alt

opinion » post-editorial

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

হেনা শিকদার

: বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন এক অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতি বছর এসব দুর্যোগে বিপুল পরিমাণ জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সহযোগী এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও, এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারÑসাধারণ জনগণÑতাদের ভূমিকা প্রায়শই অলিখিত এবং উপেক্ষিত থেকে যায়। দুর্যোগের প্রথম শিকার এবং প্রথম সাড়া প্রদানকারী হওয়া সত্ত্বেও, সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার কাঠামোতে তাদের শক্তি ও সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয় না।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার চক্রটিকে মূলত তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়: দুর্যোগ পূর্ববর্তী প্রস্তুতি, দুর্যোগকালীন সাড়া এবং দুর্যোগ পরবর্তী পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন। বিস্ময়করভাবে, এই প্রতিটি পর্বেই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত এবং অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার টেবিলে খুব কমই গুরুত্ব পায়।

দুর্যোগ আঘাত হানার আগেই এর ঝুঁকি কমানো এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করা সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এই পর্যায়ে জনগণের ভূমিকা প্রধানত দুটিÑব্যক্তিগত ও সামাজিক। পারিবারিকভাবে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা, ঘরের ঝুঁকিপূর্ণ অংশ মেরামত করা, এবং দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্রের তথ্য জেনে রাখাÑএইসব ব্যক্তিগত প্রস্তুতি একটি বড় দুর্যোগের প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে সাহায্য করে।

সামাজিক পর্যায়ে এই ভূমিকা আরও বিস্তৃত। স্থানীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দুর্যোগের পূর্বাভাস বোঝা এবং তা প্রতিবেশীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, এলাকার তরুণ ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে দল গঠন করে মহড়া আয়োজন করা, এবং গ্রামের দুর্বল ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করাÑএসবই দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা মেঘের রং, বাতাসের গতি ও পশুপাখির আচরণ দেখে ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার যে সনাতনী জ্ঞান ধারণ করে, তা আধুনিক প্রযুক্তির চেয়ে কোনো অংশে কম কার্যকর নয়। কিন্তু এই অমূল্য জ্ঞান এবং স্ব-উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার সাথে সমন্বিত করার প্রচেষ্টা অত্যন্ত সীমিত। পরিকল্পনাগুলো প্রায়শই উপর থেকে নিচে চাপিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে নিচ থেকে উপরে আসা জনগণের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করা হয়।

যেকোনো দুর্যোগ আঘাত হানার পর প্রথম কয়েক ঘণ্টা বা অনেক ক্ষেত্রে প্রথম দিন পর্যন্ত সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এই ‘গোল্ডেন আওয়ারে’ উদ্ধারকাজ, প্রাথমিক চিকিৎসা, এবং নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে প্রতিবেশীরাই। নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যকে বাঁচানোর যে অগণিত বীরত্বগাথা প্রতি দুর্যোগে তৈরি হয়, তার স্বীকৃতি কোথায়? গণমাধ্যমের ক্যামেরায় যখন উদ্ধারকারী দলের ছবি দেখানো হয়, তখন তার আড়ালে থেকে যায় শত শত সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যারা কোনো যন্ত্র বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই কেবল মানবিক তাগিদে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এই সাধারণ মানুষগুলোই প্রথম নিজেদের নৌকা নিয়ে বন্যাকবলিত মানুষকে উদ্ধার করে, শুকনো কাপড় ও খাবার দিয়ে আশ্রয় দেয়। অথচ, দুর্যোগকালীন ব্যবস্থাপনার আলোচনায় তাদের প্রায়শই ‘সহায় সম্বলহীন দুর্গত’ বা ‘পীড়িত’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, ‘সক্রিয় উদ্ধারকর্মী’ হিসেবে নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাদের আত্মমর্যাদাকে যেমন ক্ষুণœ করে, তেমনি তাদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়।

দুর্যোগের ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ এবং কষ্টসাধ্য। এই পর্যায়েও জনগণের ভূমিকা কেন্দ্রীয়। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সহায়তা সাময়িক স্বস্তি দিলেও, দীর্ঘমেয়াদী পুনরুদ্ধার নির্ভর করে স্থানীয় সম্প্রদায় বা ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর। ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ি মেরামত করা, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা, কৃষিজমি পুনরায় চাষের উপযোগী করা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে মানসিক শক্তি জোগান দেওয়াÑএই সবই জনগণ নিজেদের উদ্যোগে করে থাকে।

কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের কেবল ‘গ্রহীতা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এর ফলে একদিকে যেমন প্রকৃত প্রয়োজন ও বাস্তবতার সাথে গৃহীত পদক্ষেপের ফারাক তৈরি হয়, তেমনি অন্যদিকে মানুষের মধ্যে পরনির্ভরশীলতার মানসিকতা জন্মায়। স্থানীয়ভাবে কী ধরনের ঘরবাড়ি টিকে থাকতে পারে, কোন প্রযুক্তিতে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে, বা কাদের সহায়তা সর্বাগ্রে প্রয়োজনÑএই সিদ্ধান্তগুলো যখন স্থানীয়দের অংশগ্রহণ ছাড়া নেওয়া হয়, তখন তা টেকসই হয় না।

জনগণের ভূমিকাকে উপেক্ষা করার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, একটি আমলাতান্ত্রিক ও কেন্দ্রমুখী ব্যবস্থাপনা কাঠামো, যেখানে সব পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয়ভাবে নেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যম ও দাতাসংস্থাগুলোর ‘পীড়িত’ মানুষের ছবি দেখিয়ে তহবিল সংগ্রহের প্রবণতা, যা তাদের অসহায়ত্বের চিত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে, শক্তির চিত্রকে নয়। তৃতীয়ত, কমিউনিটি পর্যায়ে সংগঠিত উদ্যোগ গ্রহণ ও তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট বিনিয়োগের অভাব।

এই অবস্থার পরিবর্তনে একটি মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দর্শনকে ‘ত্রাণকেন্দ্রিক’ না রেখে ‘জনগণকেন্দ্রিক’ ও ‘সক্ষমতাকেন্দ্রিক’ করতে হবে। এর জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:

স্থানীয় জ্ঞানকে স্বীকৃতি: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সকল পরিকল্পনা ও নীতিতে জনগণের স্থানীয় ও সনাতনী জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

কমিউনিটি ক্ষমতায়ন: প্রতিটি এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন, তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করতে হবে। ‘কমিউনিটি ভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা’ মডেলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ: দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস থেকে শুরু করে পুনর্বাসন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

স্বীকৃতি ও সম্মান: দুর্যোগের সময় সাধারণ মানুষের অসাধারণ অবদানকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের বীরত্বগাথা প্রচারের মাধ্যমে অন্যকে অনুপ্রাণিত করতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেবল সরকার বা কয়েকটি সংস্থার দায়িত্ব নয়, এটি একটি সম্মিলিত সামাজিক দায়িত্ব। জনগণ এই ব্যবস্থাপনার অসহায় শিকার নয়, বরং এর সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী অংশীদার। তাদের অভিজ্ঞতা, শক্তি এবং উদ্যোগকে উপেক্ষা করে একটি টেকসই ও দুর্যোগ সহনশীল জাতি গঠন অসম্ভব। যখন প্রতিটি নাগরিক জানবে যে সে কেবল একজন সম্ভাব্য ‘দুর্গত’ নয়, বরং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার একজন সক্রিয় ‘যোদ্ধা’, তখনই আমরা দুর্যোগ মোকাবিলায় সত্যিকার অর্থে এক ধাপ এগিয়ে যাব।

‎[লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

পাহাড় থেকে সমতল: আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন: আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

রম্যগদ্য: “কেশ ফ্যালায় ভাই, কেশ ফ্যালায়...”

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীর অধিকার: বিসিএস ও শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্য

ন্যাশনাল গ্যালারি : রঙতুলির মহাসমুদ্রে একদিন

যুব শক্তি বনাম বেকারত্ব

প্রযুক্তি, আর্থিক পরিকল্পনা ও গণিতের ব্যবহার

ফরাসি বিপ্লব: বৈষম্য নিরসনে সামগ্রিক মুক্তির প্রেরণা

অন্তর্বর্তী সরকারের নিউইয়র্ক সফর

প্রবীণদের যত্ন: নৈতিক দায়িত্ব থেকে সামাজিক শক্তি নির্মাণ

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের অপরিহার্যতা

জনমিতিক সুবিধা: স্বপ্নের দশক ও নীতিগত সংস্কারের অপরিহার্যতা

বিদ্যালয় ও মাঠ দখলের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগ্রাম

শিক্ষাসংস্কারে চাই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

ভারতে এসআইআর বিতর্ক

কীটনাশক: জনস্বাস্থ্যের হুমকি

কীটনাশক: জনস্বাস্থ্যের হুমকি

ব্যাংক একীভূতকরণ: আর্থিক খাতের সামনে নতুন বাস্তবতা

দায়িত্বশীল আচরণে গড়ে উঠুক দেশের পর্যটন খাত

এশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন সমীকরণ

বাংলাদেশের গিগ অর্থনীতি: উন্নয়নের হাতিয়ার নাকি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?

