শেখর ভট্টাচার্য

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মানসিক পরিশুদ্ধতা, উন্নত রুচি ও সংস্কৃতি বারবার প্রত্যাশা করেছে মানুষ
সুবর্ণভূমির কোমল পলির মতো বাঙালির মনোভূমি। আমাদের অর্থনীতি চিরকাল কৃষিভিত্তিক। জীবন ও জীবিকা একসময় ছিলো নদীকেন্দ্রিক। গভীর রাতে কিংবা অলস দুপুরে উদাত্ত কণ্ঠে বাউল-ভাটিয়ালি গানের সুর আমাদের জনজীবনকে মুখরিত করে তুলতো। যাত্রাপালার দর্শক হয়ে নিপীড়িতের উপর নির্যাতন দেখে বাঙালি অঝোর ধারায় কাঁদতো একসময়। যাত্রার বিবেক বাঙালির বিবেক হয়ে নৈতিক কথা বলতো। শেক্সপিয়রের কিংবা এলিজাবেথান যুগের নাটকে “কোরাস” যে ভূমিকা পালন করতো আমাদের যাত্রাগানের বিবেকও সে ভূমিকা পালন করে গেছে। আমাদের অকৃত্রিম সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য শাখা ছিলো যাত্রাপালা।
এক সময় “পঞ্চায়েত” গ্রামের সুখদুঃখের সকল অনুষ্ঠান, বিচার ব্যবস্থা, সমাজের কল্যাণমূলক কাজের দায়িত্ব স্বতঃপ্রণোদিত গ্রহণ করতো। আধুনিক উন্নয়ন বিজ্ঞান যাকে বলে জননেতৃত্বে সামাজিক কর্মকাণ্ড। বাঙালির ধৈর্য, স্থৈর্য সীমাহীন। পরার্থে জীবন দানের অগণন নজির আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে। আবার এই ভীতু , কোমল বাঙালি বুক পেতে দাঁড়িয়ে যায় মাতৃভূমির মুক্তির যুদ্ধে। আমেরিকা থেকে সপ্তম নৌবহর আসার খবর বিচলিত করে না লাঠি হাতে প্রতিরোধ করা বাঙালিকে।
কী হলো কোমল স্বভাবের বাঙালির! হঠাৎ করে এতো অস্থিরতা, চিত্তে এতো চাঞ্চল্য। বাঙালির অনুভুতিও কী কিছুটা ভোঁতা হয়ে গেলো! মিরপুরের গার্মেন্টস ও কেমিকেল কারখানার অগ্নিকাণ্ডে তরতাজা ষোলটা মানুষ প্রাণ হারালো এ’নিয়ে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক বেদনাবোধ লক্ষ্য করা গেলো না। সামজিক মাধ্যমে এ’নিয়ে উল্লেখ করার মতো আবেগ প্রকাশিত হতেও দেখা গেলো না।
সামাজিক অস্থিরতা, মানবিকতাহীনতা ও অসহিষ্ণুতা যেন দিনদিন বেড়েই চলছে। পারিবারিক সংঘাত, সংঘর্ষ, গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ, স্থানীয় আধিপত্য, রাস্তাঘাটে মারামারি ইত্যাদি নানা ঘটনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। মানুষ এমনিতেই নানা কারণে বিষাদগ্রস্ত। এসব ঘটনা মানুষকে আরও বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে। সামাজিক এসব অনাচার ও বিশৃঙ্খলার ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। এ’কারণেই বোধ হয় সুযোগ পেলেই মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশও ঘটাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণাবাচক মন্তব্য, রাজনৈতিক মতভেদে শত্রুতা, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ে বৈষম্য–এসবই প্রশ্ন তোলে, আমরা কি জাতিগতভাবে অমানবিক ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?
