্মমর্যাদা, যা তাকে বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষিত করে রাখে।
শিশুদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখতে হলে শুধু পাঠ্যপুস্তক নির্ভরতা যথেষ্ট নয়, বরং খেলাধুলা ও বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। ফুটবল, ক্রিকেট, কেরাম, দাবা, লুডু ইত্যাদি খেলাধুলার সামগ্রী রাখতে হবে এবং ছাত্রদের আগ্রহ অনুযায়ী তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, লুকোচুরি ইত্যাদির মতো স্থানীয় খেলায় অংশ নিতে তাদের উৎসাহিত করতে হবে। মাঝে মাঝে শিক্ষকরাও তাদের সঙ্গে খেলায় অংশ নিলে শিশুরা আরও বেশি উৎসাহ পাবে।
যেসব শিশু খেলাধুলায় অংশ নিতে চায় না, তাদের জন্য পাঠাগারে শিশুতোষ বইয়ের সংরক্ষণ ও অবসরে পাঠের সুযোগ রাখা যেতে পারে। বিদ্যালয় যেন প্রতিটি শিশুর প্রতিভা বিকাশের একটি উন্মুক্ত ক্ষেত্র হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিটি শিশু আলাদা বৈশিষ্ট্য ও প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। বিদ্যালয়ে তাদের সেই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিলে বিদ্যালয় হবে তাদের কাছে আনন্দের স্থান। তারা নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসবে, ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোটায় পৌঁছাবে।
ফলে শিক্ষার্থীরা প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করবে, হয়ে উঠবে সৃজনশীল ও আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার দক্ষতা অর্জন করে তারা ভবিষ্যতে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।
[লেখক : প্রধান শিক্ষক, উত্তর গুজরা উমা বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়]
সনজিৎ নন্দী
মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সব মহলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তির হার প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু ভর্তির পর শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা চক্র সম্পন্ন করা নিশ্চিত করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।
প্রাথমিক শিক্ষা চক্র বলতে বোঝায়, একটি শিশু প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করা। নানা কারণে অনেক শিশু এই চক্র সম্পন্ন না করে বিদ্যালয় ত্যাগ করে। যদিও বর্তমানে ঝরে পড়ার হার অনেক কমেছে, তবুও এটি একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনা জরুরি।
ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হতে পারে শিক্ষার্থীর পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা। অনেক সময় পরিবার মনে করে, শিশুটি পড়ালেখার পরিবর্তে কাজ করলে আয়ের মাধ্যমে পরিবারে অবদান রাখতে পারবে। কিন্তু বিষয়টি শুধু অর্থনৈতিক নয়Ñএতে অভিভাবকের শিক্ষার অভাব, সচেতনতার ঘাটতি এবং মানসিকতার সমস্যাও জড়িত।
এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যালয়ে মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ ও উঠান বৈঠকসহ সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। শিক্ষকদের দায়িত্ব হবে অভিভাবকদের বোঝানোÑশিক্ষা হলো শিশুর ভবিষ্যতের ভিত্তি, শ্রম নয়।
আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি লক্ষ্য পূরণের জন্য ১৩টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং প্রাথমিক শিক্ষা শেষে অর্জনযোগ্য ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারিত আছে। এসব যোগ্যতা শ্রেণিভিত্তিক ও বিষয়ভিত্তিকভাবে বিভাজিত। যখন কোনো শিক্ষার্থী তার শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়, তখন সে পাঠের প্রতি আগ্রহ হারায়, বিদ্যালয়ে অনিয়মিত হতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্যালয় ত্যাগ করে।
এ কারণে একজন শিক্ষকের ভূমিকা হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষককে নিশ্চিত করতে হবে, প্রতিটি শিশু নির্ধারিত শ্রেণিতে প্রাপ্তিযোগ্য যোগ্যতা অর্জন করছে। এজন্য পাঠদান হতে হবে পরিকল্পিত ও আনন্দময়। শ্রেণিকক্ষে থাকতে হবে নিরাপদ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ।
শিক্ষককে হতে হবে শিশুদের জন্য সহজগম্য ও প্রেরণাদানকারী। শিশুর সঙ্গে আচরণ হবে উৎসাহব্যঞ্জক, কৌতূহল উদ্দীপক এবং শ্রদ্ধাস্নেহময়। যারা অন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তায় সমৃদ্ধ, কিন্তু সামাজিক খেলাধুলায় কম অংশগ্রহণ করেÑতাদের জন্য বই পড়া, চিত্রাঙ্কন বা সৃজনশীল কর্মকা-ের সুযোগ দিতে হবে।
পাঠপরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়াদের জন্য বিশেষ কৌশল গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষক যেন শিশুদের মনে ভয় নয়, বরং ভরসার স্থান হিসেবে স্থান করে নেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। মা-বাবার পর শিশু যাকে সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গায় রাখে, সে হচ্ছে শিক্ষক।
একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা যায়Ñএক শিক্ষার্থী, যে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, বিদ্যালয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে আসা বন্ধ করে দেয়। অনেক চেষ্টা করেও অভিভাবক তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেন না। একসময় শিক্ষক কৌশলে তাকে বিদ্যালয়ে এনে পিটি করানোর দায়িত্ব দেন। শিশু সেই দায়িত্ব এত আন্তরিকভাবে পালন করে যে, সে আর কখনও অনিয়মিত হয়নি। এই দায়িত্ব তার কাছে হয়ে ওঠে এক ধরনের আত্মমর্যাদা, যা তাকে বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষিত করে রাখে।
শিশুদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখতে হলে শুধু পাঠ্যপুস্তক নির্ভরতা যথেষ্ট নয়, বরং খেলাধুলা ও বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। ফুটবল, ক্রিকেট, কেরাম, দাবা, লুডু ইত্যাদি খেলাধুলার সামগ্রী রাখতে হবে এবং ছাত্রদের আগ্রহ অনুযায়ী তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, লুকোচুরি ইত্যাদির মতো স্থানীয় খেলায় অংশ নিতে তাদের উৎসাহিত করতে হবে। মাঝে মাঝে শিক্ষকরাও তাদের সঙ্গে খেলায় অংশ নিলে শিশুরা আরও বেশি উৎসাহ পাবে।
যেসব শিশু খেলাধুলায় অংশ নিতে চায় না, তাদের জন্য পাঠাগারে শিশুতোষ বইয়ের সংরক্ষণ ও অবসরে পাঠের সুযোগ রাখা যেতে পারে। বিদ্যালয় যেন প্রতিটি শিশুর প্রতিভা বিকাশের একটি উন্মুক্ত ক্ষেত্র হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিটি শিশু আলাদা বৈশিষ্ট্য ও প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। বিদ্যালয়ে তাদের সেই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিলে বিদ্যালয় হবে তাদের কাছে আনন্দের স্থান। তারা নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসবে, ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোটায় পৌঁছাবে।
ফলে শিক্ষার্থীরা প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করবে, হয়ে উঠবে সৃজনশীল ও আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার দক্ষতা অর্জন করে তারা ভবিষ্যতে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।
[লেখক : প্রধান শিক্ষক, উত্তর গুজরা উমা বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়]