ফকর উদ্দিন মানিক
লন্ডনের প্রভাত যেন রাজকীয় আলোয় মোড়া। বাকিংহাম প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে সময়ের গতিবেগ থেমে যায়। প্রহরীরা লাল পোশাকে শৃঙ্খলার নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর আমি-এক সাধারণ পর্যটক-দাঁড়িয়ে আছি ইতিহাসের দার্শনিক দ্বারে। হাতে ক্যামেরা, মনে প্রশ্নচিহ্ন। এই প্রাসাদ কেবল রাজপরিবারের আবাস নয়, বরং সভ্যতার, শাসনের, আর উপনিবেশের ইতিহাসের এক নিঃশব্দ সাক্ষী।
১৭০৩ সালে লর্ড বাকিংহামের জন্য নির্মিত হয় “বাকিংহাম হাউস”, যা পরে রাজা জর্জ তৃতীয়ের অধীনে আসে। রানী ভিক্টোরিয়া এখানে বসবাস শুরু করলে, এটি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আজ এই প্রাসাদে ৭৭৫টি কক্ষ, ১৯টি রাজকীয় অভ্যর্থনা কক্ষ, এবং প্রায় ৪০০ জন কর্মচারী। এটি শুধু রাজপরিবারের আবাসভবন নয়; বরং ব্রিটেনের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক দক্ষতার এক নিদর্শন।
যখন প্রথম চোখে প্রাসাদটি দেখি, বিস্ময়বোধ ঘিরে রাখে। প্রতিটি জানালা, স্তম্ভ, দরজা যেন শতাব্দীর ইতিহাসকে কথা বলতে শুরু করেছে। সকালবেলা গার্ড বদলের অনুষ্ঠান দেখতে হাজার হাজার পর্যটক জড়ো হয়। সোনালি ব্যান্ডের তালে প্রহরীর পদক্ষেপ যেন ইতিহাসের ছন্দে বাজে। এই দৃশ্য পর্যটককে শুধু আনন্দ দেয় না, বরং শেখায়-কোন জাতি কীভাবে তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জীবনধারায় রূপ দিতে পারে। ব্রিটেনের শক্তি হয়তো তাদের অর্থনীতিতে নয়; বরং ঐতিহ্য সংরক্ষণের সংস্কৃতিতে নিহিত।
ইতিবাচক চোখে বাকিংহাম প্রাসাদ সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন। যে জাতি তার অতীতকে সম্মান জানায়, সে শতাব্দী পেরিয়ে টিকে থাকে। রাজপরিবারের জাঁকজমক এখন আর শাসনের প্রতীক নয়, বরং ঐক্যের ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার প্রতীক। শিক্ষা, প্রশাসন, প্রযুক্তি-সব ক্ষেত্রেই এই ঐতিহ্য আমাদের শেখায় কিভাবে ইতিহাসকে গৌরবের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা যায়।
কিন্তু নেতিবাচক চোখে দৃশ্যটি ভিন্ন। এই প্রাসাদের সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে উপনিবেশের ইতিহাস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আর্থিক প্রাচুর্য, প্রাসাদের জাঁকজমক-সবই উপনিবেশিত দেশের শ্রম, সম্পদ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। বাংলার মসলিন, ভারতের হীরা, আফ্রিকার সোনা, ক্যারিবিয়ানের চিনি-এই সবকিছুই একসময়ে বাকিংহাম প্রাসাদের জাঁকজমক ও রাজকীয় অনুষ্ঠানে শোভা পেয়েছে। অতীতের এই অদৃশ্য দাগ, ঘাম, পরিশ্রম-আজও এই দেয়ালে অজানা সাক্ষী হয়ে আছে।
