alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

প্রতিটি জাতির আত্মার গভীরে লুকিয়ে থাকে তার সংস্কৃতি। জাতির চরিত্র, মূল্যবোধ, চিন্তা ও জীবনধারা সেই সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়। সংস্কৃতি শুধু সংগীত, সাহিত্য বা উৎসব নয়-এটি একটি জাতির জীবনবোধ, নৈতিকতা, মানবিকতা ও সমাজচেতনার সমষ্টি। সেই অর্থে বাংলা জনপদের সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রাচীনতম ও সমৃদ্ধতম সংস্কৃতির একটি। এর মূল উপাদান হলো মানবপ্রেম, উদারতা, বৈচিত্র্য ও সহাবস্থান।

সংস্কৃতির মূল ধারা কখনো একরৈখিক নয়। এটি গড়ে ওঠে হাজার বছরের মানবসম্পর্ক, বিশ্বাস, সহাবস্থান ও বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। বাঙালি সংস্কৃতি গঠিত হয়েছে দ্রাবিড়, আর্য, মুসলমান, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার মিশ্রণে-যেখানে প্রত্যেকটি প্রভাব একে করেছে আরও মানবিক, আরও বৈচিত্র্যময়। তাই বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপ হলো মিলনের, বিভেদের নয়

বাঙালির সংস্কৃতির মূলে রয়েছে উৎসবপ্রিয়তা। “বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ”-এই প্রবাদ বাক্য কেবল কথার কথা নয়; এটি এক গভীর সত্য। পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে নবান্ন, দুর্গাপূজা, ঈদ, দোলযাত্রা, চৈত্রসংক্রান্তি, শরৎ উৎসব কিংবা ভাইফোঁটা-সবই বাঙালির জীবনকে রঙিন করে তোলে। ধর্মীয় ভেদাভেদ পেরিয়ে এই উৎসবগুলো আমাদের মধ্যে সামাজিক ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আনন্দ ভাগাভাগির চেতনাকে জাগ্রত করে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনাপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে, এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবধারায় নানাবিধ বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে-বাঙালি কি তার সংস্কৃতির মূলধারা হারাতে বসেছে?

সম্প্রতি ঢাবির চারুকলা অনুষদ বকুলতলায় সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর “শরৎ উৎসব” আয়োজনের অনুমতি বাতিলের ঘটনা আমাদের সংস্কৃতিচর্চার সংকটকে স্পষ্ট করে তুলেছে। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে ঢাবির বকুলতলায় এই উৎসবটি আয়োজন হয়ে আসছিল। সব নিয়ম মেনে, ভাড়া পরিশোধ করে, লিখিত অনুমতি নিয়েও যখন অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন সেটি কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়-এটি আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার উপর একটি ছায়া ফেলেছে। পরবর্তীতে গেণ্ডারিয়ায় অনুষ্ঠান স্থানান্তরের পরও পুলিশি বাধা প্রমাণ করে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এখন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী মূলত নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সংস্কৃতির সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। গণমানুষের অধিকার, সাম্য, স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের ধারক এই সংগঠনটি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও গণআন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক শক্তি। তাই তাদের ওপর বাধা পড়া মানে কেবল একটি সংগঠনের ওপর নয়-এটি বাঙালি সংস্কৃতির আত্মার ওপর আঘাত।

সংস্কৃতির মূল ধারা কখনো একরৈখিক নয়। এটি গড়ে ওঠে হাজার বছরের মানবসম্পর্ক, বিশ্বাস, সহাবস্থান ও বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। বাঙালি সংস্কৃতি গঠিত হয়েছে দ্রাবিড়, আর্য, মুসলমান, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার মিশ্রণে-যেখানে প্রত্যেকটি প্রভাব একে করেছে আরও মানবিক, আরও বৈচিত্র্যযময়। তাই বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপ হলো মিলনের, বিভেদের নয়।

তবে আজ আমরা এমন এক সময় পার করছি, যখন সংস্কৃতিকে সংকুচিত করে তোলা হচ্ছে নির্দিষ্ট ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ছাঁচে। সংস্কৃতি হয়ে উঠছে ক্ষমতার প্রদর্শনীর উপকরণ, মুক্তচর্চা হয়ে পড়ছে সন্দেহের বিষয়।

