জাহাঙ্গীর আলম সরকার
রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনার আঁধারে আমাদের চারপাশে প্রতিদিন মৃত্যু ক্রমেই বেড়ে চলেছে। শহর ও গ্রামে, সুনিপুণ পরিকল্পনার অভাবে মানুষ হারায় জীবন। বায়ুদূষণের বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রাণ যায়, নদী বা খালে ডুবে অনেকে বিদায় নেন, বিষধর সাপের কামড়ে কেউ মারা যায়, বজ্রপাতের অপ্রত্যাশিত ঝড়ও প্রাণহানির এক নির্মম অধ্যায়। কিন্তু এই সবের মাঝে সবচেয়ে অমানবিক, সবচেয়ে হঠাৎ এবং প্রায়শই প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ঘটে—সড়ক দুর্ঘটনায়।
সড়ক দুর্ঘটনা শুধু সংখ্যা নয়; এটি নিখুঁত পরিকল্পনার অভাব, দায়িত্বহীনতা ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার সরাসরি প্রতিফলন। এক মুহূর্তের অবহেলা, এক সেকেন্ডের অসতর্কতা—এগুলো প্রিয়জনকে কাঁদিয়ে যায়, পরিবারকে শূন্য করে দেয়। অথচ সেই জীবন বাঁচানোর জন্য রাষ্ট্র বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না। বারবার ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন হলেও বাস্তবতা বদলায়নি। অজস্র লাঠি-ঘোষ, প্রতিশ্রুতি ও প্রতিরোধের ডাক—সবই শোনার পরও পথ ধরে মৃত্যুর ধারা থেমে নেই। এভাবে, আমাদের দেশের মহাসড়কগুলো হয়ে উঠেছে নীরব হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী—যেখানে প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি রাস্তার মোড়, প্রতিটি যানবাহনের গতি নিয়ে নিরুপায় জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক গবেষণা আমাদেরকে এক কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে, দেশে সংঘটিত হয়েছে মোট ৩৭ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনা একেবারে নির্দিষ্ট ৩১৪টি স্থানের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সংখ্যা যতই ভয়ঙ্কর হোক, তার চেয়েও নির্মম সত্য হলো—এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৩৩ হাজারেরও বেশি মানুষ।
এগুলোকে ভাগ করা হয়েছে ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী। বিশেষজ্ঞরা ২১টি স্থানের নাম দিয়েছেন ‘অতি উচ্চ ঝুঁকি এলাকা’, যেখানে মৃত্যুর সম্ভাবনা সর্বাধিক, যেখানে প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি মোড়, প্রতিটি সিগন্যাল অনিয়ন্ত্রিত—প্রাণহানির একটি সময়বদ্ধ আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। এর বাইরে আছে ১৩৯টি অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা, যেখানে দুর্ঘটনার হার চোখে পড়ার মতো এবং প্রতিনিয়ত সতর্কতা জরুরি। আরও আছে ১৭৫টি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা, যেখানে নিয়মিত দুর্ঘটনা হলেও সচেতন পদক্ষেপের অভাবে তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
পরিসংখ্যানগুলো শুধু সংখ্যা নয়—এগুলো প্রতিটি পরিবারের নিঃশ্বাসহীন সন্ধ্যা, প্রতিটি মা-বাবার অনন্ত কান্না, প্রতিটি শহরের অশান্ত রাতের চিত্র। এক কথায়, এগুলো আমাদের দেশের সড়কের নীরব মৃত্যু-কথা, যা চোখে না পড়লেও হৃদয়ে খোঁচা দেয়।
গত পাঁচ বছরে এই অতি উচ্চ ঝুঁকির এলাকায় নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬৩৯ মানুষ। প্রতিটি সংখ্যা একটি পরিবারকে শূন্য করে দিয়েছে, প্রতিটি নামের পেছনে রয়েছে অসংখ্য অশ্রু ও নিঃশব্দ যন্ত্রণা। এই মৃতদের সংখ্যা আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার এক করুণ বাস্তব চিত্র, যা চোখে না পড়লেও হৃদয়ে খোঁচা দেয়, আর মনে করিয়ে দেয়—সড়ক দুর্ঘটনা কোনও দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের অবহেলার ফল।
পরিসংখ্যানগুলো শুধু সংখ্যা নয়—এগুলো যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সড়ক ব্যবস্থাপনার করুণ ব্যর্থতা। উন্নতমানের অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেই অবকাঠামোর উপর নিয়ন্ত্রণ, সতর্কতা এবং নীতিমালার অভাব দুর্ঘটনার কারণগুলোকে অপরিবর্তিত রেখে দিয়েছে।