গবেষণাধর্মী দৃষ্টিতে, বাকিংহাম প্রাসাদকে তিনটি স্তরে দেখা যায়। প্রথম, স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে, যেখানে ইউরোপীয় নিওক্লাসিক্যাল শৈলী, মার্বেল, স্তম্ভ ও জ্যামিতিক নিখুঁততা ব্রিটিশ নান্দনিকতার পরিচয় দেয়। দ্বিতীয়, রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক হিসেবে, যেখানে রাজা বা রানী কেবল পদধারী নয়, রাষ্ট্রীয় ঐক্যের এক জীবন্ত প্রতীক। এবং তৃতীয়, উপনিবেশ-পরবর্তী ইতিহাসের প্রতীক হিসেবে, যেখানে সভ্যতার আলো ও শোষণের ছায়া পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।
প্রতিটি পর্যবেক্ষক এই প্রাসাদকে দুই চোখে দেখবে। একটি চোখে বিস্ময়, গৌরব, শৃঙ্খলা; অন্য চোখে ইতিহাসের নীরব কণ্ঠে শোষণ ও বেদনার ছায়া। এই দ্বৈততা একান্তই শিক্ষণীয়। সভ্যতার গৌরব যতই উজ্জ্বল হোক না কেন, তার সঙ্গে সংযুক্ত আছে অতীতের ক্ষত ও লোপ পাওয়া সংস্কৃতির স্মৃতি।
যে জাতি তার অতীতকে স্বীকার করে, সে ভবিষ্যতকে গড়তে পারে। বাকিংহাম প্রাসাদ তাই শুধু ব্রিটেনের নয়, উপনিবেশিত জাতিগুলোর জন্যও শিক্ষা। এই প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা শিখি-গৌরব এবং অনুশোচনা একসঙ্গে বিচার করা যায়, আর ইতিহাসের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। গৌরব ছাড়া অনুশোচনা, এবং অনুশোচনা ছাড়া গৌরব, কোনো ইতিহাসই সম্পূর্ণ নয়।
প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে পতাকাটা দোল খাচ্ছে বাতাসে। মনে হয়, এই পতাকা শুধু ব্রিটেনের নয়, ইতিহাসেরও পতাকা। একসময় যে রাজা পৃথিবী শাসন করত, আজ সেই রাজপ্রাসাদ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। এখানে দেখা যায়-শাসকও একদিন দর্শক হয়। সময়ই প্রকৃত রাজা, আর ইতিহাস তার প্রাসাদ।
আমার দুটি চোখ এখন সম্পূর্ণরূপে এই দ্বৈত সত্যকে ধারণ করেছে। এক চোখে গর্বের দীপ্তি, অন্য চোখে গ্লানির স্মৃতি। এই মিলনেই তৈরি হয় আত্মচেতনা। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে জাতি শক্তিশালী হয়; ইতিহাসকে ভুলে গেলে জাতি কেবল গর্বময় প্রতীক হয়ে থাকে। বাকিংহাম প্রাসাদ সেই শিক্ষা দিতে সক্ষম-গৌরবকে চিনতে শেখায়, আর শোষণের ইতিহাসও মনে করিয়ে দেয়।
আমাদের জন্য বাকিংহাম প্রাসাদের শিক্ষা স্পষ্ট-সভ্যতার আসল সৌন্দর্য কোনো প্রাসাদের দেয়ালে নয়, বরং মানুষের আত্মজিজ্ঞাসায়। দুটি চোখে দুই ইতিহাস, দুটি অনুভূতিতে দুই পাঠ। কিন্তু দুটির মিলনেই নিহিত ভবিষ্যতের শিক্ষা। আমরা যদি ইতিহাসের দ্বৈত চিত্রকে বুঝতে পারি, তবে আমরা সত্যিকার অর্থে আমাদের স্বাধীনতা, পরিচয় এবং গৌরবকে নতুন আকার দিতে পারব।
প্রাসাদ থেকে ফিরে আসার পথে মনে হয়, হাতে শুধুই কয়েকটি ছবি নেই; আছে ইতিহাসের গভীর উপলব্ধি। সভ্যতা এক দীর্ঘ যাত্রা, যেখানে বিজয়ীও একদিন দর্শক হয়, এবং পরাজিতও শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। গৌরব ও অনুশোচনা-দুটিই সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে জাতি এই দ্বৈততাকে স্বীকার করে, সে জাতিই ভবিষ্যতের আলো ছড়িয়ে দিতে পারে।