সম্প্রতি বাউল শিল্পীদের ওপর নিপীড়নের ঘটনাগুলো এ বাস্তবতাকে আরও প্রকট করেছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ময়মনসিংহের তারাকান্দায় একজন বয়স্ক বাউলের জটা চুল জোর করে কেটে দেয় তিনজন ব্যক্তি। তাদের পোশাক ও আচরণে ধর্মীয় কঠোরতার ছাপ স্পষ্ট ছিল। বাউল হালিম উদ্দিন, যিনি আজও মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেননি, সেই ঘটনার পর সমাজ যেন নির্বিকার। অথচ বাউলরা আমাদের লোকসংস্কৃতির প্রাণ। তারা প্রেম, মানবতা, আল্লাহ ও মানুষের ঐক্যের বাণী প্রচার করেন। তাঁদের উপর আঘাত মানে মানবিক সংস্কৃতির উপর আঘাত।

একইভাবে নারীদের পোশাক, চলাফেরা কিংবা ব্যক্তিগত পছন্দকে কেন্দ্র করে সামাজিক নিপীড়ন বেড়েই চলেছে। সাংবাদিক ঝর্ণা রায় ও পর্বতারোহী শায়লা বিথীর উপর হামলার ঘটনাগুলো আমাদের সমাজে এক ধরনের অসহিষ্ণু মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়। এমনকি “ওড়না নেই কেন” বলে রাস্তায় নারীদের ঘিরে হেনস্তা করা হচ্ছে-যা কেবল অসভ্যতা নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতির শালীনতা ও সহনশীলতার পরিপন্থী।

বাঙালি সংস্কৃতির মূলে রয়েছে মুক্ত চিন্তা, উদার মানবিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধও ছিল মূলত এই সংস্কৃতি রক্ষার যুদ্ধ। পাকবাহিনী কেবল ভূখণ্ড দখল করতে আসেনি-তারা আঘাত করেছিল আমাদের ভাষা, গান, কবিতা ও সংস্কৃতির উপর। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বই নির্ভর করছে তার সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার উপর।

আজ যখন ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে, কিংবা বিদেশি সাংস্কৃতিক প্রভাবের ছদ্মবেশে বাঙালিত্বের চেতনা ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, তখন প্রয়োজন নতুন করে সাংস্কৃতিক জাগরণ। তরুণ প্রজন্মকে জানতে হবে বাউল লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীন, সত্যেন সেনদের কথা-যারা মানবতার গান গেয়েছেন, বিভেদের নয়।

আমাদের গ্রামীণ মেলা, নবান্ন উৎসব, পিঠাপুলি, পালাগান, নাটক, চিত্রাঙ্কন, সংগীত-সবকিছুই আমাদের আত্মার অংশ। এগুলোকে সংরক্ষণ করা মানে কেবল ঐতিহ্য রক্ষা নয়, বরং সামাজিক সাম্য, মানবিকতা ও মুক্ত চিন্তার সংরক্ষণ।

বাংলা সংস্কৃতি আজ এক সঙ্কটময় সময় পার করছে। একদিকে ধর্মীয় উগ্রতা, অন্যদিকে বাণিজ্যিক সংস্কৃতির আগ্রাসন-এই দুই প্রান্তের টানাপোড়েনে মাঝখানে পড়ে যাচ্ছে মূল ধারার বাঙালিয়ানা। টেলিভিশন থেকে সোশ্যাল মিডিয়া পর্যন্ত সবখানেই মৌলিক সাংস্কৃতিক ভাবনা এখন ক্রমেই উপেক্ষিত হচ্ছে।

তবে আশা হারানো যাবে না। যতদিন বাঙালি মাটির গন্ধে, নবান্নের ঘ্রাণে, রবীন্দ্রসংগীতের সুরে, কিংবা পহেলা বৈশাখের রঙে মেতে উঠবে-ততদিন বাংলার সংস্কৃতি মরে যাবে না।

বাংলা জনপদের সংস্কৃতি রক্ষার জন্য এখন প্রয়োজন সর্বস্তরের ঐক্য। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, শিল্পী, সাহিত্যিক ও নাগরিক সমাজ-সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সংস্কৃতি কেবল বিনোদন নয়; এটি জাতির আত্মা। আত্মাকে যদি বিক্রি করি, তবে আমরা কেবল দেহধারী মানুষ হয়ে থাকব-মানবিক জাতি নয়।

বাংলার সংস্কৃতি আমাদের ইতিহাস, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের চেতনা। এই চেতনাকে রক্ষাই এখন সবচেয়ে বড় কর্তব্য।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: উন্নয়নকর্মী]

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

জমি কেনা দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে

রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে?

শতরঞ্জ কি খিলাড়ী

শিক্ষক থাকে রাজপথে, আর পুলিশ ছাড়ে থানা

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা : স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবিষ্যৎ কী?

