শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বাংলাদেশ হাজার বছর পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ ছিল। উপনিবেশিক শাসনামলে এ দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভূমিকায় ছিলেন এ দেশের ছাত্র ও শিক্ষকরা। বাংলাদেশের স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনটিতে ঘটেছিল গণঅভ্যুত্থান, যা ছিল বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মাইলফলক।
মুক্তিকামী নিপীড়িত জনগণের পক্ষে জাতির মুক্তিসনদখ্যাত ছয় দফা এবং পরবর্তীতে ছাত্রসমাজের দেওয়া ১১ দফা কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়েছিল এই গণঅভ্যুত্থান। এই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন, সেই নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ প্রায় ৫৪ বছর। এই চুয়ান্ন বছরে উপনিবেশিক আমলের বিরাজমান শিক্ষা ব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল ভূমিকায় ছিলেন ছাত্র, শিক্ষক, এবং শিক্ষা-বঞ্চিত দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকেরা। সবারই লক্ষ্য ছিল-স্বাধীন বাংলাদেশ হবে একটি বৈষম্যহীন দেশ।
কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্যগুলো নিরসনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ১৯৭২ সালে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা ছিল না-যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
তাহলে কি এ দেশের মানুষ সরকারি ব্যবস্থায় শুধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই পড়বে? তারা কি শুধু পিয়ন বা চৌকিদারের কাজ করবে? উপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা সীমিত পরিসরে বাঙালিদের পড়াশোনার সুযোগ দিয়েছিল; তাদের উদ্দেশ্য ছিল-এই জনপদের মানুষ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কেবল দপ্তরী ও নিম্নস্তরের কাজ করবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীন বাংলাদেশেও শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকাংশে এখনো সেই ব্রিটিশ কাঠামোয় রয়ে গেছে।
একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ২৬,১০৪টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাসিক বেতন আদেশ (এমপিও) সুবিধা ভোগ করছে। এই সংখ্যা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা, কারিগরি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় ২ কোটি ৭৪ লাখ ২৯ হাজার ৩১৭ জন (কওমি মাদ্রাসা ও কিছু মেডিকেল কলেজ বাদে)।
দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় অংশই পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারিভাবে। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশের ২১ হাজার ৮৬টি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৯ হাজার ৭৫৭টি বেসরকারি, যা মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বাকিগুলোর মধ্যে ৬৯১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৬৩৮টি আপগ্রেডেড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
তবে গত ১২ মার্চ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব আপগ্রেডেড সরকারি বিদ্যালয়ের নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখার আদেশ জারি করেছে।
ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক স্তরে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৯৪ লাখ ৫ হাজার ৭৮৫। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে ২৯ লাখ ২৬ হাজার ৮৪৯ জন এবং গ্রামাঞ্চলে ৬৪ লাখ ৭৮ হাজার ৯৩৬ জন। গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার্থী বেশি হলেও সরকারি প্রতিষ্ঠান বেশি শহরাঞ্চলে। ৬৯১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৫২টি গ্রামাঞ্চলে এবং ৬৩৯টি শহরাঞ্চলে অবস্থিত।
৯৪ লাখ ৫ হাজার ৭৮৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ছেন ৮৭ লাখ ৪১ হাজার ৪৮০ জন, সরকারি মাধ্যমিকে পড়ছেন ৫ লাখ ৭১ হাজার ৬৮১ জন এবং আপগ্রেডেড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছেন ৯২ হাজার ৬২৪ জন। সে হিসেবে ৯২ দশমিক ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ছেন।
একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে বর্তমানে ২২ হাজার ১৭৪টি এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৬০৮ জন। এই সংখ্যাটি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং মাদ্রাসা-এই তিন স্তরের প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে। আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে মোট ৩৯,০৯২টি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা অন্তর্ভুক্ত।
মূল বিষয়টির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাদান করছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। এই বিপুল শিক্ষার্থীসমাজের শিক্ষা কার্যক্রম যারা সম্পন্ন করছেন, রাষ্ট্র তাদের প্রতি কতটা দায়িত্ব পালন করছে-তা জানা দরকার।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও শিক্ষণ পদ্ধতির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগ্যতার মান একই ধরনের; কিন্তু আর্থিক সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসরকারি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য স্পষ্ট।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের একটি নির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে। সেই কাঠামো অনুসারে তারা বাড়িভাড়া, চিকিৎসাভাতা, ও অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। কিন্তু বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের জন্য বেতন কাঠামো থাকলেও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেই।
একটি এমপিওভুক্ত কলেজ বা বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিতে হলে প্রথমে প্রার্থীকে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত সংস্থার নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। তারপর সেই যোগ্যতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিদ্যালয়ে নিয়োগের সুযোগ পান। একইভাবে সরকারি কলেজ বা বিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে হলে সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।
নিয়োগের প্রক্রিয়ায় দেখা যায়-উভয়ের পদ্ধতি প্রায় একই রকম। কিন্তু এমপিওভুক্ত ও সরকারি শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে বেতন বৈষম্যসহ নানা ধরনের পার্থক্য।
একজন বেসরকারি এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষক প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর সর্বোচ্চ পদোন্নতি পান সহকারী অধ্যাপক পর্যন্ত-তাও ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। কারণ প্রতিটি বেসরকারি এমপিওভুক্ত কলেজে কতজন সরকারি অধ্যাপক হতে পারবেন, তার একটি নির্দিষ্ট কোটা রয়েছে।
এ ধরনের বৈষম্যের কারণে শিক্ষক সমাজ হতাশ। একই কারিকুলাম তারা পাঠদান করেন, তবু বেতন ও সুবিধায় এত পার্থক্য কেন থাকবে? বর্তমানে শিক্ষকরা ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া ও ৭৫ শতাংশ উৎসবভাতার দাবিতে আন্দোলন করছেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন-পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে আন্দোলন করা ঠিক নয়। তিনি আরও বলেছেন, “আমি একজন শিক্ষক, তাই শিক্ষকদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখছি।” কথাটি যথার্থ। সমাজে শিক্ষকরা বিবেকবান হওয়া উচিত।
তবে প্রশ্ন হলো-শিক্ষা উপদেষ্টা নিজে শিক্ষক হিসেবে কত শতাংশ বাড়িভাড়া পেতেন? কত শতাংশ উৎসবভাতা পেতেন? তিনি প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাননি? এসব প্রশ্ন কি তিনি নিজের বিবেকের কাছে করছেন?
শিক্ষকেরা যদি বিবেকের তাড়নায় শিক্ষার্থীদের স্বার্থে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন, তাহলে উপদেষ্টারও উচিত নিজের বিবেক দিয়ে শিক্ষকদের সমস্যার সমাধান করা।
অনেকে বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আবার বাড়িভাড়া কিসের! তাদের জানানো প্রয়োজন-সম্প্রতি সরকারের গঠিত নিবন্ধন কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তিনজন মাধ্যমিক শিক্ষককে রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার প্রেমতলীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনজনই নারী। সেখানে ন্যূনতম বাড়িভাড়া চার হাজার টাকার নিচে নয়, অথচ সরকার তাদের মাত্র ১০০ টাকা বাড়িভাড়া বাবদ দিচ্ছে! তারা সেখানে কীভাবে থাকবে?
এই প্রশ্ন কি কারও বিবেককে নাড়া দেয় না? শিক্ষকরা সব সময় নানা বৈষম্যের শিকার-এটা দূর করা প্রয়োজন।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যগুলো আশু নিরসনের জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আগামী প্রজন্মকে যথাযথভাবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার পূর্ণ জাতীয়করণ এখন সময়ের দাবি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশ হাজার বছর পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ ছিল। উপনিবেশিক শাসনামলে এ দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভূমিকায় ছিলেন এ দেশের ছাত্র ও শিক্ষকরা। বাংলাদেশের স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনটিতে ঘটেছিল গণঅভ্যুত্থান, যা ছিল বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মাইলফলক।
মুক্তিকামী নিপীড়িত জনগণের পক্ষে জাতির মুক্তিসনদখ্যাত ছয় দফা এবং পরবর্তীতে ছাত্রসমাজের দেওয়া ১১ দফা কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়েছিল এই গণঅভ্যুত্থান। এই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন, সেই নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ প্রায় ৫৪ বছর। এই চুয়ান্ন বছরে উপনিবেশিক আমলের বিরাজমান শিক্ষা ব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল ভূমিকায় ছিলেন ছাত্র, শিক্ষক, এবং শিক্ষা-বঞ্চিত দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকেরা। সবারই লক্ষ্য ছিল-স্বাধীন বাংলাদেশ হবে একটি বৈষম্যহীন দেশ।
কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্যগুলো নিরসনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ১৯৭২ সালে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা ছিল না-যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
তাহলে কি এ দেশের মানুষ সরকারি ব্যবস্থায় শুধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই পড়বে? তারা কি শুধু পিয়ন বা চৌকিদারের কাজ করবে? উপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা সীমিত পরিসরে বাঙালিদের পড়াশোনার সুযোগ দিয়েছিল; তাদের উদ্দেশ্য ছিল-এই জনপদের মানুষ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কেবল দপ্তরী ও নিম্নস্তরের কাজ করবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীন বাংলাদেশেও শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকাংশে এখনো সেই ব্রিটিশ কাঠামোয় রয়ে গেছে।
একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ২৬,১০৪টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাসিক বেতন আদেশ (এমপিও) সুবিধা ভোগ করছে। এই সংখ্যা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা, কারিগরি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় ২ কোটি ৭৪ লাখ ২৯ হাজার ৩১৭ জন (কওমি মাদ্রাসা ও কিছু মেডিকেল কলেজ বাদে)।
দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় অংশই পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারিভাবে। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশের ২১ হাজার ৮৬টি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৯ হাজার ৭৫৭টি বেসরকারি, যা মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বাকিগুলোর মধ্যে ৬৯১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৬৩৮টি আপগ্রেডেড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
তবে গত ১২ মার্চ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব আপগ্রেডেড সরকারি বিদ্যালয়ের নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখার আদেশ জারি করেছে।
ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক স্তরে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৯৪ লাখ ৫ হাজার ৭৮৫। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে ২৯ লাখ ২৬ হাজার ৮৪৯ জন এবং গ্রামাঞ্চলে ৬৪ লাখ ৭৮ হাজার ৯৩৬ জন। গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার্থী বেশি হলেও সরকারি প্রতিষ্ঠান বেশি শহরাঞ্চলে। ৬৯১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৫২টি গ্রামাঞ্চলে এবং ৬৩৯টি শহরাঞ্চলে অবস্থিত।
৯৪ লাখ ৫ হাজার ৭৮৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ছেন ৮৭ লাখ ৪১ হাজার ৪৮০ জন, সরকারি মাধ্যমিকে পড়ছেন ৫ লাখ ৭১ হাজার ৬৮১ জন এবং আপগ্রেডেড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছেন ৯২ হাজার ৬২৪ জন। সে হিসেবে ৯২ দশমিক ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ছেন।
একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে বর্তমানে ২২ হাজার ১৭৪টি এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৬০৮ জন। এই সংখ্যাটি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং মাদ্রাসা-এই তিন স্তরের প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে। আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে মোট ৩৯,০৯২টি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা অন্তর্ভুক্ত।
মূল বিষয়টির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাদান করছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। এই বিপুল শিক্ষার্থীসমাজের শিক্ষা কার্যক্রম যারা সম্পন্ন করছেন, রাষ্ট্র তাদের প্রতি কতটা দায়িত্ব পালন করছে-তা জানা দরকার।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও শিক্ষণ পদ্ধতির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগ্যতার মান একই ধরনের; কিন্তু আর্থিক সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসরকারি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য স্পষ্ট।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের একটি নির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে। সেই কাঠামো অনুসারে তারা বাড়িভাড়া, চিকিৎসাভাতা, ও অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। কিন্তু বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের জন্য বেতন কাঠামো থাকলেও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেই।
একটি এমপিওভুক্ত কলেজ বা বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিতে হলে প্রথমে প্রার্থীকে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত সংস্থার নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। তারপর সেই যোগ্যতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিদ্যালয়ে নিয়োগের সুযোগ পান। একইভাবে সরকারি কলেজ বা বিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে হলে সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।
নিয়োগের প্রক্রিয়ায় দেখা যায়-উভয়ের পদ্ধতি প্রায় একই রকম। কিন্তু এমপিওভুক্ত ও সরকারি শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে বেতন বৈষম্যসহ নানা ধরনের পার্থক্য।
একজন বেসরকারি এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষক প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর সর্বোচ্চ পদোন্নতি পান সহকারী অধ্যাপক পর্যন্ত-তাও ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। কারণ প্রতিটি বেসরকারি এমপিওভুক্ত কলেজে কতজন সরকারি অধ্যাপক হতে পারবেন, তার একটি নির্দিষ্ট কোটা রয়েছে।
এ ধরনের বৈষম্যের কারণে শিক্ষক সমাজ হতাশ। একই কারিকুলাম তারা পাঠদান করেন, তবু বেতন ও সুবিধায় এত পার্থক্য কেন থাকবে? বর্তমানে শিক্ষকরা ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া ও ৭৫ শতাংশ উৎসবভাতার দাবিতে আন্দোলন করছেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন-পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে আন্দোলন করা ঠিক নয়। তিনি আরও বলেছেন, “আমি একজন শিক্ষক, তাই শিক্ষকদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখছি।” কথাটি যথার্থ। সমাজে শিক্ষকরা বিবেকবান হওয়া উচিত।
তবে প্রশ্ন হলো-শিক্ষা উপদেষ্টা নিজে শিক্ষক হিসেবে কত শতাংশ বাড়িভাড়া পেতেন? কত শতাংশ উৎসবভাতা পেতেন? তিনি প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাননি? এসব প্রশ্ন কি তিনি নিজের বিবেকের কাছে করছেন?
শিক্ষকেরা যদি বিবেকের তাড়নায় শিক্ষার্থীদের স্বার্থে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন, তাহলে উপদেষ্টারও উচিত নিজের বিবেক দিয়ে শিক্ষকদের সমস্যার সমাধান করা।
অনেকে বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আবার বাড়িভাড়া কিসের! তাদের জানানো প্রয়োজন-সম্প্রতি সরকারের গঠিত নিবন্ধন কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তিনজন মাধ্যমিক শিক্ষককে রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার প্রেমতলীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনজনই নারী। সেখানে ন্যূনতম বাড়িভাড়া চার হাজার টাকার নিচে নয়, অথচ সরকার তাদের মাত্র ১০০ টাকা বাড়িভাড়া বাবদ দিচ্ছে! তারা সেখানে কীভাবে থাকবে?
এই প্রশ্ন কি কারও বিবেককে নাড়া দেয় না? শিক্ষকরা সব সময় নানা বৈষম্যের শিকার-এটা দূর করা প্রয়োজন।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যগুলো আশু নিরসনের জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আগামী প্রজন্মকে যথাযথভাবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার পূর্ণ জাতীয়করণ এখন সময়ের দাবি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]