বাকিংহাম প্রাসাদ আজ শুধু একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়; এটি মানুষের আত্মচেতনার শিক্ষাকেন্দ্র। যেখানে ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা, আত্মসমালোচনা, শৃঙ্খলা ও নান্দনিকতার মিলন ঘটেছে। এই প্রাসাদের দেয়ালে শুধু সোনার সজ্জা নেই; লুকিয়ে আছে শত শত বছরের ঘাম, শ্রম এবং ইতিহাসের অদৃশ্য দাগ। আর সেই দাগই আমাদের মনে করিয়ে দেয়-যতই আলো উজ্জ্বল হোক, ছায়া কখনো অদৃশ্য হয় না।
প্রাচীরের প্রতিটি ইটে, প্রতিটি কক্ষের কোণে, প্রতিটি রাজকীয় অনুষ্ঠানেই লুকিয়ে আছে ইতিহাসের গল্প। আমাদের কাজ হলো শুধুমাত্র দর্শক না থেকে, সেই গল্পকে বোঝা, স্বীকার করা এবং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষণীয় করে তোলা। সভ্যতার প্রকৃত সৌন্দর্য, তাই, বাহ্যিক প্রাচুর্য নয়, আত্মজিজ্ঞাসা, সতর্কতা এবং শিক্ষায় নিহিত।
সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-গৌরব এবং গ্লানির মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানবজাতির প্রকৃত পাঠ। আমরা যদি অতীত থেকে শিক্ষা নিই, তবে শুধুমাত্র ইতিহাসের দর্শক নয়, আমরা হবো ইতিহাসের সক্রিয় নির্মাতা।
[লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
ফকর উদ্দিন মানিক
রোববার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫
লন্ডনের প্রভাত যেন রাজকীয় আলোয় মোড়া। বাকিংহাম প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে সময়ের গতিবেগ থেমে যায়। প্রহরীরা লাল পোশাকে শৃঙ্খলার নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর আমি-এক সাধারণ পর্যটক-দাঁড়িয়ে আছি ইতিহাসের দার্শনিক দ্বারে। হাতে ক্যামেরা, মনে প্রশ্নচিহ্ন। এই প্রাসাদ কেবল রাজপরিবারের আবাস নয়, বরং সভ্যতার, শাসনের, আর উপনিবেশের ইতিহাসের এক নিঃশব্দ সাক্ষী।
১৭০৩ সালে লর্ড বাকিংহামের জন্য নির্মিত হয় “বাকিংহাম হাউস”, যা পরে রাজা জর্জ তৃতীয়ের অধীনে আসে। রানী ভিক্টোরিয়া এখানে বসবাস শুরু করলে, এটি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আজ এই প্রাসাদে ৭৭৫টি কক্ষ, ১৯টি রাজকীয় অভ্যর্থনা কক্ষ, এবং প্রায় ৪০০ জন কর্মচারী। এটি শুধু রাজপরিবারের আবাসভবন নয়; বরং ব্রিটেনের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক দক্ষতার এক নিদর্শন।
যখন প্রথম চোখে প্রাসাদটি দেখি, বিস্ময়বোধ ঘিরে রাখে। প্রতিটি জানালা, স্তম্ভ, দরজা যেন শতাব্দীর ইতিহাসকে কথা বলতে শুরু করেছে। সকালবেলা গার্ড বদলের অনুষ্ঠান দেখতে হাজার হাজার পর্যটক জড়ো হয়। সোনালি ব্যান্ডের তালে প্রহরীর পদক্ষেপ যেন ইতিহাসের ছন্দে বাজে। এই দৃশ্য পর্যটককে শুধু আনন্দ দেয় না, বরং শেখায়-কোন জাতি কীভাবে তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জীবনধারায় রূপ দিতে পারে। ব্রিটেনের শক্তি হয়তো তাদের অর্থনীতিতে নয়; বরং ঐতিহ্য সংরক্ষণের সংস্কৃতিতে নিহিত।