ছবি

শ্লীলতা, অশ্লীলতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে ফিরে আসা কালো মেঘ

গীর্জায় হামলার নেপথ্যে কী?

সংঘের শতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য

দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

প্রতিটি জাতির আত্মার গভীরে লুকিয়ে থাকে তার সংস্কৃতি। জাতির চরিত্র, মূল্যবোধ, চিন্তা ও জীবনধারা সেই সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়। সংস্কৃতি শুধু সংগীত, সাহিত্য বা উৎসব নয়-এটি একটি জাতির জীবনবোধ, নৈতিকতা, মানবিকতা ও সমাজচেতনার সমষ্টি। সেই অর্থে বাংলা জনপদের সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রাচীনতম ও সমৃদ্ধতম সংস্কৃতির একটি। এর মূল উপাদান হলো মানবপ্রেম, উদারতা, বৈচিত্র্য ও সহাবস্থান।

সংস্কৃতির মূল ধারা কখনো একরৈখিক নয়। এটি গড়ে ওঠে হাজার বছরের মানবসম্পর্ক, বিশ্বাস, সহাবস্থান ও বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। বাঙালি সংস্কৃতি গঠিত হয়েছে দ্রাবিড়, আর্য, মুসলমান, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার মিশ্রণে-যেখানে প্রত্যেকটি প্রভাব একে করেছে আরও মানবিক, আরও বৈচিত্র্যময়। তাই বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপ হলো মিলনের, বিভেদের নয়

বাঙালির সংস্কৃতির মূলে রয়েছে উৎসবপ্রিয়তা। “বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ”-এই প্রবাদ বাক্য কেবল কথার কথা নয়; এটি এক গভীর সত্য। পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে নবান্ন, দুর্গাপূজা, ঈদ, দোলযাত্রা, চৈত্রসংক্রান্তি, শরৎ উৎসব কিংবা ভাইফোঁটা-সবই বাঙালির জীবনকে রঙিন করে তোলে। ধর্মীয় ভেদাভেদ পেরিয়ে এই উৎসবগুলো আমাদের মধ্যে সামাজিক ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আনন্দ ভাগাভাগির চেতনাকে জাগ্রত করে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনাপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে, এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবধারায় নানাবিধ বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে-বাঙালি কি তার সংস্কৃতির মূলধারা হারাতে বসেছে?

সম্প্রতি ঢাবির চারুকলা অনুষদ বকুলতলায় সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর “শরৎ উৎসব” আয়োজনের অনুমতি বাতিলের ঘটনা আমাদের সংস্কৃতিচর্চার সংকটকে স্পষ্ট করে তুলেছে। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে ঢাবির বকুলতলায় এই উৎসবটি আয়োজন হয়ে আসছিল। সব নিয়ম মেনে, ভাড়া পরিশোধ করে, লিখিত অনুমতি নিয়েও যখন অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন সেটি কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়-এটি আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার উপর একটি ছায়া ফেলেছে। পরবর্তীতে গেণ্ডারিয়ায় অনুষ্ঠান স্থানান্তরের পরও পুলিশি বাধা প্রমাণ করে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এখন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী মূলত নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সংস্কৃতির সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। গণমানুষের অধিকার, সাম্য, স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের ধারক এই সংগঠনটি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও গণআন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক শক্তি। তাই তাদের ওপর বাধা পড়া মানে কেবল একটি সংগঠনের ওপর নয়-এটি বাঙালি সংস্কৃতির আত্মার ওপর আঘাত।

সংস্কৃতির মূল ধারা কখনো একরৈখিক নয়। এটি গড়ে ওঠে হাজার বছরের মানবসম্পর্ক, বিশ্বাস, সহাবস্থান ও বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। বাঙালি সংস্কৃতি গঠিত হয়েছে দ্রাবিড়, আর্য, মুসলমান, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার মিশ্রণে-যেখানে প্রত্যেকটি প্রভাব একে করেছে আরও মানবিক, আরও বৈচিত্র্যযময়। তাই বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপ হলো মিলনের, বিভেদের নয়।

তবে আজ আমরা এমন এক সময় পার করছি, যখন সংস্কৃতিকে সংকুচিত করে তোলা হচ্ছে নির্দিষ্ট ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ছাঁচে। সংস্কৃতি হয়ে উঠছে ক্ষমতার প্রদর্শনীর উপকরণ, মুক্তচর্চা হয়ে পড়ছে সন্দেহের বিষয়।