জলাতঙ্ক: প্রতিরোধযোগ্য তবু প্রাণঘাতী

বেড়ে চলা বৈষম্যের দেওয়াল

নৃশংসতার ভিডিও, নীরব দর্শক আর হারিয়ে যাওয়া মানবতা

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও জনস্বাস্থ্যের সংকট

জেন জি’র অস্থির অভিযাত্রা

রম্যগদ্য: রবার্ট ব্রুস ও মাকড়শা

জাতিসংঘের নিউইয়র্ক সম্মেলন

বিশ্ব ফুসফুস দিবস: সুস্থ শ্বাসের অঙ্গীকার

সংখ্যার আড়ালে অর্থনীতির অদেখা বাস্তবতা

tab

opinion » post-editorial

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

হেনা শিকদার

বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন এক অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতি বছর এসব দুর্যোগে বিপুল পরিমাণ জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সহযোগী এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও, এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারÑসাধারণ জনগণÑতাদের ভূমিকা প্রায়শই অলিখিত এবং উপেক্ষিত থেকে যায়। দুর্যোগের প্রথম শিকার এবং প্রথম সাড়া প্রদানকারী হওয়া সত্ত্বেও, সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার কাঠামোতে তাদের শক্তি ও সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয় না।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার চক্রটিকে মূলত তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়: দুর্যোগ পূর্ববর্তী প্রস্তুতি, দুর্যোগকালীন সাড়া এবং দুর্যোগ পরবর্তী পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন। বিস্ময়করভাবে, এই প্রতিটি পর্বেই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত এবং অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার টেবিলে খুব কমই গুরুত্ব পায়।

দুর্যোগ আঘাত হানার আগেই এর ঝুঁকি কমানো এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করা সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এই পর্যায়ে জনগণের ভূমিকা প্রধানত দুটিÑব্যক্তিগত ও সামাজিক। পারিবারিকভাবে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা, ঘরের ঝুঁকিপূর্ণ অংশ মেরামত করা, এবং দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্রের তথ্য জেনে রাখাÑএইসব ব্যক্তিগত প্রস্তুতি একটি বড় দুর্যোগের প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে সাহায্য করে।

সামাজিক পর্যায়ে এই ভূমিকা আরও বিস্তৃত। স্থানীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দুর্যোগের পূর্বাভাস বোঝা এবং তা প্রতিবেশীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, এলাকার তরুণ ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে দল গঠন করে মহড়া আয়োজন করা, এবং গ্রামের দুর্বল ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করাÑএসবই দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা মেঘের রং, বাতাসের গতি ও পশুপাখির আচরণ দেখে ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার যে সনাতনী জ্ঞান ধারণ করে, তা আধুনিক প্রযুক্তির চেয়ে কোনো অংশে কম কার্যকর নয়। কিন্তু এই অমূল্য জ্ঞান এবং স্ব-উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার সাথে সমন্বিত করার প্রচেষ্টা অত্যন্ত সীমিত। পরিকল্পনাগুলো প্রায়শই উপর থেকে নিচে চাপিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে নিচ থেকে উপরে আসা জনগণের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করা হয়।

যেকোনো দুর্যোগ আঘাত হানার পর প্রথম কয়েক ঘণ্টা বা অনেক ক্ষেত্রে প্রথম দিন পর্যন্ত সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এই ‘গোল্ডেন আওয়ারে’ উদ্ধারকাজ, প্রাথমিক চিকিৎসা, এবং নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে প্রতিবেশীরাই। নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যকে বাঁচানোর যে অগণিত বীরত্বগাথা প্রতি দুর্যোগে তৈরি হয়, তার স্বীকৃতি কোথায়? গণমাধ্যমের ক্যামেরায় যখন উদ্ধারকারী দলের ছবি দেখানো হয়, তখন তার আড়ালে থেকে যায় শত শত সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যারা কোনো যন্ত্র বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই কেবল মানবিক তাগিদে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এই সাধারণ মানুষগুলোই প্রথম নিজেদের নৌকা নিয়ে বন্যাকবলিত মানুষকে উদ্ধার করে, শুকনো কাপড় ও খাবার দিয়ে আশ্রয় দেয়। অথচ, দুর্যোগকালীন ব্যবস্থাপনার আলোচনায় তাদের প্রায়শই ‘সহায় সম্বলহীন দুর্গত’ বা ‘পীড়িত’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, ‘সক্রিয় উদ্ধারকর্মী’ হিসেবে নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাদের আত্মমর্যাদাকে যেমন ক্ষুণœ করে, তেমনি তাদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়।