সহিষ্ণুতা আসলে কী? সহিষ্ণুতা কি শুধু নৈতিক গুণ? সভ্য, সম-অধিকারের সমাজে সহিষ্ণুতা হলো টিকে থাকার সবচেয়ে বড় শর্ত। সমতা, সমদৃষ্টির, বহুত্ববাদী সমাজ গড়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো সহিষ্ণুতা। সহিষ্ণুতার কী কোন সূচক আছে জাতিসংঘে, আমার জানা নেই। সূচক থেকে থাকলে আমাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। সাম্প্রতিককালে আমাদের যে সহিষ্ণুতার মান, সেই মান নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামলে নীচের সারিতে আমাদের অবস্থান ঠেকায় কে। ব্যক্তি, পরিবার কিংবা সমাজকে বিবেচনা করলে আমাদের অবস্থা তপ্ত কড়াইয়ের মতো। পানি কিংবা তৈল যাকিছু ঢালা হোক না কেনো আমরা ধুম্রসহ জ্বলে উঠবো। সেই জ্বলা এতোই তীব্র কখনো কখনো বড় অট্টালিকাও জ্বালিয়ে দিতে পারি আমরা নির্ভয়ে। জাতি হিসেবেও আমরা অগ্নিশর্মা। সহিষ্ণুতার অভাবে যে অগ্নি সংযোগ ঘটে, সেটিই হলো প্রকৃত মবদণ্ড বা মব জাস্টিস।
জাতিগতভাবে আমরা যে অসহিষ্ণু ছিলাম না তা’ ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপকে বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যাবে। আমাদের স্বদেশপ্রেম, স্বাধিকারের দাবির জন্য আক্রমণ আসলে আমরা প্রতিহত করেছি। এসব ক্ষেত্রে আমরা সতত আপসহীন ছিলাম। আমাদের মানসজগত মূলত লালন, হাছন, রাধারমণ, আরকুম শাহসহ সকল মরমী কবিদের চেতনায় সমৃদ্ধ। বৈচিত্র?্য, বহুত্ববাদের দর্শন আমরা প্রকৃতিগতভাবে ধারণ করি। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের আগমনের পূর্বে বাঙালি মানসে সামান্য পরিমাণও সাম্প্রদায়কতার প্রকাশ দেখা যায়নি। সমাজকে বিভাজিত করার যে কূটকৌশল গ্রহণ করেছিলো ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকের প্রভাবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা অব্যবহিত পূর্বে এবং পাকিস্তানত্তোর সময়ে কিছুটা সাম্প্রদায়িক মনোমালিন্য, দাঙ্গার নজির সৃষ্টি হয়েছিলো। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন উদার, বহুত্বভাদ, প্রগতিবাদী এক সমাজের ধারণা সফলভাবে বাঙালি হৃদয়ে প্রোথিত করতে সমর্থ হয়। বায়ান্নের আন্দোলনের মালিকানা ছিলো বাংলাদেশের জনগণের। তাই এই মহান আন্দলনের স্বরূপ আন্বেষণ করলে বাঙালি মননের প্রকৃত রূপ দর্শন করা যায়।
ফিরে আসি সহিষ্ণুতার আলোচনায়। সহিষ্ণুতার প্রতিফলন দেখা যায় সবচেয়ে বেশি শাসক এবং রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম, আচার আচারণে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, চর্চার ভেতরে মুক্তোর মতো ঝিনুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকে সহিষ্ণুতা। কিছুটা কাব্যিক শুনাতে পারে, তবে সহিষ্ণুতার ভেতরেই সমতা, সমদৃষ্টি, সম-অধিকারের বীজ লুক্কায়িত থাকে। উদার, সহিষ্ণু একটি রাজনৈতিক দল সব সময় সমাজের প্রান্তিক, বিপন্ন, অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য লড়াই করে যায় সেটি নির্ভর করে দলটির দর্শনে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমরা যেমন সমাজের প্রতিটি সদস্যের দিকে “সমদৃষ্টি” দিতে সক্ষম হইনি একইভাবে রাজনৈতিক দলের ভেতরে নিবেদিত, নেতৃত্বগুণে সমৃদ্ধ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতি দৃষ্টির নীতিকেও অনুসরণ করতে পারিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে যেমন পদ-পদবী ক্ষমতার চর্চা হয়েছে, একইভাবে শাসক দলগুলোর ভেতরে ক্ষমতার লড়াই বহমান ছিলো। ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতা শাসকদলের ভেতরে এমনভাবে রোপন করা হয়েছে যে, বীজ থেকে ক্রমান্বয়য়ে ক্ষমতার লড়াই আকারে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা অর্জনের লড়াই যখন প্রবল হয়ে যায় তখন সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে নির্বাসিত হতে থাকে।
আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, দেখতে পাবো- সহিষ্ণুতা রাতারাতি জন্মায়নি, বরং এটি দীর্ঘ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ফল। সমাজের আচরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের আচরণকে প্রভাবিত করে। ক্ষমতা যখন রাজনৈতিক দলের একমাত্র আরাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন সমাজেও এর প্রবল চর্চা হতে থাকে। সমাজের আচরণ এবং রাজনৈতিক দলের আচরণকে বিভক্ত করা কঠিন। সমাজের আচরণ রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমাজের চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। মূলত রাজনৈতিক দলের আচরণের সংস্কৃতি গণমুখী , কল্যাণকামী, সমদৃষ্টি সম্পন্ন না হলে সমাজের সকল স্তরে অস্থিরতা এবং বিভাজন চলতে থাকে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মানসিক পরিশুদ্ধতা, উন্নত রুচি ও সংস্কৃতি বারবার প্রত্যাশা করেছে মানুষ। প্রত্যাশা করেছে, দেশ ও জাতি গঠনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে এদের মাধ্যমে বড় ধরনের জাগরণ ঘটবে। দেশের উন্নয়নসহ হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা শুধুই হতাশায় রূপ নিচ্ছে। দেশটা কিছুতেই সামনের দিকে এগোতে পারছে না। জনগণ শুধু অসহায়ের মতো লক্ষ্য করছে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ একে অন্যের প্রতি আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ লিপ্ত হয়ে রয়েছে। আক্রোশ আক্রোশ আক্রমণের মধ্যে দলীয় ব্যর্থতার চেয়ে ব্যক্তি বিদ্বেষ, ব্যক্তি কুৎসা অতিমাত্রায় দৃশ্যমান বলে মনে হয়। পারস্পরিক এই যে দ্বন্দ এ’দ্বন্দের পেছনে প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া মানুষকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার যে গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা তা’ কাজ না করে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার প্রবল কামনাই প্রধান হয়ে ওঠে।
সমাজ, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের সহিষ্ণুতা একই সূত্রে গাঁথা। সামজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয় সহিষ্ণুতাকে প্রভাবিত করে। আবার রাষ্ট্রীয় সহিষ্ণুতা সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার চাহিদাকে অনুসরন করে। স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থা আবার কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করে না। একমাত্র নিরবিচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেই যেমন সকল মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি প্রদানের সংস্কৃতি জাগ্রত করা যায় একই সাথে মানুষের সহিষ্ণুতার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে, সহিষ্ণুতা মূলত একটি নৈতিক গুণ যা সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে কোন ভাবেই আরোপ করা যায় না। ক্ষমতার রাজনীতি থেকে যদি সকল মানুষের প্রতি মমতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায় তাহলে ধীরে ধীরে আমরা সহিষ্ণুতার মতো