সম্প্রতি বাউল শিল্পীদের ওপর নিপীড়নের ঘটনাগুলো এ বাস্তবতাকে আরও প্রকট করেছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ময়মনসিংহের তারাকান্দায় একজন বয়স্ক বাউলের জটা চুল জোর করে কেটে দেয় তিনজন ব্যক্তি। তাদের পোশাক ও আচরণে ধর্মীয় কঠোরতার ছাপ স্পষ্ট ছিল। বাউল হালিম উদ্দিন, যিনি আজও মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেননি, সেই ঘটনার পর সমাজ যেন নির্বিকার। অথচ বাউলরা আমাদের লোকসংস্কৃতির প্রাণ। তারা প্রেম, মানবতা, আল্লাহ ও মানুষের ঐক্যের বাণী প্রচার করেন। তাঁদের উপর আঘাত মানে মানবিক সংস্কৃতির উপর আঘাত।

একইভাবে নারীদের পোশাক, চলাফেরা কিংবা ব্যক্তিগত পছন্দকে কেন্দ্র করে সামাজিক নিপীড়ন বেড়েই চলেছে। সাংবাদিক ঝর্ণা রায় ও পর্বতারোহী শায়লা বিথীর উপর হামলার ঘটনাগুলো আমাদের সমাজে এক ধরনের অসহিষ্ণু মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়। এমনকি “ওড়না নেই কেন” বলে রাস্তায় নারীদের ঘিরে হেনস্তা করা হচ্ছে-যা কেবল অসভ্যতা নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতির শালীনতা ও সহনশীলতার পরিপন্থী।

বাঙালি সংস্কৃতির মূলে রয়েছে মুক্ত চিন্তা, উদার মানবিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধও ছিল মূলত এই সংস্কৃতি রক্ষার যুদ্ধ। পাকবাহিনী কেবল ভূখণ্ড দখল করতে আসেনি-তারা আঘাত করেছিল আমাদের ভাষা, গান, কবিতা ও সংস্কৃতির উপর। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বই নির্ভর করছে তার সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার উপর।

আজ যখন ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে, কিংবা বিদেশি সাংস্কৃতিক প্রভাবের ছদ্মবেশে বাঙালিত্বের চেতনা ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, তখন প্রয়োজন নতুন করে সাংস্কৃতিক জাগরণ। তরুণ প্রজন্মকে জানতে হবে বাউল লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীন, সত্যেন সেনদের কথা-যারা মানবতার গান গেয়েছেন, বিভেদের নয়।

আমাদের গ্রামীণ মেলা, নবান্ন উৎসব, পিঠাপুলি, পালাগান, নাটক, চিত্রাঙ্কন, সংগীত-সবকিছুই আমাদের আত্মার অংশ। এগুলোকে সংরক্ষণ করা মানে কেবল ঐতিহ্য রক্ষা নয়, বরং সামাজিক সাম্য, মানবিকতা ও মুক্ত চিন্তার সংরক্ষণ।

বাংলা সংস্কৃতি আজ এক সঙ্কটময় সময় পার করছে। একদিকে ধর্মীয় উগ্রতা, অন্যদিকে বাণিজ্যিক সংস্কৃতির আগ্রাসন-এই দুই প্রান্তের টানাপোড়েনে মাঝখানে পড়ে যাচ্ছে মূল ধারার বাঙালিয়ানা। টেলিভিশন থেকে সোশ্যাল মিডিয়া পর্যন্ত সবখানেই মৌলিক সাংস্কৃতিক ভাবনা এখন ক্রমেই উপেক্ষিত হচ্ছে।

তবে আশা হারানো যাবে না। যতদিন বাঙালি মাটির গন্ধে, নবান্নের ঘ্রাণে, রবীন্দ্রসংগীতের সুরে, কিংবা পহেলা বৈশাখের রঙে মেতে উঠবে-ততদিন বাংলার সংস্কৃতি মরে যাবে না।

বাংলা জনপদের সংস্কৃতি রক্ষার জন্য এখন প্রয়োজন সর্বস্তরের ঐক্য। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, শিল্পী, সাহিত্যিক ও নাগরিক সমাজ-সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সংস্কৃতি কেবল বিনোদন নয়; এটি জাতির আত্মা। আত্মাকে যদি বিক্রি করি, তবে আমরা কেবল দেহধারী মানুষ হয়ে থাকব-মানবিক জাতি নয়।

বাংলার সংস্কৃতি আমাদের ইতিহাস, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের চেতনা। এই চেতনাকে রক্ষাই এখন সবচেয়ে বড় কর্তব্য।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: উন্নয়নকর্মী]

back to top