দুর্যোগের ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ এবং কষ্টসাধ্য। এই পর্যায়েও জনগণের ভূমিকা কেন্দ্রীয়। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সহায়তা সাময়িক স্বস্তি দিলেও, দীর্ঘমেয়াদী পুনরুদ্ধার নির্ভর করে স্থানীয় সম্প্রদায় বা ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর। ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ি মেরামত করা, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা, কৃষিজমি পুনরায় চাষের উপযোগী করা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে মানসিক শক্তি জোগান দেওয়াÑএই সবই জনগণ নিজেদের উদ্যোগে করে থাকে।

কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের কেবল ‘গ্রহীতা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এর ফলে একদিকে যেমন প্রকৃত প্রয়োজন ও বাস্তবতার সাথে গৃহীত পদক্ষেপের ফারাক তৈরি হয়, তেমনি অন্যদিকে মানুষের মধ্যে পরনির্ভরশীলতার মানসিকতা জন্মায়। স্থানীয়ভাবে কী ধরনের ঘরবাড়ি টিকে থাকতে পারে, কোন প্রযুক্তিতে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে, বা কাদের সহায়তা সর্বাগ্রে প্রয়োজনÑএই সিদ্ধান্তগুলো যখন স্থানীয়দের অংশগ্রহণ ছাড়া নেওয়া হয়, তখন তা টেকসই হয় না।

জনগণের ভূমিকাকে উপেক্ষা করার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, একটি আমলাতান্ত্রিক ও কেন্দ্রমুখী ব্যবস্থাপনা কাঠামো, যেখানে সব পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয়ভাবে নেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যম ও দাতাসংস্থাগুলোর ‘পীড়িত’ মানুষের ছবি দেখিয়ে তহবিল সংগ্রহের প্রবণতা, যা তাদের অসহায়ত্বের চিত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে, শক্তির চিত্রকে নয়। তৃতীয়ত, কমিউনিটি পর্যায়ে সংগঠিত উদ্যোগ গ্রহণ ও তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট বিনিয়োগের অভাব।

এই অবস্থার পরিবর্তনে একটি মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দর্শনকে ‘ত্রাণকেন্দ্রিক’ না রেখে ‘জনগণকেন্দ্রিক’ ও ‘সক্ষমতাকেন্দ্রিক’ করতে হবে। এর জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:

স্থানীয় জ্ঞানকে স্বীকৃতি: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সকল পরিকল্পনা ও নীতিতে জনগণের স্থানীয় ও সনাতনী জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

কমিউনিটি ক্ষমতায়ন: প্রতিটি এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন, তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করতে হবে। ‘কমিউনিটি ভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা’ মডেলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ: দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস থেকে শুরু করে পুনর্বাসন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

স্বীকৃতি ও সম্মান: দুর্যোগের সময় সাধারণ মানুষের অসাধারণ অবদানকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের বীরত্বগাথা প্রচারের মাধ্যমে অন্যকে অনুপ্রাণিত করতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেবল সরকার বা কয়েকটি সংস্থার দায়িত্ব নয়, এটি একটি সম্মিলিত সামাজিক দায়িত্ব। জনগণ এই ব্যবস্থাপনার অসহায় শিকার নয়, বরং এর সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী অংশীদার। তাদের অভিজ্ঞতা, শক্তি এবং উদ্যোগকে উপেক্ষা করে একটি টেকসই ও দুর্যোগ সহনশীল জাতি গঠন অসম্ভব। যখন প্রতিটি নাগরিক জানবে যে সে কেবল একজন সম্ভাব্য ‘দুর্গত’ নয়, বরং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার একজন সক্রিয় ‘যোদ্ধা’, তখনই আমরা দুর্যোগ মোকাবিলায় সত্যিকার অর্থে এক ধাপ এগিয়ে যাব।

‎[লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top