নৈতিক গুণ অর্জন করতে সক্ষম হবো। সহিষ্ণু সমাজ গণতন্ত্রকে খুব দ্রুত সংস্কৃতির অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। আর প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় জন অংশগ্রহণ স্থিতিশীল সমাজ, স্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম বলে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন। আমরা কি সে পথে এগোতে পারবো? এই পারা না-পারার উপর জাতি হিসেবে টিকে থাকার উপাদানগুলো নিহিত আছে বলে মনে করি।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
শেখর ভট্টাচার্য

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মানসিক পরিশুদ্ধতা, উন্নত রুচি ও সংস্কৃতি বারবার প্রত্যাশা করেছে মানুষ
শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫
সুবর্ণভূমির কোমল পলির মতো বাঙালির মনোভূমি। আমাদের অর্থনীতি চিরকাল কৃষিভিত্তিক। জীবন ও জীবিকা একসময় ছিলো নদীকেন্দ্রিক। গভীর রাতে কিংবা অলস দুপুরে উদাত্ত কণ্ঠে বাউল-ভাটিয়ালি গানের সুর আমাদের জনজীবনকে মুখরিত করে তুলতো। যাত্রাপালার দর্শক হয়ে নিপীড়িতের উপর নির্যাতন দেখে বাঙালি অঝোর ধারায় কাঁদতো একসময়। যাত্রার বিবেক বাঙালির বিবেক হয়ে নৈতিক কথা বলতো। শেক্সপিয়রের কিংবা এলিজাবেথান যুগের নাটকে “কোরাস” যে ভূমিকা পালন করতো আমাদের যাত্রাগানের বিবেকও সে ভূমিকা পালন করে গেছে। আমাদের অকৃত্রিম সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য শাখা ছিলো যাত্রাপালা।
এক সময় “পঞ্চায়েত” গ্রামের সুখদুঃখের সকল অনুষ্ঠান, বিচার ব্যবস্থা, সমাজের কল্যাণমূলক কাজের দায়িত্ব স্বতঃপ্রণোদিত গ্রহণ করতো। আধুনিক উন্নয়ন বিজ্ঞান যাকে বলে জননেতৃত্বে সামাজিক কর্মকাণ্ড। বাঙালির ধৈর্য, স্থৈর্য সীমাহীন। পরার্থে জীবন দানের অগণন নজির আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে। আবার এই ভীতু , কোমল বাঙালি বুক পেতে দাঁড়িয়ে যায় মাতৃভূমির মুক্তির যুদ্ধে। আমেরিকা থেকে সপ্তম নৌবহর আসার খবর বিচলিত করে না লাঠি হাতে প্রতিরোধ করা বাঙালিকে।
কী হলো কোমল স্বভাবের বাঙালির! হঠাৎ করে এতো অস্থিরতা, চিত্তে এতো চাঞ্চল্য। বাঙালির অনুভুতিও কী কিছুটা ভোঁতা হয়ে গেলো! মিরপুরের গার্মেন্টস ও কেমিকেল কারখানার অগ্নিকাণ্ডে তরতাজা ষোলটা মানুষ প্রাণ হারালো এ’নিয়ে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক বেদনাবোধ লক্ষ্য করা গেলো না। সামজিক মাধ্যমে এ’নিয়ে উল্লেখ করার মতো আবেগ প্রকাশিত হতেও দেখা গেলো না।
সামাজিক অস্থিরতা, মানবিকতাহীনতা ও অসহিষ্ণুতা যেন দিনদিন বেড়েই চলছে। পারিবারিক সংঘাত, সংঘর্ষ, গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ, স্থানীয় আধিপত্য, রাস্তাঘাটে মারামারি ইত্যাদি নানা ঘটনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। মানুষ এমনিতেই নানা কারণে বিষাদগ্রস্ত। এসব ঘটনা মানুষকে আরও বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে। সামাজিক এসব অনাচার ও বিশৃঙ্খলার ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। এ’কারণেই বোধ হয় সুযোগ পেলেই মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশও ঘটাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণাবাচক মন্তব্য, রাজনৈতিক মতভেদে শত্রুতা, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ে বৈষম্য–এসবই প্রশ্ন তোলে, আমরা কি জাতিগতভাবে অমানবিক ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?