জেলা ও উপজেলার সড়কগুলোতে অরেজিস্টার্ড যানবাহনের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। রাস্তার পাশে হাটবাজার, পরিবহন কাউন্টার ও টিকিট বিক্রয়কেন্দ্রের জটিলতা যেন মৃত্যুর ধারা আরও জটিল করে তুলেছে—যাত্রী ওঠানো-নামানো হচ্ছে যত্রতত্র, যেখানে শৃঙ্খলা নেই। দীর্ঘ সড়কগুলোতে চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো চালকেরা যেন অদৃশ্য শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপজ্জনক বাঁকগুলো—যেখানে প্রতিটি মোড়ই মৃত্যুর সুযোগ—সেখানে সংস্কারের অনুপস্থিতি প্রতিনিয়ত প্রাণের সাথে খেলা করে।
এই সব উপাদান মিলিয়ে, প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনা একরকম নীরব অভিযোগ হয়ে উঠে—যে অভিযোগ আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার অপরিপক্বতা, দায়িত্বহীনতা এবং সমন্বয়ের অভাবের প্রতি। উন্নত অবকাঠামো থাকলেও, যদি নিয়ম, নীতি ও নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তবে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়; বরং তা শুধু আরও ভয়াবহ আকারে ঘনিয়ে ওঠে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এবং বিআরটিএর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিতকরণ ও নিরসনে যে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব রয়েছে, তা আমাদের সড়ক দুর্ঘটনার নীরব কারণগুলোর অন্যতম। এই সমন্বয়ের অভাব প্রতিনিয়ত মানুষকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
অতি উচ্চ ঝুঁকির ২১টি ‘হটস্পট’—এর প্রতিটির জন্য বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করা আবশ্যক। শুধু পরিকল্পনা নয়, তা বাস্তবায়নও সমান জরুরি। প্রতিটি স্থানে হতে হবে—নিরাপদ ইউটার্ন, ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাসের নির্মাণ, রাস্তার পাশে থাকা অবৈধ স্থাপন সরানো, এবং সঠিক গতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থাপন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা। যত্রতত্র থামানো গাড়ি, দ্রুতগতির যানবাহন, এবং অরেজিস্টার্ড চলাচল—এই সবকে নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। মহাসড়কে তিন চাকার যান বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন এগুলো মৃত্যুর নীরব হাত হয়ে না দাঁড়ায়।
প্রকৃত বাস্তবতায়, পরিকল্পনা যদি শুধু কাগজে থেকে যায়, তবে এই ‘হটস্পট’গুলো থেকে প্রতিদিনের মতো প্রাণহানি থেমে থাকবে না। সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিটি মুহূর্তই আমাদের দায়িত্বহীনতার পরিণতি, আর এই দায়িত্ব পালনে সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া মানুষ রক্ষা করা যাবে না।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধ কেবল সরকারের সদিচ্ছার উপরই নির্ভরশীল। তবে শুধু প্রশাসন বা সরকারি সংস্থার উদ্যোগই যথেষ্ট নয়; এখানে আমাদের সকলের—নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, স্থানীয় প্রশাসন, এবং সচেতন পথচারীর—দায়িত্ব সমানভাবে জড়িত। প্রতিটি প্রাণবাণিজ্যিক উদ্যোগ, প্রতিটি নিয়মিত নজরদারি, প্রতিটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ—সবই জীবন রক্ষার জন্য অপরিহার্য।
যদি আমরা সকলে সঠিক মনোযোগ না দিই, কঠোর পরিকল্পনা গ্রহণ না করি, এবং দায়িত্বের সঙ্গে এগিয়ে না যাই, তবে এই মহাসড়কের ধূসর মৃত্যুর ধারা থামানো হয়ে উঠবে এক অব্যাহত দুঃস্বপ্ন। প্রতিটি অবহেলা, প্রতিটি অনিয়ম, প্রতিটি অসম্পূর্ণ পদক্ষেপ—সবই আমাদের অমনোরম নিঃশ্বাসহীন ভবিষ্যতের সাক্ষী হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ একরকম নীরব, কিন্তু এটি থেমে থাকে না। আমাদের সাহস, সতর্কতা, এবং নীতি-পালনের দৃঢ়তায়ই এই মৃত্যুর ধারা আটকানো সম্ভব। এক মুহূর্তের সচেতনতা বা একটুকরো কার্যকর পদক্ষেপ হয়তো কারো জীবন বাঁচাতে পারে—এটাই আমাদের সতর্কবার্তা, আমাদের আহ্বান, এবং আমাদের দায়িত্বের চূড়ান্ত প্রতিফলন।
[লেখক: আইনজীবী]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
জাহাঙ্গীর আলম সরকার
শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫
রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনার আঁধারে আমাদের চারপাশে প্রতিদিন মৃত্যু ক্রমেই বেড়ে চলেছে। শহর ও গ্রামে, সুনিপুণ পরিকল্পনার অভাবে মানুষ হারায় জীবন। বায়ুদূষণের বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রাণ যায়, নদী বা খালে ডুবে অনেকে বিদায় নেন, বিষধর সাপের কামড়ে কেউ মারা যায়, বজ্রপাতের অপ্রত্যাশিত ঝড়ও প্রাণহানির এক নির্মম অধ্যায়। কিন্তু এই সবের মাঝে সবচেয়ে অমানবিক, সবচেয়ে হঠাৎ এবং প্রায়শই প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ঘটে—সড়ক দুর্ঘটনায়।
সড়ক দুর্ঘটনা শুধু সংখ্যা নয়; এটি নিখুঁত পরিকল্পনার অভাব, দায়িত্বহীনতা ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার সরাসরি প্রতিফলন। এক মুহূর্তের অবহেলা, এক সেকেন্ডের অসতর্কতা—এগুলো প্রিয়জনকে কাঁদিয়ে যায়, পরিবারকে শূন্য করে দেয়। অথচ সেই জীবন বাঁচানোর জন্য রাষ্ট্র বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না। বারবার ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন হলেও বাস্তবতা বদলায়নি। অজস্র লাঠি-ঘোষ, প্রতিশ্রুতি ও প্রতিরোধের ডাক—সবই শোনার পরও পথ ধরে মৃত্যুর ধারা থেমে নেই। এভাবে, আমাদের দেশের মহাসড়কগুলো হয়ে উঠেছে নীরব হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী—যেখানে প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি রাস্তার মোড়, প্রতিটি যানবাহনের গতি নিয়ে নিরুপায় জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক গবেষণা আমাদেরকে এক কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে, দেশে সংঘটিত হয়েছে মোট ৩৭ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনা একেবারে নির্দিষ্ট ৩১৪টি স্থানের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সংখ্যা যতই ভয়ঙ্কর হোক, তার চেয়েও নির্মম সত্য হলো—এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৩৩ হাজারেরও বেশি মানুষ।
এগুলোকে ভাগ করা হয়েছে ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী। বিশেষজ্ঞরা ২১টি স্থানের নাম দিয়েছেন ‘অতি উচ্চ ঝুঁকি এলাকা’, যেখানে মৃত্যুর সম্ভাবনা সর্বাধিক, যেখানে প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি মোড়, প্রতিটি সিগন্যাল অনিয়ন্ত্রিত—প্রাণহানির একটি সময়বদ্ধ আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। এর বাইরে আছে ১৩৯টি অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা, যেখানে দুর্ঘটনার হার চোখে পড়ার মতো এবং প্রতিনিয়ত সতর্কতা জরুরি। আরও আছে ১৭৫টি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা, যেখানে নিয়মিত দুর্ঘটনা হলেও সচেতন পদক্ষেপের অভাবে তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
পরিসংখ্যানগুলো শুধু সংখ্যা নয়—এগুলো প্রতিটি পরিবারের নিঃশ্বাসহীন সন্ধ্যা, প্রতিটি মা-বাবার অনন্ত কান্না, প্রতিটি শহরের অশান্ত রাতের চিত্র। এক কথায়, এগুলো আমাদের দেশের সড়কের নীরব মৃত্যু-কথা, যা চোখে না পড়লেও হৃদয়ে খোঁচা দেয়।
গত পাঁচ বছরে এই অতি উচ্চ ঝুঁকির এলাকায় নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬৩৯ মানুষ। প্রতিটি সংখ্যা একটি পরিবারকে শূন্য করে দিয়েছে, প্রতিটি নামের পেছনে রয়েছে অসংখ্য অশ্রু ও নিঃশব্দ যন্ত্রণা। এই মৃতদের সংখ্যা আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার এক করুণ বাস্তব চিত্র, যা চোখে না পড়লেও হৃদয়ে খোঁচা দেয়, আর মনে করিয়ে দেয়—সড়ক দুর্ঘটনা কোনও দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের অবহেলার ফল।
পরিসংখ্যানগুলো শুধু সংখ্যা নয়—এগুলো যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সড়ক ব্যবস্থাপনার করুণ ব্যর্থতা। উন্নতমানের অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেই অবকাঠামোর উপর নিয়ন্ত্রণ, সতর্কতা এবং নীতিমালার অভাব দুর্ঘটনার কারণগুলোকে অপরিবর্তিত রেখে দিয়েছে।