ইতিবাচক চোখে বাকিংহাম প্রাসাদ সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন। যে জাতি তার অতীতকে সম্মান জানায়, সে শতাব্দী পেরিয়ে টিকে থাকে। রাজপরিবারের জাঁকজমক এখন আর শাসনের প্রতীক নয়, বরং ঐক্যের ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার প্রতীক। শিক্ষা, প্রশাসন, প্রযুক্তি-সব ক্ষেত্রেই এই ঐতিহ্য আমাদের শেখায় কিভাবে ইতিহাসকে গৌরবের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা যায়।
কিন্তু নেতিবাচক চোখে দৃশ্যটি ভিন্ন। এই প্রাসাদের সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে উপনিবেশের ইতিহাস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আর্থিক প্রাচুর্য, প্রাসাদের জাঁকজমক-সবই উপনিবেশিত দেশের শ্রম, সম্পদ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। বাংলার মসলিন, ভারতের হীরা, আফ্রিকার সোনা, ক্যারিবিয়ানের চিনি-এই সবকিছুই একসময়ে বাকিংহাম প্রাসাদের জাঁকজমক ও রাজকীয় অনুষ্ঠানে শোভা পেয়েছে। অতীতের এই অদৃশ্য দাগ, ঘাম, পরিশ্রম-আজও এই দেয়ালে অজানা সাক্ষী হয়ে আছে।
গবেষণাধর্মী দৃষ্টিতে, বাকিংহাম প্রাসাদকে তিনটি স্তরে দেখা যায়। প্রথম, স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে, যেখানে ইউরোপীয় নিওক্লাসিক্যাল শৈলী, মার্বেল, স্তম্ভ ও জ্যামিতিক নিখুঁততা ব্রিটিশ নান্দনিকতার পরিচয় দেয়। দ্বিতীয়, রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক হিসেবে, যেখানে রাজা বা রানী কেবল পদধারী নয়, রাষ্ট্রীয় ঐক্যের এক জীবন্ত প্রতীক। এবং তৃতীয়, উপনিবেশ-পরবর্তী ইতিহাসের প্রতীক হিসেবে, যেখানে সভ্যতার আলো ও শোষণের ছায়া পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।
প্রতিটি পর্যবেক্ষক এই প্রাসাদকে দুই চোখে দেখবে। একটি চোখে বিস্ময়, গৌরব, শৃঙ্খলা; অন্য চোখে ইতিহাসের নীরব কণ্ঠে শোষণ ও বেদনার ছায়া। এই দ্বৈততা একান্তই শিক্ষণীয়। সভ্যতার গৌরব যতই উজ্জ্বল হোক না কেন, তার সঙ্গে সংযুক্ত আছে অতীতের ক্ষত ও লোপ পাওয়া সংস্কৃতির স্মৃতি।
যে জাতি তার অতীতকে স্বীকার করে, সে ভবিষ্যতকে গড়তে পারে। বাকিংহাম প্রাসাদ তাই শুধু ব্রিটেনের নয়, উপনিবেশিত জাতিগুলোর জন্যও শিক্ষা। এই প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা শিখি-গৌরব এবং অনুশোচনা একসঙ্গে বিচার করা যায়, আর ইতিহাসের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। গৌরব ছাড়া অনুশোচনা, এবং অনুশোচনা ছাড়া গৌরব, কোনো ইতিহাসই সম্পূর্ণ নয়।