সহিষ্ণুতা আসলে কী? সহিষ্ণুতা কি শুধু নৈতিক গুণ? সভ্য, সম-অধিকারের সমাজে সহিষ্ণুতা হলো টিকে থাকার সবচেয়ে বড় শর্ত। সমতা, সমদৃষ্টির, বহুত্ববাদী সমাজ গড়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো সহিষ্ণুতা। সহিষ্ণুতার কী কোন সূচক আছে জাতিসংঘে, আমার জানা নেই। সূচক থেকে থাকলে আমাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। সাম্প্রতিককালে আমাদের যে সহিষ্ণুতার মান, সেই মান নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামলে নীচের সারিতে আমাদের অবস্থান ঠেকায় কে। ব্যক্তি, পরিবার কিংবা সমাজকে বিবেচনা করলে আমাদের অবস্থা তপ্ত কড়াইয়ের মতো। পানি কিংবা তৈল যাকিছু ঢালা হোক না কেনো আমরা ধুম্রসহ জ্বলে উঠবো। সেই জ্বলা এতোই তীব্র কখনো কখনো বড় অট্টালিকাও জ্বালিয়ে দিতে পারি আমরা নির্ভয়ে। জাতি হিসেবেও আমরা অগ্নিশর্মা। সহিষ্ণুতার অভাবে যে অগ্নি সংযোগ ঘটে, সেটিই হলো প্রকৃত মবদণ্ড বা মব জাস্টিস।
জাতিগতভাবে আমরা যে অসহিষ্ণু ছিলাম না তা’ ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপকে বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যাবে। আমাদের স্বদেশপ্রেম, স্বাধিকারের দাবির জন্য আক্রমণ আসলে আমরা প্রতিহত করেছি। এসব ক্ষেত্রে আমরা সতত আপসহীন ছিলাম। আমাদের মানসজগত মূলত লালন, হাছন, রাধারমণ, আরকুম শাহসহ সকল মরমী কবিদের চেতনায় সমৃদ্ধ। বৈচিত্র?্য, বহুত্ববাদের দর্শন আমরা প্রকৃতিগতভাবে ধারণ করি। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের আগমনের পূর্বে বাঙালি মানসে সামান্য পরিমাণও সাম্প্রদায়কতার প্রকাশ দেখা যায়নি। সমাজকে বিভাজিত করার যে কূটকৌশল গ্রহণ করেছিলো ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকের প্রভাবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা অব্যবহিত পূর্বে এবং পাকিস্তানত্তোর সময়ে কিছুটা সাম্প্রদায়িক মনোমালিন্য, দাঙ্গার নজির সৃষ্টি হয়েছিলো। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন উদার, বহুত্বভাদ, প্রগতিবাদী এক সমাজের ধারণা সফলভাবে বাঙালি হৃদয়ে প্রোথিত করতে সমর্থ হয়। বায়ান্নের আন্দোলনের মালিকানা ছিলো বাংলাদেশের জনগণের। তাই এই মহান আন্দলনের স্বরূপ আন্বেষণ করলে বাঙালি মননের প্রকৃত রূপ দর্শন করা যায়।
ফিরে আসি সহিষ্ণুতার আলোচনায়। সহিষ্ণুতার প্রতিফলন দেখা যায় সবচেয়ে বেশি শাসক এবং রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম, আচার আচারণে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, চর্চার ভেতরে মুক্তোর মতো ঝিনুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকে সহিষ্ণুতা। কিছুটা কাব্যিক শুনাতে পারে, তবে সহিষ্ণুতার ভেতরেই সমতা, সমদৃষ্টি, সম-অধিকারের বীজ লুক্কায়িত থাকে। উদার, সহিষ্ণু একটি রাজনৈতিক দল সব সময় সমাজের প্রান্তিক, বিপন্ন, অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য লড়াই করে যায় সেটি নির্ভর করে দলটির দর্শনে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমরা যেমন সমাজের প্রতিটি সদস্যের দিকে “সমদৃষ্টি” দিতে সক্ষম হইনি একইভাবে রাজনৈতিক দলের ভেতরে নিবেদিত, নেতৃত্বগুণে সমৃদ্ধ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতি দৃষ্টির নীতিকেও অনুসরণ করতে পারিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে যেমন পদ-পদবী ক্ষমতার চর্চা হয়েছে, একইভাবে শাসক দলগুলোর ভেতরে ক্ষমতার লড়াই বহমান ছিলো। ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতা শাসকদলের ভেতরে এমনভাবে রোপন করা হয়েছে যে, বীজ থেকে ক্রমান্বয়য়ে ক্ষমতার লড়াই আকারে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা অর্জনের লড়াই যখন প্রবল হয়ে যায় তখন সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে নির্বাসিত হতে থাকে।
আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, দেখতে পাবো- সহিষ্ণুতা রাতারাতি জন্মায়নি, বরং এটি দীর্ঘ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ফল। সমাজের আচরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের আচরণকে প্রভাবিত করে। ক্ষমতা যখন রাজনৈতিক দলের একমাত্র আরাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন সমাজেও এর প্রবল চর্চা হতে থাকে। সমাজের আচরণ এবং রাজনৈতিক দলের আচরণকে বিভক্ত করা কঠিন। সমাজের আচরণ রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমাজের চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। মূলত রাজনৈতিক দলের আচরণের সংস্কৃতি গণমুখী , কল্যাণকামী, সমদৃষ্টি সম্পন্ন না হলে সমাজের সকল স্তরে অস্থিরতা এবং বিভাজন চলতে থাকে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মানসিক পরিশুদ্ধতা, উন্নত রুচি ও সংস্কৃতি বারবার প্রত্যাশা করেছে মানুষ। প্রত্যাশা করেছে, দেশ ও জাতি গঠনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে এদের মাধ্যমে বড় ধরনের জাগরণ ঘটবে। দেশের উন্নয়নসহ হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা শুধুই হতাশায় রূপ নিচ্ছে। দেশটা কিছুতেই সামনের দিকে এগোতে পারছে না। জনগণ শুধু অসহায়ের মতো লক্ষ্য করছে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ একে অন্যের প্রতি আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ লিপ্ত হয়ে রয়েছে। আক্রোশ আক্রোশ আক্রমণের মধ্যে দলীয় ব্যর্থতার চেয়ে ব্যক্তি বিদ্বেষ, ব্যক্তি কুৎসা অতিমাত্রায় দৃশ্যমান বলে মনে হয়। পারস্পরিক এই যে দ্বন্দ এ’দ্বন্দের পেছনে প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া মানুষকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার যে গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা তা’ কাজ না করে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার প্রবল কামনাই প্রধান হয়ে ওঠে।
সমাজ, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের সহিষ্ণুতা একই সূত্রে গাঁথা। সামজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয় সহিষ্ণুতাকে প্রভাবিত করে। আবার রাষ্ট্রীয় সহিষ্ণুতা সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার চাহিদাকে অনুসরন করে। স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থা আবার কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করে না। একমাত্র নিরবিচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেই যেমন সকল মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি প্রদানের সংস্কৃতি জাগ্রত করা যায় একই সাথে মানুষের সহিষ্ণুতার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে, সহিষ্ণুতা মূলত একটি নৈতিক গুণ যা সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে কোন ভাবেই আরোপ করা যায় না। ক্ষমতার রাজনীতি থেকে যদি সকল মানুষের প্রতি মমতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায় তাহলে ধীরে ধীরে আমরা সহিষ্ণুতার মতো নৈতিক গুণ অর্জন করতে সক্ষম হবো। সহিষ্ণু সমাজ গণতন্ত্রকে খুব দ্রুত সংস্কৃতির অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। আর প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় জন অংশগ্রহণ স্থিতিশীল সমাজ, স্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম বলে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন। আমরা কি সে পথে এগোতে পারবো? এই পারা না-পারার উপর জাতি হিসেবে টিকে থাকার উপাদানগুলো নিহিত আছে বলে মনে করি।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]