জেলা ও উপজেলার সড়কগুলোতে অরেজিস্টার্ড যানবাহনের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। রাস্তার পাশে হাটবাজার, পরিবহন কাউন্টার ও টিকিট বিক্রয়কেন্দ্রের জটিলতা যেন মৃত্যুর ধারা আরও জটিল করে তুলেছে—যাত্রী ওঠানো-নামানো হচ্ছে যত্রতত্র, যেখানে শৃঙ্খলা নেই। দীর্ঘ সড়কগুলোতে চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো চালকেরা যেন অদৃশ্য শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপজ্জনক বাঁকগুলো—যেখানে প্রতিটি মোড়ই মৃত্যুর সুযোগ—সেখানে সংস্কারের অনুপস্থিতি প্রতিনিয়ত প্রাণের সাথে খেলা করে।
এই সব উপাদান মিলিয়ে, প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনা একরকম নীরব অভিযোগ হয়ে উঠে—যে অভিযোগ আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার অপরিপক্বতা, দায়িত্বহীনতা এবং সমন্বয়ের অভাবের প্রতি। উন্নত অবকাঠামো থাকলেও, যদি নিয়ম, নীতি ও নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তবে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়; বরং তা শুধু আরও ভয়াবহ আকারে ঘনিয়ে ওঠে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এবং বিআরটিএর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিতকরণ ও নিরসনে যে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব রয়েছে, তা আমাদের সড়ক দুর্ঘটনার নীরব কারণগুলোর অন্যতম। এই সমন্বয়ের অভাব প্রতিনিয়ত মানুষকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
অতি উচ্চ ঝুঁকির ২১টি ‘হটস্পট’—এর প্রতিটির জন্য বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করা আবশ্যক। শুধু পরিকল্পনা নয়, তা বাস্তবায়নও সমান জরুরি। প্রতিটি স্থানে হতে হবে—নিরাপদ ইউটার্ন, ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাসের নির্মাণ, রাস্তার পাশে থাকা অবৈধ স্থাপন সরানো, এবং সঠিক গতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থাপন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা। যত্রতত্র থামানো গাড়ি, দ্রুতগতির যানবাহন, এবং অরেজিস্টার্ড চলাচল—এই সবকে নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। মহাসড়কে তিন চাকার যান বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন এগুলো মৃত্যুর নীরব হাত হয়ে না দাঁড়ায়।
প্রকৃত বাস্তবতায়, পরিকল্পনা যদি শুধু কাগজে থেকে যায়, তবে এই ‘হটস্পট’গুলো থেকে প্রতিদিনের মতো প্রাণহানি থেমে থাকবে না। সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিটি মুহূর্তই আমাদের দায়িত্বহীনতার পরিণতি, আর এই দায়িত্ব পালনে সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া মানুষ রক্ষা করা যাবে না।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধ কেবল সরকারের সদিচ্ছার উপরই নির্ভরশীল। তবে শুধু প্রশাসন বা সরকারি সংস্থার উদ্যোগই যথেষ্ট নয়; এখানে আমাদের সকলের—নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, স্থানীয় প্রশাসন, এবং সচেতন পথচারীর—দায়িত্ব সমানভাবে জড়িত। প্রতিটি প্রাণবাণিজ্যিক উদ্যোগ, প্রতিটি নিয়মিত নজরদারি, প্রতিটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ—সবই জীবন রক্ষার জন্য অপরিহার্য।
যদি আমরা সকলে সঠিক মনোযোগ না দিই, কঠোর পরিকল্পনা গ্রহণ না করি, এবং দায়িত্বের সঙ্গে এগিয়ে না যাই, তবে এই মহাসড়কের ধূসর মৃত্যুর ধারা থামানো হয়ে উঠবে এক অব্যাহত দুঃস্বপ্ন। প্রতিটি অবহেলা, প্রতিটি অনিয়ম, প্রতিটি অসম্পূর্ণ পদক্ষেপ—সবই আমাদের অমনোরম নিঃশ্বাসহীন ভবিষ্যতের সাক্ষী হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ একরকম নীরব, কিন্তু এটি থেমে থাকে না। আমাদের সাহস, সতর্কতা, এবং নীতি-পালনের দৃঢ়তায়ই এই মৃত্যুর ধারা আটকানো সম্ভব। এক মুহূর্তের সচেতনতা বা একটুকরো কার্যকর পদক্ষেপ হয়তো কারো জীবন বাঁচাতে পারে—এটাই আমাদের সতর্কবার্তা, আমাদের আহ্বান, এবং আমাদের দায়িত্বের চূড়ান্ত প্রতিফলন।
[লেখক: আইনজীবী]