প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে পতাকাটা দোল খাচ্ছে বাতাসে। মনে হয়, এই পতাকা শুধু ব্রিটেনের নয়, ইতিহাসেরও পতাকা। একসময় যে রাজা পৃথিবী শাসন করত, আজ সেই রাজপ্রাসাদ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। এখানে দেখা যায়-শাসকও একদিন দর্শক হয়। সময়ই প্রকৃত রাজা, আর ইতিহাস তার প্রাসাদ।
আমার দুটি চোখ এখন সম্পূর্ণরূপে এই দ্বৈত সত্যকে ধারণ করেছে। এক চোখে গর্বের দীপ্তি, অন্য চোখে গ্লানির স্মৃতি। এই মিলনেই তৈরি হয় আত্মচেতনা। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে জাতি শক্তিশালী হয়; ইতিহাসকে ভুলে গেলে জাতি কেবল গর্বময় প্রতীক হয়ে থাকে। বাকিংহাম প্রাসাদ সেই শিক্ষা দিতে সক্ষম-গৌরবকে চিনতে শেখায়, আর শোষণের ইতিহাসও মনে করিয়ে দেয়।
আমাদের জন্য বাকিংহাম প্রাসাদের শিক্ষা স্পষ্ট-সভ্যতার আসল সৌন্দর্য কোনো প্রাসাদের দেয়ালে নয়, বরং মানুষের আত্মজিজ্ঞাসায়। দুটি চোখে দুই ইতিহাস, দুটি অনুভূতিতে দুই পাঠ। কিন্তু দুটির মিলনেই নিহিত ভবিষ্যতের শিক্ষা। আমরা যদি ইতিহাসের দ্বৈত চিত্রকে বুঝতে পারি, তবে আমরা সত্যিকার অর্থে আমাদের স্বাধীনতা, পরিচয় এবং গৌরবকে নতুন আকার দিতে পারব।
প্রাসাদ থেকে ফিরে আসার পথে মনে হয়, হাতে শুধুই কয়েকটি ছবি নেই; আছে ইতিহাসের গভীর উপলব্ধি। সভ্যতা এক দীর্ঘ যাত্রা, যেখানে বিজয়ীও একদিন দর্শক হয়, এবং পরাজিতও শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। গৌরব ও অনুশোচনা-দুটিই সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে জাতি এই দ্বৈততাকে স্বীকার করে, সে জাতিই ভবিষ্যতের আলো ছড়িয়ে দিতে পারে।
বাকিংহাম প্রাসাদ আজ শুধু একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়; এটি মানুষের আত্মচেতনার শিক্ষাকেন্দ্র। যেখানে ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা, আত্মসমালোচনা, শৃঙ্খলা ও নান্দনিকতার মিলন ঘটেছে। এই প্রাসাদের দেয়ালে শুধু সোনার সজ্জা নেই; লুকিয়ে আছে শত শত বছরের ঘাম, শ্রম এবং ইতিহাসের অদৃশ্য দাগ। আর সেই দাগই আমাদের মনে করিয়ে দেয়-যতই আলো উজ্জ্বল হোক, ছায়া কখনো অদৃশ্য হয় না।
প্রাচীরের প্রতিটি ইটে, প্রতিটি কক্ষের কোণে, প্রতিটি রাজকীয় অনুষ্ঠানেই লুকিয়ে আছে ইতিহাসের গল্প। আমাদের কাজ হলো শুধুমাত্র দর্শক না থেকে, সেই গল্পকে বোঝা, স্বীকার করা এবং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষণীয় করে তোলা। সভ্যতার প্রকৃত সৌন্দর্য, তাই, বাহ্যিক প্রাচুর্য নয়, আত্মজিজ্ঞাসা, সতর্কতা এবং শিক্ষায় নিহিত।
সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-গৌরব এবং গ্লানির মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানবজাতির প্রকৃত পাঠ। আমরা যদি অতীত থেকে শিক্ষা নিই, তবে শুধুমাত্র ইতিহাসের দর্শক নয়, আমরা হবো ইতিহাসের সক্রিয় নির্মাতা।
[লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী]